সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

আয়া সোফিয়া উপ্যাখান: ক্ষমতার খেলা : খাদিজা খান সাদিয়া


প্রকাশিত:
১৮ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৯

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৫

 

নাৎস তিস হাগাস টু থিও সোফিয়াস, (Naós tis Hagías tou Theou Sophías, lit) অর্থ 'ঈশ্বরের পবিত্র জ্ঞানের মন্দির'। দেড় হাজার বছর আগের এই মন্দিরই এখন আয়া সোফিয়া বা হায়া সোফিয়া নামে পরিচিত । মূলত ত্রিতত্বের দ্বিতীয় "প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের ঈশ্বর " অর্থাৎ সোফিয়া কে উৎসর্গ করে তৎকালীন কনস্টান্টিনোপলের শাসক জাস্টিনিয়ান প্রথমের আদেশে ৫৩২ থেকে ৫৩৭ এর মধ্যে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল হিসাবে এটি নির্মিত হয়। সেই থেকে ইতিহাসের যাত্রা শুরু । কনস্টান্টিনোপলের একিউম্যানিকাল মহাবিশপ এপিসোপাল সী অনুসারে ১৫১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর ধরে আয়া সোফিয়াই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ক্যাথেড্রাল ।
আয়া সোফিয়ার সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আয়া সোফিয়া নিজের পরিবর্তন করে বহাল তবিয়তে টিঁকেও আছে।

৫৩৭–১০৫৪ সময়কালে আয়া সোফিয়া ছিল বাইজেন্টাইন খ্রিষ্টান ক্যাথেড্রাল ।

নিকা দাঙ্গাসহ নানান কারণে ১০৫৪ দিকে কনস্টান্টিনোপল গ্রিক প্রভুদের হাতে চলে যায় । তখন আয়া সোফিয়া হয়ে যায় গ্রিক অর্থডক্স ক্যাথেড্রাল; সময় কাল: ১০৫৪–১২০৪ ।
চতুর্থ ক্রুসেডারদের সময় অর্থাৎ ১২০৪ সালে এটি লাতিন সাম্রাজ্যের অধীনে রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালে রূপ নেয় ।রোমান ক্যাথলিক চার্চ সময়কাল: ১২০৪–১২৬১ ।

১২৬১ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আবার ফিরে আসার সাথে সাথেই আয়া সোফিয়া পূর্বের অর্থোডক্স চার্চ এ রূপ পায় । আবার ১২৬১–১৪৫৩ সাল পর্যন্ত আয়া সোফিয়া হল গ্রিক অর্থডক্স ক্যাথিড্রাল ।

১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল এর ইতিহাস নতুনভাবে লিখা হয় । অটোম্যান সুলতান ২য় মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল দখল নেয় এবং প্রথমবারের মত কনস্টান্টিনোপলে ইসলামী খেলফ্তের প্রতিষ্ঠিত হয় ।
এই সময় কনস্টান্টিনোপলের আমূল পরিবর্তন আসে ।কনস্টান্টিনোপলের নাম বদলে হয় ইস্তাম্বুল । ইসলাম খেলফ্ত হওয়ায় সম্ভ্রান্ত খ্রিষ্টানরা ইস্তাম্বুল ছেড়ে চলে যায় ইউরোপের অন্য দিকে, এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য তৎকালীন কনস্টান্টিনোপল ছিল অভিজাত ও সম্ভ্রান্তদের শহর তাই তারা ইস্তাম্বুল ছেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে অচিরেই ইস্তাম্বুলে খ্রিষ্টানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ থেকে সংখ্যা লঘিষ্ট হয়ে পড়ে ।

এছাড়াও ক্রমাগত অটোম্যান সম্রাজ্যের উত্থান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ক্রমেই তাদের কোষাগারে প্রভাব ফেলছিল । আর এই সময়েই অটোম্যান সুলতান ২য় মেহমেদ এর আয়া সোফিয়া ক্রয় করার লোভনীয় প্রস্তাবকে আয়া সোফিয়ার ধর্মগুরুরা অবজ্ঞা করতে পারে নি।শেষ পর্যন্ত বিরাট অংঙ্কের লেনদেনে হাত বদল ঘটে, সুলতান ২য় মেহমেদ ব্যাক্তিগতভাবে আয়া সোফিয়া কিনে নেন ।
আর ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিপত্রটি আজ অবধি আঙ্কারার ‘তার্কিশ ডকুমেন্ট অ্যান্ড আর্গুমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’-এ সংরক্ষিত আছে।

আয়া সোফিয়ার ক্রয়-বিক্রয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ এবং দূরদর্শি একটি সিদ্ধান্ত বা ঘটনা । খ্রিষ্টান ধর্মগুরুগণ কেন এটি বিক্রি করেছিলেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, অর্থলিপ্সার কারণেই তাঁরা সুলতানের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন যে, ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় প্রান্তিক হয়ে পড়ার কারণে এত বড় গির্জা রাখার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
সে যাই হোক, পরবর্তী সময়ে সুলতান ২য় মেহমেদ আয়া সোফিয়াকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে ওয়াক্ফ্ করে দান করেন । এই সময় থেকেই আয়া সোফিয়া ইসলামী শরীয়াহ্ মেনে মুসলমানদের মসজিদ রূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।
উসমানীয় শাসনামলের ১৪৫৩–১৯৩১ সাল পর্যন্ত আয়া সোফিয়া ছিল উসমানীয় মসজিদ । ১৬১৬ সালে নিকটবর্তী সুলতান আহমেদ মসজিদ নির্মাণ সমাপ্তির আগ পর্যন্ত ও নীল মসজিদের আগে, আয়া সোফিয়াই ইস্তাম্বুলের প্রধান জামে মসজিদ ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উসমানীয় অটোম্যান শাসনামলের পতন এবং অবসান ঘটে ।এরপর ১৯৩৫ সালে আধুনিক তুরস্কের স্থপতি ও স্বাধীন তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক আয়া সোফিয়া কে যাদুঘরে রূপান্তর করেন।
জাদুঘর হিসাবে ১৯৩৫–২০২০ পর্যন্ত এটি ছিল ইস্তাম্বুলের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র ।এইসময় রবিবার-বৃহস্পতিবার সকাল ৯.৩০ থেকে বিকাল ৪.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকতো । এর প্রবেশ মূল্য ছিল ২৫ তুর্কি লিরা (প্রায় ৳১,০০০)। এটি তুরস্কের সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণশীল স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় ।

৩১ মার্চ ২০১৮, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান আয়া সোফিয়া কে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের আবেদন পেশ করেন  এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জুলাই ২০২০ সালের রোজ শুক্রবার তুরস্কের শীর্ষ আদালত এটাকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের রায় ঘোষণা করেন। এইভাবেই প্রায় ৮৬ বছর পর আবারো আলোচনায় এলো আয়া সোফিয়া। নতুন আঙ্গিকে নিজের নাম লিখালো এবং ইতিহাসে যোগ হল আরো একটা পালক ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top