সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

দেয়াল ফেটেছে দেবালয়ের ও মেঘের পরে : ড. ময়ূরী মিত্র 


প্রকাশিত:
৩ মে ২০২১ ২০:০০

আপডেট:
১৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৫৩

ছবিঃ ড. ময়ূরী মিত্র 

 

 এক
 দেয়াল ফেটেছে দেবালয়ের 

বছর বারো তেরো পর্যন্ত মন্দির মানে বুঝতাম, অনেক মানুষের অনেক অনেক ভালো কাজের একটা ঘর। ঘর কিংবা বড়সড় একটা বাড়ি। আর সেই অনেক ভালোমানুষের মাঝে যে সবচেয়ে ভালো, সেই মানুষটাই মূর্তি হয়ে গেছে। মূর্তি হয়ে বসে রয়েছে ঘরের মাঝে --- আর জগতের বাকি সব ভাল লোক সামনে বসে চেয়ে আছে সে মূর্তির দিকে। 

তখন আমার কাছে সে মূর্তিমানুষ। এবং খুবই অমায়িক এক মানুষ ---যে কিনা মানুষকে দেয় সম্পদ, যশ, মান --আরো কত কী! ভালো কাজের জন্যই সেও নিয়মিত প্রাইজ পায়। আম, লিচু, লাড্ডু, পুরি, খিচুড়ি, মিঠে পোলাও, তানপুরার মত দেখতে পানতুয়া।

বেলগাছিয়ার ভাড়াবাড়ির নাকের ডগায় থাকা পরেশনাথ। ৭৮ এর বন্যায় সারা পাড়া পুকুরনদী হয়ে গেল। ভিখিরীর বাচ্চাগুলো জলে চুবে চুবেই খাবারের জন্য চিল্লাতে লাগল। বন্যায় ইজের হারিয়ে উদোম হয়ে নাচল পথের বাচ্চা। বৃষ্টি বন্ধ হয়ই না সেবার। সন্ধ্যেতে ছাদে উঠতাম। দেখতে চাইতাম পৃথিবীর সবথেকে ভালো মানুষের কার্যকলাপ। দেখতাম দেবতার রসালাপ। তখনো দ্বীপের মাঝে দীপ জ্বালিয়ে একের পর এক লাড্ডু মেরে যাচ্ছে পরেশনাথ। ঘিয়ে মজে গেছে দেবতা। মনে আছে, অনেকখানি বড় বয়স অব্দি মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পরে খাবারগুলো খুব ভালো করে লক্ষ্য করতাম। ভাবতাম কত ভালো কাজ করলে তবেই না জোটে এইসব স্বাদু খাদ্য। লোভ জাগত আমার। absolute এক ভালো কাজের লোভ।

তো শুরু করলাম ভালো কাজ। ডেকে ডেকে সবাইকে দেখাতেও লাগলাম নিজের ভালো কাজের নমুনা। পাড়ার নেড়ি খেঁকি কুত্তাদের গায়ে রুটিন মাফিক হাত বুলোনো, সমবয়সী খোকাদের বর না ভেবে ভাই পাতানো। উদ্দেশ্য পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে হব ও মূর্তি হয়ে সবার সামনে লাড্ডু পুরি খাব। একদিকে মায়ের পয়সার ঘট ভেঙে ঘাম ঝরাচ্ছি নাকে, অন্য দিকে সেই পয়সায় নেপালি বস্তির বন্ধুদের চকলেট খাওয়াচ্ছি। 

আরেকটু বড় হতেই নিজের মধ্যে এক ফুরফুরে পাপের আনন্দও জাগছে পুণ্য চাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে। কাণ্ড দেখো! সরস্বতীর পাদপদ্মে বই সাজাচ্ছি আর পাড়ার দাদাদের সাথে "কালিয়া মহব্বতের" প্ল্যান চালাচ্ছি। পছন্দের কেলোদা মুচকি হাসল একদিন। নাচতে নাচতে চুমু মেরে দিলাম নিত্যদিন ঠাকুমার সাথে গপ্প করতে আসা খোঁড়া বাসনওয়ালাকে। আমার পাপে ফুল্ল হাসি বুড়ো বাসনবিক্রেতাকে সেদিন চমকে দিয়েছিল কিনা কে জানে!    

শুধু দেখলাম ভালোর সাথে মন্দের এই দ্রবণটি টানছে বেশি আমায়। চুরির পয়সা ছাড়া দরিদ্র বন্ধুদের খাবার চকলেট খাওয়াতে ইচ্ছে হয় না। সুঠাম কিশোরের দিকে একটু চোখ না মটকালে রামায়ণ পড়তে মন চায় না। ভালমন্দের mixture জীবনে যেই মানে আনতে শুরু করল মূর্তি হওয়া হল না আমার। ইচ্ছেই মরল। এক ঝটকায় মানুষ বনে গেল ময়ূরা। 

মন্দ হয়েও আশা মরেনি ময়ূরাণীর। লোভ যায়নি একটি ভাল মানুষ খোঁজার। বন্যার জমা জল সরিয়ে যে উন্মোচন করবে একটি সুফলা শস্যখেত। খামচে মেঘ  ছড়াবে  এক কুচি চাঁদ  |

উড়বে স্বাধীন গাংফড়িং। 
পিড়িং পিড়িং।  
দেবপুরুষ। অনিন্দকান্তি। হৃদয় অনাদি
এখন দুগ্গামূরতি। পুজোয় ওড়ে লক্ষ নোট। কোটি ছোঁবে?
ভয় পাই। 
বানিয়ার পানের মেটেরঙ পিকে খরা বন্যা সমান।
ভয় পাই। 
দান হবে। ভিখারি কদিন ভোজ্য পাবে। 
ভয় পাই। 
ভালো মানুষের ঘর ভেঙেছে। 
খোলামকুচি!
পা কাটছে!  
ভয় পাই…। 

পুনঃ পুনশ্চ: খুঁজি দয়ার সাগরের জন্মতিথি – বিদ্যাসাগর। আজ বাদে কাল ---যদি আসে সে সজল মানব।

 

দুইঃ
মেঘের পরে 

আমার দেশটার আকাশে কালো মেঘ জমে কি আজকাল? একদম কুচুং কুচ কালি কালো? ছেলেবেলায় এরম মেঘ হলে ভাবতাম --- মেঘ বুঝি দৈত্য দানো হয়ে গ্যাছে! এবার বুঝি সে মেরে দেবে ফর্সা নীল ঈশ্বরমেঘগুলোকে। তখন কালো সাদা বা মন্দ ভালোকে বোঝাবার দুটি মাত্রই শব্দ ছিল আমার মগজে। দানো বা ঈশ্বর। সেই সূত্রে কালো মেঘ দানো মেঘ আর নীল আকাশের তুলো মেঘ হলো ঈশ্বরমেঘ।

মা ঠাকুমার মুখে সর্বক্ষণ তোশক বালিশ শুনে শুনে ঈশ্বরমেঘের একটা দুনম্বর নাম বের করে ফেলেছিলাম আমি। তুলোতোশক মেঘ। খুব ইচ্ছে করত তুলোতোশক মেঘগুলোকে বাঁচিয়ে দি। বাঁচিয়ে রাখি বরাবরের মতো। যেমন করে জলে বাতাসে পুরুষ্টু হয় গাছ। আর দৈত্য মেঘগুলোকে ফটাফট মেরে দি। জন্মের মতো সরিয়ে দি আকাশের দুনিয়া থেকে। মেঘ খুনের এক আজব কল্পনা বিস্তৃত হত তখন। 

মনে আছে ---- এইরকম ভাবাভাবির সময়ে বাবা এনে দিয়েছিলেন একটু দম দেয়া কলের রেলগাড়ি। তখনো অব্দি কলের উড়োজাহাজ বেরোয়নি কলকাতা শহরে। অন্তত আমার স্মৃতিতে নেই। তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম, যেভাবেই হোক ট্রেনটিকেই ওড়াতে হবে আকাশের রাস্তায় রাস্তায়। তখন থেকে আজ --আকাশ আমার আরেক পৃথিবী। 

সারাদিন ধরে কলের রেল মেঝেতে ঘুরত বনবন। ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁফিয়ে যেতাম! সমতল থেকে কখন রেল উঠবে চেয়ারে। চেয়ার থেকে জানলায়। আর জানলা সে গাড়িকে ছুঁড়ে দেবে একদম আকাশে। সেই উড়ন্ত ট্রেনের কামরা থেকেই রাশি রাশি শস্ত্র ছোটাব আমি। নিকেশ করবো বদমাশ মেঘেগুলোকে! পাপখুনের পর বড় আনন্দে ঈশ্বরমেঘের দল জাপটে ধরবে আমায়। মেঘঈশ্বরের বুকের মাঝে নিপিস হয়ে থাকব আমি!

রেল আজো ওড়েনি। মাটির ওপর লেটকে থেকে গেছে আমার খতমযন্ত্র! বততমিজরা গিলছে দেশ! ম্লান বসে ঈশ্বরমেঘ! ওড়েও না। নড়েও না!  বিকল! হান্ড্রেড পার্সেন্ট!

কাঁদি। 
কাঁদার পর ভালো ঘুম আসে। 
শুদ্ধি অসমাপ্ত থেকে যায়। 
মেঘের যুদ্ধে ঈশ্বর কি হারে গো? 
বলো না বাবা। 

ড. ময়ূরী মিত্র 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top