সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
১২ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৩৫

আপডেট:
১৩ জানুয়ারী ২০২১ ০৪:০৪

 

- আমরাতো যে যার মতো যাব না। সবাইকে একটাই ভাবনা মাথায় রাখতে হবে। আমাদেরকে এক জায়গায় জড়ো হতে হবে। একই সময়ে। সময়ের হেরফের করা চলবেনা।  - আশিকা এমন চুপ হয়ে আছিস কেন? 
- আমি সবার কথা শুনছি। কে কি বলে তাতো আমার জানতে হবে। তারপর নিজের কথা বলব। 
সুহাস হাসতে হাসতে বলে, আশিকার কথা শোনার আগে আমরা বাদাম শেষ করি। 
- না, দুটোই একসঙ্গে হবে। আয় বাদাম চিবাই আর কথা শুনি। 
- কথা গড়াবে ঝর্ণার মতো, ঠিক তো? 
- তাহলে আশিকা শুরু করুক। বল কি ঠিক করেছিস।
- আমরা রাতে কক্সবাজারগামী বাসে উঠব। আমাদেরকে চকরিয়ায় নামতে হবে। সেখান থেকে বাসে বা জিপ ভাড়া করে আলীকমদ যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাসে উঠলে দুই ঘন্টা লাগবে। আর যদি জিপ ভাড়া করি তাহলে আরও কম সময় লাগবে একদিকে, অন্যদিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন জায়গায় নামতে পারব। দেখাটাও দারুণ হবে। প্রকৃতির ছোঁয়া আমাদের মুগ্ধতার আবেশ বাড়াবে। আমরা প্রকৃতির রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারি। 
হা-হা করে হেসে ওঠে সবাই। 
সেঁজুতি ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, হারিয়ে গেলে ফিরে আসতে পারব আমরা? 
- ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে ফিরে আসার কথা ভাবব কেন? ঘোরাঘুরির মাত্রা বাড়ানোর জন্য হারাব। যখন মনে হবে ফেরা দরকার তখনতো ফিরতেই পারব। পথ খুঁজে ফেরা এমন কোনো কঠিন কাজ হবে না। এত অল্পে ঘাবড়ে যাস কেন? 
আশিকা মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলে। 
- দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। যেতে সাহস করিস? 
- সাহস না করলে এত কথা বলছি কেন? সাহস করেছি বলেইতো পরিকল্পনা করেছি। তোদেরকে দলে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ করেছি। দুর্গম এলাকায় একা একা যাওয়া উচিত না।  এবার আশিকার কন্ঠে রাগ ছড়ায়।
- প্রকৃতির রাজ্যে আর কি দেখব রে আশিকা? 
- মুরংদের তিনটি পাড়া পথে পড়বে। ওদের সঙ্গে কিছু গল্প হতে পারে আমাদের। 
আসিফ দুটো বাদাম দূরে ছুঁড়ে বলে, শুধু গল্প? একজন মুরং মেয়ের সঙ্গে প্রেম হবে না? 
- দেব একটা থাপ্পড় শয়তান। কেবল খারাপ চিন্তা। প্রেম করবি কেন? বিয়ে করতে পারবি? 
- বিয়ে করতে হবে কেন? প্রেমের বন্ধুত্ব হবে। 
- দুদিনের জন্য এসে এত শখ কিসের? ফাজলামি করার জায়গা পাস না। ঢাকা শহরে থেকে কীভাবে বন্ধুত্ব রাখবি? 
- এত প্রশ্ন করবি না আশিকা। আমি তোর এত প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না। 
- রেগে উঠছিস কেন? মারামারি করবি নাকি? 
- বাজে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হবে। বাধ্য না হলে বলবি না। এভাবে বললে পার পাবিনা। আজকে ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে ছাড়ব না। 
- ছাড়িস না। একদম ছাড়বিনা। নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে রাখিস।  
হা-হা-হি-হি হাসিতে ভরে যায় মাঠ। হাসির রেশ কমলে আশিকা সবার দিকে তাকিয়ে বলে, তোরা সবাই আসিফকে সার্পোট দিলি কি? ওর এত বাজে ভাবনা হলো কেন? 
আসিফ জোরেসোরে বলে, মোটেই এটা আমার বাজে ভাবনা না। আমি ফান করেছি। একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা কি সোজা কথা!
- তাহলে বললি কেন? আমি এসব কথা সহ্য করতে পারিনা। দু’একটা প্রেমের কথা বলে গায়ে হাত দিবি এটা একদম অসহনীয় ব্যাপার। 
সেঁজুতি ওর হাত ধরে বলে, তোকে ফান বুঝতে হবে আশিকা। তুইতো এমন হাবা মেয়ে না যে ফান বুঝবি না।  
- আমি সবই বুঝি। কিন্তু বাজে ফান বুঝতে চাই না। গায়ের জোরে বোঝাতে আসিস না। ফান এত সোজা কথা না, ফান বুঝতে মেধা লাগে। একটা ঢাউস মাথা থাকলে কেবল হয় না। - হয়েছে বাপু, আর কোনোদিন বলবো না। আমাদেরকে ছাত্র-ছাত্রী পেয়েছিস। শিক্ষকের মতো কথা বলছিস।  
- আমাদেরকে এখন বাদাম খেয়ে শেষ করতে দে। সুহাস হাসতে হাসতে বলে, আশিকা আমাদের সঙ্গে টিচারের মতো কথা বলছে। 
- ওতো ফার্স্ট ক্লাশ পাবে। ডিপার্টমেন্টের টিচার হয়ে যাবে। এজন্য ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক প্র্যাকটিস করছে। 
আবার হাসির তোড়ে বয়ে যায় সময়। আশিকা নিজে হাসতে পারেনা। বুঝতে পারে ওরা ওকে টিজ করছে। ও থম ধরে চুপ থাকে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়।  
হাসি থামলে আশিকা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, তোরা এভাবে আমার সিরিয়াস কথাটির অপব্যাখ্যা করলি। আমি চাইনা আমাদের বন্ধুরা ভ্রমণের আনন্দের সময় কোনো মুরং মেয়েকে বিব্রত করবে। 
মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে বলে, আশিকা ঠিক বলেছে। আমরাও চাইনা কোনো বাজে ঘটনা ঘটুক। 
- আমরাও চাইনা। আসিফ ফান করে যে কথা বলেছে সেটা আমাদের কাছে ফানই থাকবে। 
ছেলেরাও একসঙ্গে কথা বলে। 
- আমি যা ফান ভেবে বলেছিলাম দ্বিতীয় বার তা আর বলব না। আমার কথার এমন ব্যাখ্যা হবে আমি তা ভাবতেও পারি নাই। 
আসিফ প্রতিজ্ঞার মতো করেই বলে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলে, আমাদের বান্ধবীদের পাহাড়ের চ‚ড়োয় বসে প্রেম নিবেদন করতে পারলে আমার ভ্রমণের আনন্দ সার্থক হবে। আমি ধন্য হব। 
- বাব্বা, স্বপ্নের মতো কথা বললি। কিন্তু এভাবে কথা বললে তুই আমাদের হাতে মার খাবি। আমরা তোকে ছাড়বনা।  
- চল, আমরা আগে গিয়ে ঝর্ণার ধারের দাঁড়াই। তারপর নিজেদের আবেগের হিসেব কষব। আসিফ বেশ বাড়াবাড়ি করছে। 
- ঠিক আছে, তুই দিন-তারিখ ঠিক করে ফেল। কি পরিমাণ টাকা লাগবে তাও আমাদের জানা। আমরা রেডি হয়ে যাব। আমাদেরকে যেন টাকার টানাটানিতে পড়তে না হয়।  
- ঠিক আছে। জানাচ্ছি। সবাইকে মেইল করে দেব। 
- হুররে, আমাদের যাত্রা শুভ হোক। 
- শুভ হোক মন্ত্র। শুভ হোক ধ্বনি। 
- শুভ হোক কলরব। শুভ হোক মিলন। 
- ধর্মের সঙ্গে, বর্ণের সঙ্গে, নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে এক হয়ে যেতে চাই। দামতুয়া শুধু ঝর্ণা না, আমাদের প্রাণের কলকল ধ্বনি। 
- বাব্বা, আশিকার শেষ কথাটাই আমাদের চেতনার দীপশিখা। আমরা এভাবেই দেখব প্রকৃতি আর মানুষকে। 
- একই সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রকে। কেউ যেন সম্পর্কের সূত্র নষ্ট না করি। জয় হোক আশিকার। 
- হয়েছে, আর ফাটাতে হবে না। চলো বাড়ি যাই। 
রিক্সার জন্য টিএসসির সামনে এসে দাঁড়ায় আশিকা। ওর সঙ্গে অন্যরাও আছে। আশিকা রিক্সায় ওঠার আগে বলে, আমাদের যাত্রা বেশ দূর্গম পথের। পার হতে হবে চারটি পাহাড়, অনেকগুলো ছড়া, চারটি মুরং পাড়া। 
সুহাস বলে, মুরং পাড়াগুলোর নাম পেয়েছিস। পেয়ে থাকলে বল। কাগজে লিখে রাখব। যেন ভুলে না যাই। 

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top