সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

সেদিন কেউ ছিলো না : লিপি নাসরিন


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২২:৪০

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ১০:৪৪

 

প্রাইভেট কার এসে থামলো বাসার সামনে। শায়লা দাঁড়িয়ে ছিলো গেট খুলে। তার প্রিয় শিক্ষককে কতোদিন পর দেখবে- তা প্রায় পঁচিশ বছর পর!! দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ড.জুবায়ের শাম্মী। শায়লা ততক্ষণে একদম গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে মুখে এক আনন্দ বিস্ময়! কতো খোঁজ করেছে প্রিয় এই মানুষটার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাবার পর কিন্তু এতো বছর তার প্রিয় শিক্ষকের কোন হদিস কেউ তাকে দিতে পারিনি। ফেসবুক সেই মানুষটাকে তার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। শায়লার এসব ভাবনার ঘোর কাটে প্রিয় শিক্ষককের কথায়-

শায়লা কেমন আছো?

শায়লা সালাম দিয়ে বলে, স্যার, কতোদিন পর আপনাকে দেখলাম!

হ্যাঁ,তা প্রায় দুই যুগ...

ড্রয়িং রুমের দরজা ঠেলে ধরে শায়লা, ডঃ জুবায়ের শাম্মী ভিতরে প্রবেশ করলেন। শায়লা তার দু'মেয়ে আর স্বামী আহসান চৌধুরীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো প্রিয় শিক্ষককে। শায়লার স্বামী ভদ্রলোক বহুবার স্ত্রীর মুখে তার প্রিয় এই শিক্ষকের নাম শুনেছে আর ফেসবুকে বন্ধু হবার পর ছবি দেখেছে, এখন তাঁকে বাসায় পেয়ে সে কথাই আলাপচারিতার প্রাথমিক পর্যায়ে জানাতে ভুললো না। ডঃ শাম্মীরও ভদ্রলোককে ভালোই লাগলো প্রথম দেখাতেই।

এই আলাপচারিতার মাঝেও দু'টি হৃদয়ের স্পন্দন কিন্তু সেই একটি জায়গায় গিয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল। শায়লা পরেছে টিয়া রঙের মধ্যে কমলা রঙের কাজ করা একটা একটা সুতি শাড়ি, চুল খোলা পিঠের উপর। সেও স্বামী আর প্রিয় শিক্ষকের সাথে রাজ্যের স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে আছে। ডঃ জুবায়ের শাম্মী একে একে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবনের কয়েক বছরের প্রিয় শিক্ষার্থীদের খবর জানার চেষ্টা করছে। ফেসবুকের কল্যাণে বেশ ক'জনের সাথে তার যোগাযোগ আছে সেটিও বললেন। এর ফাঁকে ফাঁকে আহসান চৌধুরীর চাকরির ধরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  জানার চেষ্টা করছে আর গভীর এক অনুভূতি নিয়ে শায়লাকে রাখছে চোরাচোখের নিরীক্ষণে।

দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেলে শায়লা উঠে টেবিলে খাবার রেডি করতে গেলো।

খাবার টেবিলে আহসান চৌধুরী বললো, স্যারকে আর এক টুকরো মাছ দিও। শায়লা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আহসান চৌধুরী মাছের টুকরো চামসে তুলতেই ডঃ শাম্মি না ,না বলে উঠলেন।

মাছ আমার ফেবারিট না, আর দিবেন না প্লিজ।

শায়লা বললো, স্যারের মাটন খুব ফেবারিট আমি জানি।

তুমি যে সেটি মনে রেখেছে সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ শায়লা।

ঠিক আছে তাহলে স্যারকে আজ বেশি করে মাংস খাওয়াবো, আহসান চৌধুরী মাছ রাখতে রাখতে বললো।

মাটন আমার প্রিয়, কিন্তু আর অত খাবার বয়স আছে কি?

কী যে বলেন স্যার,আমি এখনো প্রচুর খাই। শায়লা তো আমাকে খেতে দিতেই চায় না।

ডঃ জুবায়ের শাম্মী খেতে খেতে শায়লার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এই হাসিটা শায়লার খুব প্রিয়। হয়তো এই হাসিটার প্রেমেই ...

আজ আহসান চৌধুরী টেবিলে সার্ভ করছে। শায়লাকে বললো, তুমি স্যারের সাথে একসাথে বসো আমি আজকে সবাইকে সার্ভ করে খাওয়াবো। শায়লা একটু অবাক হয়েছিল স্বামীর এ কথায়। ডঃ জুবায়ের শাম্মী এজন্য আহসান চৌধুরীর বেশ প্রশংসা করে বললেন, বাঙালি  পুরুষরা তো ঘরের কাজ তেমন করে না কিন্তু আমেরিকাতে সবাইকে সব কাজ করতে হয়।

শায়লা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো, স্যার কিন্তু নারীর অধিকার নিয়ে খুব সোচ্চার। এসব নিয়ে লেখালেখি করেন খুব।

এই কথোপকথনের মধ্যে ডঃ জুবায়ের শাম্মী বারবার আহসান চৌধুরীকে বলছিলেন, আপনিও আমাদের সাথে বসুন না প্লিজ, আমি উঠিয়ে নিতে পারবো। সব কিছুই তো এখানে রেডি আছে।

স্যার এত বছর পর আমাদের এখানে এলেন আপনাকে একটু যত্ন করে খাওয়াই। আমি পরে বসবো স্যার।

আহসান চৌধুরীর মুখে স্যার ডাকটা কেমন যেন বেমানান লাগছিল আবার ভাই ডাকটাও বুঝি ঠিক পছন্দ হতো না তাঁর।

ড্রয়িং রুমে বসে শায়লা বললো ,স্যার আপনার সব প্রোগ্রাম কিন্তু আমি দেখি।

আচ্ছা, তো তুমি আরো ভালো কিছু করতে পারতে প্রাইমারি স্কুলে জব না করে।

বি সি এস পরীক্ষায় ভাইবা থেকে দু'বার ফিরে এসেছিলাম তারপর আর পরীক্ষা দেয়নি। কোন কোম্পানিতে চাকরি মেয়ের বাবা পছন্দ করেন না তাই বাধ্য হয়ে...

ডঃ শাম্মী দেখলেন শায়লার কথার মধ্যে কোন জড়তা নেই, সংশয় নেই। এই কি সেই শায়লা? সে যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখন শায়লার কান্না থামাতে তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে বোঝাচ্ছে শায়লার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় কিনা। কিন্তু তাঁর স্পষ্ট জবাব ছিল সে আর যাইহোক ছাত্রী বিয়ে করবে না তাছাড়া শায়লার সাথে তাঁর তো কোন প্রেমের সম্পর্কও ছিলো না যে শায়লার এই চোখের পানি তাঁকেই মুছতে হবে। অন্য সবার মতো শায়লাও  তাঁর কাছে প্রিয় ছাত্রীদের একজন বৈ কিছুই না। তাহলে আজ এতো বছর পর ফেসবুকে শায়লাকে দেখে কেন তাকে বাস্তবে দেখার ইচ্ছা তাঁর পেয়ে বসেছিল? সেকি তাঁর বিপন্ন জীবনে এক চিলতে শান্তির জন্য নাকি প্রছন্ন চিত্তে সে শায়লাকে শুনিয়ে গেলো চোখের পানির বিনিময় হার স্বরূপ  তাঁর অতৃপ্ত জীবনে আখ্যান। কিন্তু পরক্ষণেই ডঃ শাম্মী ভেবেছিলেন শায়লাকে তো সে ভালোবাসতো না,তাই তার প্রতি সে কোনরূপ দায় অনুভব করে না।

আহসান চৌধুরী ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই দু'জনেই একটু নড়েচড়ে বসলো।

স্যার আপনি দেশে চলে আসেন ,আর কোতদিন ও দেশে থাকবেন নাকি আর ফিরবেন না? আহসান চৌধুরী জিজ্ঞেস করলো।

ডঃ শাম্মীর  কণ্ঠে যেন একটু বিষাদের ধ্বনি খেলে গেলো। বললো, দেশে এসে কী করবো,  কে চাকরি দেবে আমাকে। ওখানে তো মোটামুটি যা হোক কিছু  একটা করছি, চলে যাচ্ছে; ভালো আছি।

স্যার ভাবিকে নিয়ে এলেন না কেন? শায়লা জিজ্ঞেস করলো। কৌতূহল অনেকটুকুই যেন সেই নারীকে ঘিরে;যে তার প্রিয় মানুষটিকে ঘিরে থাকে সারাক্ষণ।

ওর তো অফিস খোলা তাছাড়া এতো কম সময়ের জন্য এবার এলাম যে ওকে এ যাত্রায় সঙ্গী করলাম না।

সেদিন বিকেলে শায়লার বাসা থেকে বেরোনোর সময় শায়লার চোখে চোখ রাখলেন ডঃ জুবায়ের  শাম্মী।দেখতে চেয়েছিলেন  হয়তো  অশ্রুরেখা এখনো কাজলের ধার ঘেঁষে বয়ে চলেছে কিনা?

গাড়ি তে ওঠার সময় শায়লা বললো, স্যার অনেক খুঁজেছিলাম আপনাকে, ভেবেছিলাম হয়তো অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। আমি কখনোই ভাবিনি আপনার সাথে আবার দেখা হবে। আমি খুবই খুশি হয়েছি আপনি আমার বাসায় এসেছেন। আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন। শায়লার গলাটা কি একটু কেঁপে উঠলো?

এবার এলে ভাবিকে সাথে নিয়ে আসবেন।

ডঃ শাম্মীর ঠোঁট ঘিরে সেই রহস্যময় হাসির টুকরো। ভালো থেকো বলে  তিনি গাড়িতে গিয়ে বসলেন।

 

আচ্ছা তাহলে এই তোমার গল্প?

হ্যাঁ,  গল্পই বলতে পারো।

আচ্ছা কায়সার কতো বছর পর তোমার সাথে নীহারের দেখা হলো?

নীহারের সাথে দেখা মানে? তুমি একটা গল্পের প্লট চেয়েছো, আমি দিলাম, ব্যাচ।

কায়সারের চোখে সিঁথি চোখ ফেলতেই সে নিউজ পেপারে চোখ নামিয়ে নেয়।

তুমি গতবার দেশে এসে একসপ্তাহ পর ফিরে গিয়েছিলে। আমাদের দেখা হবার কথা থাকলেও হয়নি।

হ্যাঁ গতবার ইমিগ্রেশন নিয়ে একটু সমস্যা হলে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল। হঠাৎ এ কথা কেন কায়সার তাকালো সিঁথির দিকে।

কেন আমার কাছে লুকাচ্ছো বলতো?

কায়সারের মুখে মৃদু হাসি। সিঁথি যেন বিরাট কিছু আবিষ্কার করছে এমন একটা উচ্ছ্বলতা নিয়ে  কায়সারের সম্মুখে চেয়ার টেনে বসলো।

এই তোমার সেই ছাত্রী যে তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, যার কান্নাকে তুমি উতরে চলে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।

ডঃ কায়সার আহমেদ উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়ালো। একটু অন্যমনস্ক, দূরে রাঁধাচূড়া গাছটার  দিকে তাকিয়ে আছে। সিঁথি ওঁর পিছনে এসে দাঁড়ালো। কায়সারের পিঠে হাত রাখতে গিয়েও টেনে নিলো হাত।

মৃদু স্বরে বললো কেন তুমি ওকে বিয়ে করলে না? তাহলে হয়তো ...

তোমাকে তো সব বলেছি। তারপরও এই প্রশ্ন কেন? কায়সারের গলাটা কেমন যেন আর্দ্র ঠেকলো সিঁথির কাছে।

কয়েক মুহূর্ত  নীরব থেকে সিঁথি বললো,কেমন দেখলে নীহারকে, ওর সংসারকে ?

ভালোই আছে। খুব দেখার ইচ্ছা ছিল তাই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম ওর দাওয়াত পেয়েই।

না বললে বুঝি যেতে না? সিঁথির এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে কায়সার, নিবিষ্ট মনে সেই গাছটির দিকেই তাকিয়ে থাকে।

কায়সার,এই কায়সার কী ভাবছো? সিঁথি ডাকে।

ভাবছি এইটুকু না থাকলে জীবন মনে হয় একঘেয়েমি হয়ে যেতো, এটাই বোধহয় জীবনের চালিকাশক্তি সিঁথি।

নীহারের চোখের জল এতো বছরে মিউসিলেজে রূপান্তরিত হয়ে তোমার চলার পথ পিচ্ছিল করে ফেলেছে কায়সার।

সেটা আমিও ভাবি জানো, ওর চোখের জল আমাকে সুখী হতে দিলো না।মাঝে মাঝে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি জানো আমি সহজে ভেঙে পড়ি না।

আচ্ছা তোমারা একটা বাচ্চা নাওনি কেন? আর এখনো সময় আছে কায়সার। দেখবে বাচ্চা নিলে তোমাদের সম্পর্কটা অনেক স্বাভাবিক হয়ে যাবে, সিঁথি বলে- আফটার অল তোমরা দু'জন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে।

কায়সার একটু সশব্দে হেসে উঠে, ভালোবাসা!!

কেন? বিস্ময়ে জানতে চায় সিঁথি।

বাচ্চা নিতে হলে তো সে প্রসেসে আগাতে হবে, বলে ওঠে কায়সার।

তার মানে?

সহজ হিসাব, তার  সাথে আমার কোন সেক্সুয়াল রিলেশন নেই। একই ঘরে আমরা রুমমেটের মতো থাকি, হাত মেপে ঘুমাই।

সিঁথির বিস্ময়ভরা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করে, কতো দিন?

শেষ ২০০৯।

ওহ ! দুপুরের রোদ তেতিয়ে ওঠে বাইরে। এয়ার কন্ডিশন্ড রুমের মধ্যেও সিঁথির কপালে ঘামের সুক্ষ্মবিন্দু ছড়িয়ে পড়ে।

অবাক হচ্ছো? কায়সার জানলা থেকে ঘুরে সিঁথির দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। সিঁথি পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করে স্বাভাবিক থেকে।

দেখো তুমি আমি বিপরীত মেরুর দু'জন, তারপরও আমার মনে হয়েছে তোমাকে সবকিছু বলা যায়;মাঝে মাঝে ডিপ্রেশন আমাকে ঘিরে ধরে। হঠাৎ কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে কায়সার বললো,আশা করি আমার সামাজিক অবস্থান চিন্তা করে তুমি এসব তোমার ভিতরে রাখবে।

তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো কায়সার।

থ্যাঙ্কইউ সিঁথি।

একটা কথা বলি কিছু মনে করো না, সিঁথি কায়সারের মুখটাতে হঠাৎ হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলে।

কায়সার একটু চমকে ওঠে। দীর্ঘ পরিচয় তার সিঁথির সাথে কিন্তু ফোনেই কথা হয়েছে এতোদিন। আজই প্রথম দেখা তাদের- তাই এই স্পর্শে চমকিত হতে হয় বৈকি !

কায়সার সিঁথির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে ,তুমি আমাকে যা খুশি বলতে পারো, যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করতে পারো- সেটা নিশ্চয়ই এতো দিনে নতুন করে আর বলতে হবে না।

তুমি আবার বিয়ে করলে না কেন কায়সার?

একটু থেমে কায়সার বললো, বিয়ে তো মানুষ একবার করে। দুই বার নয় সিঁথি।

সিঁথি যেন কী এক মহাভুল কথা বলে ফেলেছে ভেবে লজ্জা পেলো।

কথা ঘোরাতে বললো, তুমি আর মেয়ে খুঁজে পেলে না শেষ পর্যন্ত এক তামিল মেয়েকে বিয়ে করলে। বলেই সিঁথি হাসতে লাগলো।

জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে-এ তিন বিধাতা নিয়ে। আমার কথা নয়, তোমাদের বিশ্বাসীদের কথা ।

হু, বলে সিঁথি চুপ হয়ে গেলো। সে জানে কায়সার অন্য প্রকৃতির মানুষ, জীবনের সব কিছুই বিচার করে একেবারে যুক্তির বাটখারায়।

তাই বলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা নিশ্চয় দোষের কিছু না, সিঁথি বলে।

আমি নিজের বিবেকের কাছে মাথা নিচু করে চলি তুমি কি তাই চাও? ও ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে এবং বাবা-মা'র বড় সন্তান। আমাকে বিয়ে করার জন্য ওদের পরিবারকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছে, কায়সার বেডের উপর বসে। একটু যেন ক্লান্ত মনে হচ্ছে ওঁকে। তুমি কি চাও আমি ওকে ত্যাগ করি?

না ,না তা কখনোই চাই না, সিঁথি তাড়িত হয়।

তুমি এ ক'বছরে আমার আদর্শ কী সেটি ভালো করেই জেনেছো। এসব আমার আদর্শের সাথে যায় না সিঁথি। আমি আমার কাজ নিয়ে ভালো আছি। আচ্ছা তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো?

ছেলেকে বাসায় রেখে এসেছো।

সমস্যা নেই, সিঁথি চেয়ারে বসতে বসতে বলে।

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে কায়সার লাঞ্চের অর্ডার দিতে চাইলে সিঁথি বাঁধ সাধলো।

আমার মনে হয় প্রয়োজন থেকেই তোমরা কাছে এসেছিলে তাই, প্রিয়জন থাকতে পারলে না। যেন কিছুটা আনমনে সিঁথি বলে উঠে। আর একটা কথা কায়সার-

বলো কী কথা, কায়সার জলের গ্লাসে ঠোঁট রাখে

এটা আমার একান্ত অবজারভেশন। তোমার বউ অনেক ভেবেচিন্তে তোমার সন্তান ধারণ করতে চায়নি, সিঁথি চেয়ার ছেড়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে। কায়সার ওর প্রতিটি পদক্ষেপে কী যেন শোনার অপেক্ষায় থাকে।

তোমার বউ চায়নি তার সন্তান আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ুক, কারণ তুমি তোমার ধর্ম পালন না করলেও তোমার বউ কিন্তু তাঁর ধর্ম পালন করে যেটি তুমি আমাকে বলেছিলে- সিঁথি ঘুরে এসে কায়সারের মুখোমুখি হয়।

হয়তো তুমি ঠিক, কায়সার আবার খবরের কাগজে চোখ নামায়।

জীবন আমাদের গভীর কিছু শিক্ষা দেয় কায়সার,জীবনের প্রবাহ একবার থামলে তা কেবল বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। সিঁথি জানালার কাছে গিয়ে বাইরে নিচে তাকায়। নয় তলা থেকে মানুষগুলোকে কেমন অচেনা পোকামাকড়ের মতো লাগে।

আসলে সন্তান না নিয়ে তোমাদের মধ্যে  স্বাভাবিক সেক্সুয়াল লাইফে ফেরা তার পক্ষে আর সম্ভব ছিলো না, সিঁথি জানালায় তাকিয়ে থেকেই বলে।

এমন সময় হঠাৎ সিঁথির মোবাইলটা বেজে ওঠে।

কায়সার এক মিনিট, আমি ফোনটা রিসিভ করি বলে ব্যাগের ভিতর থেকে ফোনটা বের করে দেখলো অচেনা নম্বর এবং অন্য দেশের।

কায়সারের দিকে সিঁথি তাকাতেই  ও একটা হাসি দেয়।

ফোনটা আসে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা থেকে। ড.কায়সার আহমেদের এক বন্ধু সিঁথির নম্বরটা পেয়েছিল তাঁর মোবাইল সেট থেকে। সে রাতে সিঁথির সেল নম্বরটা কায়সারের মোবাইলে ডায়ালিং লিস্টে ছিল বেশ কয়েকবার। হয়তো কায়সার সিঁথিকে কিছু বলতে চেয়েছিল। কোন কারণে সিঁথির ফোনে সংযোগ পায়নি হয়তো। তাঁর বন্ধুটি  সিঁথিকে জানিয়েছিল গত পরশু রাত আনুমানিক তিনটের দিকে কায়সার লেখালেখি করছিল হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ওর বউ জয়ারাম চেন্নাইয়ে বাবার বাড়িতে। সকালে প্রতিবেশী কেউ একজন কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পুলিশকে ইনফরম করে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে, পড়ে যাবার সাথে সাথেই কায়সারের মৃত্যু হয়েছিল।

সিঁথির হাত থেকে মোবাইল মেঝেতে পড়ে যায়, পাশ ফিরে তাকায় কায়সারের দিকে, কোথায় কায়সার!! এখনি তো, এখানেই, এই রুমেই কায়সারের সাথে তার কথা হচ্ছিল। ঐ যে খবরের কাগজটা সেখানেই পড়ে আছে, আধখাওয়া জলের গ্লাস, তাহলে কায়সার!! সিঁথি নির্বাক হয়ে তাকায় রুমটার চারদিকে। না কোথাও নেই কায়সার, একটু আগেও ছিলো না। সিঁথির বোধোদয় হয় ওয়েটারের ডাকে

ম্যাডাম, রুম কি আপনার পছন্দ হয়েছে? আপনার কোন গেস্ট থাকবে নাকি আপনি?

সিঁথি কোন কথা বলে ভয়ার্ত হতবিহ্বল চোখে ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে মোবাইলটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে ,ব্যাগটা এক ঝটকায় হাতে তুলে নিয়ে লিফটের দিকে পা বাড়ায়। লিফট না পেয়ে    যেন ধেয়ে আসা তুফানের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে একদম রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। জোরে জোরে শ্বাস নেয়।তখনো তার আচ্ছন্নতা পুরো কাটেনি।পড়ন্ত বিকেলে সেই রাঁধাচূড়ার নিচে ফুটপাতের উপরেই বসে পড়ে। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস তার বিহ্বলতা উড়িয়ে নিয়ে যায়। নিজের মধ্যে ফিরে আসতে শুরু করে সে। সিঁথি বুঝতে পারে না এই হোটেলের নয়তলার ঐ রুমে সে কখন কিভাবে গেলো, কায়সার দেশে এসে গতকালই তো তাকে ফোন করে দেখা করতে বললো।তাঁর  নাকি অনেক কথা বলার আছে সিঁথিকে। সিঁথি যেসব নিয়ে গল্প লিখতে চেয়েছিল। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাথা উঁচু  করে তাকায়  সিঁথি। ঐ তো সেই রুমটা, সেই জানালা- যেখানে একটু আগে কায়সার দাঁড়িয়ে ছিলো। সিঁথির চোখ জলে ভরে যায়, ভিতর থেকে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে উপরে উঠতে থাকে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top