সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৫ জানুয়ারী ২০২১ ২১:৩৭

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৪

 

ঘোরাঘুরি আশিকার নেশা। নিজের দেশকে দুচোখ ভরে দেখতে চায়। বছরে একবার কোথাও না তোখাও যেতে চায় ও। যেতে না পারলে কেঁদেকেটে বুক ভাসায়। বাবা-মাকে বলে, কিছুইতো চাইনা। কাপড়-চোপড় সোনাদানা কিছু না। শুধু প্রাণভরে দেখতে চাই নিজের দেশের আনাচ-কানাচের সবটুকু। তাও তোমরা দিতে চাও না। কয় টাকাইবা লাগে। 

হামিদা বানু মেয়ের অভিযোগের উত্তর দেয় না। নিজের কাজে চলে যায়। মেয়েকে নানা জায়গায় ঘুরিয়েছে সবাই মিলে। ওর মামা-চাচা-খালা-ফুপুরাও ওকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়েছে। ও যেখানে যেতে চেয়েছে সেখানেই নিয়ে গেছে। তারপরও মেয়েটির গলা শুকিয়ে থাকে। পানির জন্য দৌড়ঝাঁপ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নিজেই প্রোগ্রাম বানায়। বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে জোট বানিয়েছে ঘোরার জন্য। উদ্যোগটা ওর নিজের। বাকিরা সায় দেয়। যায় ওর সঙ্গে। ও যেখানে বলবে সেখানেই যেতে হবে সবাইকে। ও ঠিক করলে কেউ আর নতুন জায়গার কথা বলে না। বললে ও বলবে, এবার না। সামনের বার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে এসব আয়োজন করে। রেজাল্ট ভালো করে দেখে বাবা-মা কিছু বলে না। দলেবলে যায় সেটাও তাদের ভরসার জায়গা। স্বস্তি নিয়ে থাকতে পারে। হামিদা বানুর এমন ভাবনার মাঝে ভেসে ওঠে সেই কথা - মেয়েটার পায়ের নিচে সর্ষে। সব মানুষ পায়ের নিচে সর্ষে রাখতে পারে না। এজন্য ভিন্ন মনের জোর লাগে। তারপরও মাঝে মাঝে মেয়েকে বলে, ভুলে যাসনা যে তুই একটা মেয়ে। তোকে সবকিছু বুঝেশুনে চলতে হবে। 

মায়ের এমন কথায় রেগে যায় আশিকা। মায়ের সঙ্গে মুখোমুখি প্রতিবাদ করে না। দুপদাপ পায়ে ফিরে আসে নিজের ঘরে। রাগে ফুঁসতে থাকে কিছুক্ষণ। নিজেকেই বলে, মেয়ে হওয়ার হিসেব করতে হবে কেন? মেয়ে হওয়াতো প্রকৃতির নিয়ম। সে নিয়মকে অস্বীকার করার দায় কি কারো আছে? যদি না থাকে তাহলে মেয়ের হিসেব কষে জীবনকে দেখতে হবে কেন? দেখবেনা ও, কিছুতেই দেখবেনা ও। ছোটবেলা থেকেই আশিকার মনে হতো ও দেশের শুধু শহর না, বনবাদাড়সহ সব জায়গা ঘুরে দেখবে। নিজের দেশ না দেখে বিদেশ দেখার ভাবনা ও কখনোই ভাবতে পারে না। তবে বিদেশ দেখার কথা মনে এলে ওর প্রথমেই মনে হয় অন্য দেশ দেখার আগে ইন্ডিয়া দেখবে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত আগে না দেখলে ওর অন্য দেশ দেখার আনন্দ থাকবেনা। ভারতের অনেক জায়গা ঘুরে দেখা হলে ও নেপাল-ভুটান দেখবে। এমন চিন্তা কেন ওকে আপ্লূত করেছে বাবা-মা তা বুঝতে পারেনা। কোথাও যাওয়ার জন্য বাবা বাধা দিলে কেঁদে বুক ভাসায়। চিৎকার করে বলে যাব, যাব। তোমরা বাঁধা দাও কেন? তোমাদের কয় টাকাই বা খরচ হয়? বাবার হাতে তো অনেক টাকা দেখতে পাই। 

বাবা ধমক দিয়ে বলে, বড় হয়ে নে তারপর  যাবি। তোর কি কোথাও হারিয়ে যাওয়ার ভয় নাই? দুষ্টু মেয়ে হয়েছিস একটা। 

- আমাকে বকা দিও না বাবা। নিজের দেশকে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছার মধ্যে কোনো দুষ্টুমী নাই। 
- হয়েছে, বুঝেছি। আমাকে বুঝাতে হবে না। বলেছি, বড় হয়ে নে তারপর ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করবি। 
- বাবা, আমি বড় হয়ে চাকরি পেলে তোমাকে আর বিরক্ত করব না। নিজের মতো করে কোথাও যাওয়া গোছাব। মাকেও জ্বালাতন করবনা। আমার কথা শুনলে মা আর কথা বলে না।
- ঠিকই করে। তোকে ধমকালে তোর মায়ের মনও খারাপ হয়। তার মনের দুঃখের কথা আমাকে বলে। 
- ভালোই তো করে দুঃখ ভাগাভাগি হয়ে যায়। আমি ঠিক করেছি মাকে আর জ্বালাবনা। 
- হয়েছে থাম। আর কথা বাড়াসনা।
ওকে ধমক দিয়ে আতিকুর রহমান নিজের ঘরে চলে যায়।     

আশিকা নিজের ঘরের চেয়ারে বসে প্রবলভাবে নিজের মাথা ঝাঁকায়। ডানে-বামে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিজেকে অস্থির করে তোলে। একসময় ঝাঁকুনি থামায়। ভাবে, এত অল্পে অস্থির হলে চলবে কেন? বাবা-মাতো এটুকু শাসন করতেই পারে এবং করবেই। বরঞ্চ নিজেকে নিজেরও শাসন দরকার। পরক্ষণে নিজেকেই বলে, পদে পদে পরাজয় বেঁচে থাকার সত্য কলুষিত করে। এই কলুষিত জীবনযাপন করে ও বেঁচে থাকবে না। এমন একটি প্রতিজ্ঞায় আলোড়িত হয় ও। এসব চিন্তার পাহাড়ে মনের জোর গুঁজে রেখে নিজেকে শক্ত রাখে আশিকা। এমন ভাবনার পেছনে যে কাজটি ওর আনন্দের সেটি হলো সুযোগ বুঝে নতুন জায়গা ঘুরে দেখার আনন্দ। বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন সবাই বলে, ওর পায়ের নিচে সর্ষে। তবে সমস্যা একটাই, ও মেয়ে। হা-হা হাসিতে ভরিয়ে তোলে ঘর। হাসির উচ্ছাসে নিজেকে নিজের জায়গায় শক্ত পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখার যুক্তি খোঁজে ও। যুক্তি পেয়েও যায়। জোরে জোরে বলে, মেয়ে হয়ে জন্মানো ভালোবাসার সৌরভ। মেয়ে ছাড়া মানবশিশুর জন্ম দেবে কে? সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে কে? আমরা যদি শিশুদেরকে জন্মের পরে শ্বাস বন্ধ করে দেই তাহলে মানবজাতির কি হবে? তখন খেলাটা জমবে বেশ। রঙিন ঘুড়ি শূন্যের মাঝে বাতাসে উড়বে। নাটাই ধরার কেউ থাকবে না। তারপর একদিন পৃথিবীর খেলাঘর থেকে উড়ে যাবে ছাই। ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের শূন্য মাঠের ছাই। 

এমন কথা শুনলে মঞ্জুরি চেঁচিয়ে বলবে, খেলো যুক্তি দেখাস না। এটা কোনো কাজের যুক্তি না। 

হা-হা-হা পৃথিবীর মানুষ কাজের যুক্তি চায়। বোঝে না যে এটাই মূল যুক্তি। মেয়েদেরকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হবে - এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। 

দল বেঁধে কোথাও যাওয়া আনন্দের উৎসব। একা একা ঘুরে বেড়ানো উৎসব হয় না। তখন বিচ্ছিন্ন জীবনের আর্তনাদ ধ্বনিত হয় বুকের ভেতর। ভালোলাগার আনন্দ নষ্ট হয়। সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া বুনোপাখিও আনন্দের জোয়ারে ভাসায়না। সেজন্য আশিকা কোথাও একা যাওয়ার প্রোগ্রাম মেনে নেয়না। গাছের নিচে চুপ করে বসে থাকলে বুকের ভেতরটা জমাট হয়ে যায়। পাথরের স্তর যেন, যে স্তর ভেঙে এগোনো কঠিন। সেজন্য দলের দায় কখনো ওকে বেশি টানতে হয়। এই টানাটাকে ও নিয়মের মাঝে নিয়েছে। মন খারাপ করে না। টাকা জমায় বছর জুড়ে। টের পায় যে এতেও আনন্দ আছে। এর মাঝে নিজের ইচ্ছা পূরণ হয়। ইচ্ছাপুরণতো স্বপ্নের  মতো। আশিকা এমন ভাবনার সঙ্গে হাততালি বাজায়। দুহাতে গাল চেপে ধরে। কপালে হাত বুলোয়। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে নিজেকে বলে, ইচ্ছা তুমি ঘুমিও না। জেগে থাক। আমরা হাত ধরে হেঁটে যাব দামতুয়া ঝর্ণার কাছে। সেখানে পাথরের ওপর বসে থেকে জলের স্রোত দেখব। দূরের পাহাড় দেখব। নীল আকাশকে বলব, আকাশ আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাক। পেঁজো তুলোর মতো মেঘ পাঠিও আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আকাশ তোমাকে আমি বন্ধু মনে করি। তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার সামনে নানা ছবি ভেসে ওঠে। সেই ছবি ধরে আমি মনের ডানায় উড়তে পারি।  

ভাবনার মাঝে ঘুম আসে আশিকার। ও গভীর ঘুমে ডুবে যায়। সূর্য ওঠার আগে ওর ঘুম ভাঙে না। ঘুম ভাঙে বেলা ওঠার বেশ পরে। হামিদা বানু দুবার এসে দেখে গেছে আশিকাকে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে ডাকেনি। খেয়াল করেছে ওর চেহারায় আনন্দের জ্বলজ্বলে আভা লেপ্টে আছে। হামিদা বানু বুঝে যায় যে, মেয়েটি কোথাও যাওয়ার জন্য স্থান বাছাই করেছে সেজন্য এমন খুশিতে ভরে আছে ও। মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখার এটাই আনন্দ। অনায়াসে বোঝা যায় ওর মনের ছবি। হামিদা বানু আশিকার মনের ছবি দেখে নিজেকে আপ্লুত করে। ভাবে, মেয়ের আনন্দ নিজের মধ্যে নিয়ে দিন কাটানো এক ভিন্ন ধরণের আনন্দ। নিজে ঘুরতে না গেলে কিছু যায় আসে না। মেয়ের চেহারায় ফুটে ওঠা খুশির আভা তাকে বাইরে ঘোরার আনন্দে ভরিয়ে তোলে। হামিদা বানু আশিকার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। 

নাস্তার টেবিলে হামিদা বানু সরাসরি জিজ্ঞেস করে, কি রে কোথায় যাবি বলে ঠিক করেছিস?
- ঠিক করেছি? তোমাকেতো বলিনি। তুমি কি করে জানলে? 
- তোর চেহারা দেখে। জায়গা ঠিক করলে তোর চেহারা সে ছবি ফুটিয়ে তোলে। 
- বাব্বা। মাগো তুমি দেখছি -
- হয়েছে, হয়েছে থাম। মাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। 
- তুমিতো আমাকে দেখতেই থাক। কতকিছু দেখতে পাও আমার মধ্যে। নিজের চেহারায় আমি নিজেও এতকিছু দেখতে পাই না। 
- নিজের চেহারাতো আয়নায় দেখতে হয়। আয়নায় সবসময় সবটুকু ধরা পড়ে না। আর ধরা পড়লেও নিজের চোখে সেটা দেখা যায়না। অন্যরা দেখতে পায়।  
- মাগো, তুমি আমার সামনে একজন দার্শনিক। শুধু স্কুল-শিক্ষক না। তোমার দেখার ভিন্ন চোখ আছে।  এখন থেকে আমি তোমার ছাত্রী হব। 
- নতুন করে কি ছাত্রী হবি? ছোটবেলা থেকে কতকিছু তোকে শেখালাম। 
- হ্যাঁ ঠিক। তোমার কাছে শিখতে শিখতেইতো বড় হলাম। এখন যেসব শিখি তা সব পানসে। রুটিরুজির শিক্ষা। 
- হয়েছে থাম, থাম। একথা শুনলে মন খারাপ হবে। আমার ক্লাশের ছেলেমেয়েরাও বলবে, আমার কাছে যা শিখছে তা সব পানসে। এমন কথা আর একদিনও বলবি না। শিক্ষকদের অপমান করা হবে।  
- মাফ করে দাও মাগো, আর কখনো বলব না। এখন বুঝতে পারছি অনেককিছু না বুঝে বলা হয়ে যায়।  
- থাক এসব কথা। ফ্রিজে দই আছে। দেব তোকে? 
- না, মা এখন খাব না। বিকেলে খাব। আব্বা অফিসে গেছেন? 
- হ্যাঁ, বেরিয়ে গেছে। তুইতো জানিস তোর বাবা ঠিক সময়ে বের হতে না পারলে অস্থির হয়ে যায়।
- হ্যাঁ, জানি সময়ের নিয়ম বাবা খুব মানে।    
- তুই ইউনিভার্সিটিতে যাবি না? 
- যাব। এখনই রেডি হব। 
- ক্লাশ মিস হবে? 
- না, মা ক্লাশ মিস হবে না। 
- তুই কোথায় ঘুরতে যাবি? ঠিক করেছিস বুঝেছি। জায়গাটা কোথায়?
- বান্দরবনের আলীকদম উপজেলায় যাব। ওখানে একটি চমৎকার ঝর্ণা আছে। ওটার নাম দামতুয়া ঝর্ণা। প্রকৃতির নয়ন ভোলানো দৃশ্য মুগ্ধ করবে আমাদেরকে। মাগো তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
- না রে মা, আমার যাওয়া হবে না। স্কুল থেকে ছুটি পাব না। তোরতো দলবল আছে। 
- হ্যাঁ, তা আছে। আজ ওদের সঙ্গে বসব। যাই গোসল করে নেই। 

খাবার টেবিল ছেড়ে একছুটে নিজের ঘরে যায়। বাথরুমে ঢুকে সাওয়ার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামতুয়া ঝর্ণার অনুভব ওকে আপ্লুত করে। মনে হয় এই সকালবেলা সাওয়ারের ঝরে পড়া পানি ওকে দামতুয়া ঝর্ণার ছোঁয়া দিচ্ছে, তবে প্রকৃতির অনুভবের মাত্রা দিতে পারে না। নেট থেকে এই ঝর্ণার দারুন ছবি বের করেছিল ও। ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে গুনগুন করেছিল। একটু আগে নিজেকে শাসন করেছে। এমন নানামুখী অনুভব ওকে বিভিন্ন পথে হাঁটায়। এখন গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়া পানির স্রোত ওর দেখা দামতুয়া ঝর্ণার অবিকল ছবি হয়ে বাথমরুমের ছোট পরিসর বিশাল করে তোলে। চারদিকের দেয়াল ওর সামনে পাহাড়ের ছবি হলে ভেনটিলেটারটা ঝর্ণা যেন। মাথার ওপর থেকে পানি পায়ের নিচে গড়িয়ে এলে সেটা সমুদ্র হয়ে যায়। আমি সমুদ্র ভালোবাসি মা। কতবারতো কক্সবাজার গিয়েছি। সমুদ্রে পা ডুবিয়ে বসে থেকেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। আমিতো প্রকৃতির কন্যা। প্রকৃতির ভেতর থেকে উঠে আসা দিনের সঙ্গী হতে চাই। একই সঙ্গে পাব আদিবাসী মুরং জনগোষ্ঠীকে। ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে আমার দিনগুলো পাহাড় আর বনের মতো সবুজ হয়ে যায়। সাগরের মতো নীল হয়ে যায়। ঝর্ণার মতো শুভ্র হয়ে থাকে। পাখির মতো উড়ে যায় আকাশে। মেঘের মতো ভাসমান ফুল হয়। আমার নানা বিস্তার ঘটে মাগো। আমার বন্ধুদের দেখি প্রজাপতির মতো নিষ্পাপ সুন্দর। ওরা আমার সামনে ছেলে আর মেয়ে থাকে না - ওর শুধুই আনন্দ হয়। সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ে পা দাপায়। পায়ের নিচে জমে থাকা পানি থেকে ছপছপ শব্দ হয়, যেন ও কোনো এক খালের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পায়ে ছলকাচ্ছে পানি। পানির শব্দ ঝর্ণার গড়িয়ে পড়া স্রোতের মতো দুকান ভরিয়ে দিচ্ছে। মনের আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে নিজেকে উম্মাতাল হতে দেখার অনুভব ওকে ভরিয়ে রাখে। ওই ঝর্ণার আশেপাশে থাকে মুরংরা। ওদের ভাষায় দাম শব্দের মানে মাছ আর তুয়া শব্দের মানে বাস করার শেষ জায়গা। মুরং নারীদের আমি ঝর্ণাধারা বলব। ওখানে গেলে ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে। আর আমার বয়সী যারা থাকবে তারা হবে ঝর্ণার গান।  কীভাবে পারবে? এমন ভাবনাওতো বোকামি। ঝর্ণা পাহাড়ি বনভূমির সোনালি উৎস। আহারে কি আনন্দ! আশিকা আনন্দে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে দুচার লাফ দেয়। মাথা ঘাড়ের পেছনে হেলিয়ে মুখ জুড়ে পানির ছোঁয়া লাগায়, কিন্তু তাতে প্রাকৃতিক ঝর্ণার ছোঁয়াটি কোনোভাবে অনুভবে আসেনা। পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে বলে, এসব আমার পাগলামি। নিজের সঙ্গে পাগলামি করছি। হাত বাড়িয়ে সাওয়ার বন্ধ করে। আবার খুলে দেয়।   

বাথরুমের আয়নার সামনে ভেজো চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ওর ভেতরে নানামুখী চিন্তা ছড়াতে থাকে। ভাবে, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে ভালোবাসা গড়ে তোলা আমার জীবনদর্শন হবে। জীবনভর এই দর্শন অনুযায়ী কাজ করব। পাঁচ বছর আগে কুয়াকাটায় গিয়ে দেখেছিলাম ওখানকার সমুদ্র সৈকত সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়নি। এই পাঁচ বছরে হয়তো কিছু পরিবর্তন হতে পারে। যদি না হয় তাহলে পটুয়াখালির জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করব। এই সমুদ্র সৈকত সুন্দর করার জন্য পাঁচশ জনের স্বাক্ষর নিয়ে একটি দরখাস্ত নিয়ে যাব।  

আমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করব। ওদের শিশুদের মাতৃভাষা শেখানোর জন্য ছোট ছোট স্কুল করতে হবে। ওদের মাতৃভাষা যেন বিলুপ্ত না হয়। যেখানে গেলে যে কাজ হবে সেখানে গিয়ে চেষ্টা করব। তার আগে সরকারি চাকরিতে ঢুকব। পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে, বেশি বেশি ভাবছিস আশিকা। নিজেই নিজেকে উত্তর দেয়, নারে আশিকা, বেশি বেশি ভাবছিনা। এটা আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। যেখানেই চাকরি করিনা কেন, পাশাপাশি এসব করব।

আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের চেহারা দেখে। চুল আঁচড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিজের চেহারায় কিছু খুঁজে না পেয়ে দরজা খোলে। প্রায় দুই ঘন্টা বাথরুমে কেটে গেল।  

হা-হা করে হেসে ওঠে আশিকা। হাসতে হাসতে সাওয়ার বন্ধ করে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে জামা পরে বের হলে দেখতে পায় বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মা। 

হামিদ বানু ভুরু কুঁচকে বলে, এতক্ষণ লাগিয়েছিস কেন গোসল করতে? ভিজেভুজে একসার করেছিস? ঠান্ডা লাগলে-

- কিছু হবে না মাগো। আমি সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার শব্দ শুনছিলাম। মুরং মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা ভাবছিলাম। সাওয়ার আমার কাছে ঝর্ণার মতো লাগছিল। ভিজতে ভিজতে অনেক মজা করেছি। 
- পাগলামি করার আর জায়গা পাস না, না? 
- মাগো মানুষের পাগলামিও থাকতে হয়। পড়ালেখার চাপ থেকে ছুটি পাওয়া যায় পাগলামি দিয়ে। 
- কত কি যে তুই ভাবতে পারিস আমার মেয়ে- 
- ভেবেই জীবন উড়িয়ে দেব। মাগো আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। 
- উড়িয়ে দিবি? উড়িয়ে দেয়ার মানে কি? 
- আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না মা। ওটা আমার চিন্তায় থাকুক। 
- ঠিক আছে থাকুক। কিন্তু আমার মরার আগে জীবন উড়াবি না। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবনা।
- এমন কথা বলোনা মাগো।
- তুই বলতে পারলে আমি পারবনা কেন? তুইও আমার সামনে এমন করে আর কথা বলবিনা। 
- হ্যাঁ, মা, একদমই বলবনা। যে কথায় তুমি দুঃখ পাবে , সেকথা কেন বলব আমি। 
হামিদা বানু এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, কখন বের হবি? 
- এক্ষুনি মাগো। যাই রেডি হই। 
- রেডি হওয়ার সময় আবার ঝর্ণা মাথায় ঢুকবে না তো? 
হা-হা করে হাসতে হাসতে আবার আশিকা বলে, ওটাতো মাথায় ঢুকেই আছে। তবে হাতে সময় কম। সেজন্য ঝর্ণার পানিতে ডুবব না। ঝর্ণার পানি ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে যাবে। একদিন তোমাকে নিয়ে যাব পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে। দুজনে একসঙ্গে ভিজব। তোমাকে আমি জড়িয়ে ধরে রাখব মাগো। 

- তোর বাবাকে নিবি না? 
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবাকেও নেব। ইস কেন যে বাবার কথা বললাম না। বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবকে যাবার কথা বলব। তুমি একটুও মন খারাপ করবে না। 

মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আশিকা। জানালার পর্দা টেনে কাপড় বদলায়। গুনগুন শব্দে গানের বানী ছড়ায়। মাঝে মাঝে কন্ঠস্বর উঁচু করে, যেন বাইরে থেকে মা শুনতে পায়। মায়ের একটি প্রিয় গান - ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে - নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে - জাগ্রত করো - উদ্যত করো - নির্ভয় করো হে - মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।’

এই কয় লাইন গাইতে গাইতে শাড়ি পরা হয়ে যায়। ভাবে দরজা খুলে দিলে মা গানের পরের বাণী সরাসরি শুনতে পাবে। ও চলে গেলে মা একা হয়ে যাবে। এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ওর পরে দুটো ছেলে হয়েছিল। দুজনই জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। তাপর আর সন্তানের কথা ভাবেনি। স্কুলের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। আশিকার কখনো মনে হয় মায়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক বন্ধুত্বের। মা ওর প্রাণের বন্ধু। মায়ের সঙ্গে যে কোনো বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া যায়। গান গাইতে গাইতে আর একটু সময় যায়- ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ - সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ - চরণপদ্মে মম চিত্ত নিস্পন্দিত করো হে - নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে।’  

 শেষ পংক্তি গাইতে গাইতে আশিকা দ্রুত বেরিয়ে আসে। দেখতে পায় মা ডাইনিং রুমের জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সরাসরি ওর ঘরের দরজার ওপর। মায়ের আজকে কি হয়েছে? কেন ওকে নিয়ে মায়ের এমন ব্যাকুলতা? দুটো সন্তান হারিয়েছে বলে একমাত্র জীবিত সন্তানের হৃৎপিন্ডের টুনটুন ধ্বনি আজ বোধহয় তাকে ছন্নছাড়া করে ফেলেছে!

 মেয়েকে দরজা খুলতে দেখে এগিয়ে আসে হামিদা বানু। মাথায় হাত রেখে বলে, এমন সুন্দর গানটি ঠিকমতো শুনতে পাইনি। তুই কখন ফিরবি? বাইরে বেশি সময় না কাটিয়ে তুই আমাকে সময় দিবি মা রে।
- আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরব। আমি ফিরে এসে তোমাকে আর বাবাকে গান শোনাব মা।  
- তোর বাবা বলেছে আজকে আমাদেরকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবে। তুই যে রেস্তোঁরায় যেতে চাইবি সেখানে যাবে।
- হুররে - হুররে - মজা হবে। আমি বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব। আমি চাইনিজ রেস্তোঁরায় যাব।  
- দেরি করিস না মা। তাড়াতাড়ি আসিস।  
- তোমার আজকে কি হয়েছে মা? তোমার মন খারাপ কেন? 
- তুইতো জানিস মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। মরে যাওয়া ছেলে দুটোর চেহারা আমার সামনে আটকে থাকে। ওরা আমাকে বলে, মাগো আমাদেরকে দুধভাত দাও। খিদে লেগেছে।
- আজকে তেমন লাগছে? 
- হ্যাঁ, লাগছে। কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না। 
- তাহলে আমি বাসায় থাকব?
- না, না তুই যা। তোর ক্লাশ আছে না। আর আমার এমন লাগলে আমি তো কারো সঙ্গে কথা বলি না। আমার একা থাকাটাই জরুরি হয়। আমি নিজের ভেতর থেকে কথা খুঁজে বের করি। 
- মাগো, তাহলে আমি এখন যাই? 
- যা মা। তাড়াতাড়ি যা। তোর দেরি হয়ে গেল নাকি? 
- বেরিয়ে একটা রিক্সা পেয়ে গেলে আর দেরি হবে না। যাচ্ছি। 

দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আশিকা। বাড়ির সামনেই রিক্সা পায়। অল্প সময়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে আসে। মনে মনে ভাবে, কপাল ভালো যে ট্রাফিক জ্যাম নেই। মনিরুজ্জামান স্যারের ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে টিএসসির মাঠে বসে পড়ে আশিকা। গোল হয়ে বসে থাকা সবার মাঝে একগাদা বাদাম রাখে ও। বলে, বাদাম খাব আর গল্প করব। 

- গল্প কিসের, তোর প্ল্যানের কথা বল। আমিতো তোর ইমেইলে দামতুয়া ঝর্ণার বর্ননা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। কবে যাব এই অস্থিরতায় ভুগছি। 
হাসিতে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে সেঁজুতি। বেশ শব্দ করে হাসতে থাকে।  
আসিফ খেঁকিয়ে ওঠে।
- এত হাসির কি হলো সেঁজুতি? 
- খুশি, খুশি। নিজের দেশকে নতুন করে দেখার খুশি। আমিতো আশিকার মতো দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরিনি। এবারই প্রথম বাবা-মাকে ছাড়া যাচ্ছি। 
- এতদিনে তুই বড় হয়েছিস। আমরা বুঝে গেলাম যে একমাস আগেও তুই খুকী ছিলি। 
- ফাজলামি করবি না আসিফ। 
- মোটেই ফাজলামি করছি না। খুকীকে খুকী বলছি মাত্র।
- ঢং দেখানোর জায়গা পাসনা তুই। সবার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করিস। মতিগতি ঠিক রাখতে পারিসনা। মনে হয় না তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস। 
- আমি মাত্র একটা কথা বলেছি। আর তুই কতগুলো কথা বললি।  
- হয়েছে, হয়েছে তোরা থাম। বাদাম খেতে শুরু কর। তাহলে এমন কথা বন্ধ হবে। এসব কথা শুনে আমাদের মন খারাপ হচ্ছে। 

আশিকা দুহাত নেড়ে কথা বলে। ওরা ছয়জন বসে আছে। চার জন ছেলে ও দুজন মেয়ে। এবার ছয় জনের দল হয়েছে। কারো জন্য টাকা ব্যয় করতে হবে না আশিকার। দলের সবাই টাকা-পয়সায় স্বচ্ছল। সুহাস এদের মধ্যে বেশি স্বচ্ছল। এই দলের সঙ্গে এবারই ওর প্রথম যাত্রা। ওর নিজেরও উচ্ছাসের শেষ নেই। বলে, দামতুয়া ঝর্ণার পুরো খবর আমি নেট থেকে দেখে নিয়েছি। আশিকার কাছ থেকে যাবার পরিকল্পনার কথা আমার দরকার নেই। ও যে পরিকল্পনা করেছে সেজন্য ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমারও এলাকাটি দেখার আগ্রহ বেড়েছে।  
- আশিকা যে পরিকল্পনা করেছে সেটা আমাদের দরকার আছে। সবাই মিলে একসঙ্গে যাত্রার খবর মাথায় রাখব। নইলে এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে। 
- ঠিক বলেছে ইউসুফ। দলের সবাই একত্রে না থাকলে একে-ওকে খোঁজাখুঁজি শুরু হবে।

(চলমান)...   

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top