সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

 অজানা অতীত : ছন্দা বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৭

আপডেট:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৩৩

 

সমতল থেকে বেশ খানিকটা চড়াইয়ে ওঠার পরে চওড়া একটা সমতল জায়গা দেখে গাড়ীটা দাড় করাল ড্রাইভার রানা কুমার। ড্রাইভারের সাথে সাথে অর্কও গাড়ী থেকে নেমে এল। ওদের নামতে দেখে পিছনের সীট থেকে অস্মি এবং  অর্কর মামা নেমে এলেন।

শীতের শেষ, বসন্তের শুরু। পাহাড়ি পথের দুইধারে তাই শুকনো পাতার সমারোহ। এদিকটাতে শিমূল, সীতাহার, মেহগনির জঙ্গল চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে পাহাড়ি বাঁশ আর বুনো কুলগাছের ঝোপ থেকে পাখিদের কিচ কিচ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

অস্মি তাই গাড়ীর ভিতর থেকে পশ্মিনা চাদরটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। এখানে বেশ কয়েকটা দোকান চোখে পড়ল। চা- কফি-মোমো, পকোড়া ছাড়াও রুটি, সব্জি, চিকেন কারি এবং ভাত পাওয়া যাচ্ছে।

ড্রাইভার  অর্ককে ঊদ্দেশ করে বলল,”স্যার, যা খাওয়ার এখান থেকে খেয়ে নিন, উপরে কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না।”

অর্ক তখন ওর ডি এস এল আর এ দূরে পলাশ গাছের উপরে বসে থাকা একটা পাহাড়ি চন্দনাকে ফ্রেমে বন্দী করতে তৎপর। গাঢ় সবুজ গায়ের রং। পাখিটার ফোটো তোলা শেষ করতে না করতেই অর্কর সামনে দিয়ে একটা কালো রঙ্গের ময়না উড়তে উড়তে পাহাড়ের ঢালে একটা মেহগনির গাছের উচু ডালে গিয়ে বসল। বসেই কু-উই কু-উই করে ডাকতে লাগল। সম্ভবত ওর সঙ্গিনীকে ডাকছে। মেহগনি গাছটা অর্কর থেকে সামান্য কিছুটা দূরে। অর্ক লোভ সামলাতে না পেরে তাকেও লক্ষ্যভেদ করে।

ওদের গন্তব্যস্থান বেশ খানিকটা উপরে। তাই এখানে ওরা খুব বেশী সময় নষ্ট না করে গাড়ীতে উঠে বসল। বেশ কিছু ছড়ানো ছিটানো চা বাগিচা, কয়েক কিলোমিটার অন্তর পাঁচ কি ছয় খানা পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এক একটা গ্রামকে পাশ কাটিয়ে ক্রমশঃ উপরে দিকে উঠতে লাগল।

 

দুই

ঘন্টা খানেকের ভিতরে অস্মিরা ওদের নির্ধারিত জায়াগায় পৌছে গেল। চারিদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটা ভ্যালি। খানিকটা বাটির মতো দেখতে জায়গাটা। পাহাড়ের ঢালে পাইন, দেবদারু, কিছু পাহাড়ি বাঁশ, বহেরা , হরতকি, ঘোড়া নিম , বুনো কুল, মহুয়া ছাড়াও আরও কত  নাম না জানা বিচিত্র গাছের সারি। একটা পাহাড়ী নদী  জঙ্গলের শুড়ি পথ থেকে বেরিয়ে কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলেছে। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জলে পাহাড়ের ছায়া পড়েছে। নদীতে গোড়ালির খানিকটা উপর পর্যন্ত জল হলেও বেশ স্রোত তাতে। সামনেই একটা পাথরে বাধা পেয়ে জল লাফিয়ে ছুটে চলেছে।

ওরা বালির উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। অস্মির বেশ ভাল লাগছে জায়গাটা। কী সুন্দর শান্ত, মনোরম পরিবেশ। নদীর ধারে পাইন গাছে শুকনো ফুলগুলো  নিয়ে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে খেলা করছিল। একজন গাইড অর্কর চাইতে বয়সে কিছুটা বড়ো কয়েকজনকে কী যেন বোঝাচ্ছেন। এদের সকলের চোখে কালো রঙ্গের চশমা। রাণা এগিয়ে এসে অর্ককে বলল,”এখানে আজ প্রকৃতি পাঠের আসর বসেছে। মাঝে মধ্যে এইসব দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা হয় এখানে।“

অস্মি দেখল, শুধু দৃষ্টিহীনই নয়, মূক, বধির এবং কয়েকজন মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়েও আজ এখানে প্রকৃতি পাঠের আসর বসেছে। সামনের পাহাড়, নদী, বন-জঙ্গল পাখির ডাক, নদীর জলের শব্দ-সব কিছু ওদের শোনানো এবং শেখানো হচ্ছে। হিমালয়ান নেচার য়্য্যন্ড য়্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশানের একজন কর্মকর্তার সাথে নবীণবাবুর পরিচয় আছে দেখা গেল। তিনি এগিয়ে এসে নবীণবাবুর সাথে করমর্দন করলেন। নবীনবাবু অর্ক এবং অস্মির সাথে ওনার পরিচয় করে দিলেন।

কানে শুনে, গন্ধ শুকে, কিম্বা স্পর্শ অনুভব করে কীভাবে একটা অচেনা পরিবেশকে চেনা যায়, সেই সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করছে।

কয়েকজন ছাড়া বাকীদের ভিতরে বেশ একটা সপ্রতিভতা লক্ষ্য করল অস্মি। দৈহিক ভাবে অক্ষম হলেও মনের দিক থেকে কয়েকজন বেশ পরিণত।

অস্মি এই মাসুম শিশু-কিশোরদের মুখে এক অনাবিল খুশী প্রত্যক্ষ করল। বাইরের মানুষ ভাবে ওরা কত না দুখী। আসলে ঈশ্বর ওদের যতটুকু দিয়েছেন তাই নিয়েই ওরা সন্তুষ্ট। তারা খেলছে, হাসছে, গাছের শুকনো ফুল, পাতা, ফল, কাঠি দিয়ে যার যেমন ইচ্ছা নানান জিনিস বানাচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন শিশু উপস্থিত আছে এখানে।

যারা হাটাচলা করতে পারে না ঠিকমতো তাদের জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নদীর গতিপথ ধরে একটা রাস্তা সোজা পুর্বদিকে চলে গেছে। অস্মিরা এই জায়গা ছেড়ে একটা সাঁকো পার হয়ে হাটতে লাগল। অর্ক রীভার বেড ধরে হাটছে। বেশ খানিকটা হাটার পরে ক্লান্ত হয়ে একটা বড় পাথর দেখে হঠাৎ ও বসে পড়ে অস্মিকে ডাকে, "এই অস্মি, দেখো, দেখে যাও, কতো পাখি এইখানে।”

অস্মিও ওর ডাক শুনে এগিয়ে যায়।

সত্যি ত ছোটো ছোটো কিছু পাখি জলের ধারে ঘোরাফেরা করছে। কী যেন মুখে করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

নবীণবাবু বললেন,"এগুলিকে  বলে ধোবি পাখি। এরা সারাটাদিন জলের ধারেই ঘুরে বেড়ায়, মাছ শিকারের নেশায়।”

কিছু হিল প্রিনিয়া, গ্রেট বারবেট, মিনিভেট আর হিমালয়ান গ্রিফন অর্কর ক্যামেরায় বন্দী হল কিছু সময় অন্তর অন্তর। জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা পাখি বেশ জোরে জোরে ডাকছে। সেই ডাক এই শান্ত উপত্যকার প্রতিটা কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ওদের ভিতরের একটি ছেলে যে চোখে দেখতে পায় না, ঠিকমত হাঁটতে চলতে পারে না, হঠাৎ চীৎকার করে বলল, "স্যার, রিভার ল্যাপুইং ডাকছে।”

ছেলেটার কথা সকলের কানে গেল। শব্দ শুনে ঠিক বুঝতে পেরেছে ডাকটা যে রিভার ল্যাপুইং এর।

রাণা অর্কদের সাথেই ছিল। ও বলে, ”স্যার, আশেপাশে নিশয়ই কোনো জন্তু জানোয়ার আছে। এই পাখিগুলোর কাজই হল জঙ্গলে কোন হিংস্র জন্তু-জানোয়ার দেখলে আশেপাশের সকলকে সতর্ক করে দেওয়া।”

অর্ক মুখ তুলে বলল, "তাই নাকি?”

 

তিন

অর্ক বসেছিল একটা উঁচু পাথরের উপরে। অস্মি স্বছ নদীর জলে পা ডুবিয়ে হাঁটছিল। বেশি জল ছিল না , বড়োজোর গোড়ালির উপর পর্যন্ত।

অস্মি এবারে  চুড়িদার পাজামাটা কিছুটা উপরে তুলে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে সাবলীল ভঙ্গিমায় এগিয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলা থেকে কী সুন্দর সরসর করে সরে যাচ্ছে বালি। মাঝে মাঝে মাছের ঝাঁক ওর পায়ে একটা ঠোক্কর কেটে পালিয়ে যাচ্ছে। জলের ভিতরে মাঝে মাঝে বড়ো পাথর খণ্ড ডিঙ্গিয়ে ও এগিয়ে যাচ্ছে।

ওর ইচ্ছা নদীর ওপারে যাওয়ার। অর্ককে সেকথায় বলায় অর্ক জানাল ও এখন কিছুতেই জুতো খুলতে পারবে না।

অস্মি নদীর বুকে জেগে থাকা কয়েকটা বড়ো বড়ো পাথরখন্ড দেখিয়ে বলল, "দেখ, এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গেলে তোমার পায়ে জল লাগবে না।। এস, খুব বেশি জল নেই। “

অস্মি এখন পাজামা থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে হাঁটছে। খরস্রোতা নদীর জলে ওর পাজামা ভিজে যাচ্ছে। তাতে সে আরও বেশি মজা পাচ্ছে।

কী স্বচ্ছ জল। নীচের প্রতিটা নুড়ি পাথরকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। কিছু চঞ্চল মাছ ঝাঁক বেধে ছুটে ছুটে যাচ্ছে আর সুযোগ পেলে পাথর খণ্ডের ভিতরে লুকিয়ে পড়ছে।

অর্ক অস্মির কথামত কয়েকটা পাথর পেরিয়ে মাঝখান পর্যন্ত এসেও ফিরে গেল। বলল, নাহ, কিছুতেই সম্ভব নয়। পরেরগুলো প্রায় জল ছুঁই ছুঁই করছে। হয় ওর জুতো মোজা ভিজে যাবে নয়ত ও পা পিছলে পড়ে যেতে পারে। খুব পিচ্ছিল পাথরগুলো।

ও পরিষ্কার জানিয়ে দিল, " তুমি গেলে যাও, কিন্তু সাবধান, বোল্ডারে যেন আঘাত না লাগে।”

অস্মির টার্গেট ওপারে একটা বেশ বড়সড় উঁচু পাথরখণ্ডের কাছে যাওয়া। এপার থেকে ও লক্ষ্য করেছে সেই পাথর খণ্ডের উপরে সুন্দর সব ছবি আঁকা। এখানে বিভিন্ন সময়ে নানান ধরনের পর্যটকেরা আসেন। তাদের কেউ হয়ত ছবিগুলো এঁকে রেখেছে। ভাবল অস্মি।

অস্মি এগোচ্ছে, ক্রমশ নদীর জলতল বাড়ছে সেটা ও খেয়াল করছে না সম্ভবত। পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি, তারপর হাঁটুর প্রায় নীচ পর্যন্ত উঠে গেছে। সেই সাথে তীব্র স্রোত। অস্মির এখন ন যযৌ ন তস্তৌ অবস্থা।  ও সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে জল তীব্রও বেগে পাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে জায়গাটা এর চাইতেও গভীর। ও বিপদ বুঝে বড়ো একটা পাথর খণ্ডের উপরে উঠে অর্ককে দেখতে লাগল।

কিন্তু অর্ককে কোথাও দেখা গেল না। যে পাথরটাতে বসেছিল সেখানে অর্ক নেই। শুধু তাই নয়, এই মুহূর্ত্যে ওর আশেপাশে কেউ কোত্থাও নেই।

রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটা। নদীর পাড়ে পাইন গাছের সারি থাকায় কেউ থাকলেও ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না।

অস্মি অসহায় হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। এই নির্জন জায়গায় ওর বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। কেন যে এইরকম একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত ও নিলো। নিজের বোকামির জন্যে বেশ রাগ হল। কিন্তু এখন ও কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

হঠাৎ একটা ছেলে কোত্থেকে যেন এগিয়ে আসছে ওর দিকে। পাহাড়ের পিছনে লুকিয়ে ছিল কি?

অস্মি চমকে উঠল। এই নির্জন জায়গায় ছেলেটা তার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? ওর কি খারাপ কোনও মতলব আছে। অস্মি ত্রিশ পেরিয়েছে বহুদিন, কিন্তু ওর চেহারা দেখলে পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি মনে হয় না। এমনি লাবণ্য ওর চেহারায়।

সত্যি তো ছেলেটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এই মুহূর্ত্যে অস্মির কী করা উচিত ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

অস্মি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখল  মুখ ভর্তি দাড়ি মাথার চুল গুলো ঘাড় পর্যন্ত নামানো। চোখে কালো চশমা। একেবারে ভয় পাওয়া চেহারা।

ছেলেটা হাত নেড়ে কী যেন ওকে বলছে। অস্মি সেটা বুঝতে পারছে না।

অস্মি একবার ভাবল, চীৎকার করে অর্ক কিম্বা মামাবাবুকে ডাকবে। পরক্ষণে মনে হল, নাহ, ছেলেটা হয়ত ওর এই বিপজ্জনক অবস্থা দেখে এগিয়ে এসেছে।

অস্মির অনুমান সঠিক।

ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে কিছুটা দূর থেকে হাত নেড়ে বলল, "ম্যাডাম, আসুন এইদিক থেকে আসুন।”

হাত দিয়ে ডান দিকের একটা পাথর খণ্ডের দিকে নির্দেশ করে দেখিয়ে দিল, ওই দিকের জলস্তর তুলনামূলকভাবে  অনেক কম।

সত্যিই  তাই। কোনোরকম সাহায্যও ছাড়াই অস্মি ছেলেটার নির্দেশিত পথ ধরে ওপারে গেলো। দেখল এপারে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আছে। যাদেরকে ওপার থেকে দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেটা দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে সেই পাথর খণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল।

অস্মি সেই বিরাট পাথর খণ্ডের কাছে যেতে যেতে দেখতে পেল ছেলেটা  রঙ তুলি হাতে নিয়ে আবার তার সৃষ্টিকর্মে মগ্ন হয়েছে। কালো পাথরের উপরে শাদা রঙ দিয়ে আঁকছে।

 

অস্মি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটার অপুর্ব  শিল্পকর্মের দিকে। কালো পাথরের উপরে ফুটিয়ে তুলেছে অপুর্ব এক নারীমূর্তি। কিন্তু ছবিটাতে চোখের জায়গাটা ফাঁকা রাখা আছে।

অস্মির ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে, বিশেষ করে হাঁটার ভঙ্গিমাটা। ঠিক যেন,- ।

ও হঠাৎ শিল্পীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। ততক্ষ্ণে চোখ থেকে কালো চশমাটা সে খুলে ফেলেছে।

হঠাৎ ছবি আঁকা বন্ধ রেখে ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

অস্মিতার মাথার ভিতরটা ঘুরে গেল।

ও ফিরে যাচ্ছে বহু বছর আগের সেই দিনগুলিতে।

 

চার

ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের মতোই হঠাৎই  বিয়ে হয়ে গেলো অস্মিতার। শ্বশুর মশায়রা চার ভাই এসেছিলেন অস্মিতাকে দেখতে। মনে আছে ডিসেম্বরের কোন এক রবিবারে।

টি পট থেকে চা ঢালার সময়ে ওর কাঁপা কাঁপা হাতের দিকে লক্ষ্য করে শ্বশুর মশায় বললেন, “আরে এ কি হচ্ছে, এত ভয় পাওয়ার কি আছে? আমরা বাঘ নই আর ভালুকও নই যে আমাদের দেখে এত ভয় পেতে হবে। “

অস্মির তরফে সেদিন ওর মা বাবা কাকা কাকিমনি ছাড়াও ওর দিদি জামাইবাবু উপস্থিত ছিল। ওভাল শেপেড কাচের সেন্টার টেবিল ঘিরে সুসজ্জিত সোফায় বসে সকলে তখন বিভিন্ন গল্পে মশগুল। অস্মিতার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার নিয়ে তখন সকলে উচ্ছ্বসিত।

অস্মিতা নিজের কানে শুনল ওনারা নাকি ওর রেজাল্ট শুনেই ওকে দেখতে এসেছেন। এই মুহূর্ত্যে ওনাদের দেখে কে বলবে যে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত দুই পরিবারের কেউ কাউকে চিনত না।

পাত্রপক্ষ ফিরে গিয়ে সেই রাতেই তাঁদের পছন্দের কথা জানিয়ে দিলেন।

এরপর পাত্রের বাড়ি থেকে ফিরে এসে অস্মির বাবা কাকাদের সে কি গল্পও। অর্ক, অর্ক, অর্ক,- কী সুন্দর চেহারা, কী অমায়িক ব্যবহার, এত বড়ো একজন ডাক্তার বিদেশ থেকে এতো এতো ডিগ্রি অর্জন করেছে অথচ এতটুকু অহমিকা নেই। সত্যি হীরের টুকরো ছেলে।

 

 বিয়ের কেনাকাটা রশ্মি আর ওদের মা মিলে করেছিল। বাড়িতে এসে কাঞ্জিলাল থেকে কেনা লাল বেনারসীর  কিছুটা ভাঁজ খুলে রশ্মি অস্মির গায়ের উপরে রেখে বলেছিল, " দেখ বোন, কী সুন্দর লাগছে তোকে।”

অস্মি শাড়ীটার দিকে না তাকিয়ে বিষণ্ণ মুখে বসে রইল।

রশ্মি ওর এই ভাবসাব দেখে বোনের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ”কী রে, শাড়ীটা তোর পছন্দ হয়নি?”

অস্মি দিদির বুকের ভিতরে মুখ রেখে বলেছিল, "দিদি, একটা কথা কিন্তু ওদের জানানো হয়নি।”

রশ্মি ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে অস্মির  মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।

অস্মি  আস্তে আস্তে বলল, "আমার যে একটা অভিশপ্ত অতীত আছে, সেটা তো ওদের জানানো হয়নি। পরে যদি কখনও ওরা জানতে পারে?”

কথাটা শোনা মাত্র রশ্মির মুখটা পাংশুটে হয়ে গেলো।

“জানবে না, কিচ্ছুটি জানবে না। আর জানলেও সব শোনার পরে বুঝতে পারবে তুই কতটা নির্দোষ ছিলি।”

কথাটা বলতে বলতে রশ্মিও অস্মির সাথে কাঁদতে লাগল। ওদের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে ওদের মা ছুটে এসে বললেন, "কি হল কি তোদের, রশ্মি, তুই কোথায় ওকে সামাল দিবি তা নয় নিজেও বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলি। এদিকে কত কাজ পরে আছে বলত,  হাতে কি আর সময় আছে? আয় এদিকে আয়। কান্নাকাটি পরে হবে।”

রশ্মি মায়ের সাথে সাথে চলে গেলে একলা ঘরে অস্মিতার মনে হল ও যেন ক্রমশঃ এক জমাট অন্ধকারময় সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করছে। এই পার্থিব জগতের কোনও কিছুর প্রতি তার কোনও আকর্ষণ নেই। নেই কোনও বোধ। শুধু জেগে আছে এক নিঃসীম শূন্যতা। তিল তিল করে বড় হয়ে ওঠা সেই অস্মি আজ যেন ক্ষুদ্র থেকে আর ক্ষুদ্রতর হতে হতে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে সেই কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতরে।

 

পাঁচ

অস্মি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। যেন সেই চোখের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছে এক ধূসর অতীতের দিকে। একসময়ে ওরা একসাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। তীর্থ, পার্থ, জয়তী, ঈভারা আসতো কৃষ্ণনগর থেকে। ট্রেনে উঠে দেখা হতো ওদের গ্রুপটার সাথে। গেদে থেকে আসত তানিয়া আর ঋষা। ওরা রানাঘাটে নেমে একসাথে শিয়ালদহ যাওয়ার জন্যে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরত।

শিয়ালদায় নেমে ওরা সকলে হেটেই ইউনিভার্সিটি যেত। বেশ কিছুদিন ধরে সুরেন্দ্রনাথের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওই কলেজেরই কয়েকজন ওদের দেখে নানান মন্তব্য করত। বেশ কিছুদিন চলার পরে তীর্থই একদিন প্রতিবাদ করতে এগিয়ে যায়। অস্মি, জয়তিরা সেদিন দেখেছিল তীর্থ রেগে গেলে কী ভয়ংকর হতে পারে।

দিন কাটছিল স্রোতের অভিমুখে পানসি নৌকার মতো স্বচ্ছন্দ, অনাবিল গতিতে। ওদের সেকশানের পড়ত সাথী আর আয়ুশ। প্রেসিডেন্সি থেকে এসেছিল ওরা। আয়ুশ ছিল প্রেসিডেন্সির টপার। ওরা দুজন সেরকম কারুর সাথে মিশত না। সেবার অ্যানুয়াল ম্যাগাজিনে অস্মির একটা কবিতা বের হয়। বাংলাদেশের একজন বিতর্কিত লেখিকার উদ্দেশ লেখা কবিতা।

কবিতাটা নাকি অসম্ভব নাড়া দিয়েছিল আয়ুশকে। সেই প্রথম আয়ুশ এগিয়ে এসে ওকে কংগ্রাচুলেশান জানিয়েছিল। অস্মিদের গ্রুপটা তখন অফ পিরিয়ডে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল।

আয়ুশ পাঁচ মিনিট দাড়িয়ে থেকে অস্মির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেলো ওর ঝুলি থকে ঘ্যামা ঘ্যামা সব শব্দ বাক্য ব্যবহার করে।

আয়ুশ চলে যেতেই তীর্থ কি একটা বাজে মন্তব্য করে বসল । অস্মি কেন কেউই তীর্থর মুখ থেকে এই জাতীয় কথা বলতে শোনেনি। অস্মির মনে হল তীর্থ বুঝি আয়ুশকে ঈর্ষা করছে। সেদিনের পর থেকে অস্মি লক্ষ্য করেছে তীর্থ ঠিক আয়ুশকে পছন্দ করছে না।

এর ভিতরে পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট আউট হল। এবারে সবাইকে পিছনে ফেলে অস্মি টপার হল। বন্ধুরা ওকে নিয়ে গেলো কফি হাউজে। বসন্ত কেবিনেও আড্ডা জমল।

আর কয়েকমাস বাদেই এম এর ফাইনাল এগজ্যাম। অস্মির এখন বেশিরভাগ সময়টাই কাটে লাইব্রেরি রুমে। আয়ুশের সাথেও দেখা হয় সময়ে সময়ে। এখন আর চারটে পঁয়তাল্লিশের কৃষ্ণনগরটা ধরতে পারে না অস্মি। পরের শান্তিপুর ধরে কখনও পৃথা কখন বা তৃষাদের সাথে চলে যায়। তীর্থর পড়ায় ততটা মন ছিল না,  যতটা ও মন দিয়ে ছবি আঁকত। প্রায় দিন সুযোগ পেলেই চলে যেত অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। শিয়ালদা স্টেশানে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে শিল্পীদের ছবি আঁকা দেখত। কয়েকদিন অস্মিকে বলেছে ওর সাথে যেতে। কিন্তু লাইব্রেরি রুমে অস্মিকে গভীর মন দিয়ে পড়তে দেখে একাই চলে গেছে। অস্মি বুঝতে পারছে ইদানীং তীর্থর সাথে ওর একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। এখন সামনা স্যামনই দেখা হলেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সব সময়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। সামনেই ফাইনাল এগজ্যাম, তাই ওসব ভাববার সময় নেই অস্মির।

কয়েকদিন ধরে বন্ধুরা অস্মিকে ধরেছিল খাওয়ানোর জন্যে। সকলকে একসাথে করতে করতে এতটা দেরি হয়ে গেলো। সেদিন মোগলাই আর কোল্ড ড্রিঙ্ক অর্ডার দিল বন্ধুরা। ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনেই সকলে উপস্থিত ছিল। সেদিন ক্যান্টিনে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ । সকলে মিলে গান, কবিতা, তুমুল হৈ চৈ করছে। আয়ুশ আর স্বাতীও এসেছিল। ওআয়ুষ সবে মাত্র গাইতে শুরু করেছে , "ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে, তোমাকে করেছে রানী- সবে মাত্র এইটুকু গেয়েছে, তার ভিতরে অস্মির মনে হল দরজায় একবার তীর্থ উকি দিয়ে চলে গেলো।

অস্মি দ্রুত বাইরে এসে ডাক দেয়, "এই তীর্থ, শোন।”

 

তীর্থ আসব না আসব করেও ধীর পায়ে ফিরে এলো। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে অস্মির সামনে চলে এলো এবং শান্ত, নিবিড়  শীতল দৃষ্টিতে অস্মির দিকে তাকিয়ে রইল।

অস্মি এতদিন ওর সাথে মিশেছে কিন্তু কখনও এইভাবে তাকাতে দেখেনি। মনে হচ্ছে আজ যেন অস্মির ভিতরে কিছু একটা খুঁজছে। ওর কাছে কিছু একটা পেতে চাইছে।

অস্মির কান দুটো  সহসা গরম হয়ে গেলো। সমস্ত শরীর কাপতে লাগল।

ও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললো, "আয়, এদিকে।”

এর ভিতরে কখন জানি আয়ুশ এসে খানিকটা গায়ে পরা ভাব দেখিয়ে অস্মিকে ডাকতে লাগল,  "আয়,  তোর জন্যেই গাইছি, আর তুই যদি না শুনিস-।”

সকলে বেশ মজা করে মোগলাই খেতে লাগল। অস্মি, পার্থ, ঈভা, তীর্থ আর জয়তিরা একটা টেবিল ঘিরে বসেছিল। ঈভা আর পার্থকে নিয়ে জয়তিরা ইয়ার্কি করতে লাগল। অস্মি মিটিমিটি হাসছিল। তীর্থ নীরব ছিল।

আয়ুশ হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পাশের টেবিল থেকে উঠে এসে এক টুকরো মোগলাই ফর্কে গেঁথে অস্মিকে খাওয়াতে চলে এলো।

"এই কি হচ্ছে কি, এটা?” বলে অস্মি এড়িয়ে গেলেও আয়ুশ এক প্রকার জোর করে ওকে খাওয়াতে গেলো। আয়ুশের বাম হাতটা এখন অস্মির ঘাড়ের উপরে রাখা আছে। বেশ অন্তরঙ্গ হয়েই খাওয়াতে যাচ্ছে।

হঠাৎ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তীর্থ পাগলের মতো আয়ুশের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারপর ওর হাতের কাঁটা চামচ দিয়ে আয়ুশকে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগল।

সমস্ত ক্যান্টিন জুড়ে তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি। সকলে ছুটে এলো অস্মিদের টেবিলের দিকে। তীর্থকে পার্থ এবং অন্যান্যরা জোর করে সরিয়ে নিয়ে গেলো ।

আয়ুশকে নিয়ে যাওয়া হল মেডিকেল কলেজে।

 

ছয়

বিয়ের পরের দিনগুলো যে কীভাবে কেটে গেলো অস্মির। অর্ক দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় ওর ভিতরে কোনো নীচতা কিম্বা ক্ষুদ্রমনা স্বভাব  নজরে পড়েনি অস্মির।

তখন ওরা সানফ্রানসিসকোতে। বিয়ের পরে এক বিকেলে অর্ক অস্মিকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিল সমুদ্র তীরে। অদূরেই গোল্ডেন গেট ব্রিজ। তখন বেলা পড়ে এসেছে। আকাশে নানান রঙের খেলা চলছে। পশ্চিমাকাশের রক্তিম আভা ব্রিজটাকে আরও রাঙ্গিয়ে তুলেছে। এই মনোরম পরিবেশ এবং অপরূপ আলোর ভিতরেও অর্ক লক্ষ্য করল অস্মি নিরুত্তাপ।

সামনের উত্তাল তরঙ্গমালার মতোই ওর বুকের ভিতরে অবিরাম চলছে ঢেউয়ের প্রত্যাঘাত।

অর্ক অস্মির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছে অস্মি? আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়নি?”

অস্মি অর্ককে সেদিন বলতে চেয়েছিল, ওর জীবনের একটা কাহিনী আছে, একটা অতীত আছে। সেটা ওর শোনা দরকার। শুরুও করেছিল। বেশ থেমে থেমে কোনও কিছু বাদ না দিয়ে অকপটে সত্যিটা তুলে ধরতে চেয়েছিল অর্কর সামনে।

কিন্তু অর্কর সেদিন সবটা শোনার মতো ধৈর্য বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। নিতান্ত ছেলেমানুষি ঘটনা ভেবে নিয়েছিল। তীর্থ, অস্মি আর আয়ুশের কাহিনীটা সেখানেই চাপা পড়ে গেল।

অর্ক সেদিন অস্মির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ”প্রত্যেকের জীবনেই একটা না একটা কাহিনী থাকে। সেই হারানো অতীতকে টেনে এনে বর্তমানকে  নষ্ট হতে দিতে পারিনা। আমি শুধু বর্তমানকেই  প্রত্যক্ষ করি আর সেই দৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।”

কথাটা বলে অর্ক সেদিন অস্মিকে বুকে টেনে নিল। সানফ্রান্সিকোর উজ্জ্বল আকাশের মতোই এরপর ওদের দাম্পত্য উত্তাপ এবং উষ্ণতা পেল।

 

বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে।

অর্ক আর নবীনবাবু একটা বাঁশের সাকো পার হয়ে নদীর ওপারটায় চলে এলেন। দেখলেন পাহাড়ের ঢালে গাছে গাছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। বেশ  বড়ো পাথর খণ্ড পরে আছে এখানে। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে সেই পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলছে নানান ছবি।

কথা বলতে বলতে নবীনবাবু এগিয়ে গেলেন বেশ বড়ো একটা কালো  রঙের পাথর খণ্ডের দিকে। একটি ছেলে আনমনে সেখানে ছবি আঁকছিল। আর তার সামনে ছবিটার ঠিক পাশে পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অস্মি। ছেলেটা একবার অস্মির দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে আবার ছবি আঁকায় মন দিল।

নবীন বাবু ছেলেটাকে উদ্দেশ করে বললেন,”কী, তীর্থংকর  না?”

ছেলেটা পাথরের গা থেকে তুলিটা সরিয়ে নবীন বাবুকে একনজর দেখল। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এসে বলল, "স্যার আপনি এখানে?”

"এই এলাম একটু ঘুরতে। তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমার স্কুল কেমন চলছে?”

ছেলেটা মৃদু হেসে পাশের ছেলেমেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, ”এই যে আজ ওদেরকে এখানে একটু নিয়ে এলাম। মাঝে মাঝে একটু সময় সুযোগ পেলে ওদেরকে এখানে নিয়ে আসি।”

 নবীনবাবুরা কথা বলছিলেন আর অর্ক তাকিয়ে দেখছিল কী নিপুণ হাতে পাথর খণ্ডের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছে অপুর্ব এক নারীমূর্তি। কেমন মায়া ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছবি যে কথা বলে এই প্রথম সে দেখল। আর হুবহু মিলিয়ে নিলো পাশে দাঁড়ানো একজনের চেহারার সাথে। সেই চোখ, সেই নিষ্পাপ চাহনি। যেন এইমাত্র শিল্পী সেই চোখ দেখে তার ছবির নারী মূর্তির চোখ আঁকা সম্পন্ন করল।

 

নবীনবাবু হাটতে হাটতে বললেন, "জানিস অর্ক, খুব ট্যলেন্টেড ছেলে ছিল এই তীর্থ। কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ। ভাগ্যদোষে একটা ভুল করে ফেলে আর সেটাই ওর জীবনের অভিশাপ হয়ে দাড়ায়। ইউনিভার্সিটিতে পড়া চলাকালীন একটা ট্র্যাঙ্গেল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। তারপরে হঠাৎ একদিন একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। আমার তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পোস্টিং ছিল। ঘটনাচক্রে সেখানেই  তীর্থ বন্দী ছিল বেশ কয়েকবছর। সেই সময় খুব কাছ থেকে ওকে দেখেছিলাম। সারাটাদিন পেন্সিল নয়তো রঙ তুলি দিয়ে সুন্দর সুন্দর সব ছবি আঁকত।  কিছুতেই মেলাতে পারতাম না অমন একজন বুদ্ধিমান, ধীর, শান্ত, বিনয়ী ছেলেটা কীভাবে এরকম ঘটনা ঘটাল।

 

অর্ক উৎসুক দৃষ্টিতে মামার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো শুনছে ঠিকই, কিন্তু ওর মন পড়ে আছে সেই ছবিটার দিকে। হুবহু অস্মির মতো। সেই চোখ, সেই ভ্রু ভঙ্গিমা।

নবীনবাবু বলেন, “অনেকদিনের কথা তো, ঘটনাটা ঠিক মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে,  তীর্থ এম এ পড়া চলাকালীন নাকি উত্তেজনা বশতঃ ওরই  একজন সহপাঠীকে ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনের ভিতরে সকলের সামনে কাঁটা চামচ  দিয়ে দারুণভাবে আঘাত করে। ছেলেটার বাবা একজন প্রভাবশালী ব্যাবসায়ী। মন্ত্রী আমলাদের সাথে তার নিত্য ওঠাবসা। এই ঘটনার পরে তীর্থর নামে বেশ কয়েকটা মামলা ঠুকে দিলেন তিনি। বেচারার দশ বছরের হাজতবাস হল। পরে অবশ্য জেলে বসেই ও এম এ পরীক্ষা দেয় এবং ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করে। ওর ইংরাজী  হাতের লেখা দেখলে সকলে অবাক হয়ে যেত। এমনিতে ভীষণ শান্ত শিষ্ট এবং বিনয়ী ছেলে ছিল তীর্থ। কেন যে হঠাৎ ওরকম আচরণ করতে গেল।”

 

শেষের কথাগুলো অর্কর মাথায় ঢুকছিল না। ও ভাবছিল অস্মির কথা। অস্মির সেই 'অতীতের’ কথা। অনেকদিন আগে সানফ্রানসিসকোর সেই বেলাভূমিতে দাড়িয়ে এর কথাই কি তাহলে বলতে চেয়েছিল অস্মি সেদিন?

অর্কর বেশ মনে আছে, সেদিন ও বলেছিল অতীত নয়, বর্তমানটাকেই ও বেশি বিশ্বাস করে।

অথচ আজ কেন জানি মনে হচ্ছে অস্মির সেই ‘অতীত’ জানাটা  ভীষণ দরকার।

 

 

ছন্দা বিশ্বাস
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top