সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২০ ২১:৫০

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২০:২৭

ছবিঃ অমর মিত্র

 

উজ্জয়িনীর পশ্চিমপ্রান্তেই ক্ষিপ্রা প্রকৃতির শিপ্রা নদী, দক্ষিণ থেকে উত্তরে বহেছে। শিপ্রার তীর ধরে অনেকটা পথ এগিয়ে, শেষ পর্যন্ত নদীকে ফেলে রেখে শিবনাথকে পশ্চিমে গম্ভীরার পথে যেতে হবে। নদী এবং গ্রাম দুই-ই গম্ভীরা।

মঙ্গলনাথের মন্দিরের কাছে পৌঁছে বুকের ধুকপুকানি কমল বৃদ্ধের। এতটা পথ হেঁটে আসার সময় তাকে বহুবার দাঁড়াতে হয়েছে, বট, অশ্বত্থ, পিপুল গাছের  আড়ালে। দেখতে হয়েছে রাজকর্মচারী আসছে কিনা। বিপদটি যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে। সেই উদ্ধবনারায়ণ! কী বিষণ্ণ মুখখানি ছিল তার, কী বিনীত ভঙ্গি। কীভাবে রাজসভার আনুকূল্য পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে নাকি পরামর্শও করত ধ্রুবপুত্রর সঙ্গে।  ধ্রুবপুত্র তো সান্দীপনি আশ্রমের সেরা শিক্ষার্থী, উজ্জয়িনীতেই তার বাস ছিল। বণিক সুভগ দত্ত তার শাস্ত্রশিক্ষার যাবতীয় ব্যয় ভার বহন করতেন। রাজশক্তির অংশভুক্ত হয়ে, রাজশক্তির ছিটেফোঁটা স্বাদ পেয়ে কতটা না বদলে গেছে উদ্ধবনারায়ণ!

দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয় বৃদ্ধ। কুলকুল করে ঘামছে সে। গৃহে কন্যা বয়স্থা হলে এমন বিপদই হয়ে থাকে। থাকত গন্ধবতীর পিতা কার্তিককুমার, উদ্ধব তার সামনে কীটের মত গুটিয়ে যেত। ওইটুকু উচ্চতার উদ্ধব, খর্বাকার, ও তো কার্তিককুমারেরর পায়ে নিচে পিষ্ট হত। দুই আঙুলে টিপেই মেরে ফেলত কার্তিক। কী ছিল তার শৌর্যময় দেহখানি, কতখানি ছিল তার উচ্চতা, কত প্রশস্ত ছিল বক্ষদেশ। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এলে সে নিশ্চয়ই রাজসভায় কোনও পদ পেয়ে যেত। পদাতিক বাহিনীতেই তার নিযুক্তি হয়ে যেত কোনও  এক বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে। সে নাকি অসম্ভব যুদ্ধ করেছিল। তার বীর্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল হুন যোদ্ধারা। ভল্লের আঘাতে আঘাতে আহত, হত করছিল শত্রু সৈন্যদের। শোনা যায় হূণ যোদ্ধারা পালাচ্ছিল কার্তিককুমারকে দেখে। কার্তিককুমার তাদের তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছিল সহযোদ্ধাদের নিয়ে। সব বলেছে ভৈরব। গোপ-সম্প্রদায়ের যুবক, কার্তিককুমারেরই সমবয়স্ক ভৈরব গিয়েছিল যুদ্ধে। ফিরেওছে। সে এসে গন্ধবতী, ধ্রুবপুত্র, গন্ধবতীর মা রেবাকে বলে গেছে কার্তিককুমারের বীরত্বের কাহিনী। যুদ্ধ অবসানের পর আরও দশদিন দশপুরায় ছিল অবন্তীর সেনাবাহিনী। মৃত যোদ্ধাদের দাহ করা হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রেই। সেনাবাহিনীর একটি অংশ থেকে গিয়েছিল সেখানে। না সেই অংশে ছিল না কার্তিককুমার। তার খোঁজ কেন হয়নি, তাও বিস্ময়ের। জয়ের আনন্দে সামান্য যোদ্ধার কথা বিস্মৃত হয়েছিল সকলে। উজ্জয়িনীতে ফেরার পর মনে পড়ল। পদাতিক বাহিনীর অধ্যক্ষ বলেছিলেন, সে রয়ে গেছে দশপুরায়। কিন্তু দশপুরার বাহিনীর সৈন্য তালিকায় তার নাম ছিল না। হূণ বিজয়ের আনন্দে সামান্য সৈনিকের কথা কেউ মনে রাখল না। বলা হল, সে নিরুদ্দিষ্ট। আজ উদ্ভবনারায়ণ বলছে, সে মৃত। এতদিন বাদে কীভাবে প্রমাণিত হবে সে মৃত?  মাত্র পাঁচ বৎসর কেটেছে। দ্বাদশ বৎসর অপেক্ষা করা শাস্ত্র সম্মত। পুত্রবধূ রেবা বলেছে, যদি অনুমতি দেন শ্বশুর মহাশয় সে সমস্ত জীবন  অপেক্ষা করবে তার জন্য। আপাতত আট বৎসর, তারপর আরও চার বৎসর অপেক্ষা করতেই পারে পুত্রবধূ। যদি বেঁচে থাকে ততদিনে কি ফিরবে না? মনের ভিতর খচখচ করছিল উদ্ধবনারায়ণের কথাগুলি। আচমকা সে কার্তিককুমারের মৃত্যু ঘোষণা করতে চাইছে কেন? কী তার অভিপ্রায়? ধ্রুবপুত্রের সম্পর্কে যে কথা বলেছে তাও তো ভয়ঙ্কর!  সে হূণজাতির আশ্রয়ে আছে, দেশের শত্রুর মিত্র হয়ে আছে। এর চেয়ে খারাপ কথা হয় না। এসব কথা বলে তার মনের উপর চাপ ফেলতে চাইছে যেন উদ্ধবনারায়ণ। কিছুটা  এগোয় শিবনাথ। মঙ্গলনাথের মন্দিরের পাশে আচার্য বৃষভানুর আশ্রম। তিনি বড় জ্যোতির্বিদ, গ্রহ-নক্ষত্র চর্চাতেও তিনি  সুখ্যাত। খালি চোখে আকাশের বহু তারা এখনও এই বয়সেও চমৎকার পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। পঞ্চাশোরধ হয়েছেন শোনা যায়। দশদিক হতে কত নবীন যুবক এসে তাঁর কাছে জ্যোতির্বিদ্যা শেখে, আকাশের গ্রহতারা তাঁর কাছেই চিনেছিল ধ্রুবপুত্র। সন্ধেবেলায় সে গন্ধবতীকে  তারা চেনাত। স্বাতী, চিত্রা, অভিজিৎ, কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল চিনেছে গন্ধবতী তার সখা ধ্রুবপুত্রের কাছেই। আকাশ দেখা ছিল তার মনের আনন্দ, খেয়াল। সেই আনন্দ, খেয়াল সঞ্চারিত করে দিয়েছিল গন্ধবতীর ভিতরে। এখন গন্ধবতীর মনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে যেন। কই আকাশে তাকিয়ে তো তার মা রেবাকে ডেকে দেখায় না, ওই, ওই যে দেখা যায় মা, ওই তো বশিষ্ট ঋষির পাশে মা অরুন্ধতী।

 

কে চেনাল তোকে? বিনবিনে গলায় জিজ্ঞেস করেছে রেবা।

 

কেন সখা। আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদুগলায় বলেছে গন্ধবতী। তার কণ্ঠস্বর তবুও কানে এসেছে শিবনাথের। সে যে কান পেতে থাকত সেই সময়। মনে মনে হেসেছে কত। মনের ভিতরে গোপন বাসনা জেগে উঠেছে ধীরে ধীরে। অরুন্ধতী তারা কে দেখায় কাকে? যৌবনে শিবনাথ তো তার নববধূকে দেখিয়েছিল বিবাহের পর আঙিনায় দাঁড়িয়ে। রেবাকে চিনিয়েছিল নিশ্চয়ই তার স্বামী কার্তিককুমার। 

শিবনাথ দাঁড়ায়, ভাবে, যাবে নাকি আশ্রমে? বৃষভানুর কাছে গিয়ে বলবে নাকি তার উদ্বেগের কথা? কোথায় আছে ধ্রুবপুত্র, কোথায় আছে কার্তিককুমার? যে কথা বলল উদ্ধবনারায়ণ তা কি সত্যি? নাকি সব তার বানানো। সবটাই কোনও ছলনা-জাত। সত্যিই কি ধ্রুবপুত্র অপমানিত হয়ে অবন্তী দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে হূণ রাজ্যে, সিন্ধুতীরে? এও কি সম্ভব! প্রেমে ব্যর্থ হলে মানুষ কি এইভাবে ধ্বংস করে দেয় নিজেকে? আর কার্তিককুমার কি হত হয়েছে সত্যি? দীপাবলীর প্রভাতে এসব কী শুনল সে? মৃত্যু সংবাদ! উদ্ধবনারায়ণ কী অক্লেশে বলে দিল বেঁচে নেই কার্তিককুমার। এই সংবাদ সে উজ্জয়িনী থেকে বয়ে নিয়ে গম্ভীরায় ফিরবে পুত্রবধূ, পৌত্রীর কাছে। শিপ্রাতীরে একাকী বসল শিবনাথ। মাথার উপর একটি নবীন ছাতিম বৃক্ষ ছায়া মেলেছে। গায়ের চাদরখানি খুলে বুকে ফুঁ দিয়ে শান্ত হতে থাকে শিবনাথ।

নদীর ওপারে জোয়ার ক্ষেতে চাষী নেমেছে। কিন্তু ফসল এবার হল কই? বৃষ্টিই তো হল না। সীতাধ্যক্ষের লোক এসে কতটা ফসল নেবে কর হিসাবে? ফসল তো মরে গেছে বৃষ্টির অভাবে। কতদিন বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা থাকতে থাকতেই হিম পড়তে শুরু করেছে। হিম পতনও শুরু হয়েছে মাসাধিকাল হল। আকাশ ধূসর হয়ে আছে। পুড়ে গেছে যেন আকাশমণ্ডল।

এখানে শিপ্রা নদীর অর্ধচন্দ্রাকার রূপ। নদী দক্ষিণ থেকে পুবে বয়ে এসে আবার দক্ষিণে বেঁকেছে। ডানদিকের ঘাটে নদীর জলে নেমে যাচ্ছে এক নবীন যুবক। ধ্রুবপুত্রেরই বয়সী। এ কি চেনে ধ্রুবপুত্রকে? নদীর জল কত নিচে নেমে গেছে। স্রোত অতি দুর্বল। কেমন ক্ষয়াটে লাগছে প্রকৃতিকে। শিবনাথ যুবকটির দিকে তাকিয়ে আছে। আচমন শেষ করে উঠে আসছে মধ্যম উচ্চতার যুবক।  গায়ের রঙ তামাটে, মাথার চুল  ঘন, কোঁকড়ানো। এইরকম চুল এদেশের নিষাদ জনজাতির  ভিতরে দেখা যায়। মাথায় সবুজ পাতার রসে রঞ্জিত সবুজ বস্ত্রের পটি বাঁধা, সেখানে ময়ূরের পালক গোঁজা, কাঁধে ধনুক, পিঠে বাঁধা তলবাঁশের কোটরে তীর। কী স্বাস্থ্যবান তারা! অনাবৃত ঘনকৃষ্ণ দেহের দিকে তাকিয়েই থাকতে হয়। যুবকটির দেখে নিষাদের কথা মনে পড়ে গেল। অথচ এই শীর্ণকায় যুবক যে ধনুক বা ভল্লের ভার সহ্য করেত পারবে না, তেমনই মনে হয়। শিবনাথ উঠে এগিয়ে গেল। যুবক দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শিবনাথ জিজ্ঞেস করে, মহাশয় কি আচার্য বৃষভানুর আশ্রমের শিক্ষার্থী?

যুবক ঘাড় কাত করে বলল, আপনি?

গম্ভীরা থেকে আসছি, আচার্য কি আছেন?

যুবকের সঙ্গে হাঁটতে লাগল শিবনাথ। দশার্ণ দেশের নীচৈঃ পাহাড়ের কোলে গ্রাম সোনাগাঁও থেকে তাম্রধ্বজ এসেছে বৃষভানুর নিকটে। ইচ্ছা জ্যোতির্বিদ্যা, গ্রহবিদ্যা অধ্যয়ন করে বিদিশানগরে ফিরে যাবে। যুবক যেতে যেতে বলছিল, সম্প্রদায়ে সে বৈশ্য, পিতা বেচা কেনা করেন।

শিবনাথ বলল, আপনি কি গ্রহ-বিদ্যা জানেন?

কেন বলুন তো?

শিবনাথ বলল, না, থাক, আচার্যের কাছে যাই, ধ্রুবপুত্র তো তাঁরই শিষ্য।

তাম্রধ্বজ বলল, আচার্য খুব উদ্বিগ্ন।

কেন?

তাব্রধ্বজ আকাশে তাকায়, দুই বৎসরের অধিক হলো অবন্তী দেশে বৃষ্টি নেই।

শিবনাথ মাথা দোলায়, তাই-ই তো। জোয়ার মকাই কোনওটাই ফলেনি।

তাম্রধ্বজ বলল, এমন নাকি কখনও হয়নি রাজা ভর্তৃহরির শাসনকালে।

শিবনাথ বলল, হ্যাঁ, তা বটে, রাজা ভর্তৃহরির শাসনকাল সুভিক্ষার কাল, সুবৃষ্টি হয়েছে।

তাম্রধ্বজ বলল, আচার্য গণনায় বসেছেন।

কীসের গণনা?

অনাবৃষ্টির হেতু।

তাহলে দেখা হবে না?

জানি না, আপনি কি কোনও গণনার জন্য এসেছেন?

হ্যাঁ, শিবনাথ বলে, রৌদ্রে কী উষ্ণতা! এই শিশির ঋতুতে এমন হয় না কখনও। বিড়বিড়িয়ে বলে বৃদ্ধ, আমি খুবই বিভ্রান্তি ও উদ্বেগে  আছি।

তাম্রধ্বজ বলল, আচার্য গ্রহ-নক্ষত্র সাজিয়ে বসেছেন, তিনি ডুবে আছেন তার ভিতরে, আপনি আসুন, নিশ্চুপ থাকবেন।

আশ্রমের নিকোনো প্রশস্ত আঙিনায় পা দিল দু’জনে। তারপর ঘুরে আশ্রম গৃহের পিছনে ধীরে ধীরে  গিয়ে দ্যাখে গ্রহ-নক্ষত্রের স্থান নির্ণয় করতে আঙিনায় ভূর্জপত্রের উপর ছক এঁকে  বসে আছেন আচার্য বৃষভানু। নিবিড় শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ। আচার্যের বয়স হলেও একটি কেশেও রূপোলি রং ধরেনি। রীতিমত ঘনকৃষ্ণ তাঁর চুল-দাড়ি।

তাম্রধ্বজ চাপা গলায় বলল, এখন আচার্য অন্য কোনও গণনায় যাবেন না, গ্রহ-নক্ষত্রকে যেভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তা থেকে সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত আচার্যদেবকে বিব্রত করা যাবে না, এই গণনায় অবন্তীর ভাগ্যকে জানবার চেষ্টা করছেন আচার্য

শিবনাথ আকাশে তাকায়। ঘোলাটে নীল আকাশ। ওই আকাশ থেকে গ্রহ-দেবতারা সত্যিই কি অবন্তী দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করেন? নিশ্চিতই করেন, না হলে দীর্ঘকাল মেঘহীন হয়ে থাকে কী করে অবন্তীর আকাশ। দুই শ্রাবণ, প্রোষ্টপদ গেল জলহীন হয়ে এর কি কোনও কারণ নেই? তাম্রধ্বজ বলছে, আচার্য বৃষভানুকে রাজসভায় জানাতে হবে অনাবৃষ্টির কারণ, ফসলহানি কেন?

দু’জনে সরে এসেছে আঙিনার প্রান্তসীমায়। এখানে দাঁড়িয়ে আচার্যকে দেখা যায়, কিন্তু আচার্যর কানে তাদের কণ্ঠস্বর যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাম্রধ্বজকে শিবনাথ বলে, অবন্তীর আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র সন্নিবেশ যদি প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে, তার ছায়া কি অবন্তীর মানুষের জীবনেও পড়বে?

হাসে তাম্রধ্বজ, ফসলহানি তো হয়েছেই, এতে কি অবন্তীর মানুষ সুখী হতে পারে?

কেউ হয়ত অন্তর্ধান করল, নিরুদ্দিষ্ট হল অবন্তী দেশ থেকে, এও কি অবন্তীর আকাশে গ্রহ তারার প্রতিকূল  সন্নিবেশের কারণে?

মাথা নাড়ে তাম্রধ্বজ, আমি কীভাবে বলব, আমি না জেনে কোনও কিছুই অনুমান করতে পারি না, কোনও কথাই বলতে পারি না।

আপনি তো আচার্যর কাছে শিক্ষা করেন গ্রহবিদ্যা?

এ এক অসীম রহস্য, রাতের আকাশে তাকালে কী ক্ষুদ্রই না হয়ে পড়ি আমি। বিড়বিড় করতে করতে তাম্রধ্বজ আবার শিপ্রা নদীর দিকে ফিরছিল। তাকে অনুসরণ করছিল শিবনাথ। তাম্রধ্বজ বলছিল, সে কিছুই যেন শেখেনি। গ্রহ, ‍নক্ষত্র, তারাগুলি দশজন্মেও চেনা হবে না সব। শতকোটি আলোর বিন্দু! তবে হ্যাঁ, সব তো আচার্যদেবও চেনেন না, সব তারাগুলির নামও তো জানেন না তিনি। আসলে কেউই জানে না বোধহয়। আকাশগঙ্গায় কত তারা! বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়াল তাম্রধ্বজ, আস্তে আস্তে বলছে, শুক্রগ্রহের উদয় অস্তের উপর বৃষ্টিপাত নির্ভর করে, বৃষ্টিপাতের পরই ফসলের জন্ম, শুক্রই তো জন্মবীজ পাঠায় এ পৃথিবীতে।

বাহ্ চমৎকার বলেছেন।

আচার্যদেবের কথা, তিন এখন জানতে চাইছেন গত দুটি বৎসরে আষাঢ় মাসের পঞ্চমী তিথিতে শুক্রগ্রহের সঞ্চার কীভাবে হয়েছিল অবন্তী দেশের আকাশমণ্ডলে। কিন্তু এখন তো সন্ধ্যায় শুক্র অদৃশ্য। আরও সাতদিন বাদে ভোরের আকাশে দেখা দেবেন শুক্রাচার্য, কী রকম যেন বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে সব, অথচ আকাশের শৃঙ্খলা তো এতটুকুও ভাঙে না কখনও। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, গ্রহ-তারাদের উদয় অস্ত তো নিবিড় শৃঙ্খলায় বাঁধা। আমার মনই বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে মহাশয়, আমিও যে কেন চঞ্চল হয়ে পড়েছি প্রকৃতির এই নিদয়া রূপে!

শিবনাথ অস্ফুট স্বরে বলে, আচার্য এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন বোধহয়।

মাথা দোলায় তাম্রধ্বজ, তা পারবেন, কিন্তু মনের আকাশ তো মাথার ওই আকাশের চেয়েও অনেক অনেক বড়, মহাকাল ব্যতীত কে দেখবেন সেই আকাশের সবটা, আমার মনের ভিতরে যে বিপুল ব্রহ্মাণ্ড!

চমকে উঠে শিবনাথ। তরুণ শিক্ষার্থীর কন্ঠে মগ্নতার আভাস। সে বলছে, আসলে কী জানেন মহাশয়, আকাশে চোখ রেখে বসে আছি আমি, শুধুই দেখতে চাইছি অরুন্ধতী ‍নক্ষত্রটিকে, তিনি বারবার হারিয়ে যাচ্ছেন চোখ থেকে। অতি ক্ষুদ্র তো, যখন হারায় বুক কাঁপে। আপনি কি জানেন...?

কী! শিবনাথ যেন কাঁপল তাম্রধ্বজের গভীর জিজ্ঞাসায়।

না থাক, অরুন্ধতী কেন হারাবে তাঁর চোখ থেকে?

কার চোখ থেকে?

না থাক, শুনুন মহাশয়, অবন্তীর রাজা খুবই ব্যগ্র হয়ে আছেন অনাবৃষ্টির কারণ জানতে, তা না হয় জানা গেল, কিন্তু আকাশে কি মেঘ আনা যাবে এরপর?

সে তো মহাকালের অভিপ্রায়।

কী জানি!

শিবনাথ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, কবে যে বৃষ্টি নামবে!

এখন বৃষ্টিতে কী হবে?

তা ঠিক। হাসে শিবনাথ, বৃষ্টি আসতে আবার সেই শ্রাবণ, কতদিন বাদে! মহাকাল মন্দিরের কোলে শ্রাবণী অমাবস্যায় মেলা বসবে।

তাম্রধ্বজ বলল, এই অবন্তী দেশে তেইশ দ্রোণ পরিমাণ বৃষ্টিপাতে শস্য ফলন স্বাভাবিক হয়, গত দুই বৎসর সর্বমোট দশ দ্রোণের চেয়েও কম বৃষ্টি হয়েছে, সেই কারণে ফসল হয়নি।

আপনার দশার্ণ দেশে?

বৃষ্টিপাত অপ্রতুল, বেত্রবতী,বন নদী বিশুষ্ক প্রায়, অতি শীর্ণ, আমি অবশ্য সঠিক জানি না, দশার্ণ দেশ থেকে যে বণিকেরা আসে উজ্জয়িনীতে, তাদের কাছে শুনেছি।

কতদিন আপনি এখানে আছেন?

সেই গত আষাঢ়ের আগের আষাঢ় মাস থেকে, প্রকৃতির নির্দয় রূপ দেখছি তখন থেকে।

হাঁটছিল দুজনে। যুবকটিকে ভাল লাগছিল শিবনাথের। কথা বলে একটু বেশি, এই আশ্রমে কথা বলার মানুষ কই? বৃষভানুর অন্য শিষ্যরা কোথায়? তাম্রধ্বজ কি একা থাকে?

তাম্রধ্বজ অনুমান করল তার জিজ্ঞাসা, বলল, দীপাবলীতে সকলে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে, এখন ফসল কর্তনের সময়ও বটে, আমি একা।

আপনি যাননি?

মাথা নাড়ে তাম্রধ্বজ, দশার্ণ দেশ বহুদূর, আমার যাওয়া হয়নি, আর গৃহে ফিরলে হয়ত আবার এখানে ফেরা না হতেও পারে। আপনি কী জানতে চাইছেন আচার্যর কাছে?

বলবে নাকি তাম্রধ্বজকে সব কথা? শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা কি নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে খুঁজে বের করে দিতে পারে? সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারে কোথায় আছে সে?

তাম্রধ্বজ জিজ্ঞেস করল, কার কথা বলতে চাইছেন আপনি?

অবাক হয়ে গেল শিবনাথ। এই জ্ঞানী যুবক কি মনের কথা পড়তে পারে? এ তো আশ্চর্য ব্যাপার! কার কথা মানে? সে কি জানে ধ্রুবপুত্রের কথা, গন্ধবতীর পিতা কার্তিককুমারের যুদ্ধে গিয়ে না ফেরার কথা?

তাম্রধ্বজ বলল, আপনি নিজে না বললে আমি কীভাবে গণনা করি ?

শিবনাথ জিজ্ঞেস করে, আপনি কি নিরুদ্দিষ্টের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবেন?

তাম্রধ্বজ শিপ্রা নদীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ওপারে ফসল মরে যাওয়া জোয়ার ক্ষেত। ঘোলাটে ময়লা আকাশ। বৃষ্টির হয়নি তো আকাশ পরিষ্কার হবে কীভাবে? তাম্রধ্বজ তার দিকে ফিরল, আপনার উদ্বেগ গভীর, আপনি নিজে না বললে আমি কীভাবে আপনাকে কোনও কথা বলি, যে মাসে, যে তিথিতে, যে সময়ে...

শিবনাথ বলল, আপনি কি জানেন সব?

চুপ করে থাকে তাম্রধ্বজ। শিবনাথ বলল, ধ্রুবপুত্র এই আচার্য আশ্রমেরই শিক্ষার্থী ছিল, আমার বয়স্যের পুত্র, সে একটি বেদনাদায়ক ঘটনার পর...।

তাম্রধ্বজ বলল, আমি পড়তে পারছি আপনার কথা। আমি কিছুটা জানি, শুনেছি, তবু আপনি বলুন, আপনি নিজে না বললে নিজে মুক্ত হবেন না।

অবাক হয়ে তাম্রধ্বজের দিকে তাকিয়ে শিবনাথ বিহ্বল। সব জেনে গেছে এর ভিতরে? দশার্ণ দেশের এই গুণী যুবকটি আসলে কে? তাম্রধ্বজের হাত দুটি ধরে ফেলল শিবনাথ। গড়গড় করে বলতে লাগল ধ্রুবপুত্রের কাহিনী। কার্তিককুমারেরর কথা। উদ্ধবনারায়ণের কথা। কোথায় আছে তারা? কার্তিক বেঁচে আছে না মারা গেছে তা কি জানাতে পারবে তাম্রধ্বজ?

শুনতে শুনতে তাম্রধ্বজ হাত ছাড়িয়ে নিল। নিঝুম পায়ে ঘাট ভেঙে ভেঙে শিপ্রার জলের দিকে এগিয়ে গেল। পিছনে পিছনে শিবনাথও হাঁটে। জলে আকাশের ছায়া। তাম্রধ্বজ জলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে নিশ্চল। শিবনাথ নিজের মুখখানি দেখল। মাথার উপর দিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছিল। একঝাঁক টিয়া। সূর্য রশ্মি জলে প্রতিফলিত হয়ে শিবনাথের মুখে লাগছিল। সময় যাচ্ছিল। শিবনাথ জলের দিকে এক এক ধাপ নামতে লাগল। শেষ ঘাটে উবু হয়ে বসে শিপ্রার জলে হাত দিয়ে অস্ফুট গলায় বলে উঠল, তোমার সন্তান আমরা, হারিয়ে যাওয়া সন্তানের ছায়াটি জলে কি আবার ধরবে না মা?

চলবে

 

অমর মিত্র
লেখকসাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারবঙ্কিম পুরস্কার এবং যুগশঙ্খ পুরস্কার প্রাপ্তভারত

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top