সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ধন্যবাদ : আসিফ মেহ্দী


প্রকাশিত:
৯ জুন ২০২০ ২১:০৬

আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২০:৫২

 

এক.

মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে আতংকিত বাবলু চেঁচাতে লাগলেন। অ্যা-অ্যা টাইপের চিৎকার। কিছু বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু জিভ-ঠোঁট-দাঁত-তালু অর্থাৎ কথা বলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শরীরের সব অংশ যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে! তাই শব্দ তৈরি হচ্ছে না। ধড়াক করে বিছানায় উঠে বসলেন বাবলু। হাঁপাচ্ছেন আর ঘামছেন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। স্বামীর অ্যা-অ্যা চিৎকারে মুক্তাও ধড়ফড়িয়ে উঠেছেন। মুক্তা অস্থিরভাবে বললেন, ‘অ্যাই, অ্যাই, কী হয়েছে?’

বাবলু কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। ভয় পেয়ে গেলেন মুক্তা। বাবলুর মুখ দিয়ে অর্থপূর্ণ কথা বেরোতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। বললেন, ‘স্বপ্ন দেখেছি। পানি খাব।’

কথা না বাড়িয়ে মুক্তা পানি আনার জন্য বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাতি জ্বলিয়ে দিলেন। ডিম-লাইটের আলো-আঁধারিতে বেশ ভয় লাগছিল। পানি আনতে গেলেন অন্য ঘরে। বাবলু মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। নানা দুশ্চিন্তা থেকে হয়তো এ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। কয়েক বছর আগে একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল গড়েছেন। স্কুলটি নিয়ে এ বছর বেশ পেরেশানিতে আছেন। সম্প্রতি যে অভিভাবক সবার ভোটে স্কুল কমিটির সভাপতি হয়েছেন, তিনি খুব তালগোল পাকাচ্ছেন। উপদেশের নামে মাথা আউলে দিচ্ছেন। স্কুলের সামনে এক ঝালমুড়িওয়ালা বসত। ভালোই চলছিল তার ঝালমুড়ি-সেবা। সদ্য সভাপতি হওয়া ভদ্রলোক ঝালমুড়িওয়ালার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন! একদিন সারাদিন ধরে বেচারাকে নানারকম উপদেশ দিলেন, পরিচ্ছন্নভাবে ঝালমুড়ি কেনাবেচার ফর্মুলা শেখালেন। মাসখানেকের মধ্যে ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখা গেল ভিক্ষার থালা হাতে স্কুলের সামনে ভিক্ষা করছে! এই সভাপতির অহেতুক উপদেশের দংশনে শেষমেশ তার স্কুলটার না বারোটা বেজে যায়! অথচ সভাপতির ক্লাস সিক্স পড়ুয়া মেয়ে পড়াশুনায় ফাঁপা পটল; অন্যদিকে দুষ্টুমিতে অকাল কুমড়ো। বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেও তাকে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মতো চারটি অপশন দিয়ে টিক দিতে বলতে হবে- এমনই শোচনীয় অবস্থা। ইংরেজি ম্যাডামকে পছন্দ না বলে গতদিন ম্যাডাম টয়লেটে যাওয়ার পর মেয়েটি টয়লেটের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছে! বাপ-মেয়ে মিলে বাবলুর অশান্তি চরমে নিয়ে গেছে। এসব মানসিক অশান্তিই হয়তো এমন দুঃস্বপ্নের কারণ।

মুক্তা পানি নিয়ে এসেছেন। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলেন বাবলু। বিছানা ছেড়ে উঠলেন। স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর শার্ট পরলেন। বাবলু এত রাতে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন দেখে মুক্তা অবাক হয়ে বললেন, ‘এই রাতে তুমি আবার কোথাও যাচ্ছ নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী আশ্চর্য, কেন এমন করছ?’

‘একটা স্বপ্ন দেখেছি!’

‘কী স্বপ্ন?’

‘স্বপ্নে দেখলাম, আমাদের বাসা থেকে বের হলেই রাস্তার ওপাশে একটা ডাস্টবিন আছে না?’

‘হু।’

‘ওখানে এক মানুষ ফুটফুটে একটা শিশুকে রেখে গেল!’

‘আহা, ওটা তো স্বপ্ন। এখন শান্ত হয়ে ঘুমাও।’

‘দেখলাম, মানুষটা চলে যাওয়ার পরই একটা শেয়াল এগিয়ে আসছে বাচ্চাটার দিকে!’

‘এসব তো দুঃস্বপ্ন। বিছানায় এসো। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

‘না, আমি একটু ওই জায়গায় যেতে চাই।’

‘এত রাতে কী শুরু করলে? এই রাতের বেলা ডাস্টবিনের সামনে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এসো লক্ষ্মীটি, আর অবুঝের মতো কথা বোলো না।’

বাবলুর কানে এই কথা গেল বলে মনে হয় না। তিনি সোজা হাঁটা ধরলেন বাইরে যাওয়ার জন্য। অগত্যা মুক্তা তার পেছন ধরল। দুজন মিলে বাসা থেকে বের হয়ে উল্টো পাশের ডাস্টবিনের দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোয় চারপাশ বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। তারপরও মুক্তার ভয়ভয় করছে। মাঝরাতে এভাবে বাসার বাইরে আসা তাদের উচিত হয়নি। বাবলু-মুক্তা ঝকঝকে চাঁদের আলোয় ডাস্টবিনের দিকে তাকিয়ে কোনো শিশু বা শেয়াল-কুকুর দেখতে পেল না। ভীত মুক্তা বাবলুর হাত শক্তভাবে ধরে বললেন, ‘চলো, এবার যাই।’

দুজনে বাসায় ফেরার জন্য মাত্র ঘুরেছেন, ঠিক তখনই এক শিশুর কান্নার আওয়াজ কানে এল। মুক্তা আরও শক্তভাবে বাবলুকে ধরলেন। চাঁদের আলোপ্লাবিত ভুবনে শিশুর কান্নার আওয়াজ তাদের ওপর এক অব্যক্ত ভয় আরোপ করল; তবে সেই ভয়ের যেন আকর্ষণ ধর্ম আছে! তা নাহলে দুজন মোহাবিষ্ট হয়ে এভাবে ডাস্টবিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কেন? ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়াতেই বাবলু-মুক্তা দেখতে পেলেন ফুটফুটে এক শিশু পড়ে আছে! কাপড়ের মোড়ানো শিশুটির শুধু মুখ দেখা যাচ্ছে। সেই মুখ থেকে যেন আলোচ্ছটা ঠিকরে বেরোচ্ছে! শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন বাবলু।

 

দুই.

বাবলু-মুক্তার বিয়ের বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যেই কাঁধে শিশুপালনের দায়িত্ব এসে পড়েছে। শিশুদের প্রতি ভলোবাসা থেকে বাবলু তার কিন্ডার গার্টেনটি করেছিলেন। ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটির প্রতি কেন যেন তার অন্তরে অসম্ভব মায়া তৈরি হয়েছে। এমনকি মুক্তাও বাচ্চাটিকে আপন করে নিয়েছেন; যেন তার নিজের গর্ভের সন্তান। শিশুটার চেহারার মধ্যে অন্যরকম মায়া আছে। দেখলেই কাছে টানতে ইচ্ছা করে। হাসিমুখে এমনভাবে সে হাত বাড়িয়ে দেয় যে উপেক্ষা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না। বাবলু তার পুলিশ ও আইনজীবী বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে শিশুটিকে পালক হিসেবে নেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে বাচ্চাটির নামও রেখেছেন: ডাবলু।

সেদিনের ঘটনার পর থেকে মাঝেমাঝে বাবলুর মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। মনে হয়, হঠাৎ জ্ঞান হারাবেন। কোনো দুর্বলতার কারণে এমন হচ্ছে কিনা, তা জানা নেই। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে মুক্তা বেশ সচেতন। সংসারে সুষম খাদ্য খাওয়া হচ্ছে কিনা, সেদিকে মুক্তার বেশ খেয়াল। মাথা ঘুরলেও বিকালে হাঁটাহাঁটির অভ্যাসটা বন্ধ করেননি বাবলু। তবে ডাবলুকে কোলে নিয়ে তিনি বেরোন না। কারণ, মাথা ঘুরে জ্ঞান হারালে তো বিপদ।

 

তিন.

একদিন পার্কে হাঁটছেন বাবলু। মনে হলো, মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসলেন তিনি। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত বুলাতে থাকলেন। একটু ভালো অনুভূত হওয়ায় চোখ খুলতেই ঘাবড়ে গেলেন! সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন তরুণ। ছেলেটি বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে। আমি তোমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র।’

বাবলু মনে করার চেষ্টা করলেন। তার সব ছাত্রই শিশু-কিশোর। এত বড় ছাত্র কোথা থেকে এল! তার ওপর বলছে সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র! তাহলে তো সহজেই চেনার কথা। কিন্তু তিনি চিনতে পারছেন না। তাছাড়া ছাত্র হয়ে শিক্ষককে তুমি করে বলছে- এমন কোনো ছাত্রকে মনে পড়ছে না তার! দুঃখিত স্বরে বাবলু বললেন, ‘বাবা, আমি যে তোমাকে চিনতে পারছি না।’

‘চেনাটা জরুরি না। আর চেনার কথাও না। তবে তোমাকে একটা কথা বলা জরুরি।’

‘কী কথা বাবা?’

‘এক শব্দের একটি কথা।’

‘এক শব্দের কথা! ঠিক আছে বলো শুনি।’

‘ধন্যবাদ।’

‘ধন্যবাদ! ব্যস এটাই তোমার কথা?’

‘হ্যাঁ, এটাই আমার কথা।’

‘কিন্তু কীসের জন্য ধন্যবাদ?’

‘তুমি আর মা সেদিন মধ্যরাতে আমাকে আস্তাকুঁড় থেকে ঘরে তুলে না আনলে আমি হয়তো কোনো জন্তুর খোরাক হতাম! আদরে-শাসনে তোমাদের সন্তান হয়েই বড় হয়েছি আমি। বাবা, আমাকে কি এখনো চিনতে পারছ না? আমি ডাবলু।’

‘ডাবলু! তা কী করে হয়! ডাবলু তো এখনো হামাগুড়িও দিতে পারে না। তাছাড়া আমি তো ডাবলুকে কুড়িয়ে পেয়েছি কয়েক সপ্তাহ হলো।’

‘আমিই ডাবলু, বাবা। আমি এসেছি ভবিষ্যৎ থেকে। তোমাকে খুব মিস করি। বিশেষ করে, তুমি আমার পড়াশুনার যত্ন নিতে বলেই আজ আমি পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী। আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি সময় পরিভ্রমণের উপায়। তাই সময় পরিভ্রমণ করে প্রথমেই চলে এলাম তোমার কাছে। তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পাইনি আমি। কারণ, আমার কিশোর বয়সেই তুমি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলে।’

বাবলু কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি ছাত্রজীবনে পদার্থবিদ্যায় পড়াশুনা করেছেন। সময় পরিভ্রমণ সম্পর্কে তার হালকা ধারণা আছে। তাই বলে এমন উদ্ভট কাণ্ড ঘটা অসম্ভব। বর্তমানের নানা পেরেশানির ফলে কি তিনি আবারও দুঃস্বপ্ন দেখছেন? চোখ বন্ধ করে মাথা হাতাতে থাকলেন বাবলু। মনেমনে বললেন, দুঃস্বপ্ন দূর হ। খানিক পর চোখ খুললেন। ডাবলু নাম দাবিকারী ছেলেটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে! বাবলুকে চোখ খুলতে দেখে ডাবলু বলল, ‘বাবা, এই উপহারটা তোমার জন্য।’ বাবলু উপহারের প্যাকেট হাতে নিলেন। বেঞ্চিতে পাশে রাখলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার বক্তব্য কি শেষ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, বাবা।’

‘এবার তাহলে যাও। আমি একটু একা থাকতে চাই। আমার শরীর ভালো লাগছে না।’ বাবলু আবারও চোখ বন্ধ করে কপালে হাত বুলাতে লাগলেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় শুনতে পেলেন ছেলেটির কণ্ঠ, ‘ধন্যবাদ, বাবা। বিদায়।’

 

চার.

ধড়াক করে উঠে পড়লেন বাবলু। চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। তার মানে, অনেকক্ষণ তিনি পার্কের বেঞ্চিতে বসে ঘুমিয়েছেন। কী সব দুঃস্বপ্ন দেখছেন ইদানিং! মোবাইল সঙ্গে আনেননি। মুক্তা হয়তো দুশ্চিন্তা করছেন। বেঞ্চি থেকে উঠতে গিয়ে বাবলুর চোখে পড়ল পাশে রাখা উপহারের প্যাকেট! তিনি সঙ্গে নিলেন।

বাসায় পৌঁছে বাবলু দেখলেন ডাবলুকে নিয়ে মুক্তা ব্যস্ত। তিনি সোজা পড়ার রুমে চলে গেলেন। উপহারের প্যাকেট খুলে দেখলেন, তাতে একটি ছবির অ্যালবাম। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন যখন দেখলেন অ্যালবামভর্তি ছবি এবং সেগুলো তাদেরই ছবি! ডাবলুর ছোটবেলা থেকে তরুণ বয়স পর্যন্ত ছবি। বাবলু কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। হন্তদন্ত হয়ে অ্যালবামটা বইয়ের শেলফে বইগুলোর পেছনে রাখলেন।

বেডরুমে ঢুকতেই মুক্তা বললেন, ‘শুনছ, আজকে ভাইয়া এসেছিল। একটা সুন্দর ছবির অ্যালবাম নিয়ে এসেছে। ওইযে বিছানার ওপর রাখা।’

বিছানার ওপর রাখা ছবির অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে বাবলুর বুক কেঁপে উঠল। এ তো সেই অ্যালবাম! ছবিতে পূর্ণ অ্যালবামটিই তিনি কিছুক্ষণ আগে বুকশেলফে লুকিয়ে রেখেছেন।

মুক্তার কোলে ডাবলু। মুক্তা বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে এমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’

‘তাহলে আমার আর ডাবলুর একটা ছবি তুলে দাও না। আলমারি থেকে ক্যামেরাটা বের করো।’

বাবলু যেন অসাঢ় দেহ নিয়ে ক্যামেরা নেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন আলমারির দিকে। কেমন ছবি তোলা হবে, তা তিনি ইতিমধ্যে জানেন! আগামী বছরগুলোতে কোন কোন ছবি এই অ্যালবামে স্থান পাবে, সবই যে তার জানা! তিনি তরুণ ডাবলুকে স্মরণ করলেন। মনেমনে বললেন, ‘তোকেও ধন্যবাদ, বাবা।’

 

আসিফ মেহ্‌দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top