সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

“ইগ নোবেল” পুরস্কার: আগে মানুষকে হাসায়, পরে ভাবায় : মু: মাহবুবুর রহমান  


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:১৮

আপডেট:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৩১

 

নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে দামি পুরস্কার, এ বিষয়ে কারো দ্বিমত আছে বলে জানা নেই। তবে আপনারা কি 'ইগ নোবেল' পুরস্কারের নাম শুনেছেন? মনে হতে পারে সেটা আবার কী পুরস্কার? হ্যাঁ নোবেল পুরস্কারের নাম থেকেই ধার করে নাম রাখা হয়েছে 'ইগ নোবেল'। নোবেল পুরস্কারের মতো 'ইগ নোবেল'ও একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। 

পার্থক্য হলো নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় সফল ও অনন্য সাধারণ গবেষণা,উদ্ভাবন ও মানব কল্যাণ মূলক কাজের জন্য আর 'ইগ নোবেল' পুরস্কার দেয়া হয় মজার আর হাস্যকর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য। 

'ইগ নোবেল' পুরস্কারের মাধ্যমে এমন সব বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যেগুলো “আগে মানুষকে হাসায়, পরে ভাবায়” (“first make people laugh then make them think.”)। 

“ইগ নোবেল“ শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘Ignoble’ এবং ‘Nobel Prize’ এর মিশ্রণ থেকে। 

আবার অনেকের মতে, Ig Nobel আসলে ইংরেজি শব্দ ‘Ignoble’, অর্থাৎ ‘অর্থহীন’ শব্দের অপভ্রংশ। ১৯৯১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হাস্যরসাত্মক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘অ্যানালস অব ইমপ্রোবেবল রিসার্চ’এর উদ্যোগে এই অদ্ভুত নোবেলটি দেয়া শুরু হয় এবং আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। ‘অ্যানালস অব ইমপ্রোবেবল রিসার্চ’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক মার্ক আব্রাহামস ইগ নোবেলের প্রচলন ঘটান। আর আমরা জানি সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মাধ্যমে ১৯০১ সাল থেকে দেয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার। 

'ইগ নোবেল' মূলত নোবেল পুরস্কারের প্যারোডি। অনেকে এটাকে আবার নোবেল পুরস্কারের সৎ ভাইও বলে থাকেন।  তবে প্রকৃত নোবেলকে কোনোভাবে হেয় করা ইগ নোবেলের উদ্দেশ্য নয়। ইগ নোবেলের উদ্দেশ্য হলো, এ পুরস্কারের মাধ্যমে এমন সব বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয়া, যেগুলো প্রথমে হাসির উদ্রেগ করলে পরবর্তীতে ঐ বিষয়গুলো নিয়ে মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।  মূলত বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং ব্যতিক্রমধর্মী আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেয়াই ইগ নোবেলের উদ্দেশ্য। আর ইগ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদেরকে খোদ সত্যিকারের নোবেল জয়ীর হাত দিয়েই পুরস্কৃত করা হয়। 

ইগ নোবেল পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রগুলোও বিস্তর। ১০টি বিষয়ের জন্য প্রতিবছর এই পুরস্কার দেয়া হয়। এরমধ্যে সত্যিকার নোবেলের ৬ টি বিষয়ও রয়েছে। আগে এই ইগ নোবেলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একটি হলরুমে, কিন্তু বর্তমানে এটি দেওয়া হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যান্ডার্স হলে। তবে এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের প্রায় সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায়। ইগ নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবার ইগ নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে অনলাইনে। আর বিজয়ীদের কাছে পুরস্কার পাঠানো হয়েছে ই-মেইলে। 

অদ্ভুত গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য ইগ নোবেল দেওয়া হলেও এটিকে ছোট কিংবা খাটো করে দেখার কোন কারণ নেই। গোটা বিশ্বের কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন। ইগ নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত আবিষ্কারগুলোও কিন্তু মানবসভ্যতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী এ্যানোফিলির মশা লিমবার্গারের পনির এবং মানুষের পায়ের দ্বারা সমানভাবে আকৃষ্ট হয়- এমন একটি গবেষণা ২০০৬ সালে ইগ নোবেল লাভ করে। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলে মশার উপদ্রব কমানো সম্ভব হয়। 

আবার ২০০০ সালে রুশ পদার্থবিদ আন্দ্রে গেইম "চৌম্বক ক্রিয়ার সাহায্যে একটা ব্যাঙকে অভিকর্ষ উপেক্ষা করে ভাসমান রাখার কৌশল" আবিষ্কার করে ইগ নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। সেই পদার্থবিদ আন্দ্রে গেইম ২০১০ সালে গ্রাফিন - "কার্বনের একটা রূপভেদ গ্রাফাইট এর ষড়ভুজাকৃতি গঠন" আবিষ্কারের জন্য খোদ পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারটিই পেয়ে যান। পদার্থবিদ আন্দ্রে গেইম পৃথিবীর ইতিহাসে এযাবৎ কালের একমাত্র ব্যাক্তি যিনি নোবেল এবং ইগ নোবেল দুটো পুরষ্কারেই ভূষিত হয়েছেন। 



প্রতিবছরের মতো এ বছরও প্রদান করা হয়েছে ইগ নোবেল পুরস্কার, তবে অবশ্য ভার্চুয়ালি। 

এবারের ইগ নোবেল আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল পোকা (Bugs)। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পোকা একটি সর্বজনীন প্রাণী। এ পৃথিবীর সবাই পোকা নামক প্রাণীটিকে চেনে। আর তাই সবার চেনার সুবিধার্থেই পোকাকে করা হয়েছে ইগ নোবেল ২০২০ আসরের মূল ‘থিম!

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যান্ডার্স হলে গত ১৭ ই সেপ্টেম্বর অনলাইনে ইগ নোবেলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চলুন, জেনে নেয়া যাক বিভিন্ন বিষয়ে এ বছর ইগ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ভট ঘটনার কথা। 

নোবেল পুরস্কারের মতো ইগ নোবেল পুরস্কারেও সবচেয়ে আলোচিত হলো ইগ নোবেল শান্তি পুরস্কার। এ বছর শান্তিতে  ইগ নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে। ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিক এবং নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানের কূটনীতিকদের কেউ কেউ দুই বছর আগে অভিনব হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। হয়রানিগুলো ছিল এমন—বাসার কলিং বেল বেজে উঠলেও দরজা খুলে কাউকে না পাওয়া, কখনো আবার বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ লাইন কেটে দেওয়া ইত্যাদি। এমন অভিনব সম্পর্কের সূত্র ধরে ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে দেয়া হয়েছে শান্তির ইগ নোবেল। 

এবারের ইগ নোবেলে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইগ নোবেল জয়। "সাধারণ মানুষের জীবন–মরণে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের তুলনায় রাজনীতিকদের তাৎক্ষণিক ভূমিকা বেশি"—করোনা মহামারির এ সময় বিশ্বকে এই শিক্ষা দেয়ায় নরেন্দ্র মোদী চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগে ইগ নোবেল জিতে নেন। মোদী ছাড়াও এই বিভাগে ইগ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অন্যান্য বিশ্ব নেতারা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস লোপেজ অব্রাদর, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং তুর্কমেনিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুরবাঙ্গুলি বারদিমুহামেদো। 

একটু বলে রাখি নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইগ নোবেল জিতেন এ বছর। এর আগে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইগ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ 'আগ্রাসী শান্তিপূর্ণ'ভাবে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার জন্য বাজপেয়ীকে ১৯৯৮ সালে দেয়া হয়েছিল ঐ পুরস্কার। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, জনস্বাস্থ্য, শান্তি সহ বিভিন্ন বিভাগে একাধিক ভারতীয় ইগ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মজার ছলে৷ যেমন ২০০৩ সালে ইগ নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ভারতের উত্তরপ্রদেশের লালবিহারীবাবু। দিব্যি বেঁচে থাকা সত্ত্বেও দুষ্ট আত্মীয়স্বজনের চক্রান্তে ‘মৃত’বলে ঘোষিত হবার কারণে তিনি পেয়েছিলেন ঐ পুরস্কার।

এ বছর অর্থনীতিতে ইগ নোবেল জিতেছেন স্কটল্যান্ড, কলম্বিয়া, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ব্রাজিল, চিলি ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক। তাঁরা দেশে দেশে জাতীয় আয়ের অসমতার সঙ্গে চুমুর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটাই বের করার চেষ্টা করে জিতে নেন ২০২০ অর্থনীতির ইগ নোবেল। কেঁচোকে জোরেশোরে ঝাঁকি দিলে কী পরিবর্তন ঘটে, তা জানার চেষ্টা করার জন্য পদার্থবিদ্যায় ইগ নোবেল পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক। আলোচিত বিভাগ গুলো ছাড়া এবার চিকিত্‍সা, মনোবিজ্ঞান, ধ্বনিবিজ্ঞান, কীটবিজ্ঞান, বস্তুবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা সহ মোট  ১০টি বিষয়ের ওপর ইগ নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।  

১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছরই ১০ টি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে দেয়া হচ্ছে ইগ নোবেল পুরষ্কার। এ পুরষ্কারের জন্য যোগ্য হতে গেলে গবেষক কিংবা উচ্চশিক্ষিত হওয়া জরুরী নয়। প্রয়োজন হলো আপনাকে এমন কিছু আবিষ্কার করে দেখাতে হবে যার কথা শুনে শ্রোতাদের প্রথমে হাসি পাবে, তারপর সেই আবিষ্কারে তারা যুক্তি খুঁজতে যাবে। ইগ নোবেলের ম্যাসকটটিও বিচিত্র। পল রঁদার এর বিখ্যাত ভাস্কর্য - দ্য থিঙ্কারের উল্টানো মূর্তি। অর্থাৎ যারা প্রচলিত রাস্তায় হাঁটে না, বরং উল্টো পথে চিন্তার স্রোত বইয়ে দিয়ে নতুন কোনো দিকে আলোকপাত করেন , তাদেরই ইগ নোবেল পুরষ্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয়। 

 

মু: মাহবুবুর রহমান
লেখক, নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক   



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top