সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে খাদ্য নিরাপত্তায় মানসম্পন্ন বীজের উন্নয়নে অবদান : কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী


প্রকাশিত:
৪ মে ২০২১ ২১:০৭

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ১৭:০৪

 

খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে ক’টি উপকরণ একান্ত প্রয়োজন তারমধ্যে বীজ হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ। ভালো বীজের গুণাগুণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভালো ফসল উৎপাদন তথা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। আর তাই ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাদ্যের সংস্থান করা অর্থাৎ দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। আর অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন ভালো বীজের এবং সার ও সেচের সঠিক ব্যবস্থাপনা। বঙ্গবন্ধু হাতে নিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও পুরাতন কৃষি অবকাঠামোসমূহ পুনর্গঠন উন্নয়ন প্রকল্প। আর তাই ১৯৭৩-৭৮ মেয়াদের বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় চালু করা হলো ‘দানাশস্য বীজ প্রকল্প’ এবং বিএডিসিকে দায়িত্ব প্রদান করা হলো ধান, পাট ও গমবীজ ফসলের বীজ উৎপাদনের জন্য।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর বিচক্ষণতা ও অসীম দূরদর্শিতায় অনুধাবন করেছিলেন যা কবিতার ভাষায় বলা যায়;

“ভালো বীজে ভালো ফসল”, সুধী জনে কয়,
প্রত্যায়িত বীজই ভালো বীজ, জানিবে নিশ্চয়।
২০ ভাগ বেশি ফলন পাইতে হলে ভাই,
প্রত্যায়িত বীজ ছাড়া আর যে উপায় নাই।

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাই ১৯৭৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড গঠনের পরপরই ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন তৎকালীন ‘বীজ অনুমোদন সংস্থা’ তথা আজকের ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী’। যার অন্যতম প্রধান কাজ হলো বিএডিসি কর্তৃক উৎপাদিত বীজ ফসলের মাঠমান ও বীজমান যাচাইপূর্বক প্রত্যয়ন দেয়া।

 স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সাল হতে ‘দানাশস্য বীজ প্রকল্প’ এর আওতায় বীজপ্রযুক্তি ও বীজমান নিশ্চিতকরণে বিএডিসি ও তৎকালীন বীজ অনুমোদন সংস্থার তদারকীতে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ফলে ১৯৭৪-৭৫ সাল হতে এ কার্যক্রমের আওতায় উন্নত জাতের মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন ও আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৫-৭৬ সালে শষ্য উৎপাদন ৮৭ লাখ মে.টন থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ মে.টনে, যা বঙ্গবন্ধু নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি। কারণ কিছু দুর্বৃত্ত সেনা অফিসারদের নৃশংসতায় শাহাদতবরণ করতে হয়েছে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণের পথিকৃৎ সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ পরবর্তী বাংলাদেশে সার ও বীজ সংকটের ইতিহাস (১৯৭৫-১৯৯৬ এবং ২০০২-২০০৮)

কৃষি ও বীজের ক্ষেত্রে এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ ও নির্মমতায় ভরা। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর থেকে ২৮টি বছর স্বৈরশাসকদের দেশ পরিচালনাকালে বীজমান নিশ্চিতকরণে ছিল না কোনো উন্নয়ন, ছিল না কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক কষ্ট করে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ১ (এক) ব্যাগ বীজ আর ২-১ ব্যাগ সারের জন্য কৃষককে যেতে হয়েছে দূর দুরান্তের এক বাজার থেকে অপর বাজারে। পুলিশের লাঠির বারি খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে  উচ্চ মূল্যে (৭০-৭৫/- টাকা প্রতি কেজি) ৫০ কেজির এক বস্তা ইউরিয়া সার ও ৫-১০ কেজির এক ব্যাগ সরকারি বীজ। এমনকি প্রচন্ড সার সংকটে ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে পুলিশের গুলিতে সারা দেশে ১৮জন অসহায় কৃষককে প্রাণ দিতে হয়েছে। ফলে পরিমাণ মতো বীজ ও সার না পেয়ে, যথাযথ সেচ দিতে না পেরে ফসল পায়নি কৃষক। ফলশ্রুতিতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে প্রচুর পরিমান ধান, পাট, গম, আলু ও সবজি ফসলের বীজসমূহ। আর তাই ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশের খাদ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ৩০-৪০ লক্ষ টনে। সার ও বীজ সরবরাহে শুরু করা হয় রেশনিং পদ্ধতি।

বীজমান উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান-

১৯৭৪ সালে ‘বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি, বীজ প্রত্যয়নের সৃষ্টি’ যেমন সে সময়ে সঠিক ও যাথার্থ প্রমাণিত হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ প্রথমবার এবং ২০০৮ থেকে অদ্যবধি এক যুগেরও বেশী সময় ধরে কৃতিত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনায় বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বীজ সেক্টর আজ সুসংহত ও বিকশিত। ফলে যথাসময়ে ও সুলভমূল্যে মানসম্পন্ন বীজ আজ চাষীর দোরগোড়ায়। খাদ্য উৎপাদনবৃদ্ধিতে মানসম্পন্ন বীজের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত কিছু বিবরণ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-  

১. বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বীজ উৎপাদনে সম্পৃক্তকরণ : বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার ১৯৯৬ সালের জুনে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বাংলাদেশের বীজ সেক্টরে সরকারি গবেষনা ও বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মৌল, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণে সম্পৃক্ত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফলে বাংলাদেশের বীজ উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্রণ, প্রত্যয়ন ও বাজারজাতকরণে শুরু হয় ব্যাপক কর্মকাণ্ড। তারই ফলে আজ প্রায় ২৫,০০০টির বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিএডিসি, ডিএইসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান দানাদার ফসলের বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে নিয়োজিত যার পরিমাণ ২৫-৩০%। তবে বীজ সরবরাহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বেসরকারি খাত মূলত উচ্চ মুনাফার বীজ যেমন হাইব্রিড ধান ৯২.৪২%, ভুট্টা ৯৮.৮৫%, পাট ৯৫.৩৭%, শাকসবজি ৯৬.২১% এবং আলু ৭২.২৬% বীজের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, যা বর্ণিত ফসলের ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পাশাপাশি মানসম্পন্ন ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনেও বেসরকারী খাত ব্যাপক অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশে বর্তমানে  ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক সফল বীজ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজ আজ চাষির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। চাষিরা আজ সময়মতো তাদের স্বাধীনতা, তাদের পছন্দ অনুযায়ী মানসম্পন্ন বীজ ক্রয় করছে আর মনের আনন্দে ফসল ফলাচ্ছে ।

২. গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্রিডার বীজ প্রত্যয়ন কর্মসূচি : ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, গবেষণা ও জাত সংরক্ষণের পাশাপাশি ব্রিডার বীজ উৎপাদন ও প্রত্যয়ন করে আসছিল। যা হতে পরবর্তীতে বিএডিসি কর্তৃক ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হতো। উল্লেখ্য যে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উৎপাদিত বীজকে নিজেরাই প্রত্যয়ন করার ফলে এক দিকে যেমন পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকে তেমনি সর্বোচ্চ মানের বিষয়ে বীজ ব্যবহারকারীর মনেও কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি ভিত্তি বীজের উৎস নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ব্রিডার বীজের মানকে শতভাগ নিশ্চিত রাখার স্বার্থে জাতীয় বীজ বোর্ডের সিদ্ধান্তক্রমে ১৯৯৬ সালের শেষার্ধে হতে ব্রিডার বীজ প্রত্যয়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয় বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকে। বীজমান নিশ্চিতকরণে প্রথমবারের মতো মৌল, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ‘প্রত্যয়ন ফি’ গ্রহণপূর্বক সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বীজ প্রত্যয়নের সেবা প্রদানে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত আমন ধানের জাত বাউধান-২ এর প্রত্যয়নের মাধ্যমে প্রথম বারের মতো ব্রিডার বীজ ফসল প্রত্যয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়। বংলাদেশে যা বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য।

৩. নতুন বীজ আইন ও বীজ বিধি প্রণয়ন : বীজ মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই জারি করলেন বীজ আইন (সংশোধন) ১৯৯৭, বীজ বিধি ১৯৯৮ এবং সর্বশেষ বীজ আইন ২০১৮। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কৃষি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিলেন ব্রিডার বীজ ফসল প্রত্যয়নের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং কঠোর মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বীজমান নিশ্চিত করে যথাসময়ে সুলভমূল্যে প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন বীজের সরবরাহ অক্ষুণ্ন রাখতে। বীজের মান ভালো হওয়ায় দেশে খাদ্যশস্যের ফলন ও উৎপাদন দুটোই অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশ আজ দানাজাতীয় খাদ্য শস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

৪. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফি গ্রহণপূর্বক প্রত্যয়ন সেবা প্রদান : এসসিএ’র প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে শুরু করে ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথা বিএডিসি, কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উৎপাদিত ধান,পাট,গম ও আলু বীজ বিনামূল্যে প্রত্যয়ন করে আসছিল। এতে বিনামূল্যে পাওয়া প্রত্যয়ন সেবার প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন করা বা গুরুত্ব দেয়া হতো না। ১৯৯৭ সাল থেকে সব সরকারি বেসরকারি বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মৌল, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ প্রত্যয়ন, বীজ পরীক্ষা ও জাত ছাড়করণে নির্ধারিত ফি প্রদান স্বাপেক্ষে বীজ প্রত্যয়ন সেবা গ্রহণের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এতে একদিকে যেমন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে থাকে অপরদিকে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের জমি ও বীজের পরিমাণ এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ স্বরূপ ১৯৯৭ সালে যেখানে প্রত্যয়ন ফি বাবদ রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ২,০০০ টাকা সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় দাঁড়িয়েছে ৬২.৩০ লাখ টাকা।

৫. বীজমান নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ : বীজ শিল্প ও বীজমান উন্নয়ন কার্যক্রম আরো সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে যে সব প্রকল্প ও কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে সেগুলে হলো-

ক. বীজ মাননিয়ন্ত্রণ প্রকল্প : বিগত ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪ বছর মেয়াদি এই বীজমান নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বীজমান নিয়ন্ত্রণের সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে প্রতিটি বীজ ফসলের মাঠমান ও বীজমান নির্ধারণ এবং সেই মানের ওপর ভিত্তি করেই মানসম্পন্ন বীজ তথা মৌল, ভিত্তি, প্রত্যায়িত ও মানঘোষিত বীজের মানসমূহ মাঠ পরিদর্শনকালে ও বীজ পরীক্ষাগারে বীজ পরীক্ষার মাধ্যমে সুনিশ্চিত হয়ে প্রত্যয়ন ট্যাগ সরবরাহ ও সংযোজন করা হয়ে থাকে বাজারজাতকরণের পূর্ব মুহূর্তে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু থেকে অদ্যবধি কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বীজ বোর্ডের বিভিন্ন সভায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির যাচাই অন্তে অবশেষে ২০০৯ সালে ৭০তম সভায় মোট ০৫টি নোটিফাইড ও ডাল, তেল, মসলা, সবজি জাতীয় মোট ৮০টি নন-নোটিফাইড ফসলের মান নির্ধারণ করে ২০ ডিসেম্বর ২০১০ খ্রিঃ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়, যা বীজমান নিশ্চিতকরণে ও বীজের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

খ. ঐতিহাসিক রিভিজিট বাস্তবায়নের মাধ্যমে অফিস ও জনবল বৃদ্ধি : ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘বীজ অনুমোদন সংস্থা’ স্থাপনের ঠিক ৪০ বছর পর ২০১৪ সালের জুন মাসে বর্তমান কৃষি বান্ধব শেখ হাসিনার সরকার বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণের জন্য ঐতিহাসিক রিভিজিট অনুমোদন করেন। ফলে পূর্বের ৩০টি ফিল্ড অফিসারের অফিসসহ ৬৪ জেলায় বীজ প্রত্যয়ন অফিস স্থাপন করে পদমর্যাদা বাড়িয়ে উপপরিচালক পদের সমপর্যায়ে ৬৪ জন জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসারের পদ, পূর্বের ০৪টি আঞ্চলিক অফিসের পরিবর্তে ০৭টি বিভাগে ০৭ জন করে আঞ্চলিক ও সহকারী আঞ্চলিক বীজ প্রত্যয়ন অফিসারের ১৪টি পদ বৃদ্ধি করা হয়। শুধু তাই নয় ০৭টি বিভাগে ০৭টি আঞ্চলিক বীজ পরীক্ষাগার স্থাপনসহ ৬৪ জেলায় ১২৮জন বীজ প্রত্যয়ন অফিসারের পদ সৃষ্টি করে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির বিদ্যমান মোট ২২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্থলে সর্বমোট ৫৬৯ জন জনবল বৃদ্ধির সাংগঠনিক অবকাঠামোর ঐতিহাসিক অনুমোদন প্রদান করেন। ফলে বীজ প্রত্যয়ন কার্যক্রমের গতিশীলতা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঘ. ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগারের মাধ্যমে বীজ পরীক্ষা : বীজমান উন্নয়নে কৃষি ও কৃষকদরদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সহযোগিতা ও নির্দেশনায় আজ কৃষকের দোরগোড়ায় উপস্থিত ‘ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষা’। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন বিভাগ/জেলায় গিয়ে মাত্র ৩০ টাকায় ধান, গম ও পাট বীজের বিশুদ্ধতা, অংকুরোদগম ক্ষমতা ও আর্দ্রতা পরীক্ষা করে সরাসরি মোবাইলে এস.এম.এস করে বীজ পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে কৃষকরা জমিতে বীজ বপনের আগেই বীজের সঠিক মান নিশ্চিত হয়ে বীজ ও ফসল উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে। 

ঙ. আধুনিক প্রত্যয়ন ট্যাগ চালুকরণ কর্মসূচি : সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত বীজের মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গাজীপুরের টাকশালে অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করে সেখান হতে কঠোর নিরাপত্তায় গোপন নিরাপত্তা চিহ্ন এবং ফসল ও মৌসুম ভিত্তিক পৃথক নম্বর সংযুক্ত করে প্রত্যয়ন ট্যাগ ছাপিয়ে প্রতিটি আঞ্চলিক অফিসে সরবরাহ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে সরবরাহকৃত আধুনিক প্রত্যয়ন ট্যাগে ইঙ্ক জেট প্রিন্টার মেশিনের মাধ্যমে প্রত্যয়ন সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি প্রিন্ট করে আঞ্চলিক অফিস হতে জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসে সরবরাহ করা হচ্ছে এ কর্মসূচির মাধ্যমে যা অত্যন্ত সফল ও কার্যকর  প্রমাণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, আধুনিক এই প্রত্যয়ন ট্যাগে সংযুক্ত গোপন নিরাপত্তা চিহ্ন টঠখ (টষঃৎধ ঠরড়ষবঃ খরমযঃ) মেশিন ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না, ফলে এই প্রত্যয়ন ট্যাগ নকল করা সহজ নয় এবং কেউ নকল করলে তা ধরা পড়ে যাবে।

চ. বীজ প্রত্যয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প ও নিম্ন উৎপাদনশীল ধানের জাত প্রত্যাহার কর্মসূচি : জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ৫বছর মেয়াদি ৭৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অনুমোদিত নতুন সাংগঠনিক কাঠামো (রিভিজিট) অনুসারে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির অবকাঠামো উন্নয়ন, বীজ পরীক্ষাগার সম্প্রসারণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা। তাছাড়াও মাঠ পরিদর্শন ও মার্কেট মনিটরিং কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের মাধ্যমে উচ্চ মানসম্পন্ন বীজের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি, প্রি এন্ড পোস্ট কন্ট্রোল ও গ্রো আউট-টেস্টের মাধ্যমে জাতের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণ, নতুন জাত ছাড়করণে ডিইউএস (উটঝ-উরংঃরহপহবংং টহরভড়ৎসরঃু ধহফ ঝঃধনরষরঃু) এবং ভিসিইউ (ঠঈট-ঠধষঁব ভড়ৎ ঈঁষঃরাধঃরড়হ ধহফ টংবং) টেস্টসমূহ জোরদারকরণ ও কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে মানসম্পন্ন বীজের প্রতিটি ধাপে মাঠমান ও বীজমান নিশ্চিত করায় নতুন উদ্ভাবিত জাতের মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুন,তিনগুন।

সুতরাং একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে:-

“বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বীজ উন্নয়নে অবদান,

ভালো বীজের ব্যবহারে বাড়ছে দেশের মান।”

 

উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে সম্প্রতি বাংলাদেশ আজ বিশে^ পাট উৎপাদনে ২য় স্থান, ধান উৎপাদনে ৪র্থ স্থান থেকে ৩য় স্থান, আলু উৎপাদনে ৮ম হতে ৭ম স্থান এবং সবজি উৎপাদনে ৩য় স্থান অর্জন করেছে। তথাকথিত ‘তলাবিহিন ঝুড়ির বাংলাদেশ’ এখন পরিণত হয়েছে চাল, আলু ও সবজি রপ্তানিকারক দেশে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী কৃষিবান্ধব নীতি প্রনয়ণ, মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রকল্প-কর্মসূচি গ্রহণ, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান এবং সর্বোপরি জনবল ও সাপোর্ট সার্ভিস বৃদ্ধির মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য। সবশেষে চিরন্তন সত্য হচ্ছে; “ভালো বীজেই সুস্থ জীবন”। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বহুগুনে বৃদ্ধির ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

 

তাই “অদম্য এক বাংলাদেশ” শীর্ষক স্বরচিত কবিতার কয়েকটি লাইনে জোর গলায় বলতে পারছি

 

                                         ‘‘কিসিঞ্জারের মিথ্যে তলাবিহীন ঝুড়ি’’

নয়কো কভু বাংলাদেশ,  

ভাত-কাপড় আর মাছ-মাংসে ভরা দেশে,

ক্ষুধা দারিদ্র্য আর অশান্তির দিন প্রায় শেষ।

 

এভাবেই পাবো আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত “সোনার বাংলা” আর ২০৪১ এর মধ্যে দেশ হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার “স্বপ্নের সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরা উন্নত এক বাংলাদেশ”

 

কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী
‘‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪২৩’’ প্রাপ্ত কৃষি সাংবাদিক, লেখক,
উপ-পরিচালক ও জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার (অব: প্রাপ্ত), এসসিএ, (কৃষি মন্ত্রণালয়)
সিনিয়র সহ সভাপতি, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত পরিষদ, বাংলাদেশ। 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top