সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

শিশিরের দহন : লিপি নাসরিন


প্রকাশিত:
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৩

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০২:৪৪

 

এই যে মিস্টার, এই যে... আপনি সাইকেলটা একটু সরিয়ে রাখুন আমি গাড়িটা পার্ক করবো। গাড়ির গ্লাস খুলে আঙ্গুলের তুড়ি উড়িয়ে নুসরাত ডাকছিল শাহেদকে। ছোট খাটো মানুষটি মুখে প্রচণ্ড কাঠিন্য ছড়িয়ে দিতে দিতে বললো, আপনি ওপাশে গাড়ি রাখুন। এ পাশে দেখছেন তো অনেকগুলো সাইকেল  রাখা আছে। এভাবে একটা ছেলে তাকে উল্টো কথা শোনাবে নুসরাত ভাবতেই পারে না। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে এসে সোজা শাহেদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আপনার সাইকেলটা একটু সরিয়ে রাখতে অসুবিধা কী, অ্যাঁ কী অসুবিধা? এখানে গাড়িটা রাখলে আমার একটু সুবিধা হয় সেজন্য তো আপনাকে বললাম। মানুষের একটু কমন সেন্স ও নেই। নুসরাত রাগে কিটিরমিটির করতে থাকে। কমন সেন্স আপনার বুঝি খুব আছে? শাহেদের মুখমণ্ডলের কাঠিন্য আরো কঠিন হয়ে ওঠে। সে সাইকেল নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

স্ট্রেঞ্জ বলে মুখ ঝামটা দিয়ে নুসরাত আবার গাড়িতে গিয়ে স্টার্ট দেয়।

শাহেদ সাইকেল ধরে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

শাহেদের সারাদিন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকে, ও খুব কোমল চিত্তের মানুষ। পরদিন ক্লাসে এসে শাহেদের মন খারাপ দেখে নাইমা জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে শাহেদ? আজ সারা ক্লাসে মন খারাপ করে ছিলে কেনো ?

তেমন কিছু হয়নি? শাহেদ উত্তর দিলেও নাইমা জোরাজুরি করে। ওরা লাইব্রেরির দিকে হাঁটতে থাকে।

নুসরাতকে শাহেদ প্রথম দেখেছিল একটা বাড়িতে আন্তঃকলেজ নাটকের রিহার্সালে। সেটা সেই বাহাত্তর সালের ঘটনা কিন্তু কথা হয়নি। প্রথম কথা হয় আজ তাও একটু ঝগড়ার ছলে। নুসরাত  ম্যাট্রিকে নবম হয়েছিল। দেখতেও ছিলো লম্বা চওড়া। খুব স্মার্ট। অর্থনীতিতে অনার্স ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাহেদ তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল করে। কিন্তু শাহেদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিলো ঢাবির ক্যাম্পাস। নাইমা শাহেদের খুব কাছের বন্ধু আবার নুসরাত নাইমা দুজনে হৃদয়ে ঋদ্ধ হলেও নুসরাতের সাথে শাহেদের গত দুবছরে কোন আলাপচারিতা হয়নি।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে। নাইমা দুনিয়ার ভালো ভালো বই শাহেদকে দেয় পড়ার জন্য। সাহিত্য, ইতিহাসের সেসব অমূল্য পাঠ পড়ে আলোচনায় মেতে ওঠে দুজন। আজ শাহেদ কিছুটা বিষণ্ণ।

কী হয়েছে আমাকে বলো? নাইমা সামনে খুলে রাখা বইটা বন্ধ করে শাহেদের দিকে তাকায়। তোমার ঐ বন্ধু কী যেন নাম?

কে নুসরাত ?

হুম, কাল তার আচরণটা আমার সাথে সে ভালো করেনি।

কী হয়েছে বলতো? নাইমার ঔৎসুক্য জাগে।

কাল আমি সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল রাখতে যাচ্ছিলাম, সে তখন গাড়ি নিয়ে আসলো, আমাকে বললো সাইকেল সরিয়ে রাখতে সে গাড়ি রাখবে।

আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। এ জন্য মন খারাপ। চলো আমার সাথে।

কোথায়? শাহেদ দাঁড়িয়ে পড়া নাইমার দিকে মুখ তুলে তাকায়।

নুসরাতের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।

না, আমি যাবো না। তুমি যাও। আমাকে টিউশনিতে যেতে হবে।

আরে বাব্বা, ওর সাথে পরিচিত হয়ে তারপর যাবে।

শাহেদকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হলো।

সেইদিন পরিচয়ের পর থেকে নাইমা,শাহেদ এবং নুসরাতকে নিয়ে এক নতুন কাহিনির জন্ম হয়েছিল। এক অসাধারণ ত্রিমিতির বুদ্ধিবৃত্তিক দীপ্তিময়তায় ভরে থাকতো ওদের রাত্রি-দিনগুলি। লাইব্রেরি পাড়ায় চলতো ওদের ভর আড্ডা। নুসরাত, নাইমা এক একদিন রান্না খাবার নিয়ে আসতো। ওদের খাওয়ার মাঝেও চলতো মহৎ সাহিত্যের অসাধারণ সব চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ আর ইতিহাসের পথ পরিক্রমা। 

এর মাঝে হুট করে পঁচাত্তর সালে নুসরাত আমেরিকা চলে গেলো পড়তে। নাইমা, শাহেদ দুজনে বেশ মুষঢ়ে পড়লো নুসরাতকে হারিয়ে। চিঠি লিখতো তিনজনই। কিন্তু একবছর যেতে না যেতেই পড়া শেষ না করেই ফিরে এলো নুসরাত। ছিয়াত্তরে ফিরে এসে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়। সে বছর কেউ প্রথম শ্রেণি পায়নি।

ওরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে বসে।

শাহেদ আপনি কি ওখানেই মাস্টার্স করবেন?  নুসরাত শাহেদের দিকে তাকিয়ে  প্রশ্ন করে।

না, এখানে ভর্তি হবো আর ও মুখো হচ্ছি না নন্দিনীদ্বয়।

হো হো করে হেসে ওঠে তিনজন।

নাইমা একটা কথা ভেবে পায়না। এতোদিন হয়ে গেলো এখনো দুজন দুজনকে আপনি সম্বোধন করে।

তোমরা দুজন আপনি থেকে আর তুমিতে নামতে পারলে না।

শাহেদ পুরুষ হিসাবে একটু লাজুক প্রকৃতির। নিচের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট লাজুক হাসিতে ওর মুখটা উদ্ভাসিত হয় ওঠে।

নুসরাত আড় নজরে সে লাজুকতা মেখে নিতে নিতে বললো, আপনি ভালো, শাহেদ প্রথম দিন যেমন কঠিন করে আমার দিকে তাকিয়েছিল ,আমি কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

এবার শাহেদ জোরে হেসে ওঠে। সাথে নাইমা এবং নুসরাতও।

নাহ্ ওটা কিছু নয়।

নাইমা বলে , শোন আমাকে মাকে নিয়ে একখানে যেতে হবে তুই আর শাহেদ আড্ডা দে আমি চলি রে।

আর একটু বসে যা।

না দেরি হয়ে যাবে। কাল দেখা হবে বলে নাইমা উঠে পড়ে। ওদের দৃষ্টি সে পথে চলে ফিরে আসে  পরস্পরের প্রতি।

আপনি এবার কী করবেন? এখানে থাকবেন নাকি আবার বাইরে?

ভাবছি কী করবো। জানেন আব্বুকে খুব মনে পড়ছে। বেঁচে থাকলে কী যে আনন্দ করতেন! শাহেদ ইতিমধ্যে জেনেছিল নুসরাতের বাবা ডাঃ ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ এর ২৮ মার্চ গাজীপুর সেনাসদরে শহিদ হন। ওর বাবার পোস্টিং ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে। ৭০ সালে ওরা পাকিস্তান থেকে ফিরে আসে। দিনাজপুরের মির্জা পরিবারের মেয়ে নুসরাত। পারিবারিক বহু সম্পত্তির মালিক ওরা। সে কারণেই কী? কী জানি হয়তো তাই। শাহেদের তুমি বলতে কেমন যেন বাঁধে অবশ্য ঐ একটা বাঁধ ছাড়া আর সবগুলোই শাহেদ অতিক্রম করেছে তার স্বাভাবিক শীলতায়। নাইমার বাবাও বিরাট ব্যবসায়ী। আদি নিবাস ভারতের গুজরাট।  নাইমার টকটকে গোলাপের মতো গায়ের রঙ জানান দিচ্ছে তাদের আভিজাত্যের আভা। সে তুলনায় শাহেদের পারিবারিক পরিচয় একেবারে এদেশের সাধারণ আর দশটি পরিবারের মতো। তার স্কুল শিক্ষক বাবার কোমল  হৃদয়ের অনেকটা পেয়েছে শাহেদ। দাদা-দাদি আর বাবা চাচাদের নিয়ে একান্নবর্তি পরিবার তাদের।

নুসরাত কথা বলছে, শাহেদ মাঝে মাঝে ওর হাতের আঙ্গুলগুলো দেখছে। মন বলছে ওকে একটু ছুঁয়ে দেখি, কী স্মার্ট ও! ওর কথা বলার স্টাইল শাহেদকে মুগ্ধ করে। চঞ্চলতা বলতে যা বোঝায় তার মধ্যে  মোটেই তা নেই তবে এক ধরণের অন্তরিত অস্থিরতা ওর মধ্যে কাজ করে যেটা খুব ভালো করে না দেখলে বোঝা যায় না। শাহেদ একদম চুপ হয়ে আছে দেখে নুসরাত বলে, এখন কোন বই পড়ছেন? আপনি তো দুনিয়ার অনেক সাহিত্য এরই  মধ্যে পড়ে ফেলেছেন। আমি ভেবে পাই না ক্লাস সেভেনে থাকতে একটা পুঁচকে ছেলে কীভাবে সারা দুনিয়ার সাহিত্য পাড়া ঘুরে বেড়ায়। শাহেদ সেই স্বভাবসুলভ লাজুক হাসিটি উপহার দেয়।

ওরা দুজন উঠে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে নুসরাতের গাড়ির কাছে আসলে শাহেদ নুসরাতকে বিদায় দিয়ে ওর সাইকেল নিয়ে বের হয় টিউশনি করতে। শাহেদের বাবার ছেলেকে পড়ানোর সামর্থ থাকলেও শাহেদ এক পয়সাও বাবার কাছ থেকে নেয়না কোন এক প্রচণ্ড অভিমানে। ওর বই কেনার বাতিক। টিউশনির টাকা দিয়ে দুনিয়ার বই কিনে রাতদিন বুঁদ হয়ে থাকে। ক্লাসের পড়াশুনা ও একদমই করে না। পত্রিকা পাড়ায় তার যাতায়াত অবাধ। দেশের নাম করা কবি সাহিত্যকের আড্ডা শোনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। নিজে তেমন কিছুই বলে না শুধু ভক্ত শ্রোতার মতো চোখ কান সজাগ রেখে আলোচনা শোনে। শুধু এদেশে না, পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি সাহিত্যকদের সাথেও তার জানা পরিচয়। ভালো ভালো বই পড়াটা তার কাছে পৃথিবীর সব থেকে মজার, সব থেকে আনন্দের।

টিউশনি থেকে ফিরে শাহেদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। ঘরটায় বইয়ে ঠাসা। শুধু এই বইয়ের কারণে ও হলে না উঠে বাসা নিয়ে থাকে। অনেক বই নাইমা ওকে দিয়েছে। নুসরাতও দিয়েছে অনেক বই। নুসরাতের মুখটা মনে পড়তেই ভেতরে ভেতরে কেমন উতল হয়ে ওঠে। একা নুসরাতের সামনে বসলেই ও যেন গলে যেতে থাকে। ওকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ওর আপাত স্থির অন্তর্মুখী চঞ্চলতা যেন শাহেদকে টানে চুম্বকের আকর্ষণে। নাহ ওর সঙ্গে একা আর কখনোই সে বসবে না নাইমা বিহীন।

নাইমা এবং নুসরাত দুজনেই এম বি এ করে। শাহেদের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ভেবেছিল লিখে আর পড়িয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেবে কারণ ছাত্রাবস্থায় শাহেদ দৈনিক পত্রিকায় রিভিউ লেখা শুরু করে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে সে পথের যাত্রা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকারি চাকুরিতে ঢুকে পড়ে শাহেদ। তখন ওদের আড্ডা চলতো লাইব্রেরি পাড়া ছেড়ে নাইমাদের বাড়ি, না হয় নুসরাতের বাড়ি কিংবা শাহেদের সরকারি কোয়ার্টারে। নুসরাতের মা শাহেদকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন এবং ভালোও বাসতেন  সে প্রকারে। আর নাইমাদের বাড়ি ছিলো ওর সেকেন্ড হোম। ত্রিমুখী  আড্ডায় ওরা তিনজন ছিলো প্রাণবন্ত। নাইমা বা নুসরাত কারোর বাড়ি থেকে শাহেদের ব্যাপারে কোন আপত্তি কারোর ছিলো না। হয়তো শাহেদের বালক সুলভ কোমলতায় ওরা মুগ্ধ ছিলো। এ সময় শাহেদ বাহিরে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভিতটা ওর আধপোড়া কয়লা কাঠের মতো ধুঁকে ধুঁকে জ্বলতো। নাইমা না থাকলেও দুজনের আড্ডা, বেড়ানো সবই তখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে শুধু সেই আপনি থেকে তারা আর তুমিতে নামতে পারেনি। নুসরাতের দিক থেকে শাহেদ কোনদিন বিন্দুমাত্র কোন সাড়া পায়নি। তার  নিজের ভালোবাসার রঙ, প্রকৃতি বা গভীরতা কেমন সেটিও শাহেদ ঠিকমত বুঝে উঠতে পারতো না তবে নুসরাত শাহেদকে কেবল বন্ধু ছাড়া যে অন্য কোন চোখে দেখতো না সেটা শাহেদ বুঝেছিল অনেক পরে। ৮২ সালে নুসরাত আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে চাকরি নেয় কিন্তু ঐ যে বাইরে ও যতোই শান্ত থাকুক না কেন ভেতরে ওর বয়ে যায় কুলু কুলু ধ্বনির এক অশ্রান্ত ঝরনা। কিছুদিন যেতেই চাকরি  ছেড়ে দিয়ে হোটেল শেরাটনে পাবলিক রিলেশন্স অফিসারের চাকরিতে যোগ দেয়। শাহেদ তখন  টেলিভিশনের বার্তা বিভাগে। একদিন হন্তদন্ত হয়ে  শাহেদের রুমে ঢুকে বলে, এই যে শাহেদ, আপনি আমাদের নিউজগুলো মোটেই প্রচার করছেন না।

আপনাদের নিউজ তো যাচ্ছে।

আপনি খবর নিয়ে দেখুন। আমাদের নিউজ কতো কম যাচ্ছে।

ঠিক আছে আমি দেখছি আপনি বসুন।

না না এখন বসার সময় নেই। সন্ধ্যায় আসছেন তো?

শাহেদ হ্যাঁ যাবো বলতেই নুসরাত চলে গেলো।

এর মধ্যে নাইমা কুয়েতের একটা ব্যাংকে চাকরি নিয়ে চলে গেলে ওদের আড্ডাটা যেন অনেকটাই ভেঙে যায়। নাইমা প্রচুর পড়তো এবং সেসব নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠতো।

কুয়েত থেকে আবুধাবী তারপর নেপাল যায় পোস্টিং নিয়ে । চিঠি লিখতো, ফোন করতো ওখান থেকে দুজনকে। সেসব চিঠিতে থাকতো নানান বইয়ের খবর, ওখানে কীভাবে থাকছে, কীভাবে চলছে এসব। কিন্তু ৮৬ তে নাইমা  সবকিছু ছেড়ে চলে আসে বিয়ের জন্য। ৮৭ সালে নাইমা শিকাগো যায় বেড়াতে মূলত রথ দেখা ও কলা বেঁচা এই দুটো কাজ একসঙ্গে করাই মুখ্য। ওর হবু  বরকে দেখে ফিরে আসে। ৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসের হাড় কাঁপানো এক রাতে ওর বিয়ে হয়ে যায়। ৮৯ সালে আমেরিকায় ইমিগ্রেশন নিয়ে নাইমা বরের সাথে চলে গেলেও ওদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি সেই সময়েও। দুজনের চাকরির কারণে নুসরাত আর শাহেদ আগের মতো আড্ডায় নিয়মিত না হলেও ওদের দুজনের আড্ডা চলতো নুসরাতের বাড়িতে। কখনো কখনো বিশেষত ছুটির দিনের আগের রাতগুলোতে পড়া আর আলোচনায় কখন রাত পার হয়ে যেতো ওরা বুঝতে পারতো না। নুসরাতের প্রতি শাহেদের ভালোলাগা ছিলো অকৃত্রিম সেখানে কোন মলিনতাকে শাহেদ প্রবেশ করতে দেয়নি তবে নুসরাত যে শাহেদকে কখনো প্রেমিকের চোখে দেখেনি সেটা বোঝা গেলো যখন সায়মনকে নুসরাত পছন্দ করলো বিয়ের পাত্র হিসেবে। এর মধ্যে নাইমা এলো স্বামী নিয়ে বেড়াতে। শাহেদ আর নাইমা একদিন শেরাটনে গিয়ে সায়মনকে দেখে এলো। সায়মন অস্ট্রিয়ার নাগরিক,তখন শেরাটনের জেনারেল ম্যানেজার। নুসরাতকে সেই প্রস্তাব দেয় আগে। নুসরাত দোমনায় ভুগে শাহেদকে সব খুলে বলে। বাড়ি থেকে যে খুব বেশি চাপ দিচ্ছিল বিয়ের জন্য তা নয় তবে ওর মা চাচ্ছিল নুসরাত যেন বিয়ে করে। বিয়ের প্রতি ওর আকর্ষণ কম সেটি শাহেদ তার সাথে কথাবার্তায় আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। সায়মনের সাথে দুএকদিন বাইরে গেছে নুসরাত। ফিরে এসে হাসতে হাসতে গল্প করেছে সারাদিন কোথায় কোথায় দুজন ঘুরলো এইসব। সেসব গল্প শুনতে শুনতে শাহেদের বুকের মধ্যে জেগে থাকা রূপোলি জ্যোৎস্নায় হিম পড়ে তবুও সেই হিমের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে শাহেদ আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। নুসরাত কি বোঝে না নাকি বুঝতে চায় না।

বেশ কদিন অফিসিয়াল কাজে শাহেদ চট্টগ্রাম ছিলো। ফিরে এসে অফিসে বসতেই নুসরাত এসে হাজির।

আপনাকে আমি খুঁজছি কদিন ধরে। শেষে অফিসে এসে খবর নিয়ে জেনেছি আপনি ঢাকাতে নেই।

সরি, আপনাকে জানিয়ে যাবো সে সময় পাইনি।ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ের মতোই যেতে হয়েছিল, বলতেই নুসরাত চাপা শব্দে হেসে ওঠে।

আর কী খবর বলেন?

আরে সেইটে বলতে তো এলাম। সায়মন কুয়েতে পোস্টিং নিয়ে চলে গেছে।

আচ্ছা। তো আপনিও চলে যান। বিয়েটা ওখানে সেরে ফেলুন।

দেখি বলেই নুসরাত চেয়ার ছেড়ে ওঠে। রাতে আসেন আজ, মা আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছে।

ভাগ্যিস বেঁধে নিয়ে যেতে বলেনি বলেই দুজনে হেসে ওঠে। নুসরাত দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়। ও যেন দুনিয়ার সব সুবাস সাথে করে নিয়ে ঝড়ের বেগে আসে আবার যাবার সময় ঠিক সব কুড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। শাহেদ চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ নুসরাতে ডুবে থাকতে পারে না।

সে রাতে শাহেদ কিছু সময় নুসরাতের বাড়ি কাটিয়ে চলে আসে। চা নিয়ে  দুজন  মুখোমুখি বসে।

আপনার পরিকল্পনা কী আমাকে বলেন।

কেঁপে ওঠে শাহেদ। কোথাও বুঝি এক চিলতে আলো চমকে উঠলো।

কোন পরিকল্পনা? শাহেদ চায়ে চুমুক দেয়।

এই ঠাণ্ডা চায়ে চুমুকের মতো জীবন কি ঠাণ্ডা মেরে থাকবে? বয়স তো হচ্ছে নাকি?

দেখা যাক। তবে আমার আরো কিছু কাজ বাকি আছে আগে পরিকল্পনা অনুযায়ী সেসব কাজ সারবো তারপর গরম চায়ে চুমুক।

কী বলুন তো? নুসরাত বেশ কৌতূহলী হয়।

আমি যে কোন সময় এই চাকরি ছেড়ে দিতে পারি নুসরাত। এই চাকরি আমার জন্য না। আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পড়াশুনাতো ঠিকমতো করলাম না। আমি ওটি আবার করতে চাই।

সেটি আপনার জন্য দারুণ হবে। তবে বাইরে চলে যান। যে কোন সাপোর্ট লাগলে আমি আছি। আর বই বের করার ব্যাপারে কতদূর আগালেন?

হবে, সব হয়ে যাবে।

সেদিন আর বেশিক্ষণ শাহেদ ও বাড়িতে ছিলো না। রাত এগারোটার দিকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে যতক্ষণ মন চায়। রাস্তার উপর ল্যাম্প পোস্টের আলোয় গাছের পাতাগুলো ঝালর সৃষ্টি করেছে। বড় মনোরম লাগে ওর কাছে। সে ঝালরের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে জীবনের মানে শাহেদের কাছে পাল্টে যেতে থাকে।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই নুসরাত পোস্টিং নিয়ে কুয়েতে চলে যায়। না সায়মনকে ও বিয়ে করেনি। সায়মন বিফল মনোরথে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিল। ৯৭ সালে শাহেদ আমেরিকায় বসে খবর পেলো নুসরাত বিয়ে করেছে ওর থেকে বয়সে বেশ কয়েক বছরের ছোট বড় ভাইয়ের শ্যালককে।

সেই রাতে বাসায় ফিরে শাহেদ তার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল।  দশ বছরের সরকারি চাকরির সোনার হরিণ ফেলে বাবা-মাকে না জানিয়ে পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকায়। কাগজপত্র আগেই পাঠিয়ে সবকিছু ঠিক করে একেবারে কপর্দকশূন্য হয়ে এক অনিশ্চিত যাত্রায় প্লেনে চড়েছিল। ভবিষ্যত তার জানা ছিলো না শুধু জানতো এখানে সে থাকবে না।

নুসরাতের বিয়ে শাহেদের জীবনে বড় কোন পরিবর্তন এনেছিল কিনা, হয়তো এনেছিল  তাই পড়াশুনার প্রতি ডুবে ছিলো আকণ্ঠ। দুইটা  সাবজেক্টে নতুন করে পড়ে, পাশ্চাত্যের সেরা শিক্ষকদের সংস্পর্শে ও ধীরে ধীরে নিজেকে কষ্টি পাথরে যাচাই করার সুযোগ পেয়েছিল। আমারিকার মতো দেশে একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে গিয়ে বুকের ভিতরে পুষে রাখা একটি ক্ষীণ কষ্টকে ও প্রায় সময় ভুলে থাকতো ক্ষুণ্ণিবৃত্তি ও পড়াশুনার তাগিদে। ওর স্বপ্নকে ছুঁতে গিয়ে জীবন থেকে ঝরে গেলো বেশ কটি বছর। নাইমার সাথে যোগাযোগ আছে তবে নুসরাতের সাথে যোগাযোগে একটু ভাঁটার টান। বাইরে যে ব্যথা বাস্তবতায় আপাত বিলীন, বুকের ভেতর তার ডালপালার বিস্তার বোধহয় পরিপূর্ণ হয়।

কখনো পড়তে পড়তে শাহেদ দিন-রাত্রির পার্থক্য ভুলে গেছে, হয়তো কারো ফোন পেয়ে বুঝতে পেরেছে সময়টা দিন, নাকি রাত। পড়ার খরচ যোগাড় করতে পরিশ্রম আর ডিগ্রির জন্য কঠিন পড়াশুনার ভিতর ওর সময়গুলো ছুটে চলে। তার মধ্যেই পরিচিত বন্ধু বান্ধব যারা ওখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল তাদের সাথে সাহিত্য আড্ডায় ঢুঁ মারা সবই একদম ঘড়ির কাঁটা মেপে শাহেদের জীবন জোয়ারে প্লাবন তুলে তুলে বয়ে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে নুসরাতের ফোন পায় ,ওর ভালো লাগে। বিয়ের পর নুসরাত কেমন দেখতে হয়েছে সে কথা জানতে চায়। টেলিফোনের ওপাশে নুসরাতের হাসির কাঁচ ভাঙে কেবল। কিছুই বলে না।

 

শাহেদ চলে গিয়েছিল ৯৩ তে। ও যাওয়ার কমাস পরে নুসরাত একদিন ফোন করে বলে, শাহেদ আপনার টাকা লাগবে আমি জানি। টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। না, আপনাকে একেবারে দিচ্ছি না, চাকরি পেয়ে শোধ দেবেন।

অনেক ধন্যবাদ নুসরাত, আমি ব্যবস্থা করে ফেলেছি।

কী ব্যবস্থা করেছেন শুনি? এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। বললাম তো শোধ করে দেবেন। নুসরাত  জোর করে কিন্তু শাহেদের দৃঢ়, স্থির কণ্ঠে প্রত্যয় আর প্রত্যাশা নুসরাতকে কিছুটা হতাশ করে।

সেই নুসরাত কেমন হয়েছে দেখতে কে জানে।

নাইমা এখানে আছে। মাঝে মাঝে উইকেন্ডটা শাহেদ সময় পেলে ওদের ওখানে কাটিয়ে আসে। সবকিছু চলছে পরিক্রমায় জীবনের ছকবাঁধা নিয়ম আর গতির মধ্যে। নুসরাত তখন কুয়েতে হঠাৎ শাহেদ খবর পায় নুসরাতের ডিভোর্স হয়ে গেছে। বছর দেড়েকের সংসার ভেঙে দিয়েছে ওরা দুজন। শাহেদ প্রচণ্ড বেদনার্ত হয়ে পড়ে। নুসরাতের মুখখানি বুকের মধ্যে এ পাশ ও পাশ করে। নাইমাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়। নুসরাতকে ফোন করতে ভয় হয় কিছুটা সংকোচও। তার কিছুদিনের মধ্যেই নুসরাতের ফোন আসে। শাহেদ হ্যালো বলতেই নুসরাত বলে ওঠে, আবার মুক্ত বিহঙ্গ, এবার ছুঁটে চলা অনন্তের পানে হে বন্ধু।

নুসরাত যদি এই মুহূর্তে শাহেদকে দেখতে পেতো তাহলে দেখতো ওর মুখটা গোধূলির ম্লান আলোয় পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা করুণ এক আবছায়া ভর করে আছে। সোনালি আলো মেখেও ধূসরের গুমোট ক্লান্তি খেলা করছে ওর মুখে।

হ্যালো, কথা বলছেন না কেন? শুনতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ পাচ্ছি।

দারুণ না? নুসরাতের গলাটা ধরে এলো বুঝি।

শাহেদ তেমনি রিসিভার কানে ধরে অছে। বুকের মধ্যে পরের কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছে কেউ।

শাহেদ আমি কানাডায় ইমিগ্রেশন নিয়েছি। এখন থেকে ওখানে থাকবো বছরের ছমাস বা ততোধিক।

খুব ভালো করেছেন। আমিও এখান থেকে যেতে পারবো সেমিস্টার শেষ হলে।

হুম। নাইমাও যাবে, আবার আমাদের আগের আড্ডা জমে উঠবে। ঠিক আছে পরে কথা হবে বলে নুসরাত ফোন রেখে দেয়।

রাত দুইটা। শাহেদের রাত জাগা অভ্যাস সেই স্কুলে পড়ার সময়ে। এখানে এসে সেই অভ্যাস একেবারে নিয়মে পরিণত হয়েছে প্রায়। ঘুম আসছে না। উঠে ক্যাসেট প্লেয়ারে বেগম আখতার এর গজল চালিয়ে দিয়ে নিজের কাজ, লেখালেখি নিয়ে বসে। কিন্তু মন বসে না। কেমন আর্দ্র হয়ে ওঠে মনটা। মা বারবার বিয়ের কথা বলছে কিন্তু সবকিছু শেষ না করে বিয়ে করতে পারবে না। আবার বয়সও তো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাছাড়া বিয়ের প্রতি খুব বেশি যে আগ্রহ আছে তাও না। মা-বাবা বারবার বলে পড়া শেষ করে ঢাকা ফিরে যেতে কিন্তু শাহেদ অনেক ভেবেছে  ফিরে গিয়ে করার মতো তেমন কিছু নেই। তার চেয়ে এখানেই কিছু একটা করতে হবে। আর তাকাতে পারে না শাহেদ। ক্রমশ ওর চোখে অন্ধকার নেমে আসে।

নিউইয়র্কে শাহেদ একটা বাংলা সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করতো। দেশে থাকতে বেশ কটা বইও বেরিয়েছিল। অনুবাদ করেছিল দেশের নামকরা দুজন সাহিত্যিকের দুটি উপন্যাস। একটি সাহিত্য পত্রিকার সাথে জড়িয়ে ছিলো অনেকদিন। এখানে এসেও শাহেদ মেধা, মনন আর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে প্রতিটি পদক্ষেপে। একদিন ও কাজ করছিল পত্রিকা অফিসে হঠাৎ নুসরাত অফিসের নম্বরে ফোন করে কুয়েত থেকে। এ সময় কারো ফোন আসার  কথা না। শাহেদের শঙ্কা হয়। কোন খারাপ কিছু নয়তো? শঙ্কিত হৃদয় নিয়ে রিসিভার তোলে।

হ্যালো, আমি নুসরাত বলছি।

ওর কণ্ঠ শোনার সাথে সাথে শাহেদের শঙ্কার মেঘ বাষ্প হয়ে উড়ে যায়।

কী ব্যাপার আপনি তো এ সময়ে সাধারণত ফোন করো ন।

শাহেদ আপনি ঠিক আছেন তো? আমি আপনাকে দারুণ একটা সংবাদ দেবো এখন। নাইমাকে বলেছিলাম কিন্তু ও বললো, সে এ সংবাদ আপনাকে দিতে পারবে না। তাই আমাকেই  বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। হঠাৎ উচ্ছ্বল কণ্ঠে যেন কোন দূরবর্তী প্রতিধ্বনি কেঁপে কেঁপে আসে আলো আর ছায়ার চোরা প্রতিযোগিতায়।

হ্যাঁ বলুন আমি শুনছি। শাহেদ বাম হাতে রিসিভার ধরে ডান হাতে কাজ করতে থাকে।

শাহেদ আমার ক্যানসার ধরা পড়েছে, নুসরাতের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে।

কী ? শাহেদ যেন শুনতে পায়নি।

নুসরাত সেই একই কথা পুনরাবৃত্তি করে ফোন কেটে দেয়।

শাহেদ কিছুক্ষণ পর্যন্ত নিজের বর্তমান অস্তিত্ব  নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলো। যেন নিজের মধ্যেই আত্মস্থ হয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল কী বললো নুসরাত। একসময় ও নিজের মধ্যে ফিরে এলো, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। নাইমাকে ফোন করলো, নাইমা তেমন কোন কথা বলতে পারলো না। শুধু কেঁদেই চললো ফোন রিসিভ করে। শাহেদ বাসায় ফিরে ঘুমাতে পারলো না সারারাত। আর কিছুদিন পর ওর একটা কলেজে যোগদান করার কথা। সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালিন পড়াচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে শাহেদ যখন জীবনের আরেকটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন এই  সংবাদ তার সমস্ত স্বত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছ। তুষারে ঢাকা গাছগুলো যেমন আলোর ছোঁয়া পেতে ভিতরে ভিতরে স্থৈর্য চঞ্চলতায় মুহ্যমান থাকে আর সূর্যের ছোঁয়া পেতেই নিমেষে জেগে উঠে শরীর থেকে পোশাক খুলে ফেলার মতো করে ঝেড়ে ফেলে তুষারের আভরণ তেমন একটা কিছুর অপেক্ষায় শাহেদ আছে। যেন হঠাৎ কেউ ফোন দিয়ে বলবে, নুসরাত মজা করার জন্য বলেছে। তুমি বোঝনি?

শাহেদ অপেক্ষায় থাকে নুসরাতের আরেকটা ফোন কলের। ও নিজেই যেন আবার ফোন করে বলবে, আপনার সাথে মজা করছিলাম। আপনি খুব বোকা, বুঝতে পারেন না। কিন্তু না, শাহেদের সে অপেক্ষার অবসান আর হয়নি। জানালার পর্দা ঠেলে শাহেদ বাইরে তাকায়। চারিদিকে তুষারে ঢেকে আছে , তার উপর লাইট পড়ে কেমন এক ভৌতিক মায়ায় ভরিয়ে তুলেছে দূরে রাস্তার বাঁকগুলো।

নুসরাতের চিকিৎসা শুরু হয় কুয়েতে থাকতেই তারপর কানাডা, সিঙ্গাপুর আর বোম্বেতে তথা অধুনা মুম্বাইতে। একই সাথে ওর ব্রেস্ট ক্যান্সার আর লিম্ফোমা। ২০০১ সাল ওর ক্যান্সার ধরা পড়ে, দীর্ঘ ব্যয়বহুল চিকিৎসার পর নুসরাতের ইচ্ছাতেই ওকে দেশে ফিরিয়ে আনে ওর আত্মীয় স্বজন। ইতিমধ্যে শাহেদ নিউ জার্সির এসেক্স কলেজে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছে। পড়াশুনা, গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকে। জীবন থেকে ঝরা পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে সময়। থোকা থোকা ফুটে থাকা ফুলের মতো কখনো নুসরাত এসে রঙ ছড়িয়ে যায় সে ঝরা পাতার উপর। শাহেদ ক্ষণিক চেয়ে দেখে আবার ডুবে যায় নিজের কাজে।

নুসরাতের অসুস্থতা আরো বেড়ে যায়। শাহেদ ঢাকা আসে। বাড়িতে যাবার আগেই নুসরাতের বাসায় যায় ওকে দেখতে। আঁতকে ওঠে ওকে দেখে। শীর্ণকায় দেহটি বিছানার সাথে লেপ্টে আছে। চোখ দুটি যেন কিসের প্রতীক্ষায় জেগে আছে অতল জলের প্লাবন ধরে। গায়ের রঙের পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওর সুন্দর ববছাঁটা চুলগুলোর কগাছি পড়ে আছে ঘাড়ের কাছে অবহেলায়। শাহেদকে দেখে মৃদু হাসলো নুসরাত।

ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো একটু হা করে বললো, এসেছেন? কেমন আছেন?

শাহেদ ওর বিছানার পাশে বসে হাত ধরলো।

সব ঠিক হয়ে যাবে, আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন আবার। এবার একেবারে যুক্তরাষ্ট্র চলে আসবেন।

নুসরাত একটু হাসার চেষ্টা করলো। তারপর শাহেদকে অবাক করে দিয়ে সেই শব্দটি উচ্চারণ করলো যার বাঁধা শাহেদ এই মুহূর্তেও ডিঙাতে পারলো না, অথচ মনে মনে পেরিয়ে গেছে বহু আগেই।

শাহেদ তুমি ঢাকা চলে এসো একেবারে। আমার উত্তরার বাড়িটি তোমাকে লিখে দেবো, তুমি ওখানে থাকবে আর তোমার স্বপ্ন সারা জীবন লিখে যাওয়া সেটা পুরণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রে থেকে তুমি শিক্ষক হতে পারবে কিন্তু লেখক হওয়া খুব কঠিন হবে। আর এবার বিয়ে করবে। মরে যাবার আগে তোমার বউয়ের চেহারাটা দেখে যাই।

শাহেদ অবাক হলো ভীষণ। সেদিন আর কিছু বলার মতো ভাষা শাহেদের ছিলো না। চোখের গ্রন্থিতে জমতে থাকা জল কখন না জানি চলকে বাইরে এস ওকে লজ্জায় ফেলে। নুসরাতের চোখের দিকে তাকিয়ে শাহেদ বিদায় নিয়ে চলে আসে। তবে মন বলছিল আরো কিছুক্ষণ থাকতে ,ওর শেষদিন পর্যন্ত ওর পাশে থেকে সেবা করে যেতে। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট সেদিন নুসরাতের জন্মদিন ছিলো। শাহেদ ক্লাস শেষ করে নুসরাতকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে ভেবেছিল। মোবাইল ভাইব্রেশনে দেওয়া ছিলো। ক্লাসের মাঝপথে মোবাইল ফোনটা কাঁপতে থাকে। নুসরাতের দুলাভাই ফোন করে সংবাদটি ওকে জানায়। ও স্থির হয়ে বসে ছিলো নাকি পৃথিবীটাই স্থির হয়ে গিয়েছিল সেটা বুঝতে না পারলেও শাহেদের প্রলম্বিত একাকীত্ব সেই থেকে সার্বক্ষণিক সঙ্গে থেকে ওকে একা হতে দেয়নি আর কখনো। শিশিরের মতো শাহেদের যে ভালোবাসা ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে  দূর পাহাড়ের উপত্যকা বেয়ে নেমে এসেছিল ঘোড়ার খুরের শব্দে তা আবার তেমনি ঘণ্টি বাজিয়ে নিঃশব্দে ফিরে গেলো শুধু রেখে গেলো সূর্যের পোড়া দহনটুকু।

সরি, কিছু মনে করবেন না। আপনি কাঁদছেন কেন? কোন দুঃসংবাদ। মুুখোমুখি বসা ভদ্রলোকটি শাহেদকে জিজ্ঞেস করলো।

ইটস্ ওকে। সত্তরের কাছাকাছি শাহেদ ওর চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু মুছে নেয়। মাঝাকাশে  প্লেনটা একটু ঝাঁকুনি খায় যেন। শাহেদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আজ ২০২১ সালের ১৩ আগস্ট।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top