সাংবাদিক কথাশিল্পী রাহাত খান চলে গেলেন : মাহবুবুল আলম
প্রকাশিত:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৬
আপডেট:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৭
আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। সবার প্রিয় রাহাত ভাই। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। গত ২০ জুলাই রাহাত খানকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগের দিন বাসায় খাট থেকে নামতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান তিনি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এক্স-রে করা হলে পাঁজরে গভীর ক্ষত ধরা পড়ে। এর পাশাপাশি তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে তাকে বারডেম হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি করা হয়। ২৮ আগস্ট ২০২০ সালে নিউ ইস্কাটনের নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ডায়বেটিস সহ আরও কিছু জটিল রোগ ভোগছিলেন। ২৯ আগস্ট শনিবার রাহাত খানের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সাংবাদিক রাহাত খান। স্বনামে পরিচিত দেশের প্রগতিশীল ধারার অন্যতম ব্যক্তিত্ব তিনি। এই মৃদুভাষী, নিরহঙ্কার ও নিভৃতচারী ব্যক্তিত্বের লেখনী শুধু সাংবাদিকতা ক্ষেত্রকেই আলোকিত করেনি। তার লেখনি জীবন ও সাহিত্যের প্রতিটি ধারাকেই স্পর্শ করেছে। সমৃদ্ধ করেছে।
৩০ বছরের সাংবাদিকতা ও ৫০ বছরের বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবনে অধিকারী ছিলেন রাহাত খান। তার দীর্ঘ কর্মময় জীবন জুড়েই গভীর মানবপ্রেমে উৎসারিত ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক ধারার অনন্য এক লেখক। গল্প লেখা দিয়ে শুরু করলেও উপন্যাসে হাত দেন এবং ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষার অসাধারণ এক কথাসাহিত্যিক। তাকে বাংলা কথাসাহিত্যের নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ ও ভঙ্গি তৈরির অগ্রণী সৈনিকও বলা হয়। রাহাত খানের গদ্যের ভাষা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, গতিময়তায় ভরপুর এবং কোনো দুর্বোধ্যতা ছিল না। বাহুল্য শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করতেন না তিনি। মানুষ এবং মানুষের জীবনকে ঘিরেই ছিল তার যা কিছু সাধনা। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যে নিমগ্ন করে রেখেছিল তার লেখক সত্তা।
দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত হলেও কর্মসূত্রে রাহাত খান ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাংবাদিক।
তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে রাহাত খান কিছুদিন জোট পারচেজ ও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন। তারপর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন তিনি।
১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি। পরে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে, তিনি আড়াই বছরের জন্য বাসসের বোর্ড চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। মৃত্যুর আগে তিনি দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের অধিকারী রাহাত খান ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের এক অনিবার্য ব্যাক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অনিশ্চিত লোকালয় প্রকাশিত হয়। তার পরবর্তী উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খেলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি।
সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাহাত খান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৯৬) পেয়েছেন।
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক বার্তায় বলেছেন, “সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখক হিসেবে রাহাত খান মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সমাজ উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
শেষ করতে চাই এই বলেই, রাহাত খান ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান ও কীর্তিমান কথাশিল্পী। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ছোটগল্প, উপন্যাসসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে জাতি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিককে হারালো। তার সৃষ্টিকর্ম যতদিন থাকবে ততদিন এদেশের সাহিত্যপ্রেমী ও সাংবাদিকরা তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। প্রয়াত রাহাত খানের মতো কীর্তিমান ব্যাক্তিত্বের চির প্রস্থানে আমরা শোকাহত। রাহাত খানের বিদেহী আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক! আমীন।
মাহবুবুল আলম
কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক
বিষয়: মাহবুবুল আলম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: