সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের সেকাল-একাল : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২১ ২০:৪৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৯:০২

 

'ফুল ফুটুক বা না ফুটুক আজ বসন্ত'। বসন্ত  ভালোবাসে না এমন মানুষ  খুঁজে পাওয়া  দুষ্কর। বসন্তের কত রঙ--পরজ বসন্ত, হলুদ বসন্ত, বসন্ত বাহার। বসন্তকে উপভোগ করতে ও দেখতে আমাদের চলে যেতেই হবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের তিন জেলা বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম আর লালমটির দেশ বীরভূমের শান্তিনিকেতনে। ফাল্গুনমাস জুড়ে জঙ্গলমহলের জঙ্গল আর শান্তিনিকেতনে না গেলে এবং  দু-একদিন না থাকলে বসন্তের অনুভূতি পূর্ণতা পায় না বলে মনে হয়েছে। যদিও একান্তই নিজস্ব ভাবনা ও বিশ্বাস।     

কোকিলের ডাক যেমন বসন্তের আগমনী বার্তা বয়ে  আনে, তেমনি লাল পলাশের রঙিন দোলায় নির্ঘণ্ট বাজে বসন্তের উৎসবের। এই উৎসব যেন পলাশেরেই উৎসব, রঙের উৎসব, আনন্দেরও ভালবাসার রঙিন উৎসব। পলাশ মানেই লাল মাটির দেশ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, আর পলাশ মানেই শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব। করোনার প্রভাবে গত বছর  শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব বন্ধ ছিল।

এ বছর শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। কিন্তু করোনা আবহের কারণে অকাল বসন্ত উৎসব পালিত হল শান্তিনিকেতনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত সবাইকেই অখুশি করেছে। ২৭ শে মার্চের পরিবর্তে গত ১৬ মার্চ বিধি মেনে পালিত হল অকাল বসন্ত উৎসব এ-বছরে। তবুও স্হানীয় মানুষের উদ্যোগে নির্দিষ্ট দিনে বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অকাল বসন্তে বাইরের মানুষের প্রবেশ ছিল না। ফুলের রঙে শান্তিনিকেতনও এখন রঙিন সাজে সজ্জিত।  

রবীন্দ্রনাথ উৎসব ভাবনায়  ছিলেন এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্বপ্নের 'কর্ম- তীর্থভূমি শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে কবির আশীর্বাদে ও শুভেচ্ছায় বারো মাসে  পার্বণের সংখ্যা তেরোরও বেশি। তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে সব উৎসবের একটা  মৌলিক দিক হল--প্রকৃতি ও  মানুষের  অমলিন মৈত্রীর সেতু নির্মাণের আন্তরিক প্রয়াস। এক অনন্য  নান্দনিক  পরিমণ্ডলে শান্তিনিকেতনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল কবিগুরুর হাতধরে। কবি ১৯০১ সালে  মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থীদের নিয়ে  এক বৈদিক অনুষ্ঠানের  মধ্য দিয়েই  শান্তিনিকেতনে ব্রক্ষচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

শান্তিনিকেতনের আশ্রমে  বিদ্যাচর্চার  যে সৃজন কল্পনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন তার তুলনা বিশ্বের আর কোথাও  ছিল না বলে মনে হয়। বিদ্যাচর্চার মধ্যে আরও একটা বড়ো দিক ছিল আশ্রমে আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী-কর্মী-শিক্ষক ও সাধারণ ভাবে আশ্রমিকদের চিন্তা-ভাবনা, নান্দনিক ভাবনা ও মানবিক চেতনাকে জাগ্রত করে তোলা। এসব নিয়ে  কবি স্বপ্ন দেখতেন।  আশ্রম-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার কিছুদিন পর  থেকেই  ঋতু  উৎসব প্রবর্তিত হতে  লাগল। এই সব ঋতু উৎসবের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল--এই বিশ্ববিদ্যাতীর্থ প্রাঙ্গণে অনাবিল  আনন্দের ধারাকে প্রবাহিত করা। ক্ষণস্থায়ী রূপসী বাংলার ছয় ঋতু কবিকে আকর্ষণ করত বিশেষভাবে। বর্ষার পরেই তাঁর প্রিয়  ঋতু ছিল বসন্ত। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব কবির নিজস্ব ভাবনা ও পরিকল্পনা  প্রসূত। কবির দৃষ্টিতে  ঋতুরঙ্গশালায় ফাল্গুন মোহময়ী আনন্দ অনুপমা। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জগতে বসন্ত ঋতুর বাড়াবাড়ি উপস্থিতি আমাদের চোখএড়িয়ে না। বসন্তের  যে গান  --তা ফাল্গুন নবীন আনন্দ উদ্দীপ্ত করে তোলে হৃদয়কে। এই কারণেই  বসন্ত  হয়ে ওঠে  বাউল--পথভোলা এক পথিকেরই মতন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে, নাটকে, কবিতায়, প্রবন্ধ, চিঠিপত্রে  অশোক-শিমূল-পলাশ-মাধবী-রক্তকরবী-বাসন্তী- নীলমণিলতা-বনপুলক যারা বসন্তেরদূতী--এরা  আজও  অব্যাহত আসন নিয়ে আছে। তাঁর লেখা অনেক নাটকের পটভূমিকা বসন্তপূর্ণিমা। পলাশ মানেই বসন্ত। আর বসন্ত মানেই শান্তিনিকেতন। ফাল্গুন মাস মানেই বসন্তকাল। আমের মুকুলের মিষ্টি গন্ধের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই  শালবীথির চত্বর ঢেকে যায় শালের মঞ্জরীতে। এরপর পলাশ-শিমূলের আর কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরে ওঠে চারপাশ। আকাশ-বাতাস ভরে ওঠে  নানান ধরনের পাখির কূজন গীতে। পলাশ-অশোক-বাসন্তী- শিমূল-মহুয়া-শালমঞ্জরী আর কৃষ্ণচূড়ার ফুলে -বর্ণে আর উজ্জ্বলতায় স্বাগত  জানায়—'ঋতুরাজ"বসন্তকে’।  আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন--'উৎসবের শেষ বেলাকে তোমার অক্লান্ত মঞ্জরী ঐশ্বর্য দিল ভরিয়ে। নবীনের শেষ জয়ধ্বনি  তোমার বীর কন্ঠে। সেই ধ্বনি আজ আকাশকে পূর্ণ করল, বিপদের ম্লানতা দূর করে দিলে। কয়েকদিন আগে থেকেই বসন্ত ছুটে আসে শান্তিনিকেতনেরপলাশ-শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার মাথায় মাথায়। ফাল্গুন এসে যায় নানান রঙের ডালি সাজিয়ে। বনে-বনে আর নীরব খোয়াইয়ের বুকে অপার্থিব সৌন্দর্যে ফাল্গুন ছড়িয়ে পড়ে। আশ্রম চঞ্চল হয়ে ওঠে মৌমাছির গুঞ্জনে।আনন্দময় পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোকিল, দোয়েল, কাঠঠোকরা, পাপিয়া, মৌটুসিদের কুহু কুহু ভাকে আকাশ -বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।

শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের  সেকালঃ--   বসন্ত ঋতুর মধ্যেই একদিন আশ্রমে বসন্ত উৎসবের দিন আমাদের ডাক দিয়ে যায়। কখন কীভাবে কেমন করে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের শুভ সূচনা হয়েছিল সেই বর্ণময় ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করা দরকার। বসন্ত উৎসবের  সূচনা  বলতে গেলে--'ঋতু  উৎসব' হিসাবেই শুরু হয়েছিল। সময়টা ছিল ১৯০৭ সাল। এটাই  ইতিহাস। তদানীন্তন ছাত্রাবাস  'প্রাককুটির'-এর (বর্তমানে শমীন্দ্র পাঠাগার) সামনে থেকেই এই উৎসব শুরু হয়েছিল। কবি পুত্র শমীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। কালে কালে এই ঋতু উৎসব বসন্ত উৎসবে রূপ নেয়। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক- বিহীন সর্বজনীন এক মহান মিলন উৎসব--শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব। ধর্মের বেড়া ভেঙে বৈষম্য, অসাম্যের বন্ধন ছিন্ন করে কবি সবার মনের রঙে রঙ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। বসন্ত উৎসব হচ্ছে প্রকৃতির আরাধনা। শান্তিনিকেতনে খুব সম্ভবত: ১৯২৫ সালে  প্রথম বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেই বছর কবি বিদেশে পাঁচ মাস কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখন আশ্রমে ভরা বসন্ত। ছাব্বিশে ফাল্গুন বসন্ত উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। সেবার ঝড়-জলের জন্য আম্রকুঞ্জে অনুষ্ঠান হয় নি। সেকালে পুরোনো লাইব্রেরির দোতালায় কলাভবনের ঘরে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ  লিখেছিলেন--

'রুদ্রবেশে কেমন খেলা 
কালো মেঘের ভ্রুকুটি
সন্ধ্যাকাশের বক্ষ যে ওই
ব্যবধানে যায় টুটি। '

সেকালের  প্রকৃতির সঙ্গে  মানুষের সম্পর্ককে আরো নিবিড়ভাবে গড়ে তোলার জন্য 'মাস্টার মশাই' শিল্পাচার্য  নন্দলাল বসু শালবীথি আর আম্রকুঞ্জের গাছের গায়ে  নানান রঙের উত্তরীয় বেঁধে সাজিয়ে দেওয়ার এক অপূর্ব শিল্পের সূচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ  অনুষ্ঠানের মূল সুরটিকে  বেঁধেছিলেন, যাতে এর মাধুর্য কোনোরকম ভাবে বিচ্যুত  না হয়। দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষের এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কোন রকম বাধা থাকেনি। এ ব্যাপারে তাঁর গভীর নজর ছিল। প্রসঙ্গত, শান্তিনিকেতনের আশেপাশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ, সেই সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন বসন্ত উৎসবে অংশ নেন আন্তরিকভাবে। সেকালের বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতির বর্ণনা দেখতে পাই প্রমথনাথ বিশী-র লেখা 'রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন' বইটিতে। তিনি  লিখেছেন--'সেবারে বসন্তোৎসব খুব ধুম করিয়া হইবে স্থির হইল। রবীন্দ্রনাথ নূতন গানের পালা লিখিয়া গানের দলকে শিখাইয়া তুলিলেন। আম্রকুঞ্জের সভাস্থল আলপনা ও আবিরে সজ্জিত  হইল, আমের ডালে ডালে বাতির ব্যবস্থা হইল, সকলে পীতবর্ণের ধুতি ও শাড়ি পরিয়া প্রস্তুতি  হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল----পূব আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠিলেই সভারম্ভ হইবে।' ১৯৩৫ সালে ২০ই মার্চ  সকালে আম্রকুঞ্জের বসন্ত উৎসব উদযাপিত  উদযাপিত হয়েছিল। 'ফাল্গুন'  নাটকের কিছু  অংশ কবি পাঠ করেছিলেন। এর আগে তিনি উৎসবের মূল কথাটি বলেন সংক্ষেপে। সেবারের বসন্ত বন্দনায় বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য ও প্রধানমন্ত্রী, রবীন্দ্র স্নেহধন্যা ইন্দিরা গান্ধী, সেদিনের আশ্রমের ছাত্রী ইন্দিরা-নেহরু  নাচের দলে যোগ দিয়েছিলেন।'

'কে দেবে গো চাঁদ  তোমার দোলা', ও  'তোমার বাস কোথা যে পথিক ওগো'এই দুটি  গানের সঙ্গে ইন্দিরা- নেহরু সমবেত নাচের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। পরের বছর ১৯৩৫ সালের ৮ই মার্চ  সারা আশ্রম জুড়ে  উৎসবের আসন পাতা  হয়ে আছে। উৎসবের  দিনেই সকালেই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য জওহরলাল নেহরু-র পত্নী কমলা  নেহরুর মৃত্যু  সংবাদ এসে পৌঁছয়। এইদিন মন্দিরের উপাসনায় কমলা  নেহরুর স্মরণে  রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন--'এই উৎসবের সঙ্গে আমাদের দেশের নবজীবনের উৎসবের মিলিয়ে  দেখতে চাই। আজ অনুভব করব---- নির্মম শীতের দিন শেষ হল,এল নবযুগের ঋতুরাজ জওহরলাল। আর আছেন বসন্তলক্ষী কমলা তাঁর  সঙ্গে অদৃশ্য সত্তায় সম্মিলিত।' 

পুঁথি-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পঞ্চানন মণ্ডল লিখেছেন '১৯৩৭ সালে, ১৩ই ফাল্গুন (১৩৪৩) মাঘীপূর্ণিমা তিথিতেই আশ্রমে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় গৌরপ্রাঙ্গণে সেবার সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান হয়। সেই বছরই ২৬শে মার্চ (১২ই চৈত্র) দোলপূর্ণিমার দিনে দ্বিতীয়বার বসন্ত উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। এখনকার মতন তখনও বৈতালিক দল 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'গানটি গেয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণ  করে। ডঃ  পঞ্চানন মণ্ডল আরও  লিখেছেন--'সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীভবন হইতে আশ্রমিকদের নৃত্য ও সংগীত  সহযোগে শোভাযাত্রা আসিল মঙ্গলঘট লইয়া আম্রকুঞ্জ পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ বসিয়া আছেন বটবৃক্ষমূলের ঘন্টাতলায়। --ছোট মেয়েরা আবিরে গুরুদেবের পা রাঙা করিয়া দিয়াছে। ----রবীন্দ্রনাথের বসন্ত  সংগীতের পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটল।'

আজ থেকে একাশি বছর আগে ১৯৪০ সালের ২৭শে মার্চ রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতন বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন। সেবারে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিংহ 

সদনে।এর পরের বছর, ১৯৪১সালে অসুস্থতার কারণে কবি বসন্ত উৎসবে উপস্থিত থাকতে পারেননি। সেবারের বসন্ত উৎসবের দিনে কবি লিখেছিলেন--

'আর বার এল উৎসবের দিন 
বসন্তের অজস্র সম্মান
রুদ্ধকক্ষে দূরে আছি আমি--
এ বৎসর বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ। '  

উৎসবের আগের রাতে গৌরপ্রাঙ্গণ থেকে 'ও আমার চাঁদের আলো' গানের সঙ্গে শালবীথিতে পথ ধরে এগিয়ে চলে বৈতালিকে সূচনা হয় বসন্ত বন্দনার--'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে' গান দিয়ে। শান্তিনিকেতনে বসন্ত বরণ-- যার শুরু 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, স্হলে জলে বনতলে লাগল যে দোল' আর অনুষ্ঠানের শেষ--

'রাঙিয়ে দিয়ে যাও  যাও যাও গো এবার যাবার আগে '-- এই সমবেত গান দিয়ে। সকালে এক স্নিগ্ধ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বসন্তের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দেওয়া হয়  বৈদিক মন্ত্র, গানে, পাঠে, নাচে, কবিতায়। 'যা দিল কালোধলো'----এই গান শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় বর্ণময় আবির- খেলা। নীল দিগন্তে আঁচল পেতে বর্ণময় বসুন্ধরা। শান্তিনিকেতনের রঙখেলা আজও শুধুমাত্র আবিরেই  সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অনাবিল আনন্দের কোন ঘাটতি  থাকে না। এটাই বিশেষত্ব। শান্তিনিকেতনের আঙিনায় বেশ কয়েক বার উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম। এটাই আমার  জীবনের সৌভাগ্য। নব্বইয়ের দশকে প্রথমে সেই মুগ্ধতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সে-এক আনন্দময় বিরল অভিজ্ঞতা। আশ্রমিক পরিবেশে  এক নান্দনিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলাম। শুধু সবুজের সমারোহে  দাঁড়িয়ে মুগ্ধতার আবেশে আচ্ছন্ন  হয়ে পরেছিলাম। পৃথিবীর আর কোথাও এই  ধরণের বসন্ত উৎসবের আয়োজন  সম্ভবত  হয় না। এই ধরণের আশ্রমিক পরিবেশ সৃষ্টি  হয়নি আজও  কোথাও। এমন নান্দনিক স্নিগ্ধতার পরশ বিশ্বে বিরল। পৃথিবীর আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এই ধরণের আশ্রমিক পরিবেশে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় না বলে মনে হয়। ঐতিহ্যবাহী এই বসন্ত উৎসবের আবেদন সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এক আকাশ অহংকার। শান্তিনিকেতনের আঙিনায় যেভাবে সাজানো হয় তা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। অসাধারণ শিল্পকর্ম দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিনিকেতনকে সাজিয়ে তোলেন। দেখলে মনে হয় এক স্বপ্নিল  সবুজ  পৃথিবীর দিকে সমগ্র বিশ্ববাসী সহ বাঙালি জাতি অবাক  দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। বিভিন্ন বর্ণময় শিল্প সুষমা সম্পন্ন আলপনা মনকে মুগ্ধ করবেই। কলাভবনের ছাত্র ছাত্রীদের সৃষ্টিকর্ম অমলিন হয়ে থাকবে। বিশেষ করে বর্ণিল আলপনা। বড় প্রাপ্তি বসন্ত উৎসবের শোভাযাত্রা অনন্য মনভরানো দৃশ্য, কোন দিন ভোলার নয়। কল্পিদার পাঞ্জাবি, কোচাদোলানো ধুতি আর বাটিকের চাদর গলায় ঝুলিয়ে -- এই বিশিষ্ট পোশাকে বসন্ত উৎসবের বিশাল নৃত্যশোভাযাত্রা এককথায় মনোমুগ্ধকর। এক সময় ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানিয়ে গান গাইতেন বহু  বরেণ্য শিল্পীরা। শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা  সেন সহ আরো অনেকেই। বসন্ত উৎসবের বেশ কিছু রীতি নিয়ম আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল। আম্রকুঞ্জে বসন্ত উৎসব শেষ হয়ে গেলে, অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের কপালে আবিরের  টিপ পরিয়ে দেয়। বয়সে যারা ছোট তারা  বড়োদের  প্রণাম করে। বড়োরা  বুকভরা  আশীর্বাদ জানায়। এই সব দৃশ্য  মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।  বাউল গানের আসর আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল। 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে' গান গাইতে গাইতে আশ্রমের প্রতিটি বাড়ির  দরজায়  দরজায় পলাশ আর আবির রাখার চল আবহমান কাল থেকে  চলে আসছে।  আসলে  সকলকেই  উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর বিশেষ রীতি।  আজকের  আধুনিক যুগে সেই পরম্পরা ঐতিহ্য এইভাবেই মান্যতা পাচ্ছে । এটা আমাদের বাঙালির  সৃজনশীল সাংস্কৃতিক  সৌজন্যতার পরিচয়বাহী।  সেই সঙ্গে বাঙালির  জাতিসত্তার ও ঐতিহ্যের পরিচয়  বহন করে চলেছে।  

বসন্ত উৎসবের একালের কথা:  - রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য  নিয়ে যে বসন্ত উৎসবের সূত্রপাত হয়েছিল শান্তিনিকেতনে, বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মৌলিক ঐতিহ্য ও চরিত্র বদলে গেছে অনেক  খানি। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় । সময়ের হাত ধরে উৎসবের চরিত্রও বদলে গেছে, এটা হয়ত যুগের অনিবার্য ফসল। একে রক্ষার দায়িত্ব সকলেরই। আম্রকুঞ্জের বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান  সরে গেছে আশির দশকে। ১৯৭৯সালের কিছু  ঘটনার জন্য  এই পরিবর্তন। উৎসব প্রিয় মানুষ  এটাকেই  মেনে নিতে পারেন নি, কষ্ট পেয়েছিল। নানান ধরনের কারণেই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ  সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, বসন্ত  উৎসব আর হবে না। ১৯৮২-৮৩সালে বিশ্বভারতীর তদানীন্তন  উপাচার্য, বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ  নিমাইসাধন বসু বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী, শিক্ষক, ছাত্র- ছাত্রী, আশ্রমিক ও স্থানীয়  প্রশাসনের সঙ্গে বিশদ ভাবে ইতিবাচক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে  হারানো ঐতিহ্য ও মাধুর্য ফিরিয়ে আনার  জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা ও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে সামাজিক পরিস্থিতি ও বিশেষভাবে  নিরাপত্তার কথা ভেবেই চিরকালের উৎসবের স্হান 'আম্রকুঞ্জকে'বাদ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই উৎসবের ঐতিহ্য আর আনন্দ  অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল বলে অনেকের অভিমত । সেই  সময় থেকেই সকালে বসন্ত বন্দনা অনুষ্ঠিত হতে লাগল গৌরপ্রাঙ্গণে পুবমুখি সান বাঁধানো স্টেজে তারের জালের আবরণে। কিছু দিন পর আবার  জাগয়া বদল হল। গৌরপ্রাঙ্গণ থেকে বসন্ত উৎসবের নতুন ঠিকানা হল আশ্রম-মাঠ। প্রায় পঁচিশ বছর বাদে পুনরায় স্হান বদল হল। বছর পাঁচেক ধরে শান্তিনিকেতনের আশ্রম-মাঠে নির্মীয়মাণ স্টেজে বসন্ত উৎসব উদযাপিত হয়েছিল। বসন্ত উৎসবের ইতিহাসের কালো দিন ২০০৯ সাল। সেবার 'বসন্ত কাণ্ড'র জেরে সব উৎসব-অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে  গিয়েছিল। দেশ- বিদেশের হাজার হাজার মানুষ চরম হতাশা নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা অত্যন্ত  লজ্জার, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের পরিপন্থী। বসন্ত উৎসবের বারবার স্হান বদল বসন্ত উৎসবের চরিত্র  নষ্ট হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। বসন্ত উৎসব নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একটি  সমস্যা বড় হয়ে উঠেছে, সেটা পরিবেশ দূষণের অভিযোগ। পরপর তিন বছর বসন্ত বন্দনায় তিন লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর অভাবে আশ্রম জুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি  হচ্ছে প্রতি বছর। এর সমাধান আজও  অধরা। ভিড়ের  চাপে বহু মানুষ  অসুস্থ হচ্ছে। নানান দুর্ঘটনা ঘটেছে। যে কোন সময়ে  বড়   দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই কারণেই  বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বসন্ত উৎসবের দায়িত্ব নিতে  অস্বীকার করছেন। সেই সঙ্গে  রাজনৈতিক  অনুপ্রবেশ, এর চরিত্র বদলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ গুণিজনদের। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ,  সেই সঙ্গে  স্হানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব পুনরায় নিজস্ব ঐতিহ্য ও চরিত্র ফিরে  পেতে পারে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। গত বছর  করোনার আবহে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় নি। অত্যন্ত কষ্টের  বিষয় হলেও  মেনে নিতে  হয়েছে  উৎসব প্রিয় মানুষজনকে। এ-বছর  সমস্ত স্বাস্থ্য বিধি মেনে  হয়ত স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে  উঠবে  শান্তিনিকেতনের চির ঐতিহ্যবাহী  বসন্ত উৎসব।  কোন  কোন ক্ষেত্রে বসন্ত উৎসব তাঁর নিজস্ব  সনাতন ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য  হারাচ্ছে, এই কথাটা  সবসময় শুনতে পাই। দোলপূর্ণিমার দিনেই  হোক  বসন্ত উৎসব। সেই সঙ্গে ঐতিহ্য, পরিবেশ, ও দূষণবিধি, শৃঙ্খলা মেনে সুষ্ঠুভাবে বসন্ত উৎসব হোক--এই আর্জি  ও আবেদন আপামর দেশের জনসাধারণের।  বিশ্বের দরবারে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের আলাদা  একটা  পরিচিতি ও গরিমা আছে। তাকে  রক্ষার  নৈতিক দায়িত্ব  ও সামাজিক দায়বদ্ধতা আমাদের  সকলেরই। এটা  ভুললে চলবে না।  

 

শেষকথা :  করোনা আবহের কারণে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বসন্ত উৎসবের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছেন। পরম্পরা বজায় রাখতে অকাল বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয় ১৬-ই মার্চ। বাইরের কোন মানুষের প্রবেশ ছিল না।  বর্তমান পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়ত সঠিক। তবুও পরম দুঃখের বিষয়, এবারও শান্তিনিকেতনে  বসন্ত উৎসব সরকারীভাবে  হচ্ছে না। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের সঙ্গে গভীর ভাবে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে থাকলেও এর মূল রূপকার  ছিলেন কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সময়ের  হাত ধরে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব অনেক খানি  বদলে গেছে। উৎসবের দিনে  জনজোয়ার আছড়ে পড়ে। আশির দশক থেকে বসন্ত উৎসবে উপস্থিত দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। খুব সত্যি কথা উৎসবের পরিবেশ  আর আগের মতো নেই। প্রশাসনের উদাসীনতা খুব  দুঃখজনক। মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে অনেক খানি। আবেগে আপ্লুত হয়ে অনেকেই বসন্ত উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। এদের অনেকেই বিন্দুমাত্র রুচিশীল, সংস্কৃতিমনস্ক,  অনেকেই রবীন্দ্রানুরাগী--প্রেমী আদোও নন। কাজেই উৎসবের পরিবেশ আর আগের মতো নেই। তাই বদল তো ঘটবেই।একটি  চিরন্তন সত্য আমরা  অনেকেই জানি না, বুঝতে চাই না অধিকাংশ বাঙালির কাছেই রবীন্দ্রনাথ ও বসন্ত ঋতুর আলাদা একটা  মাহাত্ম্য আছে-চট করে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। তিনি যে ভাবে বসন্তকে  নিজের জীবনে অনুভব করেছিলেন ঠিক সেভাবেই বসন্তোৎসবকে সাজিয়েছিলেন। তাঁর  অবর্তমানে বসন্ত উৎসবের চরিত্র কিন্তু অনেকখানি পালটে গিয়েছে। বসন্ত উৎসব  আগের আম্রকুঞ্জের পরিবর্তে পৌষপ্রাঙ্গণে এখন অনুষ্ঠিত  হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি ঐতিহ্য হঠাৎ করে দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব সাফল্যে বসন্ত উৎসব মানে জনপ্লাবন। এখন হুজুগে শহুরে মানুষের ভিড়  বাড়ছে। বহিরাগত  মানুষের আনাগোনা  বেড়েছে। এদের অনেকেই বিন্দুমাত্র রুচিশীল নয়।নানান  অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়। প্রশাসনের উচিত ঘটনা গুলো  কঠোর  হাতে দমন করা। আসলে  এখন  তো সব কিছুতেই  বিশ্বায়নের একটা  দমকা হাওয়া  লেগেছে।  তাই শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের তার আঁচ পড়েছে। এ যুগের শিক্ষিত ছেলে -মেয়েরা আধুনিকমনস্ক, তাই সময়ের হাত ধরে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব বদলে  যাচ্ছে। এটা  আমরা কেউই চাই না। বসন্ত উৎসব আগে যেমন বিশ্বমিলন মেলা ছিল,  আগামী দিনে সেটাই বজায় রাখতে  হবে। বোলপুর-শান্তিনিকেতনের-বাংলা সবার ঐতিহ্য বজায় থাকুক। পরিস্থিতি--পরিবেশ যাই হোক না কেন তা মানিয়ে নিয়েই আমাদের সবাইকেই চলতে হবে। জনমানসে অক্ষয়-অমলিন হোক শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উৎসব। এই দায়িত্ব নিক আগামী প্রজন্মের তরুণ তরুণী। কারণ এটা সামাজিক দায়বদ্ধতা।  জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই  চিরস্মরণীয় গান আজো আমাদের আবিষ্ট করে বসন্ত উৎসবের  সময় "কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস/ আমি বলি আমার সর্বনাশ"। সেই সঙ্গে পরিচিত কবি গুরুর গান "খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল"। 

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক 

পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top