সিডনী বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ফতেমা বিবি, দাঙ্গা ও একটি চিতা বাঘের গল্প : বিনোদ ঘোষাল


প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:২৬

আপডেট:
১ মে ২০২৩ ২১:০২

ছবিঃ বিনোদ ঘোষাল

(লেখক পরিচিতিঃ বিনোদ ঘোষালের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগরে
জীবনে বহু বিচিত্র কাজে জড়িয়ে পড়ার পর অবশেষে তিনি লেখালেখিকেই একমাত্র পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, ফিচার, নাটক, চলচ্চিত্র সমালোচনা তার লেখালেখির বিষয়। দেশ পত্রিকাতে বিনোদ ঘোষালের লেখা প্রথম গল্প ‘একটু জীবনের বর্ণনা’  প্রকাশিত হলে, গল্পটি পাঠকমহলে বিশেষ সাড়া ফেলে। তারপর থেকে তিনি নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র জীবনকে ভিত্তি করে লেখা তার দীর্ঘ উপন্যাস ‘কে বাজায় বাঁশি?’ একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । বিনোদ ঘোষাল ২০১১ সালে তার ‘ডানাওলা মানুষ গল্প’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন কেন্দ্রীয় সাহিত্য একাডেমি যুব পুরস্কার। ২০১৪ সালে তিনি ‘নতুন গল্প ২৫’ বইটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি পূর্বভারত পুরস্কার, মিত্র ও ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার, শৈলজানন্দ পুরস্কারে সম্মানীত হয়েছেন। দেশের বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের সাহিত্য উৎসবে বাঙালি লেখক প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছেন। ২০১৬ সালে তিনি মাননীয় ভারতের রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতিভবনে 'রাইটার্স ইন রেসিডেন্স প্রোগ্রামে' যোগদান করেন। অর্জন করেছেন ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলোশিপ)

 

ফতেমা বিবি, দাঙ্গা ও একটি চিতা বাঘের গল্প

মাত্র চার মাসের মাথায় এই তিন দিন আগেই ফতেমার বুকের দুধ শুকিয়ে গেল, আর কাল থেকে লাগল দাঙ্গা। ফতেমা অস্থির হয় উঠল, নিজে খাই না খাই কিন্তু বাচ্চাটাকে তো দুধ খাওয়াতে হবে। আগের ছেলেটা দুই বছরের মাথায় জ্বর হয়ে মরল। ওষুধ দিয়েও কিছু হল না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শেষ। এবারেরটাকে যেইভাবে হোক বাঁচাতেই হবে। ফজলুল ঘরে নেই। সে গিয়েছে ভূটানে, ফিরবে মাস দুয়েক পর। ফজলুল মাঝেমাঝেই ভূটান যায়, দল বেঁধে যায় ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে। ওখানে কীসব কুলি মজুরের কাজ করে তারপর আচমকাই একদিন ফিরে আসে। তেইশ বছরের ফতেমা ততদিন অপেক্ষা করে উনত্রিশ বছরের ফজলুলের জন্য।

রংলাপোতা বস্তি ভূটান বর্ডারের কাছেই। বস্তিটা বিশাল বড়। বেশিরভাগই কুলি মজুরদের বাস। বস্তির পিছনে ঘন জঙ্গল। ওই জঙ্গলে কাঠ কুটো পাতা কেটেও বিক্রি করে সংসার চালায় অনেকে। বস্তিতে একটা মসজিদ আর তার থেকে একটু দূরে একটি শিবের মন্দির রয়েছে। রমজান কি শিবরাত্রি দুটোতেই সমান জোরে মাইক বাজে, নাচ গান হয়। পেটের দায়ে সকলে এত ব্যস্ত থাকে যে গোধরা কি বাবরি মসজিদ অথবা বারাসাত-ধুলাগড় কিছুই এদের কানে পৌঁছয় না, ওসব বুঝতেও চায় না। এই বস্তিতে সারা ভারতের কুলি মজুর শ্রমিক খুঁজলে পাওয়া যাবে। তবে বেশিরভাগই পরস্পরকে স্রেফ নামে চেনে, তার বেশি কিছু জানার আগ্রহ আসেনি। গত বিশ ত্রিশ বছরে এখানে ছুটকো ছাটকা ঝামেলা, দুই একটা খুনোখুনি, ছাড়া বড় কিছু ঘটেনি। কিন্তু এইবার প্রথম ঘটল। ভূটান যাওয়ার আগেরদিন রাতেও ফজলুল ভাত খেতে বসে ফতেমাকে বলছিল, ব্যাটাকে সাবধানে রাখবি, আর চোখ কান খোলা রাখবি সবসময়।

কেন কী হল?

দিন কাল ভাল ঠেকছে না। বস্তিটা আর ভাল আগের মতো নেই, কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।

কেমন হয়ে যাচ্ছে?

ঠিক বুঝছি না, লোকগুলো...কারা সব আসে এখানে, ঠিক চিনি না। গুজ গুজ করে, ফিস ফিস করে। দিন কাল ভাল নয় রে ফতেমা। ছেলে নিয়ে সন্ধানে থাকিস।

মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল ফজলুল। তার দুইদিন পর থেকেই বুকে আর দুধ এল না ফতেমার। মাইয়ের বোঁটা চুষে চুষে ক্লান্ত হয়ে ছেলেটা চিল চিৎকারে কাঁদতে শুরু করল। কী করবে বুঝে পেল না ফতেমা। নিজের বুক টিপে টিপে দুধ আনার চেষ্টা করে শেষটায় অসহায় হয়ে পড়ে ছোট ক্যানটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল লক্ষ্মণ রাইয়ের খাটালের দিকে। সব মিলিয়ে আট দশটা গরু মোষ তো হবেই। লক্ষ্মনের বউ রাখীভাবির কাছে গিয়ে নিচুস্বরে পুরো ঘটনাটা বলতেই রাখী বলেছিল কিছু চিন্তা না করতে। এমন কান্ড তার মেজ ছেলে যখন কোলে তখন হয়েছিল। কালো গরুর দুধ পাতলা করে দুধ খাওয়ালে কোনও অসুবিধা নেই। বলে নিজেই ফতেমার কাছ থেকে ক্যানটা নিয়ে ওতে দুধ ভরে দিয়ে বলেছিল রোজ বিকেলে এসে নিয়ে যেতে। বিকেল মানে শেষ বিকেলে। ওই গরুর দুধ দোওয়ানো হয় সবার শেষে।

বাচ্চাটাকে সেই দুধ আরেকটু জলে গুলে খাওয়ানোর পর শান্তি। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ফতেমা। তারপর দিন তিনেক তাই ই করেছিল। ছেলেটা প্রথম দুইদিন পাতলা হেগে আর দই বমি তুলে  তারপর ওই দুধ হজম করতে শিখে নিল। চলছিল বেশ। তারপর এই দিন তিন চার আগে থেকেই চারদিক কেমন যেন গরম গরম। মুসলমানরা মসজিদের সামনে মাইক বেঁধে জমায়েত করল। সে নমাজের সময় ছাড়াও এমন জমায়েত মাঝেমাঝেই হয়, যেমন শিউ মন্দিরের সামনে হিন্দুরা জমায়েত করে, ভজন গায়, প্রসাদ চড়ানো হয়। মুরুব্বিরা মাইকে অনেক কথা বলে। সকলে শোনে। কিন্তু এবারের জমায়েতগুলো যেন কেমন কেমন। ঠিক বুঝতে পারে না ফতেমা। কাল শিউজির পুজো রয়েছে, সেই জন্য আজ মন্দিরের গায়ে অনেক লাইট লাগানো হয়েছে। গান বাজছে ‘ব্যোম ব্যোম ভোলে ব্যোম’। বিকেলে ছেলেকে কোলে নিয়ে অন্যহাতে দুধের ক্যান নিয়ে দুধ আনতে বেরোল ফতেমা। বস্তির বেশ কয়েক জায়গায় জটলা। তাস-পাশার আড্ডা নয়, কোথায় কীসব লড়াই হয়েছে তাই নিয়ে গরম আলোচনা চলছে, টিভিতে কীসব দেখিয়েছে তাই নিয়েও তর্জা চলছে। ‘কে একজন বলে উঠল হারামখোররা বাচ্চাদেরও রেয়াত করেনি, টিভি তে দেখাল চারটে বাচ্চার চাকু দিয়ে পেটের নাড়িভুরি বার করে দিয়েছে’ কথাটা কানে আসতে বুক ধক করে উঠল ফতেমার। ছেলেকে আরও সপাটে জড়িয়ে ধরল। এইযে কীসব লড়াইয়ের কথা বলছে সেটা ভূটানে নয় তো! ভয়ে গা সিরসির করে উঠল ফতেমার। কার কাছে জানা যাবে?

লক্ষ্মণজির বাড়িতে টিভি রয়েছে, ভাবী টিভিতে সিনেমা দেখে। ওর কাছেই জিজ্ঞাসা করতে হবে। জোরে পা চালাল ফতেমা।

গিয়ে দেখল হুলুস্থুল কাণ্ড। খাটাল থেকে একটা বাছুর উধাও হয়েছে। কয়েকদিনের বছরা। ওর মা টা বাচ্চার জন্য ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মণ আর ওর ভাই বাছুর খুঁজতে বেরিয়েছে বস্তিতে। ফতেমা দুধ নিল, তারপর কিন্তু কিন্তু করে প্রশ্নটা করেই ফেলল ভাবীকে। কোথায় লড়াই হচ্ছে ভাবী? কোথায় বাচ্চা মারা হয়েছে?

রাখীও কিছু জানে না। ঠোঁট উলটে বলল জানি না। রামজির কৃপায় বছরাটা পেয়ে গেলেই বাঁচে। জঙ্গলে চলে গেলে আর ফেরার আশা নেই। জঙ্গলে চিতা, বন বিড়াল রয়েছে। মাঝেমাঝে জঙ্গলে খাবারের অভাব ঘটলে জন্তুগুলো লোকালয়ে ঢুকে পড়ে হাঁস মুরগির লোভে।

ভাবীর বদলে উত্তর দিল খাটাল সাফ করার রশিদ ভাই। লড়াই লেগেছে গো অনেক দূরে এখানে নয়, ভিনরাজ্যে।

ভূটানে নয় তো? কাঁপা গলায় প্রশ্নটা করেই ফেলল ফতেমা।

আরে না না ওখানে নয়। হেসে উত্তর দিয়েছিল রশিদ।

ব্যাস আর কিছু জানার দরকার নেই, নিশ্চিন্ত হয়ে বড় শ্বাস ছেড়ে দুধ নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছিল ফতেমা।  

 

পরদিন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠতেই ভয়ংকর ঘটনা। চারদিকে হৈ চৈ, এতদিনের শান্ত বস্তিটা যেন তেড়েফুঁড়ে উঠেছে। ঘর থেকে দুই পা এগোতেই জেনে গেল সাংঘাতিক কান্ড। গতকাল রাতে লক্ষ্মনের কালো গরুর বাছুরটার কারা যেন গলা কেটে শিউজির মন্দির দালানে ফেলে দিয়ে গিয়েছে। খুব অশান্তি হচ্ছে সকাল থেকে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করে উঠল ফতেমার। বস্তি জুড়ে প্রবল চিৎকার হচ্ছে। কারা যেন হর হর মহাদেও বলে হুংকার দিচ্ছে। গুটিয়ে গেল ফতেমা। শিগগির ঘরের ভেতর ঢুকে দোর দিল। মাত্র দুইপোয়া দুধ বিকেলে নিয়ে আসে। জল মিশিয়ে ফুটিয়ে বারবার খাওয়ায়। কিন্তু আজ বিকেলে ঝামেলা মিটবে তো? বিকেলে যে বেরোতেই হবে...

একটু বেলা বাড়তে আবার ঘর ছেড়ে বেরোল ফতেমা। ওর ঝুপড়ির কাছেই মগনের দোকান। চাল-ডাল আটা-আনাজ ইত্যাদি পাওয়া যায়। দরজা বন্ধ করে বেরোতেই বেশ কয়েকটা অল্পবয়েসি ছেলে প্রাণপণে দৌড়তে দৌড়তে আসছে।

কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করার আগেই একটা ছেলে চিৎকার করে ফতেমাকে বলে গেল আপা ঘরে গিয়ে দোর দেন। লড়াই লেগেছে।

ফতেমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার মাঝে। ফতেমার পাশের ঘরের রেশমি পিঠে স্কুল ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে আসছিল, ওর চোখেমুখে আতংক। স্কুল ইউনিফর্ম পরে পড়মরি ছুটে আসছিল রেশমি। রেশমি তামাং। নেপালি। ওর হাত ধরে থামাল ফতেমা। মেয়েটা হাত ছাড়িয়ে পালাতে যাচ্ছিল, তবু ওকে জোর করে চেপে ধরে ফতেমা জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে রে?

খুন হুয়া দিদি, ভাগো। বহোত লড়াই লগ গিয়া। এক মুসলমানকো মার দিয়া হিন্দুওনে। বলেই ফতেমার হাত ছাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগাল রেশমা। ফতেমা পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর নিজের ঘুমন্ত শিশুটির কথা মনে পড়তেই এক ঘুটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল, যে টুকু দুধ রয়েছে তাতে এইবেলা চলে যাবে। কিন্তু হিন্দু মুসলমান...খুন...ফজলুলের সঙ্গে শাদি হওয়ার পর এই বস্তিতে ছয় বছর হয়ে গেল, কোনওদিন শোনেনি এইসব কথা। কী হল? কী হবে?

।। ২ ।।

এই অঞ্চলে সন্ধে নামে তাড়াতাড়ি। জঙ্গল ঘেষা এলাকা রাত নামার আগেই নিঝুম হয়ে যায়। আজ সারাদিন ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে কাটিয়েছে ফতেমা। ভয়ঙ্কর দিন কেটেছে আজ। মাঝেমাঝেই বোমা, বন্দুকের শব্দ। কারা যেন ঘরের সামনে দিয়ে দৌড়ে গিয়েছে দল বেঁধে। তাদের মুখে ভয়ঙ্কর চিৎকার। ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছে ফতেমা। দরজা জানলা সব বন্ধ করে প্রায় অন্ধকারেই সারাদিন কাটিয়েছে। সারাদিন রান্নাবান্না কিছুই করেনি। ক্ষিদে তেষ্টাও পায়নি। কিন্তু বিকেলের পরই ছেলেটার চিল চিৎকার শুরু হল। ক্ষিদে পেয়েছে। এবার কী হবে? দুই পোয়া দুধ আর কত জল মিশিয়ে খাওয়ানো যায়? ছেলেটা হাঁ মুখ দেখে ফতেমা কী করবে বুঝে পেল না। দরজার ফাঁক দিয়ে এখনও আলো ঢুকছে। এরপর ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যাবে। তখন আর কিছুই উপায় থাকবে না। বাকি দুধটুকু গরম করে ছেলেকে ঝিনুক করে খাওয়াল। ছেলেটা খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। এখন ঘন্টা দুয়েক নিশ্চিন্তি। কিন্তু ঘুম ভাঙলেই আবার...তখন? তারপর কী হবে? কোল থেকে ছেলেকে নামিয়ে চৌকিতে শুয়ে বুকে কাপড় চাপা দিয়ে মশারি টাঙ্গিয়ে দিল ফতেমা। তারপর অনেক দ্বিধা নিয়ে দুধের ক্যানটা হাতে নিয়ে বেরোল। রোজ ছেলেকে কোলে নিয়েই বেরোয়, কিন্তু আজ আর উপায় নেই। বাচ্চাকে নিয়ে বেরোনো ঠিক হবে না। রাস্তায় যদি কিছু হয় ছেলে কোলে নিয়ে দৌড়নো কঠিন হবে। থাক ঘরে। তবে এই ছেলের পেট ভরা থাকলে এমনি কোনও চিন্তা নেই, পুরো বাপের মতোই বেহুঁশ হয়ে ঘুমোয়, মুখটাও হয়েছে অবিকল ফজলুলের মতো।

ফতেমা খুব সাবধানে দরজা খুলল, বাইরের হাওয়ায় কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ। কিছু জ্বলেছে। ভাবতেই সারা শরীর ভয়ে সিরসির করে উঠল। ইয়া আল্লা রহম কর! বিসমিল্লার নাম জপতে জপতে দরজার শিকলটা কোনওমতে আটকে শাড়ির আঁচল দুই কানের পাশ দিয়ে মাথায় তুলেই রওনা দিল ফতেমা।

 

রাস্তা পুরো সুনশান। দোকান পাট তো দূরের কথা একটা ঘরের দরজাও খোলা নেই। দ্রুত হাঁটতে লাগল। আজ দেরি হয়ে গিয়েছে। আলো নরম। ফেরার মধ্যেই অন্ধকার নেমে যাবে। দুধের ক্যান নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় প্রায় ছুটতে শুরু করল ফতেমা। পোড়া গন্ধে গা গুলোচ্ছে, ভয় যেন গলা চিপে দিচ্ছে ওর। ওর ঘর থেকে লক্ষ্মনের গোয়াল যেতে মিনিট পনেরো লাগে। সরু রাস্তার একপাশে ঘন জঙ্গল অন্য পাশে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি ছেড়ে তারপর বসতি শুরু। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বেদম হয়ে লক্ষ্মনের ঘরের সামনে পৌঁছল যখন আবার ধড়াস করে উঠল বুক। সদর বন্ধ। বাইরে গোয়ালে একটাও গরু মোষ নেই। কোথায় গেল অতগুলো প্রাণী! দরজা ধাক্কাতে শুরু করল ফতেমা। ভাইয়া লক্ষ্মণ ভাইয়া, ভাবী দরজা খুলো...ভেতর থেকে কোনও সাড়া নেই...ভাবী আমি ফতেমা...ছেলেটা না খেয়ে রয়েছে, কঁকিয়ে উঠল ফতেমা। দরজার ভারি শিকলটা বার বার ধাক্কা দিতে থাকল।

এবার খুব সামান্য ফাঁক হল দরজা। লক্ষ্মণ ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। ঐটুকু ফাঁক দিয়ে বাইরেটা বোঝার চেষ্টা করল, তারপর দরজা আবার দুম করে বন্ধ করে দিয়ে বলল আজ দুধ পাওয়া যাবে না। ফিরে যাও।

দয়া করো ভাইয়া, বাচ্চাটা না খেয়ে থাকবে।

কিছু করার নেই বহেন, আজ গরু দোয়ানো হয়নি।

একটুখানি দাও। একটু...দোহাই...

ভেতর থেকে কোনও শব্দ নেই। ফতেমা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে বুঝতে পারছে না। বাচ্চাটার কী হবে! নিজের মাতৃত্বের প্রতি অসীম ঘেন্না হল ওর। বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে মন মনে গাল দিতে শুরু করল। বন্ধ দরজার সামনে থেকে ফিরে আসতে যাবে আচমকাই দরজা সামান্য ফাঁক হল। ভেতর থেকে একজন বলল, ভেতরে এসো।

হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকতেই আবার দরজাটা বন্ধ করে দিল লক্ষ্মণ। পাশে ভাবীও এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবী ধমক দিলে ফতেমাকে। আজ কেউ বেরোয়? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?

কী করব ভাবী ছেলেটা...

কই ডাব্বা দেখি। হাত বাড়াল লক্ষ্মণ। ডাবাটা নিয়ে ঘরের ভেতরে গেল।

ভাবী কী হয়েছে?

খুব খারাপ হয়েছে রে...কোথায় শালা কী লড়াই হয়েছে তার জন্য  কুত্তার অউলাদরা এখানে দাঙ্গা ফাসাদের চেষ্টা করছে, আমার বছরাটাকে কেটে শিউজির মন্দির দালানে ফেলে দিয়ে গিয়েছে ওই শালা হারামিগুলো। নরকেও ঠাঁই হবে না একটারও। গরুখেকো বেজম্মা...

ভাবীর মুখে এমন ভাষা এই প্রথম শুনল, গরুখোর...হারামি...বেজম্মা! কাদের এসব বলছে ভাবী? মুসলমানদের? না বোধ হয়...ফতেমাও তো মুসলমান, কই ওকে কিছু বলছে না তো...সব কেমন গুলিয়ে গেল ফতেমার।

লক্ষ্মণ এসে ওর ডাব্বাটা হাতে দিয়ে বলল ভর্তি করে দিয়ে দিয়েছি। কালও হয়ে যাবে। আসার দরকার নেই।

 কিন্তু তুই কী করে ফিরবি ফতেমা?

কেন? বুক গুরগুর করে উঠল ফতেমার।

আবার বুম করে প্রচন্ড একটা শব্দ হল সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষের চিৎকার।

তোর ছেলে কোথায়?

ঘরে...ঘুমোচ্ছে...বলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল ফতেমা। এই বিকট শব্দে ছেলেটার যদি ঘুম চেঙে যায়...অন্ধকার ঘরে যদি মাকে দেখতে না পেয়ে...ইয়া আল্লাহ...

কী করে ফিরবি তুই? ভাবী ব্জিজ্ঞাসা করল।

ফতেমা কিছু বলার আগেই লক্ষ্মণ বলল, ওদের লোকরাই প্রথম শুরু করেছে...

ফতেমা কিছুই বুঝল না ওদের লোক মানে কারা? ফতেমা বেরিয়ে এল। দরজা বন্ধ করার আগে লক্ষ্মণ বলল, রাস্তায় যদি হিন্দুরা ধরে, বোলো না যে আমি তোমাকে দুধ দিয়েছি। আর...বলে ফতেমার মাথার ঘোমটার দিকে তাকাল লক্ষ্মণ, তারপর কিছুই না বলে দরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

অন্ধকার নেমে এসেছে। আবার ছুটতে শুরু করল ফতেমা। রাস্তা যেন ফুরোতে চাইছে না। বস্তিতে কারও ঘরে আলো জ্বলছে না বলে অন্ধকার আরও বেশি কালো লাগছে। জঙ্গলের পাশের রাস্তা দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছিল । আর কিছুটাই রাস্তা বাকি। আচমকাই ওর উল্টোদিক থেকে শুনতে পেল কয়েকটা পুরুষকন্ঠ, ওই যে ওই যে আরেকটা...

ফতেমা মুখ তুলে তাকাতেই ধক করে উঠল বুকের ভেতর। পাঁচ ছয়জন জোয়ান মদ্দ, হাতে লাঠি, টাঙ্গি, ফতেমার দিকে জ্বলন্ত আর ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ফতেমার মনে পড়ল ওর মাথার ঘোমটার কথা। এক টানে কপালের ওপর দিয়ে কানের পাশ দিয়ে টান টান ঘোমটা নামিয়ে নিতে গেল তার আগেই আরেকজন ওই দেখ শালি কাটার বাচ্চা, নিয়ে চল ওটাকে। ফতেমা উলটো দিকে পালাতে গেল, পারল না। ভয়ে পাদুটো মাটিতে যেন আটকে গিয়েছে।

লোকগুলো দৌড়ে ওর দিকে ছুটে আসতে থাকল। আর ঠিক পাঁচ-ছয় হাত বাকি ওকে ধরতে আচমকাই জঙ্গল থেকে এক লাফে ও আর ওই দলটার মাঝখানে লাফ দিয়ে রাস্তায় নামল একটা চিতা। কোনওমতে থেমে গেল দলটা। হলুদে কালো ফুটকি পূর্ণবয়স্ক প্রাণীটা একবার ফতেমার দিকে তাকাল তারপর ওই দলটার দিকে তাকিয়ে দাঁত বার ফ্যাঁস করে উঠল, তারপরেই আরেক লাফে ঢুকে পড়ল বস্তির ভেতরে।

ফতেমার কথা ভুলে ওই দলটা রে রে করে তাড়া করল বাঘটাকে ধরার জন্য। কে একজন বলে উঠল এটাই...হ্যাঁ হ্যাঁ এইটাই পরশু রাতে ঢুকেছিল, হীরুর ঘর থেকে হাঁস নিয়ে গিয়েছে...।

এই বস্তিতে পাঁচ-ছয় বছরের জীবনে বেশ কয়েকবার চিতা বাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনা দেখেছে ফতেমা। প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটার সময়ে খুব ভয় পেয়েছিল। শের ঢুকেছে বস্তিতে, কী হবে?

ফজলুল হেসে বলেছিল, বাঘ নয়, বাঘিনী, ভয়ের কিছু নেই, এমনিতে ওরা মানুষদের এলাকা এড়িয়েই চলে কিন্তু বাচ্চা দিলে তখন সহজে কাছাকাছি শিকার খোঁজে বাচ্চার জন্য। ঐ কারণে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে কখনও সখনও। শিকার পেলেই পালিয়ে যাবে।

বুকের ভেতর জমাট বেঁধে যাওয়া ভয়টা সামান্য গলতেই আবার চলতে শুরু করল ফতেমা। ঘেমে স্নান হয়ে গিয়েছে, হাত পা অসার, একটু আগেই কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল হায় আল্লাহ...!

দুধের ক্যান হাতে নিয়ে পা ঘসটে ঘসটে যখন নিজের ঘরের কাছাকাছি পৌঁছল, ততক্ষণে মসজিদের নমাজ পড়ার মাইক থেকে ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, বস্তিতে শের ঢুকেছে, সকলে যেন সাবধানে থাকে। এই এলাকায় যে কোনও ঘোষণা প্রথমে ওই মসজিদের মাইকেই হয়। শের ভাগানোর জন্য বস্তির ছেলেরা টিন, ক্যানেস্তারা, লাঠি বল্লম, আরও যা যা কিছু আছে তাই নিয়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।

ঘরের সামনে পৌঁছতেই ও আবার শিউরে উঠল। দরজার একটা কবাট খোলা। তখন তাড়াহুড়ো করে বেরোনোর সময় শিকলটা যে ঠিকমতো তোলা হয়নি একটু পরে নিজেই খসে পড়ে গিয়েছিল সেটা ভাবতে পারল না ফতেমা, এক ছুটে ঢুকে এল ঘরের ভেতর। সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায়। মশারি টেনে সরিয়ে অন্ধকারেই ওর সারা গায়ে হাত বোলাল, এখনও বেহোঁশ ঘুমোচ্ছে। বুকের ভেতর থেকে যেন পাষান নেমে গেল। এতক্ষণের তীব্র উত্তেজনা এবার অসীম কান্তি হয়ে নেমে আসছে। ঘরের ভেতর বিশ্রী একটা গন্ধ!

দুধের ক্যানটা নামিয়ে খাটের পাশের র‍্যাক থকে হাতড়ে দেশলাই নিয়ে হ্যারিকেনটা জ্বালালো। এনামেলের ক্যানটার দিকে তাকাল। ওটায় ভর্তি দুধ, ভেবে ভেবে আবারও নিশ্চিন্ত হল ফতেমা। তারপর হ্যারিকেনটা মেঝেতে নামিয়ে রাখতে যেতেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা সাপ নেমে গেল যেন। চৌকির তলায় একজোড়া জ্বলন্ত চোখ ওর দিকে তাকিয়ে। মুখ থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেড়িয়ে এল ওর আর চৌকির তলা থেকে বেড়িয়ে এল লুকিয়ে থাকা চিতাটা, মুখে কামড়ে ধরা একটা সাদা নিথর মুরগি। চিতা আর ফতেমা পরস্পরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল তারপর এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল হলুদে কালো ফুটকিওলা প্রাণীটা।

ক্যানেস্তারা পিটনোর শব্দ আর অনেক মানুষের চিৎকার এগিয়ে আসছে এইদিকে। ফতেমা মনে মনে দোয়া করল বাঘিনীটা যেন তার আগেই ওর ডেরায় পৌঁছে যেতে পারে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top