ভালো থেকো ফুল : রওনক খান
প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২২ ০১:২৯
আপডেট:
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:১৫
বাঙালী রসনার বাসনা মেটাতে ফুলেরা হয়েছে ধরাশায়ী। কুমড়ো ফুলের বড়া, বকফুলের বড়া বা সজনে ফুলের চপকাটলেটের মনোহরা স্বাদ গন্ধে নাকি অনেকেই প্রফুল্ল হন। চিন্তায়, চেতনায় সেই সব সুস্বাদু চপ কাটলেট উদরের খিদেকে চাগিয়ে দিয়ে কোন কোন সুশীল চিত্তকে করে তোলে চঞ্চল।
উঠোনের এককোণে মাঁচা বেয়ে লতিয়ে ওঠা সদ্য প্রস্ফুটিত হলুদ বর্ণের কুমড়ো ফুলের শরীরে যখন এক নবীন ভোরের সোনারোদ আলতো ছুঁয়ে যায় তখন যেন উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক স্বর্গীয় আভা। আর এমন মাহেন্দ্রেক্ষণে যদি কাঞ্চনবরণ ফুলগুলোর স্হান হয় গৃহস্হের রান্নাঘরে তবে সেটা দুঃখজনক নাকি সুখকর সেই দ্বিধার জবাব পাওয়া দুস্কর। কনকপ্রভ ফুলগুলোকে লতা থেকে টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে এনে বেশ করে কেটেকুটে শীল নোড়ায় পিষে তাতে নানান মষলা সহযোগে বড়ার আকৃতি দিয়ে জলন্ত উনুনে চাপানো কড়াইএর টগটগে ফুটন্ত তেলে ফেলে বারোভাজা করে তারপর সেটাকে কড়মড়িয়ে চিবিয়ে উদরে চালান করে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে তবেই গৃহস্হের শান্তি। সকালের ঝিলিমিলি রোদে মাঁচা জুড়ে ফুটে থাকা হলুদাভ রং এর দৃষ্টিসুখকর সেই কুমড়ো ফুলের কোমল, পেলব মখমলি শরীরটি নিয়ে মানব কূলের এ যেন এক নির্মম পরিহাস।
বকফুল বা এর জন্মদাতা বৃক্ষটি সচক্ষে দেখবার সৌভাগ্য হয়নি কখনও। তবে বইএর পাতায়, বা ছবিতে দেখেছি। এবং কেবল মাত্র ছবি দেখেই এর সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি। শুনেছি মানুষ্য প্রজাতির অসংযত স্বাদেন্দ্রিয়ের কোপে পড়ে এই চমৎকার দেখতে ফুলটির গতিও ঐ কুমড়ো ফুলের মতই হয় হরহামেশাই।
একটি শ্যামল গাঁয়ের এক প্রান্তে সদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা বকফুলের ঝাঁকড়া গাছের আগ ডাল, মগডাল জুড়ে ফুটে থাকা অজস্র সাদা রং এর বকপাখির আকৃতির ফুলগুলি কি অনবদ্য দৃশ্যকল্পের সূচনা করে তা চোখে না দেখেও খুব সহজেই কল্পনা যায়।
ঐ অসামান্য সুন্দর ফুলগুলোও শেষ পর্যন্ত নানান যন্ত্রণা সয়ে কিছু খাদ্য রসিক মানুষের রসনা নিবৃত্তিতে ব্রতী হয়। শুনেছি ডালবাটা সহযোগে বকফুলের বড়া নাকি দারুণ উপাদেয়। হবে হয়তো। তবে অমন সুতনুকা ফুলগুলোকে চিবিয়ে খাওয়ার অভিলাষ কখনও মনে জাগেনি।
এই তালিকায় আরোও আছে সজনে ফুল, পেঁয়াজ ফুল, সরষে ফুলের নাম। তাদের সুদৃশ্য, কোমল কান্তি শরীরও নানান পদ্ধতিতে বাঙালীর খাবার তালিকায় অবনত শিরে স্হান করে নিয়েছে। বুভুক্ষু মানব চক্ষুর নেক নজর এড়িয়ে এদের সাধ্য কি গাছে, লতায় উঠোনে, বনেবাদাড়ে নিজেদের অনিন্দ্য সুন্দর অবয়ব নিয়ে দিকবিদিক আলো করে ফুটে থাকে?
গোলাপ একটি অসামান্য রূপবতী ফুল। গোলাপ ভালোবাসেনা এমন মানুষ ভুভারতে মেলা দায়।উৎসব অনুষ্ঠানে নানান সুদৃশ্য পরিবেশন পাত্র জুড়ে সেই দ্বিগবিজয়ী গোলাপের পাপড়িকেও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিশেষ করে মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারে সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবে টাটকা গোলাপের পাপড়ির সমাদর সর্বজন বিদিত।
সেই মিষ্টান্নের স্বাদ যেমন তেমন হোক, সাজ সজ্জা হিসেবে পরিবেশনের পাত্রে কিছু গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেই সেটি জাতে উঠে যায়। এমন ধারণা অনেকেই মনে লালন করেন।
আহা গোলাপ, তুমি এক হিম মাখা ভোরে কুঁড়ি হবে, ক্লান্ত দ্বিপ্রহরে হবে পূর্ন স্ফুটিত। তোমার ফুল্ল রূপ ক্ষুদে আকৃতির কন্টকাকীর্ণ গাছটিকে আলো করে রইবে। তারপর এক বিষন্ন বিকেলে বাসী হয়ে ঝরে পড়বে সেই ক্ষুদে গাছটির তলদেশ জুড়ে । সেই মহার্ঘ দৃশ্যটি দেখবার জন্য কত প্রাণ যে আকুল হয়ে রয়, তার কোন হদিস কি খাদক সম্প্রদায় রাখে? রাখে না বোধহয়। তাই অমন নির্দ্বিধায় সদ্য প্রস্ফুটিত লাল, গোলাপী, হলুদ বা আরও বিচিত্র বর্ণের গোলাপের পাপড়িগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে খাবার থালায় বিছিয়ে রাখে। তাতে অতিথির সমাদর কতটুকু হয় জানিনা, তবে তাকে যে ছড়ানো গোলাপ পাপড়িগুলো নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তা সহজেই বোঝা যায়। সেই টাটকা পাপড়িগুলো না চিবিয়ে খাদ্যনালীতে চালান করা যায়, না সেগুলোকে আলগোছে পাতের কোণে জমা রাখা যায়। অবশেষে তাদের স্হান হয় আস্তাকুঁড়ে।
ফুল কি তবে ভুল করে খাদ্যে পরিণতি পায়?
ফুল হয়ে ফুটে, ফুল হয়েই ঝরে যাবে, এমনিতো বিধির বিধান ছিল। কে তবে তাকে অসময়ে বৃন্তচ্যুত করে গরম তেলে ফোড়ন দিয়ে রান্নার উপকরণে রূপ দিল? কবে, কোন সুদূর অতীতে কার মনে এমন দুরভিসন্ধি জেগেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বৃথা।
ঝরে পড়া বকুল বা শিউলির গন্ধ মাখা একেকটা ভোর অথবা বিষন্ন বিকেল প্রায়শই মনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে এমন সুবাসিত ফুলেল শয্যার স্পর্শ নেবার ভাগ্য চিরস্থায়ী হবেতো? না কি অতি শীঘ্রই এদেরকেও চপ কাটলেটে রূপান্তরের করুণ পরিণতির চাক্ষুষ সাক্ষী হতে হবে?
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: