সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

রাজনের রসিকতা : সায়ন্তনী পূততুন্ড


প্রকাশিত:
২৪ মে ২০২১ ২১:৪১

আপডেট:
২২ জুন ২০২১ ২০:৪৩

ছবিঃ সায়ন্তনী পূততুন্ড

 

“হর এক বাত পে পুছতে হো তুম কে ‘তু ক্যায়া হ্যায়’?
তুম হি কহো ইয়ে আন্দাজ-এ-গুফত গু ক্যায়া হ্যায়?
..রঘৌ মে দৌড়নে ফিরনে কা হাম নেহি কায়ল
যব আঁখ হি সে না টপকা, তো ফির লহুঁ ক্যায়া হ্যায়!!!”

তার নাম ছিল রাজন। রাজন মানে ছেলেমানুষি। রাজন মানে একটা দামাল হাসি। রাজন মানে অনাড়ম্বর সারল্য। আর মারাত্মক সেন্স অব হিউমার!

রসিকতা করতে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। আর কথায় কথায় হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ করে রীতিমতো কয়েক মাইল লম্বা একখানা মেগাহাসি দেওয়া তার স্বভাব! সকাল বিকেল যোগব্যায়াম করতে করতে আপশোশ করত – ‘হে ভগবান, কেন রামদেববাবাজি হলুম না! মহিলাদের সামনে ধুতি পরে শীর্ষাসন করার সুখটা এ জন্মের মতো ফসকে গেল!’

ভাগ্যিস ভগবান ওর কথায় কর্ণপাত করেননি। করলে ওকে পেতুম কোথায়? নিপাট ব্রহ্মচারীর জীবনে কি আর আমার মতো খেঁদি পেঁচিরা শোভা পায়?
যাই হোক, রামদেববাবাজি না হওয়ার দরুণ একদিন আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েই গেল।
দিনটা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। চোখের পাওয়ার বেড়েছে। কিন্তু আজও সেই দৃশ্যটাকে স্পষ্ট দেখতে চশমার প্রয়োজন পড়ে না।
আমাদের পাড়ার সংগীত অনুষ্ঠান। বিজয়া সম্মিলনী...।

তখনও পাড়ার অনুষ্ঠানে পেশাদারি শিল্পীদের হাজারি গানের রমরমা হয়নি। পরিচিত কাকু, কাকিমা, দাদা-বউদিরাই স্টেজ আলো করতেন।  হাপু গান, কীর্তন, রবীন্দ্রসংগীত থেকে আরম্ত করে ‘আর কত রাত একা থাকব’ – সবই চলত।

তবে এই ধরনের প্রোগ্রামের কিছু সমস্যাও আছে। কিছু মানুষ আছেন যারা একবার মাইক ধরলে সহজে ছাড়েন না! তেমনই একজন ছিলেন দাস কাকু! এমনিতে ভালো মানুষই ছিলেন, কিন্তু তার একটি-ই মহৎ দোষ, স্টেজে উঠলে কিছুতেই নামার নাম নেন না। উদ্যোক্তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। প্রতিবছর মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে যে উদ্যোক্তাদের কতজনের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ শেষপর্যন্ত অবাক পৃথিবী হয়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দর্শকরাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন... অথচ গায়কের সেদিকে খেয়ালই নেই! দর্শকদের কুইনাইন গেলা মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবেন – ‘সবই মায়া! বাস্তব শুধু এই অ-মাইক গলা ও হারমোনিয়াম!’

সেবারও তিনি গাইতে উঠেছেন। গানটা আক্ষরিক অর্থে শেষ হয়ে গেছে। তবু ক্রিজ ছাড়ছেন না। রিপিট করে গেয়েই যাচ্ছেন – ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা...ঝুলনা...ঝুলনা...।’ হারমোনিয়াম হাড় পাঁজর বের করে কেউকেঁউ করছে। দর্শক ও শ্রোতারা যথারীতি প্রাণপণে ঈশ্বরকে ডাকছেন। উদ্যোক্তারা ইশারা করে প্রথমে গান থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাদের মুকাভিনয়ে বিশেষ কাজ হল না। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে পরম করুণাময়কেই বোধহয় স্মরণ করতে বসেছেন...। ওদিকে তখনও রেকারিং ডেসিমালের মতো চলছে গান – ‘ঝুলনা... ঝুলনা... ঝুলনা... ঝুলনা...।’

সবাই যখন প্রায় ভগ্নাবশেষের মতো ‘থ’ হয়ে বসে আছে আর উদ্যোক্তারা মগ্ন মৈনাক হবার ফিকির করছেন... ঠিক তখনই সামনের সারি থেকে এক সুদর্শন তরুণ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। কথা নেই বার্তা নেই একেবারে ব্যারিটোন ভল্যুমে বলে উঠল – ‘কাকু আর কত ঝুলবেন? এবার নেমে আসুন। বাদবাকিদেরও ঝুলতে দিন।’

সঙ্গে সঙ্গে পিন ড্রপ সাইলেন্স! দাস কাকু অমন বাজখাই গলার ধাক্কায় ঘাবড়ে গিয়ে থেমে গেলেন। ঝোলাঝুলি বন্ধ হয়ে গেল। জনতা ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত। সবাই হাঁ করে ছেলেটার দিকেই দেখছে! কী অসীম সাহস! অবলীলায় কথাগুলো বলে আবার মিটমিট করে হাসছে!

সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই শুনলাম বাবা বিড়বিড় করছেন – ‘ওঃ ঈশ্বর, এতক্ষণে আমাদের প্রার্থনা তোমার কানে গেল! তা দেবদূতটি কে? চিনলাম না তো?’

বলাই বাহুল্য এই দেবদূতটির সঙ্গে পরে আলাপ হয়েছিল। এবং আমরা প্রত্যেকেই তাকে হাড়ে হাড়ে চিনেছিলাম।

ওর ভালো নাম সম্রাট। তবে রাজা নামেই সে বিশেষ বিখ্যাত ছিল। ভয়াবহ ডাকাবুকো। বাইক র‍্যালিতে তার সঙ্গে এঁটে ওঠা শুধু কষ্টকরই নয় – অসম্ভব। বাইককে আবার বাইক বললে রেগে যেত। তার বাইকের নাম ছিল – মিঃ গোমস। মিঃ গোম্‌সের পিঠে চাপলে সে নিজেকে আর্নল্ড শোয়ারজেনেগার ভাবত।

বিজয়া সম্মিলনীর ঘটনার পর দাদার সঙ্গে তার রীতিমতো দোস্তি হয়ে গেল। ‘রিস্তা’ তখনও হয়নি। তাই আমরা ‘রিস্তেদার’ – এর বদলে আপাতত ‘দোস্তিদার’ দাঁড়ালুম।

প্রথমদিন দাদা যখন তাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এল সেদিনেই কাছ থেকে ভালো করে দেখলাম। আপাতদৃষ্টিতে বেশ রাগী মনে হয়। চোখদুটোও বেশ রাগী রাগী। অথচ যখন ‘হো হো হাঃ হাঃ’ করে হাসতে শুরু করে তখন বোঝা যায় তার মধ্যে কোথাও একটা অদ্ভুত সারল্য আছে।

একবার দেখি সে হাসি আর কিছুতেই থামছে না। এবং হাসিটা বেশ অপ্রকৃতিস্থ! রাজার একটু পানদোষ ছিল। তবে মারাত্মক কিছু নয়। কিন্তু মাঝে মধ্যেই বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে মাতাল হয়ে যেত। আর তখন তাকে সামলানো যেত না। তেমনই কিছু একটা হয়ে থাকবে আন্দাজ করে দাদা সভয়ে এগিয়ে গেলো।

  • ‘কী হয়েছে রাজা? হাসছিস কেন’?

রাজা হাসতে হাসতেই বলল – ‘রাজা কি এখানে আছে?’

প্রশ্ন শুনে সবারই প্রায় আক্কেল গুড়ুম! যে লোক নিজেই নিজেকে খুঁজছে তাকে কি বলা যায়? এ আবার কি? আইডেন্টিটি ক্রাইসিস? নাকি জ্যাকি চ্যানের ‘হু আাম আই’ এর নিপাট বাঙালি সংস্করণ!

দাদা কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল – ‘না, এখানে তো... নেই – কেন?’

তখনই শুরু হল হাউ হাউ করে কান্না! সে কী কান্না! রাবণও বোধহয় রামের তীরের খোঁচা খেয়ে দশ মাথায় অমন কয়েকশো ডেসিবেলে কাঁদেনি। দাদা ঘাবড়ে গিয়ে বলে – ‘কেন? কী হয়েছে?’

- ‘শালা, আমার মিঃ গোমসের চাবি নিয়ে চলে গেছে, আমি এখন কী করি!’
- ‘কোন্‌ শালা নিয়ে গেছে?’
- ‘রাজা। রাজার কথাই তো বলছি।’

আমরা সবাই রীতিমতো ‘বর্গীয় জ' – এর মতো দশাপ্রাপ্ত হয়ে ওর কথা শুনছি। মনে হচ্ছিল ইলেকট্রিকের তারে আধখানা চাঁদ নয়, রাশি রাশি বিস্ময়সূচক চিহ্ন আর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে আছে! চতুর্দিকে দিয়ে কনফিউশন শিঙ উঁচিয়ে তাড়া করেছে। আর আমরা সবাই চণ্ডীদাসের মতো ‘রাজার কি হৈল অন্তরে ব্যথা’, প্রশ্ন করার জন্য আকুল হয়ে উঠেছি।

দাদাই প্রথম সামলে নিয়ে বলল – আচ্ছা, তা আপনি কে?’

কান্না মেশানো গলায় উত্তর এল – ‘আমি ঔরংজেব।’

সেদিন সে নাট্যোৎসব দেখে ফিরছিল। সম্ভবত ‘ঔরংজেব’ দেখে থাকবে। আর সেইটাই তার মাথায় ঢুকেছে।

দাদাও বেশ রসিক মানুষ। সে হাসি চেপে বলে – বেশ, তা এত রাত্রে আর কোথায় যাবেন জাঁহাপনা। ভেতরে আসা হোক।’

রাজা ঢুকতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দাদা তাকে জাপটে ধরতেই সে অবাক হয়ে বলল – আপনি কে?’

দাদা আরো গম্ভীর হয়ে বলল – ‘আমি শাহজাহান, তোর বাপ।’

…পরদিন সকালে জাঁহাপনা যে মহা ধর্মসংকটে আর প্রভূত লজ্জায় পড়েছিলেন তা আর না বললেও চলে। এরপর আর কখনো তাকে মাতাল অবস্থায় দেখিনি। অন্তত দীর্ঘ এক দশকের সম্পর্কে তো নয়-ই।

রাজার আরও একটা মহান দোষ ছিল। সে অসম্ভব ভুলে যেত। ভুলে গিয়ে এমন কাণ্ড বোধহয় নেই, যা সে করেনি! নাতিদীর্ঘ জীবনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটিয়েছে যার যুক্তি খুঁজে বের করার চেয়ে হাতিকে জাঙিয়া পরানো অনেক সহজ কাজ। দু পায়ে দু রকম চপ্পল পরা, গেঞ্জির জায়গায় ভাইঝির টেপজামা পরে বেরিয়ে যাওয়া, সানগ্লাস কপালের উপরে তুলে রেখে হন্যে হয়ে সেটাই খুঁজে বেরোনো... এ সব তো নিতান্তই কমন!

সবচেয়ে ভয়াবহ কাজ যেটা করেছিল সেটা ওর মুখেই শোনা।

একবার অফিস যাওয়ার পথে হঠাৎ মনে হল ট্রাউজারটা যেন বারবার নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

আমার দাদা তার সঙ্গেই অফিসে যেত। কিছুক্ষণ উশখুশ করার পর আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল – ‘বাবু, দেখ তো। আমার ট্রাউজারটা কি নেমে যাচ্ছে?’

বাবু একঝলকে দেখে নিয়ে বলে – নাঃ, ঠিক আছে।’

সে আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেল। কিন্তু অস্বস্তি ক্রমশই বাড়ছে।

খালি মনে হচ্ছে ট্রাউজার বোধহয় খুলে পড়েছে। অথচ সেটা যথাস্থানেই রয়েছে। আবার মনে হচ্ছে – নেই!

বাধ্য হয়ে অফিসে ঢুকেই পড়িমরি করে টয়লেটে দৌড়তে হল। আর তখনই রহস্যের পর্দা ফাঁস! মহারাজ সকালে উঠে পা-জামা খুলতে ভুলে গিয়েছেন, এবং তার উপরই প্যান্ট গলিয়ে চলে এসেছেন! যে কোনো কারণেই হোক পা-জামাটার দড়ি খুলে গিয়েছে। আর সেটাই ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। ট্রাউজার নয়।

এমনই একটি মানুষের প্রেমে পড়া মানে রীতিমতো চিত্রনাট্যে কঙ্কালের রোল করা। কিছুতেই বত্রিশ পাটি মুখের ভিতরে রাখার উপায় নেই। যতই ঠোঁট দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করো, বেয়াদবেরা ঠিক তাল বুঝে একেবারে আকর্ণ বিস্তৃত ক্রিজে লাফিয়ে পড়বেই।

বলাই বাহুল্য সেই কঙ্কালের রোলটা আমাকেই করতে হয়েছিল। শীতকালে কঙ্কালদের যে কী পরিমাণ কষ্ট হয় তা বোধহয় আমিই বুঝেছিলাম। বেচারাদের জন্য আমার সহানুভূতি রইল।

রাজার সেন্স অব হিউমারের কথা মনে করলে এখনও হাসি পেয়ে যায়। কিছু মজা করতে পারত বটে। কথায় কথায় ফোড়ন কাটা ওর স্পেশালিটি। সে ফোড়ন কী জাতীয় ছিল তার উদাহরণও দিয়ে দিলাম।

প্রত্যেক দিন সকালে ওর ঘুম ভাঙতো পাশের বাড়ির কেদারবাবুর নাক ঝাড়ার শব্দে। বালিশে কান ঢেকেও শাস্তি নেই। নাক ঝাড়ার ভয়াবহ আওয়াজ কিছুতেই পেছন ছাড়ে না। আর সে শব্দও এমন, যে রীতিমতো ভয় হয় এই বুঝি নাকটা সুদ্ধই ভদ্রলোকের হাতে খুলে চলে এল! বাধ্য হয়েই ঘুম চোখে বাইরে বেরিয়ে তার ডায়লগ...

- ‘দাদা, খোঁজাখুঁজি তো জোরকদমে চলছে। গুপ্তধন কিছু পেলেন?’

এরপর থেকে নাক ঝাড়ার আওয়াজ একেবারেই বন্ধ! কে জানে, হয়তো ভদ্রলোক আশঙ্কা করে বসলেন যে গুপ্তধন পেলে হয়তো ছোঁড়া তার অর্ধেকটাও দাবি করে বসতে পারে। ব্যাটাকে বিশ্বাস নেই!

যেদিন থেকে ও সেলফোন কিনেছে সেদিন থেকেই আরেক জ্বালাতনের শুরু। থেকে থেকেই গোস্ট কল আসে! একদিন দেখি ফোনে কাকে যেন বিড়বিড় করে বলছে – ‘বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ...।’

মনে মনে ভাবলাম – হল কী! একটু আশঙ্কাও হয়নি যে তা নয়। বিশেষ করে 'ঔরংজেব' কাণ্ডের পর আশঙ্কা হওয়াই স্বাভাবিক! গতবার নিজেকে ঔরংজেব ভেবেছিলেন। এবার যে বেণীমাধব শীল ভাবছেন না তার গ্যারান্টি কি?

সে আশঙ্কা রাজ নিজেই কাটিয়ে দিল। ফোনটা কেটে দিয়ে হেসে বলল – ‘বুঝলে, আমায় রোজ এক মহিলা ফোন করে ইংরেজি মাসের নাম শেখান। কোনো কথা নেই – খালি জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল...গড়গড় করে বলে যান। প্রথমে বিরক্ত হয়ে কেটে দিয়েছি। যতবার কেটে দিই মহিলা কিছুতেই হাল ছাড়েন না। আজ ভাবলাম আমিও ওকে একটু বাংলা মাসের নাম শিখিয়ে দিই। কিন্তু বোধহয় ওর সেটা বিশেষ পছন্দ হয়নি। তাই আজ নিজেই কেটে দিলেন!’

আমাদের সম্পর্ক প্রায় দশ বছরের। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলিনি। আমি বুঝেছিলাম সাহেব ভালোই হাবুডুবু খাচ্ছেন। সাহেবও বুঝেছিলেন তাকে আমি বেশ ভালোই লাই দিচ্ছি। প্রেমে শুনেছি লোকে চোখে অন্ধকার দেখে! লাভ ইজ ব্রাইন্ড। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সবই উলটো। ব্লাইন্ড হওয়ার বদলে বরং নিজের চোখের উপরে আরও একজোড়া চোখ আমদানি হয়েছিল – চশমা। রাজনও অন্ধ হয়নি, বরং একটু বেশিই চক্ষুষ্মান হয়েছিল। বলা ভালো যে ওর চোখ একটু বেশিই খুলে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে সেই খোলা চোখ সুন্দরী মেয়ে দেখলেই কপালে উঠত বটে, কিন্তু আমার চারচোখের এক কটমটে পাঞ্চে আবার যথাস্থানে ফিরেও আসত।

প্রেম শব্দটা ভারি মজাদার । শব্দ একটাই – কিন্তু তার একেকটা রং একেক রকমের। কখনও মনে হত স্নেহ, কখনও বা রীতিমতো গারজেনগিরি। কখনও কট্টর সমালোচক, আবার কখনও বা অন্ধ সাপোর্টার।

আমার আবার একটু কবিতা লেখার শখ ছিল। রাজন কবিতা লিখত না। কবিতায় ওর ভয়াবহ আ্যালার্জি। অথচ জ্ঞান দেওয়ার সময় একেবারে জ্ঞনদারঞ্জন শর্মা। আমার কবিতা পড়ে বলত – কী যে লেখো! সবই তো বুঝতে পারি!’

এই রকম ভয়াবহ মন্তব্যের উত্তরে কী বলব ভেবে পেতুম না। তখনই শুরু হত কবিতা বিষয়ে জ্ঞান –

- ‘কবিতা এত সহজে বুঝলে কী করে চলবে? এমন কবিতা লিখতে হবে যার প্রত্যেকটা শব্দই বাংলা! কিন্তু একসঙ্গে পড়লে মনে হবে ফ্রেঞ্চ পড়ছি। পাব্লিক একবার সোজা করে পড়ার চেষ্টা করবে, তারপরই উলটো করে ধরে পড়ে বোঝার চেষ্টা করবে। কিন্তু কোনোভাবেই বুঝতে পারবে না! লোকে গলগল করে ঘামবে, হাত পায়ের সমস্ত নখ চিবিয়েও যখন মাথামুন্ডু-ল্যাজামুড়ো কিছুই বুঝবে তখনই বিগলিত হয়ে বলবে – ‘কী চমৎকার কবিতা। মানে বুঝলুম না! কিন্তু ধাক্কা দিয়ে গেল!’ পরক্ষণেই হেসে সংযোজন – সে ধাক্কা যে কনফিউশনের ধাক্কা, সে কথা আর কে বলে’।’

বোঝো! কী এক্সপ্ল্যানেশন।

আবার উলটো প্রতিক্রিয়াও দেখেছি কখনও কখনও। একসময় ব্রজবুলি নিয়ে খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে ভানুদাদাকে পর্যন্ত চারশো ভোল্ট লাগিয়ে ছাড়ব! প্রায় দাঁত কিড়মিড় করেই ব্রজবুলির গুষ্টির পিন্ডির শ্রাদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছিলাম। বেশ ভারি ভারি গালভরা পদ মুখস্থ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সবসময়ই একটা ‘কাকে দিই... কাকে দিই’ ভাব। আমার খুড়তুতো দাদা সেসব শুনে বলেছিলেন – ‘এগুলো ব্যাকডেটেড। কাজ করে লাভ নেই।’

আমার মুখে হয়তো হতাশার ছাপ পড়ে থাকবে। সেটা লক্ষ করেই রাজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে দাদাকে বলল – ‘তা ঠিক। তবে ব্রজবুলির চেয়েও ব্যাকডেটেড জিনিস ডাইনোসোর। তবু স্পিলবার্গের মাথাতে কনসেপ্টটা এসেছিল।’

আমায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য ওই একটি মানুষ সবসময় তৈরি থাকত। রাতের পর রাত জেগে কবিতা শুনেছে, যতই ক্লান্তি থাকুক, প্রকাশ নেই।  সেসব কবিতা শুনলে কবিরা ‘আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান’, বলে শহিদ মিনার থেকে লাফ মারতেন। এমন অনেক কবিতা লিখে ফেলে দিয়েছি। ও তুলে জমিয়ে রেখেছে। হতাশ হয়ে পড়লে বুঝিয়েছে। দুঃখ পেলে সস্নেহে সপ্রেমে ভুলিয়েছে...।

আবার পায়ে পা লাগিয়ে মজাদার ঝগড়া করেওছে! রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও গান প্রসঙ্গে বলত –

‘ওঃ, লোকটা যে কী সব মিনমিনে গান লিখেছে! আবার কথাও বলে দেখ পাক্কা ঘটি মার্কা! কী যে এলুম, গেলুম, হালুম-হুলুম লেখে। এইভাবে ভাবনার প্রকাশ হয়? বাঙালদের দেখ! খেয়ে উঠে বলবে – খা-ই-লা-আ-আ-ম। বেশ বোঝা গেল যে তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। আর তোমার রবিঠাকুর বলবেন 'খেলুম'। ওইটুকু একটা এক্সপ্রেশন। বোঝাই গেল না পেট ভরল কি না!!!’

এইরকমই ছিল রাজন!

কর্মসূত্রে দিল্লি যাওয়ার আগে হঠাৎ আমাকে একটা নতুন কেনা মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল – ‘তাহলে ওই কথাই রইল। তুমি আমায় বে করছ’।

কথাটার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম – ‘সে কী! এমন কথা কবে হল’?

ও মুচকি হাসছে – ‘করবে না, এমন কথাও তো হয়নি!’ তারপরই পেটেন্ট অট্টগামি হেসে বলল – ‘ফোনটা রাখো। রোজ ফোন করব। কবিতা শুনব। কথা রইল।’

কথা রেখেছিল রাজন। রোজ ফোন করত। মিনিট পাঁচ-দশ কথা হত। কবিতা শুনত। নতুন কি লিখেছি জানতে চাইত। তবে যাকে বলে প্রেমে গদগদভাষণ, - তা আমরা কেউই করতাম না। বেশিরভাগটাই জরুরি অথচ আন্তরিক কথা।

এরকমই একদিন ফোন করে কেস খেয়েছিল।

সেদিন আমি স্নানে গিয়েছি। ফোনটা বাজছে দেখে বাবা রিসিভ করেছেন। রাজন আশা করেনি বাবা ফোনটা ধরতে পারেন! সে বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনোমতে গলা পালটে বলে – হ্যাঁ, টিকিপিসি আছেন?’

কিন্তু আমার বাবা দুষ্টুবুদ্ধিতে ওরও বাবা! হেসে বললেন – ‘নাঃ, টিকিপিসি স্নানে গিয়েছেন। তুমি বরং ততক্ষণ টেকোপিসোর সঙ্গে কথা বলো রাজা।’

একেবারে যাকে বলে ছড়িয়ে ছত্রিশ!

তবে রাজনের সবচেয়ে বড় রসিকতাটা আমি আজও ভুলিনি। ভোলা সম্ভব নয়।

২রা অক্টোবর ২০০৬ রাত দশটা নাগাদ ফোন এল। এ প্রান্তে খুশি খুশি গলা। খুব একচোট হেসে বলল – ‘রাবনটাকে পটিয়েছি বুঝলে। (রাবণ, ওর বস) দু'সপ্তাহের জন্য আসছি। কালকের ফ্লাইটেই। তুমি প্ল্যান করে রাখো... কোথায় কোথায় যাবে। এবার খুব বেড়াব। খুব বাইরে খাব। আর সিনেমা দেখবো। দিল্লির খানদানি আদব-কায়দাও শিখেছি। সব দেখাব। প্ল্যান করে রাখো’।

প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিলাম ইয়ার্কি মারছে।

-সত্যি?
- হ্যান্ড্রেড পার্সেন্ট। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই তুমি আমার চাঁদমুখ দেখবে। আ-ই শ-প-থ।’

পরদিন সকালে কিন্তু ও এলো না।

সারাদিন কেটে গেল। কিন্তু রাজন এল না। সন্ধে গড়িয়ে গেল। তাও এল না। বুঝে গেলাম ওটা ইয়ার্কিই ছিল। মনে মনে রাগ করে বসে আছি। - দাঁড়াও, আরেকবার ফোন করুক হতভাগা... ।

রাত্রে ফোন এল। ওর নয়, ওর কলিগের।

রাজা 2nd October রাত এগারোটায় একটা ট্রাকের সঙ্গে accident করেছে…। বাইকটা ভেঙে চুরমার... আর তার আরোহী স্পট ডেড...!

জন্ম – ২রা মে, ১৯৭৭, মৃত্যু – ২রা অক্টোবর, ২০০৬।

এটাই ওর সবচেয়ে বড় রসিকতা!

‘...রঘোঁ মে দৌড়নে ফিরলে কা হাম নেহি কায়ল  

যব আঁখ হি সে না টপকা, তোর ফির লহু ক্যায়া হ্যায়!!!’

মির্জা গালিব আমার বড় প্রিয়। বড় সত্যি কথা বলেন ভদ্রলোক... !

সমাপ্ত

 

সায়ন্তনী পূততুন্ড
লেখিকা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top