সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

তোমার চুলের বর্ণনায় কাটাতে পারি তামাম জীবন : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
৩ মে ২০২১ ২১:১৩

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ১৭:৫৪

 

শাঁখা শাড়ি কেশ / তিন নারীর বেশ--- শুধু বাংলায় নয়, চুল নিয়ে এ রকম কত প্রবাদ যে গোটা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। চিরায়িত সাহিত্যে তো বটেই, চুল নিয়ে অজস্র কাহিনি আছে প্রচলিত গল্পগাছায়, লোককথায়, এমনকী রূপকথাতেও।

এক বিদেশি রূপকথায় পড়েছিলাম--- র‌্যাপুনজেল নামে এক মেয়ে ছিল। তার ছিল চোখ ধাঁধানো লম্বা চুল। এক জাদুকর তাকে মোহাচ্ছন্ন করে দোতলার একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু না, সেখানে যাওয়ার কোনও সিঁড়ি ছিল না। র‌্যাপুনজেলের চুল এত লম্বা এবং এত শক্তপোক্ত ছিল যে, ওই জাদুকর তার সেই চুল বেয়েই উপরে উঠত।

রূপকথার সেই নায়িকার মতোই গুজরাতের নীলাংশী পাটেলেরও অত লম্বা আর এইসা গোছা চুল দেখে তাঁর স্কুলের সবাই তাঁকে র‌্যাপুনজেল নামেই ডাকে। আগে কিন্তু তাঁর অত চুল ছিল না। প্রায় বছর দশেক আগে এক পার্লারে চুল কাটতে গিয়ে তাঁর চুল এত বিচ্ছিরি ভাবে কেটে দিয়েছিল যে, তিনি রেগে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি আর কোনও দিন চুল কাটবেন না। সেই থেকে আর কাঁচি পড়েনি তাঁর চুলে। ফলে সেই চুল বাড়তে বাড়তে এখন কোমর ছাপিয়ে, পায়ের গোড়ালিও ছাড়িয়ে গেছে। এই টেবিল টেনিস খেলোয়াড় এখন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি চুলের জন্য শুধু তাঁর এলাকা নয় গোটা পৃথিবীর নজর কেড়েছেন।

শুধু লম্বা বা গোছা হলেই হবে না। যাঁর যতই কালো রং অপছন্দ হোক না কেন, সবাই কিন্তু চান তাঁর চুলের রং চিরকাল যেন কালোই থাকে। তাই চুলে পাক ধরলেই লোকে কলপ করতে শুরু করেন। এখন অবশ্য শুধু কালো নয়, বিভিন্ন রঙে চুল রাঙানোটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আর যাঁদের চুলের রং লালচে? না, চুল কালো নয় বলে তাঁদের আর লজ্জায় তাঁদের চুলের মতো রাঙা হওয়ার কোনও দরকার নেই। কারণ, ইতিমধ্যেই লাল চুলের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে বছরের একটা দিন--- ৬ নভেম্বর। যাঁদের চুলের রং পুরো না হলেও, অন্তত একটুখানি লালচে, এ দিন তাঁরাও সারা দিন ধরে যে কত লোকের কাছ থেকে 'লাভ ইয়োর রেড হেয়ারি ডে' শোনেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন না। 

যদিও কালো চুলের কদর এ দেশে সবচেয়ে বেশি। ফলে কেউ তাঁর প্রেমিকার এক ঢাল কালো চুলের প্রশংসা কখনও করেননি,এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সেই প্রেমিক যদি কবি হন, তা হলে তো কথাই নেই। লিখে ফেলবেন একের পর এক কবিতা।  

কবি জসীম উদ্দীন তার ‘দেশ’ কবিতায় লিখেছেন, 'ক্ষেতের পরে ক্ষেত চলেছে, ক্ষেতের নাহি শেষ, / সবুজ হাওয়ায় দুলছে ও কার এলো মাথার কেশ।'

কাজী নজরুল ইসলাম একটি দেশাত্মবোধক গানে বলেছেন, ‘কুঁচবরণ কন্যা রে তার মেঘবরণ কেশ। 

কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর বনলতা সেনের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’

কবি রঞ্জনা রায় তাঁর 'তুমি' কবিতায় লিখেছেন, 'তুমি বসে আছ এক ধূসর সময়ের মাঝখানে / তোমার দীঘল চুলের ঘন উচ্ছ্বাসে / ডুবে যায় জোৎস্নার রুপালি পর্দা।'

আমাদের দেশের সাহিত্যে কিংবা কাব্যে নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যে সেই প্রাচীনকাল থেকেই নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে তাঁর চুলের বর্ণনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের নায়িকারা বারবার সম্ভাষিত হয়েছেন কখনও সুকেশী, কখনও চারুকেশী, কখনও বা মুক্তকেশী নামে। আর তাঁদের চুলের প্রশংসায় উঠে এসেছে একের পর এক অভিনব শব্দ--- কুন্তলকলাপ, চিকুরকদম্ব, কেশাবলী, কেশবৃন্দ, চিকুরভার।

বাদ যাননি বিদেশি কবিরাও। পাবলো নেরুদার একটি বিখ্যাত কবিতা আছে চুল নিয়ে। যার বাংলা ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়--- তোমার চুলের বর্ণনায় কাটাতে পারি তামাম জীবন / আঁকতে পারি এক একটি নিবিড় সুন্দরতা / অন্য প্রেমিক অন্য চোখে দেখে নেয় ভালোবাসার মুখ, / তোমার চুলের বিন্যাসে আমি পাই আমার মুগ্ধতা।

চুল নিয়ে যতই চুলচেরা সাহিত্য হোক, কখনও কখনও কারও কাছে চুল হয়ে ওঠে ভয়ানক-ভয়ঙ্কর। 

সবাই জানেন, দুনিয়ায় অনেক বিরল অসুখ আছে। কিন্তু স্কটিশের মেয়ে মেগান সট্রুয়ার্টের অসুখটা বিরলগুলোর মধ্যেও বিরল। এই মেয়েটির  চুল আঁচড়ালেই নাকি মৃত্যু ঘটতে পারে! ২০০৮ সালে প্রথম এই বিষয়টি লক্ষ্য করেন মেগানের মা। 

মেগান যখন আরও ছোট, তখন একদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য সে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু চুল আঁচড়াতে গিয়েই দেখা দিল বিপত্তি। মেগানের হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেল। তার ঠোঁট যন্ত্রণায় নীল হয়ে এল। কী হয়েছে বুঝতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে তার মা ডাকলেন প্যারামেডিকদের। গ্লাসগোর ইয়র্কহিল হসপিটালের চিকিৎসকরা মেগানকে পরীক্ষা করে তার মাকে জানালেন, এটা এক বিরল অসুখ। এ রকম অসুখের কথা এর আগে তাঁরা শুধু একবারই শুনেছেন। চাক্ষুস করেননি। তাঁদের কথায় এই ধরনের রোগিদের চুল আঁচড়াতে গেলেই মস্তিষ্ক-সহ দেহের প্রধান প্রত্যঙ্গগুলো তাদের কাজ বন্ধ করে দেয়। সুতরাং অচিরেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। আসলে এটা একটা মারাত্মক অসুখ। নাম--- 'হেয়ার ব্রাশিং সিনড্রোম’।

তবু চুল নিয়ে কবিদের বন্দনার শেষ নেই। শেষ নেই গানেরও। মনে পড়ে সেই বিখ্যাত গানের কলি--- বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল, / এমন খোঁপায় বেঁধে দিব লাল গোলাপ ফুল। 

চুলের যখন এত কদর তখন মেয়েদের চুল বাঁধা নিয়েও যে হাজার রকমের কায়দা থাকবে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেগুলো বারবার ধরাও পড়েছে প্রাচীন সাহিত্যে আর স্থাপত্যে। চুল বাঁধা নিয়ে যে দশটি স্টাইল সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সেগুলো হল----

১। স্তূপ কেশপাশ : মাথার উপরি ভাগে গোল করে বড় খোঁপা বাঁধা। এর উল্লেখ শতপথ ব্রাহ্মণ আর বাজসেনীয় সংহিতায় পাওয়া যায়।

২। বেল্লিত কেশপাশ : এর উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। মাথার সামনের দিকে চুল আঁকাবাঁকা রেখায় সাজিয়ে মাথার ডানপাশে একটা ভারী খোঁপা বাঁধা।

৩। পঞ্চচূড়া : মাথার ওপর একসঙ্গে পাঁচটি খোঁপা বাঁধা। মহাভারতের  রম্ভা নাকি এ রকম স্টাইলেই চুল বাঁধতেন।

৪। সমুন্নধ শিখাণ্ডক : নাট্যশাস্ত্রের মতে, উত্তর পূর্ব ভারতের জনপ্রিয় স্টাইল। চুল মাথার ওপরে টোপরের আকৃতিতে বাঁধা।

৫। কুম্ভী বন্ধক : নাট্যশাস্ত্রের মতে, দক্ষিণ ভারতের স্টাইল। একেবারে অবিকল কলসির আকারে এক বিরাট খোঁপা। আসল চুলে অত বড় খোঁপা হয় না, তাই খোঁপাটাকে বড় দেখানোর জন্য নকল চুল বা গোঁজামিল হিসেবে অন্য কিছু ব্যবহার করা হত। এই বৃহৎ কলসি খোঁপা মাথার ওপরে, পেছনে বা যে কোনও পাশে করা হত।

৬। আবর্তললাটিকা : কপালে পরার এক ধরনের অলঙ্কারের নাম--- ললাটিকা। এই রীতিতে মাথার সামনের চুল ললাটিকার চারপাশে গোল করে সাজিয়ে দেওয়া হত।

৭। অংশুক কেশপাশ : অংশুক মানে কাপড়ের টুকরো। নাট্যশাস্ত্র বলে, আভীর রমণীরা নাকি একটুকরো কালো কাপড় দিয়ে এই রীতিতে চুল বাঁধতেন।

৮। কবরী : চুল বাঁধার সঙ্গে ফুলের ব্যবহার থাকলে তাকে যেমন কবরী বলা যেতে পারে। ঠিক তেমনই, চুলের সঙ্গে ফুলের মালা জড়িয়ে বাঁধা বিনুনীকেও কবরী বলা হয়।

৯। ধম্মিল : ধম্মিল শব্দটির মানে বোঝা দুষ্কর। আমার যত দূর মনে হয়, এটা কোনও আদি দ্রাবিড় শব্দ। চুল বাঁধার এই স্টাইল আগেকার দিনে দক্ষিণ ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে দেখা গেলেও, গুপ্তযুগে উত্তর ভারতে কিন্তু এই ভাবে চুল বাঁধাটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই রীতিতে চুলের খোঁপা ঘাড়ের ওপর থাকত এবং চুল কখনও কখনও ফুল বা মুক্তো দিয়েও সাজানো হত।

১০। বেণী : বেণী বা বেণীকা বহুপ্রচলিত একটা কেশসজ্জাই শুধু নয়, সংস্কৃত সাহিত্যে উপমা ব্যবহারে এর তুলনা মেলা ভার। যেমন, কালিদাসের মেঘদূতে যক্ষ মেঘকে বলছে ‘তোমার বিরহে সিন্ধু নদী শুকিয়ে হয়েছে একগাছি বেণীর মতো।‘ ঠিক তেমনই, বেণীর প্রশংসা করতে গিয়ে কবিরা কখনও তার তুলনা টেনেছেন কামদেবের ধনুকের জ্যার সঙ্গে, কখনও ক্রুদ্ধ সাপের সঙ্গে।

যে চুল নিয়ে এত মাতামাতি, সেই চুল যদি উঠতে শুরু করে, ব্যাস। তখন নকল চুল বা পরচুলো মাথায় তুলে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কী! তখন অনেকেই ছুটে বেড়ান নানান জড়িবুটি, তেল, মলম, ওষুধ এবং নানা কারসাজির পিছনে। খরচ করেন লক্ষ লক্ষ টাকা। আর তিনি যদি মহিলা হন, তা হলে তো কথাই নেই। 

যাঁর যতই শুষ্ক, রুক্ষ, সিল্কি, ঝাঁকড়া, কোঁকড়া বা স্টেট চুলই হোক না কেন, মেয়েরা কিন্তু মনে মনে লম্বা আর গোছা চুলই সব সময় চান। কিন্তু সবাই তো আর তা পান না। কেউ কেউ পান। যেমন, এই চুল নিয়েই সর্বকালের রেকর্ড করে ফেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টার এক কেশবতী কন্যা--- আশা ম্যান্ডেলা। গত পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি লালন পালন করে চলেছেন তাঁর চুল। আর তাঁর যত্নে সেই চুল এত লম্বা হয়ে গেছে যে, পাঁচ তলা বাড়ির ছাদ থেকে ঝুুলিয়ে দিলেও সেই চুল রাস্তায় একেবারে লুটোপুটি খায়। হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই বাস্তব। মেপে দেখা গেছে তাঁর চুল পঞ্চান্ন ফুট লম্বা। ধুয়ে শুকোতে তাঁর সময় লাগে টানা দু'দিন। ফলে এই চুলের জন্যই তিনি নাম তুলে ফেলেছেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।

না, লম্বা কিংবা গোছা চুলের জন্য নয়, কেউ কেউ চুল কেটে ফেলে শুধু শিরোনামেই আসেননি, নমস্য হয়ে উঠেছেন অনেকেই। আমরা জানি, বিখ্যাত গল্প 'গিফট অব দ্য ম্যাজাই'র মুখ্যচরিত্র ডেল তাদের বিবাহবার্ষিকীর দিন তার স্বামীকে ভালোবাসার উপহার কিনে দেওয়ার জন্য বিক্রি করে দিয়েছিল নিজের বহু সাধের একঢাল রেশমি চুল।

কিন্তু না, গড়িয়ার স্বর্ণাভ কিংবা ব্যাঙ্গালোরের শ্বেতা এলিসা অথবা কলকাতার চিকিৎসক আরুণি গর্গ চুল কাটলেও, তার পিছনে কিন্তু ওই রকম কোনও কারণ নেই। তাঁরা বরং নিজের চুল কেটে সবার নজর কেড়েছেন।

ওরা যে জন্য করেছেন ষোলো বছরের ফুটফুটে তরুণী জিয়াও সেই একই উদ্দেশে একেবারে নেড়া হয়ে তাঁর আঠাশ ইঞ্চি লম্বা বেনুনীটা মুম্বইয়ের 'মাদাদ'-এ কুরিয়ার করে পাঠিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন।

কিন্তু কেন? না, তাঁরা সেই চুল কেটেছেন একটি ভাল কাজের জন্য। যে সব ক্যানসার আক্রান্তরা কেমোথেরাপি নেওয়ার পরে চুল খোয়াতে শুরু করেন, কিন্তু ক্যানসারের ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচা চালিয়ে তাঁদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে না পরচুলো কেনার। তাঁরা মানসিক ভাবে আরও ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ ডিপ্রেশনে চলে যান। তাই ওঁদের মাথায় পরচুলো জোগানোর জন্যই তাঁরা কমপক্ষে বারো ইঞ্চি করে চুল কেটে দান করেছেন সেই সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে, যারা ক্যানসার রোগীদের বিনে পয়সায় নকল চুল মানে পরচুলো বা উইগ সরবরাহ করে। যাঁরা এই ভাবে চুল দান করছেন, তাঁদের মতে, চুল দান রক্তদানের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। মানে চুল এমন একটা জিনিস, যেটা মাথায় থাকলে তাঁকে সুন্দর বা সুন্দরী করে তোলে। আর সেই চুল কোনও মহৎ কাজের জন্য দান করলে তাঁর মনের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।

 

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top