সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

দ্যা প্রফেট (ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ) : কাহলীল জীবরান 


প্রকাশিত:
৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৪

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৫৩

ছবিঃ কাহলীল জীবরান এবং অনুবাদক রোজীনা পারভীন বনানী 

 

মূল: কাহলীল জীবরান 
অনুবাদ: রোজীনা পারভীন বনানী 

 

একাদশ 

তারপর সম্মুখে দাঁড়ানো নগর বিচারকদের একজন বললেন, আমাদের অপরাধ এবং শাস্তি সম্বন্ধে বলুন।

 

তিনি উত্তরে বললেন:

যখন তোমার আত্মা বাতাসের ভিতর বিচরণ করে বেড়ায়, সেই তুমি একাকী এবং অসতর্ক অবস্থায় অন্যের প্রতি এবং ফলশ্রুতিতে নিজের প্রতিও একটা অন্যায় আচরণ করে ফেলো।

এবং এই অন্যায় আচরণের জন্য অবশ্যই তোমাকে মঙ্গলের দরজায় আঘাত করতে হবে এবং অলক্ষ্যে অপেক্ষা করতে হবে।

তোমার আত্ম-দেবতা সমুদ্রের মত; যা চিরকাল পবিত্র রয়ে যায়। নির্মল আকাশে মেঘের মত নিজের ডানায় ভর করে উড়তে পারে। একইভাবে তোমার আত্ম-দেবতা সূর্যের মত; যা গন্ধমূষিকের চলাচলের পথ জানে না অথবা সাপের গর্তও অনুসন্ধান করে না।

 

কিন্তু তোমার আত্ম-দেবতা তোমার সত্তায় একাকী বাস করে না। তোমার সত্তার অনেকখানিই মানুষ এবং অনেকখানিই  এখনও মানুষ নয়।

 

কিন্তু একটা নিরাকার জন্তুর মত যে কুয়াশার ভিতর ঘুমন্ত অবস্থায় হেঁটে হেঁটে অনুসন্ধান করছে তার নিজের জাগ্রত অবস্থার।

 

এবং তোমার ভিতরে যে মানুষটা বাস করে আমি এখন তার কথা বলব। কারণ এ সেই মানুষ কিন্তু তোমার আত্ম-দেবতা নয় অথবা সেই কুয়াশাচ্ছাদিত জন্ত নয় যে অপরাধ এবং অপরাধের শাস্তি সম্বন্ধে জানে।

 

আমি মাঝে মাঝে শুনি তুমি একজনের কথা বলছো যে একটা অন্যায় করে ফেলেছে যেন সে তোমাদের একজন নয়, কিন্তু একজন আগন্তুক এবং তোমার জগতে যেন অনাহূতভাবে প্রবেশ করেছে।

 

কিন্তু আমি বলছি এমনকি একজন পবিত্র ও ন্যাপরায়ণ ব্যাক্তিও সর্বোচ্চের বেশী উঠতে পারে না যা তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে। সুতরাং একইভাবে একজন দুষ্ট এবং দুর্বল ব্যাক্তিও সর্বোচ্চের বেশী নিচে নামতে পারে না যা তোমার মধ্যে আছে।

 

সমগ্র বৃক্ষের মৌন সম্মতি ছাড়া একটি পাতা কখনো হলুদ হয়ে যায় না,

 

সুতরাং যে ভুল করেছে সে কখনো তোমাদের সকলের লুকানো ইচ্ছা ছাড়া ভুল করতে পারে না।

 

তোমারা সকলে একসংগে একটা মিছিলের মত তোমাদের আত্মা-দেবতাকে অনুসরণ করছ।

 

তোমরাই পথ এবং তোমারাই পথিক।

 

এবং যখন তোমাদের ভিতর একজন পতিত হয় সে তার পিছনের লোকদের জন্যই পতিত হয়, প্রতিবন্ধক সৃষ্টিকারী পাথরের সতর্কবাণী স্বরূপ।

 

হ্যাঁ, এবং সে তার সম্মুখের লোকদের জন্যও পতিত হয়, যদিও তারা দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছে, তথাপি তারা বাঁধা সৃষ্টিকারী পাথরটিকে সরিয়ে ফেলেনি।

 

এবং এছাড়াও যে কথা তোমাদের হৃদয়ে ভারী হয়ে চেপে আছে:

 

যাকে খুন করা হয়েছে সে নিজেও তার খুনের জন্য দায়ী।

 

যাকে লুণ্ঠিত করা হয়েছে সে নিজেও সেই লুণ্ঠনের জন্য দায়ী।

 

ন্যায়পরায়ণ ব্যাক্তিও মন্দলোকের কাজ থেকে নিষ্পাপ নয়।

 

এবং একজন ভয়ংকর অপরাধীর কৃত্য থেকে একজন শাদা হাতের অধিকারী ব্যাক্তিও পরিচ্ছন্ন নয়।

 

বাস্তবিক, দোষী ব্যাক্তি মাঝে মাঝেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তির বলিতে পরিণত হয়।

 

এবং এখনও পর্যন্ত প্রায়ই দোষী সাব্যস্ত ব্যাক্তি নির্দোষ এবং নিরাপরাধী ব্যাক্তির পক্ষে ভারবাহী রূপে আবির্ভূত হয়।

 

তুমি ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করতে পারবে না এবং অন্যায়কে ন্যায় থেকে।

 

তারা প্রত্যক্ষ সূর্যের সামনে পরস্পরকে জড়াজড়ি করে অবস্থান করে ঠিক যেভাবে কাল এবং সাদা সূতা পেঁচিয়ে বোনা থাকে।

 

এবং যখনই কালো সূতা ছিঁড়ে যায়, তন্তুবায় সমগ্র কাপড়টিকে পরীক্ষা করে, সেই সংগে তার তাঁতটিকেও।

 

যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অবিশ্বাসী স্ত্রীর বিচার করে, তাকে সেই স্ত্রীর স্বামীর হৃদয়টিকেও মাপকাঠিতে ওজন করতে হবে, এবং তার আত্মাকেও পরিমাপ করতে হবে।

 

যে অপরাধীকে চাবুক মারে সে যেন যার প্রতি অপরাধ করা হয়েছে তার আত্মার দিকেও তাকায়।

এবং ন্যায়পরায়ণতার নামে তোমাদের ভিতর যদি কেউ শাস্তি দেয় এবং মন্দ বৃক্ষের গোড়ায় কুঠারাঘাত করে, তাকে এই বৃক্ষের মূল দেখতে দাও;

 

এবং প্রকৃতপক্ষেই সে ভালো এবং মন্দ দুটোর মূলকেই দেখতে পাবে, ফলেপৃর্ণ এবং ফলশূন্য অবস্থায়, পৃথিবীর নিঃশব্দ হৃদয়ে সবকিছুই প্যাঁচানো অবস্থায় আছে।

 

এবং তোমরা বিচারকরা অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবে। কোন বিচার তুমি তাকে প্রদান করবে যে দৈহিকভাবে সৎ তথাপি আত্মার ভিতর একজন চোর?

 

কোন শাস্তি তুমি তাকে দেবে যে দৈহিকভাবে কাউকে হত্যা করে, অথচ আত্মিকভাবে যার নিজেকেই হত হতে হচ্ছে? 

 

এবং তুমি কিভাবে তাকে অভিযুক্ত করবে যে কার্যতই একজন প্রবঞ্চনাকারী এবং অত্যাচারী, অথচ যে নিজেও একজন দুঃখী এবং অত্যাচারিত?

 

এবং তুমি কিভাবে তাদেরকে শাস্তি দেবে যাদের ভুল কাজের চেয়ে বিবেকদংশন অনেক বেশী? বিবেকদংশনই কি ন্যায়বিচার নয় যা আইনের সাহায্যে প্রয়োগ করা হয়েছে যে আইন তুমি সানন্দে জারি করেছ?

 

তথাপি বিবেকদংশনকে তুমি নিষ্পাপের মনের উপরে আরোপ করতে পার না অথবা দোষী ব্যক্তির হৃদয় থেকে একে উঠিয়ে ফেলতেও পার না।

রাত্রে অনাহূতভাবে এটা আসে, যাতে মানুষ জেগে উঠতে পারে এবং নিজেদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাতে পারে।

যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের সকল কাজকে পরিপূর্ণ আলোকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে, ততক্ষণ তোমাদের ভিতর কে ন্যায়কে বুঝতে পারবে?

 

শুধু তখনই তুমি জানবে উত্থিত এবং পতিত ব্যক্তি আসলে একই মানুষ গোধূলির ক্ষীণ আলোকে তার পাপাত্নার রাত্রি এবং দেবাত্নার দিনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে।

 

এবং মন্দিরের প্রধান ভিত্তি-প্রস্তর কখনো ভিত্তির সবচেয়ে নীচের প্রস্তরটির থেকে উচ্চতর নয়।

 

 

দ্বাদশ 

 

তারপর একজন আইনজ্ঞ বললেন, প্রভু, আমাদের আইন কি?

 

তিনি উত্তর দিলেন:

 

তোমরা আইন প্রণয়ন করে আনন্দ পাও, তথাপি আইন ভঙ্গ করে তার থেকেও আনন্দিত হও।

 

সেই শিশুদের মত যারা সমুদ্র তীরে খেলাচ্ছলে দৃঢ়সংকল্পের সাথে বালির ঘর তৈরী করে এবং উৎফুল্লভাবে সেগুলো আবার ভেঙে দেয়।

 

কিন্তু তুমি যখন বালির ঘর তৈরী করবে তখন সমুদ্রে আরও বালি তীরে জড়ো করবে, এবং যখন তুমি সেগুলো ভেঙে দেবে সমুদ্রও তোমার সংগে হাসবে।

 

প্রকৃতপক্ষে সমুদ্র সর্বদাই নিষ্পাপদের সাথে আনন্দিত হয়। কিন্তু তাদের কি হবে যাদের কাছে জীবন সমুদ্র নয়, এবং মানুষের তৈরী আইন কোন বালির ঘর নয়, জীবন যাদের কাছে একটা পাহাড়ের মত, এবং আইন একটা বাটালির মত যা দিয়ে আঘাত করে তারা নিজেদের পছন্দমত জীবনকে বাঁকাতে পারে?

 

সেই খোঁড়া লোকদের কি হবে যারা নৃত্যশিল্পীদের ঘৃণা করে? সেই ষাঁড়ের অবস্থায়ই বা কি যে তার লাঙলকে ভালোবাসে এবং বনের হরিণকে যাযাবর প্রানী বলে মনে করে?

 

সেই বৃদ্ধ সাপ যে নিজের খোলস ত্যাগ করতে পারে না, এবং অন্যান্যদের নগ্ন ও লজ্জাহীন বলে গাল দ্যায়?

 

এবং তার কি হবে যে বিবাহ উৎসবের ভোজে সবার আগে আসে, এবং মাত্রাতিরিক্ত খাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ীর পথে যেতে যেতে বলে সকল ভোজ-উৎসবই অপবিত্র এবং উৎসবে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই হচ্ছে আইনভঙ্গকারী?

 

আমি তাদের সম্পর্কে কি বলব যারা সূর্যালোকেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সূর্যের দিকে পিছন ফিরে?

 

তারা শুধু তাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছে, তাদের ছায়াই তাদের আইন। এবং তাদের কাছে সূর্যটা কি, শুধু একটা ছায়া নিক্ষেপকারী ছাড়া?

 

এবং আইনকে ধন্যবাদ জানানো মানে হচ্ছে অবনত হয়ে পৃথিবীর বুকে তার ছায়ার চিহ্নকে অনুসরণ করা, নয় কি?

 

তোমাদের ভিতর যে সূর্যের দিকে মুখ করে হাঁটছে, পৃথিবী তার কোন প্রতিচ্ছবি দিয়ে তাকে ধরে রাখবে?

 

যে তুমি বাতাসের সঙ্গে ভ্রমণ করছ, কোন বায়ুনির্দেশক যন্ত্র তোমার গতিকে পথ দেখাবে?

 

মানুষের কোন আইন তোমাকে বাঁধবে যদি তুমি তোমার জোয়াল ভেঙে ফেল কিন্তু কোন মানুষের শৃংখলিত দরজায় নয়?

 

কোন আইনকে তুমি ভয় করবে যদি তুমি নাচো কিন্তু কোন মানুষের লোহার শিকলের সাথে হোঁচট না খেয়ে?

 

এবং কে সে যে তোমার কাছে বিচার বয়ে নিয়ে আসবে যদি তুমি তোমার পরিচ্ছেদ সজোরে ছিঁড়ে ফেলে দাও কিন্তু কোন মানুষের পথের উপর নয়?

 

অরফালেজবাসী, তোমরা মৃদঙ্গকে কাপড় দিয়ে ঢাকতে পারো, এবং বীণার তারকে ছিঁড়তে পারো, কিন্তু কে ভরত পাখিকে গান না গাওয়ার আদেশ করবে?

চলবে

 

রোজীনা পারভীন বনানী 
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top