পূর্ণ গ্রাস : রওনক খান
প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩০
আপডেট:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৫৫

সে রাতে আকাশজুড়ে কাঁসার থালার মত একটা ঝলমলে চাঁদ উঠেছিল। যেন কানামাছি খেলা জোৎস্নারাত। পথঘাট, সমগ্র চরাচর আলোকময় হয়েছিল তারই অমল আলোয় । সেই আলো আঁধারি গায়ে মেখে ঈষৎ দোল খাওয়া ধান ক্ষেতের আলে বসে আয়েশে, নির্বিকার চিত্তে ফুক ফুক করে জ্বলন্ত বিড়িতে সুখ টানে নিমগ্ন এক মুসকো জোয়ান।
দারিদ্রের সাথে রূপের সম্পর্কটা কতকটা সাংঘর্ষিক। তাই মেয়ের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ষোলতে পড়তেই পিতৃহীন সুশ্রী মায়মুনার বিয়ে দিল তার হত দরিদ্র গৃহকর্মী মা ।
বিয়ে দিল পাশের গ্রামেরই অকালকুষ্মাণ্ড ফজর আলীর সাথে। নানান ভুজুংভাজুং দিয়ে বিয়ে করল সে অনাঘ্রাতা ষোড়শী সুশ্রী মায়মুনাকে। গল্পের হলো শুরু।
মায়মুনা প্রথম প্রথম সুখেই সংসার করে। রাঁধে, বাড়ে, খায়। রাতে নিয়মমাফিক স্বামীর সোহাগ পায়। মাঝেমধ্যে ফজর আলী গঞ্জের বাজার থেকে সস্তা রুজ, লিপস্টিক, চুলের ফিতা এনে মায়মুনাকে উপহার দেয়। সুশ্রী ষোড়শী আনন্দে আত্মহারা হয়। আহ্লাদে স্বামির গায়ে এলিয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছে।
মাস দুয়েকের মধ্যেই গল্পটা পাল্টাতে শুরু করল। সেটা যেন পথ ভুলেই এক অন্ধকার চোরাগলিতে প্রবেশ করল।
হাসি খুসি লাস্যময়ী মায়মুনা সন্ধ্যা হলেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। রাঁধা বাড়ায় মন নেই। স্নান খাওয়ায় অনিয়মই ক্রমশ নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। সৌখিন মায়মুনার সাজগোজে দারুণ অনিহা। চুলের ফিতা রুজ লিপস্টিক অনাদরে গড়াগড়ি খায়। তাই দেখে ফজর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তার সোনার ডিম পাড়া হাঁসের এহেন বেগড়বাইয়ে সে যার পর নাই ক্ষুব্ধ। হবে নাই বা কেন? বিয়ের ক'মাস না পেরুতেই মায়মুনা যে তার রূপের সাথে রুপিয়ার যোগানদার হয়ে উঠেছে । ফজর আলি রোজ রাত্রিতে একজন করে পুরুষ জোগাড় করে এনে মায়মুনার ঘরে সেঁধিয়ে দেয়। তারপর বাইরে থেকে শিকল এঁটে দিয়ে আয়েশে সদ্য পাওয়া এক থোকা নতুন নোটের গন্ধে শুঁকে ।
ষোড়শী মায়মুনার ঘরের মধ্যে তখন হাবিয়া দোজখ। নিত্য নতুন পুরুষের নখর থাবায় বিক্ষত হয় তার পেলব, কোমল বেতশ লতার মতন শরীর। তাকে ঘিরে রাতভর চলে পৈশাচিক তান্ডব। সদ্য এই কিশোরী রোজ রাতে একজন করে পেশিবহুল মানুষ রূপী হায়েনার সাথে লড়াই করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। নিত্যই নিয়ম করে ধর্ষিতা হয় মায়মূনা। তার কোন ওজর আপত্তিই কানে তুলেনা ফজর আলী।
দিনে দিনে ক্রমশ কৃশকায়, পান্ডুর হয় এই কিশোরী বধূ। হাসি কথা, প্রগলভতা সব যেন এক ফুৎকারে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বেশ কয়েকবার পালাবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ফজর আলীর রোষানলের শিকার হয়।
তবে কি মায়মুনার মুক্তি মেলেনি?
কদিন ধরেই সে স্বামির নিকট মায়ের কাছে যাবার আব্দার করে আসছিল। ফজর আলী কান তুলেনি। রাত্রের বিভীষিকায় বিধ্বস্ত মায়মূনা স্হির করে কোনমতে একবার মায়ের কাছে পৌঁছুতে পারলে স্বামির ঘরে আর সে ফিরবে না।
অবিরাম আব্দারেও যখন ফজর আলীর মন গলেনা তখন সে নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করে। টানা তিনদিন কোন রকম দানাপানি মুখে না দিয়ে ঘরের মেঝেতে শাড়ীর আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। ফজর আলী কয়েকবার চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়। শরীরের যে টুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে লড়ে যায় ষোড়শি মায়মুনা। তাতে অন্তত একটা লাভ হয়। একয়দিন বাড়িতে অনাহুতদের আগমন ঠেকানো যায়।
চতুর্থ দিনগত হয়।গভীর রাত্রে ক্লান্ত, অনাহারক্লিষ্ট, নিদ্রিত মায়মুনাকে ডেকে তোলে ফজর আলী। অকস্মাৎ তার ডাকে ধরফড়িয়ে জেগে উঠে জানতে চায় এত রাতে ডাকাডাকির হেতু। ফজর আলী বলে, "চল তোকে তোর মা'র বাড়ি দিয়ে আসি"।
মায়মুনা প্রথমটায় অবাক হয়। তারপর বলে,"এত রাতে যাব কি করে, কাল সকালে রওনা দেই"।
ফজর আলী একটু বিরক্ত হয়ে বলে, "না না এখনই চল। কাল সকালে অনেক কাজ আছে"।
বিস্ময় বাড়ে মায়মুনার।
এমন অকাজের কাজির মুখে কাজের গল্প বড্ড বেমানান ঠেকে।
দ্বিধান্বিত মায়মুনা আবারও বলে, "এই আন্ধার রাতে না যেয়ে দিনের আলোয় রওনা হই"।
ফজর আলি রোষে খেঁখিয়ে ওঠে। কন্ঠে সীমাহীন বিরক্ত মিশিয়ে বলে উঠে, "আন্ধার দেখলি কই? কি সুন্দর ফকফকা জোস্না"! "এই না মায়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে আছিস! এখন এত কথা কিসের। গেলে এখবই যাবি নচেৎ নয়"।
মায়মুনা আর কোন বাক্যব্যয় না করে উঠে দাঁড়ায়। মনের কোণে একটু খুসির ঝলক উছলে উঠে। ভাবে, হোক রাতবিরেত। একজন গাট্টাগোট্টা পুরুষ সাথে আছে যখন, ভয় কি?এই জাহান্নাম থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। গপাগপ একমুঠো বাসী ভাত গিলে এ কয়দিনের অনাহারের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে শাড়িটা পাল্টে একটা ভালো শাড়ি পড়ে।তার মোহন মুখমন্ডলে জুড়ে থাকা আয়ত চোখদুটোতে একটা আবছা আনন্দ চিকমিকিয়ে উঠে। স্বামির দিকে চেয়ে একটু ফিক করে হেসেও দেয়। ফজর আলির তাতে কোন ভাবান্তর হয়না।
স্বামীকে সাথে নিয়ে পা বাড়ায় মায়মুনা। জোৎস্নালোকিত পথঘাট। তেমন একটা আঁধার নাই। পথ চলে নির্বিঘ্নে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে যুগলে এগিয়ে চলে। আকাশজোড়া বৈশাখী পূর্নিমার পূর্ন চাঁদটাও যেন তাদের পিছু ধাওয়া করে। গভীর রাত। পাড়াগুলি ডুবে আছে ঘুমের অতলে । চলতে চলতে শ্রবণে ভেসে আসে ঝিঁঝিদের ঐক্যতান। পথের পাশের ঘন বাঁশঝাড়ে থোকায় থোকায় জোনাকীর ঝিকিমিকি দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
পাশের কোন বুনো ঝোপ থেকে বাতাসে ভেসে আসে অচেনা ফুলের সুবাস। নিশীথ রাতের নিসর্গ জুড়ে থাকে এক অপার্থিক সুখ। তারই স্পর্শে সদ্য সুখী হয়ে ওঠা মায়মুনা সামান্য ভীতও হয়ে পড়ে। পরক্ষনেই সাহসে ভর করে দ্রুত পা চালায়। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডুকরে কেঁদে উঠে। মায়মুনা শিউরে ওঠে। কিছুদূর যাবার পর ফজর আলীর গ্রামের সীমানা শেষ হয়। শুরু হয় মায়মুনার আশৈশব বেড়ে ওঠার তার একান্ত গ্রামখানির সীমানা। আচমকা ফজর আলী মেঠো পথে না গিয়ে ধানক্ষেত নেমে পড়ে মায়মুনাকেও আহ্বান করে তাকে অনুসরণ করতে। ধানক্ষেতের ভিতরটা বেশ অন্ধকার। মায়মুনা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে পথ ছেড়ে কেন ধানক্ষেত দিয়ে যাচ্ছে তারা। ফজর আলী উত্তর দেয় এই পথ সংক্ষিপ্ত, তাড়াতাড়ি পৌঁছুনো যাবে, তাই। কিছুদূর যেতেই হঠাৎই আঁধার ফুড়ে দুজন মানুষ মায়মুনাকে চমকে দিয়ে তার নাক বরাবর এসে দাঁড়ায়। বিস্মিত কিশোরী একটু ঘোলাটে অন্ধকারেও দুজনকে চিনতে পারে। দুজনেই তার স্বামীর পূর্বপরিচিত। এই দুজনেই তার একাধিক সময়ের ধর্ষক। প্রচন্ড ভয় পেয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করে এরা এখানে কেন? ফজর আলী কোন উত্তর না দিয়ে ধানক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে পরে। তার কথা ফুরাবার আগেই দুজন মানুষ দুদিক থেকে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিশোরী বধূর উপর।দুজন দুদিক থেকে জাপটে ধরে মায়মুনাকে । হতভম্ব মায়মুনার ধ্বস্তাধস্তির একপর্যায়ে চোখে পড়ে এদের মধ্যে একজন তড়িৎ গতিতে তার সার্টের পকেট থেকে একটা রং চং এ রুমাল বের করে ডান হাত দিয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে পেঁচাচ্ছে।এই রুমালটিও মায়মুনার চেনা। মায়মুনা তখন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু ষোল বছরের কিশোরীর কোমল শরীর পেরে উঠবে কেন দুজন পূর্নবয়স্ক পেশিবহুল মানুষের সাথে।শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রাণপণে চিৎকার করার জন্য মুখটা একটু হা করতেই একজন তার মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে। অন্যজন হাতের প্যাঁচানো রুমালটা মায়মুনার গলায় পেঁচিয়ে তাতে তীব্র একটা টান দেয়। সংগে সংগে ষোড়শ বর্ষীয় সুশ্রী বধুটির নরম বেতশ লতার মতন ছিপছিপে দেহটি মাটিতে ঢলে পড়ে। মাটিতে পড়েও শ্বাস নেবার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যায়। দুপা দিয়ে খানিকক্ষন মাটিতে আছাড়ি পিছাড়ি করতে করতে এক সময় শান্ত নিথর হয়ে পড়ে মায়মুনার তনুদেহ।
সে রাতে মায়মুনা কি তার অন্তিম মুহূর্তে একটিবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। তাকালে দেখতে পেত আকাশে কি চমৎকার চাঁদ উঠেছে। অবিকল বালিকা ভুলানো জোৎস্না। কাঁসার থালার মতন বৈশাখী পূর্নিমার সেই পূর্ণ চাঁদটি যেন ষোড়শীর এই নির্মম মহাপ্রস্হানে ভারী আমোদিত হয়ে মুচকি হাসছে। চাঁদের ছলাকলায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে অমল আলোয় । কাছেই কোথায় বুনো ফুল ফুটেছে। বাতাসের সাথে সেই সব নাম না জানা ফুলের সুতীব্র গন্ধের মিতালী জন্ম দিয়েছে এক অপার্থিব সুখের ।মায়মুনা কি অনুভব করেছিল, অদূরেই তার স্বামী ফজর আলী ধানক্ষেতের আলে বসে নিশ্চিন্তে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আয়েশে বিড়ি ধরিয়ে তাতে ফুক ফুক করে সুখটান দিচ্ছে। সেই সাথে সম্মুখে ঘটে চলা তার স্ত্রীর মরণের সাথে যুঝে যাবার এক একটি নৃশংস মূহূর্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে।
বিষয়: রওনক খান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: