সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

একটি সত্যি ভূতের গল্প : ড. গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
২৯ জুলাই ২০২১ ২০:৩২

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:২৩

 

অপূর্ব স্যার আসার আগে হাবিববুর বনিয়াদী বিদ্যালয় কেমন একটা ম্যাড়মেড়ে স্কুল নিল। ছাত্র ছিল, শিক্ষক ছিল, স্কুল বিল্ডিং ছিল, খেলার মাঠ ছিল কিন্তু কোনোকিছুতেই তেমন প্রাণ ছিলনা। মাস্টাররা আসত, ক্লাস নিত, চলে যেত। ছাত্ররাও আসত, ক্লাস করত, পড়া না পারলে মাষ্টারমশাইয়ের পিটুনি খেত, বাড়ি ফিরে যেত। সবটাই ছিল গতানুগতিক, যেন ছাঁচে ঢালা। ছাত্র-শিক্ষক সবাই যেন দায়ে পড়ে আসত, স্কুলকে ভালোবেসে বা ভালোবাসার টানে আসতোনা। এই ব্যাপারটাই অপূর্ব স্যার স্কুলে জয়েন করার পর বদলে গেল।

অপূর্ব স্যারের পুরো নাম অপূর্বশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ জন্ম, লেখাপড়া সব কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে এমএসসি করেছেন। চাকরি এরকম এক গণ্ডগ্রামের স্কুলে হওয়ায় বাড়ির লোকজন থমকে গিয়েছিল। ওনার বাবা তো এই চাকরি নিতে বারণই করেছিলেন। কিন্তু উনি জেদ ধরলেন এই চাকরিই করবেন, তখন ওনার মা সাপ-খোপ, মশা-ম্যালেরিয়ার দেশে ছেলের বিপদ কল্পনা করে রাত্রদিন চোখের জল ফেলেছিলেন। সেই অপূর্ব স্যার এই হাবিবপুরে এসে ছমাসের মধ্যে সবাইকে চমকে দিলেন।

প্রথম ঘটনাটা ঘটল ওনার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে। কলকাতার ছেলে মফঃসলে চাকরি করতে আসছে শুনে হেডমাস্টারমশাই থেকে শুরু করে স্কুলের সেক্রেটারি সবাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। এই গণ্ডগ্রামে ওনার জন্য একটা উপযুক্ত বাসস্থান খুঁজে বের করা খুব সমস্যার। সেই সমস্যা অপূর্ব স্যার প্রথমদিনেই সমাধান করে দিলেন। স্কুলের একটা চার-কামরার হোস্টেল আছে। সেখানে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা দশ-বারোজন ছাত্র গাদাগাদি করে থাকে। মেয়েদের জন্য কোনো হোস্টেল নেই। ওই হোস্টেলের 'নাম কা ওয়াস্তে' একজন সুপারও আছেন। তিনি হলেন ভূগোলের টিচার প্রভাতবাবু। তিনিই নম নম করে হোস্টেল দেখাশোনা করতেন। যদিও সুপারের থাকার জন্যে এক কামরার একটা ঘর আছে, তবে প্রভাতবাবু কোনোদিন থাকেননি। তাঁর বাড়ি এখান থেকে মাইল আষ্টেক দূরে কৈকালায়। তিনি সাইকেলে যাতায়াত করেন। অপূর্ববাবু এসে ওই ঘরের দখলই নিলেন শুধু নয়, প্রভাতবাবুকে নিষ্কৃতি দিয়ে হোস্টেলের সুপারের দায়িত্বও নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। কদিনের মধ্যেই হোস্টেলের শ্রী ফিরে গেল। ভিতর-বাহির পরিষ্কার হল। বাইরের জমি কুপিয়ে ফল-ফুলের গাছ বসল। সর্বোপরি স্কুলের জমিতে একটা ভলিবল কোর্ট আর একটা ক্রিকেট পিচ তৈরি হল। হাবিবপুরে তখন বিদ্যুৎ এসে গেছে। অপূর্ববাবু স্কুলে জয়েন করলেন শীতের মুখে। একসপ্তাহের মধ্যে ভলিবল কোর্টে আলোর ব্যবস্থা করে রাত্রিবেলা হোস্টেলের ছেলেরা ভলিবল খেলতে শুরু করল এবং স্যার নিজেও সেই খেলায় যোগ দিতেন। গেমস পিরিয়ডে ক্রিকেট পিচে ছেলেদের কোচিং শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দুটো খেলার জন্যেই স্কুলের একটা আর হোস্টেলের একটা টিম বানিয়ে ফেললেন, তাদের মধ্যে শুরু করলেন প্রতিযোগিতা। স্কুলের পিছনের দিকে বড় মাঠটা এতদিন অনাদরে পড়েছিল। সেই মাঠ সংস্কার করে ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি, খো খো ইত্যাদি খেলা শুরু হল। শেষ দুটি খেলায় মেয়েদেরও আলাদা টিম তৈরি হল। আস্তে আস্তে অপূর্ব স্যার স্কুলে কেবল ছাত্রছাত্রীদের কাছেই নয়, শিক্ষকদের কাছেও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। হেডমাস্টার মশাইয়ের মুখে সর্বদাই অপূর্ব স্যারের প্রশংসা। আস্তে আস্তে অন্য শিক্ষকদের মধ্যেও পরিবর্তন এল, কখন যেন কাজের জায়গাটা ভালোবাসার জায়গায় বদলে গেল কেউ টেরই পেলেন না।

অপূর্ব স্যারের আরেকটা বড় গুণ ছিল তিনি প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে নামে চিনতেন, এবং তাদের পারিবারিক ব্যাপারেও আগ্রহ দেখাতেন। ফলে কোন ছাত্রের কি সমস্যা, কে সকালে না খেয়ে স্কুলে আসে, কার বাবা অসুস্থ হয়ে তিনমাস বিছানায় পড়ে আছেন, সব তাঁর জানা হয়ে যেত। তিনি আর অন্যান্য শিক্ষকেরা মিলে ছাত্রদের জন্যে যথাসাধ্য করতেন। এ ঘটনা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের। তখন প্রযুক্তির যুগ শুরু হয়নি। মানুষের মধ্যে 'আপনি কোপনি' মানসিকতা তৈরি হয়নি। মানুষে-মানুষে, ছাত্র-শিক্ষকে সম্মানের এবং ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হত।

শুধু খেলাধুলা নয়, পড়াশোনার ব্যাপারে স্যার খুব কঠোর ছিলেন। ওনার জিদ ছিল মারাত্মক। যতক্ষন না ক্লাসের সবচেয়ে কমজোরি বা অন্যমনস্ক ছেলেটি কোনো অঙ্ক বুঝত ততক্ষণ তিনি ছাড়তেন না। পড়াশোনার সাথে সাথে বার্ষিক স্পোর্টস, প্রতিষ্ঠা দিবস, সরস্বতী পূজা, পঁচিশে বৈশাখ নিয়ে স্কুল যত মেতে উঠল, স্কুলের নাম ততই চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

আমরা যখন স্যারের ছাত্র ছিলাম তখন স্যারের কতই না বয়স হবে! চব্বিশ-পঁচিশ, লম্বায় প্রায় ছয়ফুট, ফর্সা চেহারা, সরু করে ছাঁটা গোঁফ। তাঁর মধুর স্বভাবের জন্য সমস্ত ছাত্রছাত্রী যেমন শ্রদ্ধা করত, তেমনি ভালোবাসত। একদিন স্যার ক্লাসে এসে বললেন, “আজ অঙ্ক নয়, আজ গল্প বলার ক্লাস হবে”। আমরা তো আনন্দে আত্মহারা। স্যার মাঝেমাঝে ক্লাসে এসে এরকম আচমকা আনন্দ বইয়ে দিতে পারতেন। তা ওইদিন গল্প বলার ক্লাসে সবাই গল্প বলছে। স্যার বলেছেন প্রত্যক্ষ কোনো ঘটনার কথা বলতে হবে। আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে পড়ত - হাফিজ। খুব কম কথা বলত, একটু লাজুক ছিল। অপূর্ব স্যারের মত মানুষের কাছেও সহজ হতে পারতোনা। সেই হাফিজের পালা এল গল্প বলার। প্রথমে তো কিছুতেই কিছু বলবেনা, অনেক করে বলার পর রাজি হল। বলতে শুরু করার পর কখন ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি। পরের ক্লাসের মাস্টারমশাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দেওয়াতে অপূর্ববাবু চেতনায় ফেরেন এবং হাফিজের সাথে পরে কথা বলবেন বলে শঙ্করবাবুর কাছে দুঃখপ্রকাশ করে স্টাফরুমে ফিরে গেলেন।

শুধু স্যার নন, হাফিজের গল্প শুনে আমরাও ব্যোমকে গেছি। ছুটির পর সবাই মিলে হাফিজকে চেপে ধরি। ও সমানে একই কথা বলে গেল, এটা একেবারে সত্যি ঘটনা, এতটুকু বানানো নয়। হাফিজের বাড়ি এখান থেকে প্রায় সাত-আট কিলোমিটার দূরে চক- গোবিন্দপুর। তাদের গ্রামে বহু পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি আছে। তার কোনো কিছুই আস্ত নেই, সব ধসে ধসে পড়েছে। বহুকাল আগে এক ডাকাতের দল ডাকাতি করতে এসে বাধা পেয়ে বাড়ির সবাইকে খুন করে লুটপাট করে নিয়ে চলে যায়। সেই থেকে ওই বাড়িতে আর কেউ বাস করেনা। পারতপক্ষে ওদিকে কেউ যায়না। লোকে বিশ্বাস করে রাতের বেলা অশরীরীরা ওই বাড়িতে জেগে ওঠে। অতীতে দুয়েকজন অতি উৎসাহী ব্যক্তি সকলের বারণ অস্বীকার করে ওই বাড়িতে রাত্রি কাটিয়েছিল, পরেরদিন সকালে কেউ তাদের দেখেনি, তাদের পরিণতি কি হয়েছে তাও জানতে পারেনি।

এরপর কয়েকদিন অপূর্ব স্যার মাঝেমাঝেই হাফিজকে ডেকে পাঠাতে লাগলেন। একদিন শুনলাম হাফিজ রাত্রে হোস্টেলেও ছিল। ও এমনিতেই কম কথার ছেলে, তার ওপর নিশ্চয়ই স্যার কিছু বলতে বারণ করে দিয়েছে, তাই ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে জানতে পারলাম না। এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে হাফিজ আর অপূর্বস্যার দুজনেই দিন দুয়েক স্কুল ডুব মারল। আমরা দুইয়ে দুইয়ে চার জানলেও কিরকম একটা হিসেবের গোলমিলে ফেঁসে রইলাম। দুদিন পর দুজনেই একসাথে ফিরল। আমরা ক্লাসে হাফিজকে চেপে ধরলাম। ও তোতাপাখির মত একই কথা বলে যেতে লাগল, ওর পেট খারাপ হয়েছিল, তাই স্কুল আসতে পারেনি। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে ছিল, ভবেশ। বিশাল চেহারা, স্কুলের ফুটবল টিমে সেন্ট্রাল ব্যাকে খেলে। ওর পাশ দিয়ে বল বের করে নিয়ে যাওয়া আর এভারেস্ট অতিক্রম করা এক ব্যাপার। তার ওপর আবার ভীষণ রগচটা। ও হাফিজকে কিছুক্ষণ ছোট ছোট চোখ করে দেখছিল, তারপর হঠাৎ উঠে সবাইকে সরিয়ে হাফিজকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালে চেপে ধরল। বাঁ হাতটা গলার ওপর রেখে হুঙ্কার দিল, “এই সত্যি করে বল কি হয়েছিল, তা নাহলে গলাটা পুরো চেপে দেব”। হাফিজ চিঁ চিঁ করে বলল, “স্যার আমাদের বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু আমাকে বলেছে কাউকে যেন না বলি”। ভবেশের সাথে আমরাও বেশ অবাক হয়ে গেছি। হাফিজ প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওখানে গিয়ে কি হয়েছে আমি বলতে পারবো না, কারণ স্যার বলেছেন বললে চরম শাস্তি দেবেন”। আমরা সবাই চুপ। বাকি ক্লাসগুলো শেষ করে স্কুলছুটির পর ক্লাসঘরেই মিটিং বসল। আমরা বুঝতে পারছিলাম হাফিজের সেদিনকার গল্পের সাথে স্যারের ওদের বাড়ি যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। হাফিজকে আর চাপ দেওয়া যাবেনা, তাহলে রহস্যটা জানা যাবে কি করে! সেটাই মিটিংয়ের মুখ্য বিষয়। অনেকেই অনেক কিছু বললো, কিন্তু কোনোটাই যুতসই হলনা। অবশেষে ঠিক হল, স্যারের মুখ থেকেই এই রহস্যের কার্যকারণ শুনতে হবে৷ সেইমত ঠিক করলাম পরেরদিন স্কুলছুটির পর স্যারের হোস্টেলে ধাওয়া দেব। দেখা যাক না, কি হয়!

স্যারের মধ্যে কিছু একটা ঘটে গেছে, চেহারায় আগের সেই উৎসাহের ভাবটা উধাও। দুদিন পর পর ক্রিকেট প্র্যাকটিস বন্ধ রাখলেন। পরেরদিন যখন ওনার ঘরে পৌঁছলাম তখন উনি ঘরে ফিরে স্কুলের পোশাকেই শুয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। আমাদের আসার কারণ শুনে রেগে গেলেন কিনা বোঝা গেলনা। উঠে একগ্লাস জল খেলেন, তারপর আবার বিছানায় বসলেন। মুখখানা আগের চেয়ে একটু স্বাভাবিক মনে হল, আমাদের দিকে চেয়ে একটু হাঁসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন।

“ছোটবেলা থেকেই অলৌকিক ব্যাপার আমাকে টানে। তার সবচেয়ে বড় কারণ, আমি এগুলো বিশ্বাস করি না। এর আগেও আমি বহুবার অলৌকিক অভিযান করেছি, এবং প্রতিবারই আমার ধারণাই সত্যি হয়েছে, অলৌকিক বলে কিছু হয়না, সবই লৌকিক। ওসব কিছু স্বার্থান্বেষী লোকের রটনা। সেদিন হাফিজের গল্প শুনে আমি ক্লাসেই ঠিক করে ফেলি ওর গ্রামে যাবো। কিন্তু হাফিজকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না। ওর এক কথা, স্যার আমাদের বাড়িতে যাবেন, সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু ওই জমিদার বাড়িতে যেতে চাইবেন না। আব্বা-আম্মু, পাড়ার লোকজন কেউ আপনাকে যেতে দেবেনা। আপনি চলুন, আমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবো। আমাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে একটা নদী চলে গেছে। আপনার খুব ভালো লাগবে। কিন্তু ওই জমিদারবাড়ি যাওয়ার কথা বলবেন না স্যার। কিন্তু আমি আমার জেদ ছাড়িনা। অবশেষে হাফিজ যেদিন রাতে হোস্টেলে ছিল সেদিন ও নিমরাজি হয়। পরেরদিন ওর হাতে ওর বাবাকে একটা চিঠি লিখে পাঠাই। ওইদিনই স্কুল ছুটির পর আমি ওদের বাড়ি পৌঁছই। রাত্রে ওর বাবা, পাড়ার কিছু বয়স্যদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের আশ্বাস দিই, আমি বাড়াবাড়ি কিছু করবো না, বিপদ বুঝলেই তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসবো। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান হাফিজের চাচাতো ভাই হয়। তিনি বললেন, “একটা শর্ত আছে মাস্টারমশাই, আমি গ্রামের গোটা চারেক ছেলেকে ওই বাড়ির বাইরে পাহারায় রাখবো। কোনো বিপদ হলে আপনি সংকেত দেবেন, ওরা আপনার সাহায্যে এগিয়ে যাবে”। বাধ্য হয়ে ওনার শর্ত মেনে নিতে হল। পরেরদিন সন্ধ্যার মুখে হাফিজের আম্মুর বানানো খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে, একটা মাদুর, বালিশ, হ্যারিকেন, একটা টর্চ, গল্পের বই, একটা ছুরি, খবরের কাগজ, জলের বোতল আর চায়ের একটা ফ্লাস্ক নিয়ে রওয়ানা হলাম। বেশ কিছুটা দূর থেকেই বাকিদের ফিরে যেতে বললাম, আর যে চারটে ছেলে পাহারা দেবে তাদের বললাম তোমরা তোমাদের মত রাতের খাবার খেয়ে এস৷ জমিদার বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই সন্ধ্যা নেমে এলো।

বাড়িটা যতটা পুরোনো হবে ভেবেছিলাম, এসে দেখলাম তার চেয়েও বেশি পুরোনো। অমাবস্যার ঘন কালো রাত। টর্চের আলোয় যতটুকু বুঝলাম এ বাড়িতে দীর্ঘদিন কারোর পায়ের চিহ্ন পড়েনি। মূল ফটক ঝোপজঙ্গল হয়ে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। ছুরি দিয়ে অল্পবিস্তর জংলা সাফ করে ভিতরে ঢুকলাম। নিচের তলায় প্রশস্ত বারান্দার দুদিকে সার সার ঘর। তবে কোনো ঘরটাই আস্ত নেই। বারান্দার শেষে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে একটা প্রকান্ড দরজা। একট জোর দিয়ে ঠেলতেই একটা অপ্রাকৃত আওয়াজ তুলে দুটো পাল্লা খুলে গেল। টর্চের আলোয় যেটুকু বুঝলাম এটা বাবুদের নাচঘর ছিল। সিলিংয়ে বড় বড় ঝাড় ঝুলছে, এখন সেগুলো ধুলো, ঝুলকালিতে কালো হয়ে আছে। ওই ঘর থেকে ফিরে করিডোরের মাঝ বরাবর দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। হ্যারিকেনের আবছা আলোয় পথ চিনে দোতলায় উঠতে লাগলাম।

দোতলার ঘরগুলো আরও বেশি ভেঙে পড়েছে। প্রায় একটারও মাথার ওপর আস্ত ছাদ নেই। তবু এর মধ্যেই মন্দের ভালো একটা ঘরে রাত্রে থাকা মনস্থ করলাম। ঘরটা একটু পরিষ্কার করে মেঝেতে মাদুর পেতে বসলাম। ঘরটা একটা সময় শোয়ার ঘর হিসেবেই ব্যবহার হত। দেওয়াল ঘেঁষে একটা পালঙ্কের কঙ্কাল দাঁড় করানো। হাতের ঘড়ি বলছে রাত আটটা। এখনও অনেকটা সময় কাটাতে হবে। খবরের কাগজটা খুলে বসলাম। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল, কিছুই ঘটলোনা। মনের মধ্যে হাঁসির উদ্রেক হল। অশরীরী আছে কিনা জানিনা, আর যদি থাকেও আমার মত অতি অবিশ্বাসীর সামনে আসার উৎসাহ পায়না। তবে রাত শেষ হতে এখন অনেক দেরি, তাই এখন থেকেই কিছু ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। ভাবলাম এককাপ চা গেয়ে গা টা একটু গরম করে নিই। পাশে রাখা ফ্লাস্কের দিকে হাতটা বাড়িয়েছি, এমম সময় চমকে দিয়ে কিছু একটা দৌড়ে এসে হ্যারিকেনটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক করে তাকানোর আগেই হ্যারিকেন উল্টে দপদপ করতে করতে নিভে গেল। ওইটুকু আলোয় মনে হল কিছু একটা দৌড়ে গিয়ে জানলার ওপর উঠে বসেছে। অন্ধকারে হাতড়ে আগে হ্যারিকেনটা সোজা করি, তা নাহলে তেল পড়ে বসার জায়গাটার বারোটা বাজাবে। দেশলাই খুঁজে আলো জ্বেলে দেখি জানলার ওপর একটা কালো বেড়াল বসে আছে, আর প্রচন্ড রাগী রাগী চোখে আমার কান্ডকারখানা দেখছে। বুঝলাম তার রাজত্বে আমার এই অনুপ্রবেশ পছন্দ হয়নি। কিন্তু বিড়ালটার তাকানোর মধ্যে কিছু একটা আছে, কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। ভয় না পেলেও বেড়ালটার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় অস্বস্তি বাড়তে লাগল। আমি কখনও কোনো বিড়ালকে এভাবে তাকাতে দেখিনি। আমি হাত তুলে হুশ হুশ করে তাড়াতে চাইলে সে-ও গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে লাগলো। গায়ের লোমগুলো ফুলতে লাগল। এবার একটু ভয় পেলাম, টর্চটা বাগিয়ে ধরলাম। আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য টর্চের আলো ফোকাস করতেই একটা অদ্ভুত হাড় কাঁপানো আওয়াজ ছেড়ে বেড়ালটা লাফ মারলো। এত জোরে লাফ দিল যে তার মাথা সিলিংয়ে ঠেকে গেল। আমি এক লাফে বসা অবস্থাতেই পিছনে সরে গেছি। আর অবাক চোখে দেখছি, ধাক্কা লেগে বিড়ালের মুন্ডুটা সিলিংয়ে ঝুলে রইল, আর ধরটা পড়ল আমার থেকে পাঁচ হাত দূরে। আর আরও আতঙ্কের কথা, কাটা মাথাটা আবার আগের মত ক্রূর দৃষ্টিতে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি তখনও সজ্ঞানে আছি, বুঝতে পারছি কিছু একটা দৃষ্টি বিভ্রমের পালা চলছে। আমি ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ নামালাম। চা-পানের আর সাহস পাচ্ছিনা। বইয়ের অক্ষর গুলো বড় হতে হতে বেড়ালটার চোখের সাইজের হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় বাইরের বারান্দা থেকে কুকুরের আর্তচিৎকার ভেসে এল, এখানে আবার কুকুর কোথা থেকে এল! কেউ যেন কুকুরটাকে নিষ্ঠুর যন্ত্রনা দিচ্ছে। আওয়াজটা এত জোরে আসছে, মনে হচ্ছে আমার ঘরের বাইরেই কুকুরটা পড়ে আছে। আমি টর্চটা নিয়ে উঠে পড়ি। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে টর্চটা জ্বালাতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, আমার মত অবিশ্বাসী লোকেরও সারা শরীর কেঁপে উঠল। ঘরের ঠিক বাইরে একটা কুকুর শুয়ে আর্তনাদ করছে। গলার নলিটা কেউ কেটে দুটুকরো করে দিয়েছে, রক্ত বেরিয়ে সারা বারান্দা ভেসে যাচ্ছে। আর সেই রক্তস্রোত ধরে সারি সারি বসে আছে অসংখ্য রক্তখেগো বাদুড়, তারা নীরবে সেই টাটকা গরম রক্ত পান করে চলেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের গলা কাটা অবস্থায় কুকুরটা কেঁদে চলেছে। এবার আমাকে ধাক্কা মেরে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গুটি গুটি হেঁটে বেরিয়ে গেল কালো বিড়ালটা। দেখলাম তার ধড়-মুন্ডু আবার জুড়ে গেছে। যেতে যেতে আবার দিকে আবার একটা ঠান্ডা দৃষ্টি হেনে কুকুরের কাটা মুন্ডুতে নাক ডুবিয়ে কি একটা শুঁকল, তারপর স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে গেল। ভ্যানিশ হয়ে গেল, না অন্ধকারে হারিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। মাঝখান থেকে আমার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেল।

বুঝতে পারলাম রাতের অন্ধকারে এবাড়িতে কিছু একটা ঘটে চলেছে। আশপাশে অনেক অলৌকিক উপস্থিতি টের পাচ্ছি, অনেক কিছু ঘটে চলেছে, সব আমার চোখেও পড়ছে না। তবে বুঝতে পারছি আমার উপস্থিতি এ বাড়ির কারোর পছন্দ হচ্ছেনা। এইমাত্র একটা বাচ্ছা হঠাৎ কেঁদে উঠলো। কোনো মহিলা খোনা গলায় গান শুনিয়ে বাচ্চাকে ভোলাতে চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা এবাড়িতেই ঘটছে, কারণ আশপাশে অন্য কোন বাড়ি নেই। হঠাৎ ধপ করে একটা শব্দ, চমকে দেখি কালো বিড়ালটা আবার ফিরে এসেছে। আমার সামনে ধড়টা ফেলে দিয়ে মুন্ডুটা আবার সিলিংয়ে ঝুলিয়ে আমার পানে সেই হাড় হিম করা দৃষ্টি হানতে শুরু করলো৷ ওই দৃষ্টির সামনে বসে থাকা বেশ অস্বস্তিকর। আমি খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে বইটা খুলে বসলাম। রাত দশটা বেজে গেছে, খিদেও পেয়েছে। কিন্তু ওই দৃষ্টির আওতায় খাবার বের করে খেতে অস্বস্তি হচ্ছে। বইটা পড়ার চেষ্টা করেও একটা পাতা পড়তে পারছি না। বাইরে কুকুরটার চিৎকার থেমে গেছে। এতক্ষনে বোধ হয় প্রাণবায়ু বেরোলো। কিন্তু আমাকে অবাক করে কুকুরটা আবার ভুক ভুক করে ডাকতে লাগল। ওই ককুরটাই হবে, কিন্তু তা কি করে হয়! আবার উঠে এবার হ্যারিকেনটা নিয়ে এগোই। বাইরে গিয়ে আবার ঘরে ঢুকে পড়ি। এত রাতে এ বাড়িতে আমি ছাড়া আবার কে এল! দেখলাম, সাদা থান পড়া এক মহিলা পিছন ফিরে কুকুরটাকে ভাতমাখা খাওয়াচ্ছে। আর ধড়হীন গলাকাটা কুকুরটা সেটা খেয়ে চলেছে। ওদিকে রক্তচোষা বাদুরদের রক্তপানেও কোনো বিরাম নেই। মহিলা কে দেখার জন্য আবার উঁকি মারি। খাওয়ানো সেরে মহিলা উঠে দাঁড়ান, বাঁ হাতে এক ঝাঁকা এঁটো কাঁসারের বাসন, বোঝাই যাচ্ছে ধুতে যাচ্ছেন। কিন্তু যাওয়ার আগে ঘোমটার মধ্যে দিয়ে যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন সেটা দেখে আবার বুকের মধ্যে একটা ভয়ের পিন্ড যেন আটকে গেল৷ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, নিজের শ্বাসের আওয়াজে নিজেই চমকে চমকে উঠছি। হ্যারিকেনের আলোয় দেখলাম বৃদ্ধার চোখের জায়গায় বড় বড় দুটো গর্ত, আর সেখানে অক্ষি গোলকের জায়গায় দুটো আগুনের গোলা বসানো, গোলা গুলো প্রচন্ড গতিতে ওই গর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথাটা টনটন করে উঠল৷ তাড়াতাড়ি ঘরে এলাম। ফিরে দেখি বেড়াল গায়েব, না আছে তার ধড়, না মুন্ডু।

বুঝলাম এবাড়িতে আমি ছাড়া আরও অনেকে আছে, সে শরীরী, অশরীরী যেই হোকনা কেন। ইতিমধ্যে আশপাশ, উপর-নিচ থেকে নানারকম অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে লাগল। হঠাৎ 'বল হরি হরিবোল' বলে একটা আওয়াজে যারপরনাই চমকে উঠলাম। তার সঙ্গে কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন শুরু হল। আমি আর ওঠার চেষ্টা করলাম না। সহসা বারান্দাতে আলোর রোশনাই বয়ে গেল। সেই আলোয় দেখলাম, একের পর সম্ভ্রান্ত পুরুষ, কারোর হাতে সুদৃশ্য লাঠি, কারোর হাতে ছাতা, দরজার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁদের পিছনে পিছনে চলল সংকীর্তনের দল। এরপর হুড়মুড় করে এল মহিলা আর শিশুর দল। সবাই উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে চলল। তাঁদের কান্না অন্ধকার রাত্রের ভাঙা প্রাসাদের এককোনা থেকে আরেক কোনায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সকলের সাজপোশাক দেখে মালুম হল বাইরের জগৎটা টাইম মেশিন চড়ে কয়েকশো বছর পিছিয়ে গেছে। সবার পিছনে ‘হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনি দিতে দিতে আটবেয়ারা খাটে শুয়ে মৃতদেহ নিচে নেমে গেল। কেউ একবারের জন্যও অন্ধকার ঘরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে থাকা পার্থিব মানুষটার দিকে ফিরেও তাকালোনা। এই প্রথমবারের জন্য মনে হল এই অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে...এবং এক্ষুনি। কিন্তু কিসের একটা বন্ধনী যেন আমাকে আটকে রেখেছে। চোখের সামনে যা দেখলাম, ঘর ছেড়ে বেরোনোর সাহস পর্যন্ত পাচ্ছিনা। মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম, বাইরে যে ছেলেগুলি পাহারায় আছে, তারা এই অশরীরী বন্ধন ছিঁড়ে আমাকে বাইরে নিয়ে যাক।

আবার অদ্ভুত অন্ধকার আর নৈঃশব্দতায় চারপাশ ডুবে গেল। আলো কখন নিভে গেছে, জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। খিদের ইচ্ছাও চলে গেছে। বোতল থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে একটু জল খেয়ে মাদুরের ওপর শরীরটা ছেড়ে দিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি খেয়াল করতে পারলাম না। ঘুমটা ভাঙল একটা বেহালার আওয়াজে। অদ্ভুত সুন্দর সুরে বেজে চলেছে। আস্তে আস্তে উঠে বসি। একটা অপার্থিব টান অনুভব করছি। সুরের জাদু ধীরে ধীরে গোটা বাড়িটাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলছে। একটা নিশিডাক টের পাচ্ছি। নিজে কি করছি, বুঝতে পারছি কিন্তু আটকাতে পারছিনা। আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। এখন সারা বাড়ি জুড়ে নরম কমলা আলো খেলে বেড়াচ্ছে; চারদিক আবছা দেখতে পাচ্ছি। চোখে পড়ল দোতলারও ঠিক মাঝবরাবর সিঁড়ি উঠে গেছে। আমার শরীরটা সিঁড়ি ধরে তিনতলায় পৌঁছল; তারপর ডানদিকে ঘুরে এগিয়ে চলল। মনে হল কতদিনের চেনা এই বাড়ি। কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকের একটা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে একটা নীল আলো জ্বলছে। কেউ কোত্থাও নেই, শুধু খোলা জানালার কাছে সাদা গাউনের মতো পোশাক পরে একটা মেয়ে পিছন ফিরে বসে বেহালা বাজাচ্ছে৷ আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাজনা শুনতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করে সেই সুরের মোহজাদুতে ডুবে গেলাম। এ এমন একটা সুর শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে টুপটাপ শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে, কখনও মনে হচ্ছে একটা নদী শরীরের ভিতর দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে শরতের পেঁজা মেঘের দল ভেসে যেতে যেতে সারা শরীরে শীতল পরশ বুলিয়ে চলে যাচ্ছে। একসময় বাজনা থামল, আমি চোখ মেলে তাকালাম। তখনও মেয়েটি পিছন ফিরে বসে। আমি হাততালি দিলাম, এবার সে পিছন ফিরে তাকালো। আবার বুকে কে যেন একটা তীব্র বর্শার ফলক বিঁধিয়ে দিল। পিছন ফিরে যে তাকালো সে কোনো মেয়ে নয়, পোশাকের আড়ালে ঢাকা একটা নরকঙ্কাল। সেই নারী কঙ্কাল আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে এল। আমি দরজার পাশেই বসে আছি। আমার প্রাণবায়ু গলার কাছে আটকে গেছে। যেতে যেতে নারীকঙ্কাল আমার কাছে এসে কয়েক মুহূর্ত থামল, সোজা তাকালো, আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেললাম৷ শুধু টের পেলাম প্রচন্ড কনকনে একটা ঠান্ডা হাওয়া আমার হাড়েমজ্জায় কাঁপন তুলে চলে গেল। আমি আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড়লাম। আবার সারা বাড়ি সর্বগ্রাসী আলকাতরা অন্ধকারে ডুবে গেছে। তারমধ্যেই ধড়ফড় করতে করতে নামতে থাকি৷ দোতলায় নেমে যে ঘরে বসেছিলাম সেদিকে দৌড়োই। অনেক হয়েছে, জিনিসপত্র নিয়ে এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। বুঝতে পারছি হাফিজের বাড়ির আর পাড়ার লোকের কথা না শুনে খুব ভুল করেছি। ঘরে ঢুকে অন্ধকারে দেশলাই হাতড়াতে লাগলাম। আলোটা জ্বালতে পারলে ভালো হত। কিন্তু কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা- মাদুর, বইপত্র কিছু নয়। কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে ঘরে ঢুকে পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁসেই মাদুরটা পেতেছিলাম। অন্ধকারে নির্ঘাত দিক ভুল করছি। জিনিসপত্রের আর মায়া করলে চলবেনা, ওসব পরে দেখা যাবে। এবাড়ি ছেড়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হবে। আমি দরজা লক্ষ্য করে দৌড় দিলাম। মাথাটা একটু টলে গেল। বুঝলাম পায়ের নিচের মেঝে কাঁপতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে হুড়মুড় করে জিনিসপত্র পড়ার শব্দ আসছে। হঠাৎ কাঁপুনি থেমে গেল। ঘরটা উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। আমি চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখি, ঘরটা বদলে গেছে। এবাড়িতে ঢুকে আমি যে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম সেটা এঘর নয়৷ এতো একটা বিশাল বৈঠকখানা মনে হচ্ছে। তার মধ্যে ছোট ছোট জলচৌকি সামনে রেখে তার ওপর জাবদা খাতা নিয়ে মাথা নিচু করে হিসেবনিকেশ করে চলেছে অনেক মানুষ। একটু তফাতে একজন বয়স্ক সম্ভ্রান্ত মানুষ গদি মোড়া চেয়ারে বসে আছেন। তার পাশে দুটো অপেক্ষাকৃত ছোট চেয়ার। কিন্তু সে চেয়ারে কেউ বসে নেই। দুজন ভদ্রলোক ওই প্রবীণ ব্যক্তির সামনে ওইরকমই লাল মলাটের মোটা খাতা খুলে কিসব দেখাচ্ছেন। আমার পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে এক-আধজন উঠে ঘরের এদিক ওদিক যাচ্ছে, কিন্তু কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, আমি ওদের দেখতে পেলেও ঘরের অন্যরা আমার উপস্থিতি টের পাচ্ছেনা।

কতক্ষণ কেটেছে জানিনা, আমি একটা ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ওই প্রবীণ ব্যক্তি হুঙ্কার ছাড়লেন। মেঝেয় বসে থাকা মলিন ধুতি-পাঞ্জাবী পড়া এক প্রৌঢ় হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে গেলেন। জমিদার নায়েবে হাতের খেরোর খাতার দিকে ইঙ্গিত করে কিছু একটা বললেন। সেটা শুনে ওই ব্যক্তি কাঁপতে কাঁপতে ওনার পায়ে পড়ে গেলেন। জমিদার বিনা বাক্যব্যয়ে এক লাথিতে ওনাকে তিন হাত দূরে ছিটকে দিলেন। এবার বাইরের দরজার দিকে ফিরে আরেকটি হুঙ্কার ছাড়লেন। কালো তেল কুচকুচে চেহারার এক পাহারাদার এসে নেংটি ইঁদুরের মতো ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর একটা মরণ চিৎকার গোটা প্রাসাদকে কাঁপিয়ে দিয়ে আশপাশে শ্মশানের স্তব্ধতা ফিরিয়ে নিয়ে এল, গোটা পরিবেশ আবার নিশি অন্ধকারে ডুবে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর চেতনায় ফিরলাম। এবাড়ি থেকে বেরোনোর পথটা খুঁজে পাবো সেই বিশ্বাসও চলে গেছে। আমার ইতিহাস ভূগোল সব গুলিয়ে গেছে। অতীত বর্তমান এত ঘন ঘন অদলবদল হচ্ছে, আমি নিজে প্রাকৃত না অতি প্রাকৃত সেটা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। আমি সেই অতিপ্রাকৃত অন্ধকারের মধ্যে অশরীরী হয়ে বসে রইলাম। মনে হচ্ছে অনন্তকাল এই অন্ধকারকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। হঠাৎ কানে এল গানবাজনার আওয়াজ, আর অনেকগুলো মানুষের গলা- “তওবা তওবা, লা জবাব, বহোত খুব, নাজুক নাজুক”৷ আস্তে আস্তে আওয়াজ বাড়তে লাগল। তবলা, সেতার, সারেঙ্গি ছাড়িয়ে ঘুঙুরের শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। কোনো একটা ঘর থেকে প্রচুর মানুষের জটলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আবার অন্ধকার ফুঁড়ে একটা নিশিডাক ভেসে এলো। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই একটা আলোর রেখা এঁকে বেঁকে আমাকে পথ দেখাতে লাগল। দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এগিয়ে চললাম, এতক্ষণ মনে পড়ল এ বাড়িতে ঢুকেই জলসাঘরটা দেখেছিলাম। আলোর রেখা আমাকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। করিডোর পেরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠতেই বিশাল দরজাটা আপনাআপনি খুলে গেল। কেউ যেন দরজার বাইরে আমার উপস্থিতি টের পেল। ভেতরে ঢুকে মুহূর্তের মধ্যে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সেই কালিঝুলি পড়া বিবর্ণ ঘরটি এখন ঝকঝক চকচক করছে। আলোর ঝাড়গুলি থেকে শত শত উজ্জ্বল বাতি গোটা ঘরটায় আলোর ঝর্ণা ধারা বইয়ে দিয়েছে। আসরের মাঝখানে এক সুন্দরী নর্তকী নেচে চলেছেন। তাঁরই পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজ ওপর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। তাকে ঘিরে বসেছে বাজনদার। ঘরের একদিকে ঘন চিকপর্দার আড়ালে বাড়ির মেয়েবউদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। বাকি অংশ জুড়ে আরাম কেদারা, সফেদ বিছানায় রঙিন পানীয়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে গান শুনছেন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ। একটু আগে বৈঠকখানায় দেখা জমিদার মশাই মোসায়েব পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। আসর জমে উঠেছে, সেই সঙ্গে জমে উঠেছে পান পর্ব। এখানেও আমার উপস্থিতি অশরীরী, কত লোক ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে কিন্তু কেউ চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। তবে ধাক্কা আমিই কি টের পাচ্ছি, শুধু মনে হচ্ছে হালকা মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি নাচগানে ডুবে গেলাম। আমার বোধ পুরোপুরি ওরা অধিকার করতে পারেনি, তবে টের পাচ্ছিলাম কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় আটকা পড়ে গেছি। এখন নিজের ইচ্ছেয় এই জলসা ছেড়ে কিংবা বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর ক্ষমতা নেই। সময় বয়ে যেতে লাগল। রাত যত গভীর হতে চলল, তত পান পর্ব আরও প্রাণ পেতে লাগল। জমিদারনন্দনরা এখন আরও দিলদার হয়ে উঠেছে। মুঠো মুঠো টাকা, সোনার গহনা নর্তকীর দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। নর্তকী সবাইকে আদাব দিতে সেইসব মুদ্রা, গহনা ব্লাউসের মধ্যে ঢোকাতে লাগলেন। এমন সময় ঘরের সব আওয়াজকে ছাপিয়ে একটা অন্যধরণের আওয়াজে উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। সকলের অগোচরে কখন ঘরের মধ্যে অগণিত কালো কাপড়ে মুখঢাকা ডাকাতের দল ঢুকে গেছে। তাদের হুহুঙ্কারে জমিদার নন্দনদের নেশাগ্রস্ত হুমকি চাপা পড়ে যেতে লাগল। ডাকাতের দল মুহূর্তের মধ্যে নর্তকীর কাছ থেকে সব টাকাপয়সা, সোনাদানা কেড়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জমিদার বাড়ির সদস্যদের ওপর। কয়েকজন পর্দা ছিঁড়ে মহিলাদের আসরে হানা দিল। মহিলা ও শিশুদের সমবেত কান্নায় জলসঘর ভরে উঠল। এবার জমিদারের পোষা লাঠিয়ালরা ডাকাতদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটা আর লুটপাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ডাকাত আর জমিদারের লেঠেলদের মধ্যে তুমুল সংঘাত শুরু হল। কিন্তু জমিদারের লোকেদের হাতে শুধুই লাঠি। কেউ একজন একটা গাদা বন্দুক এনে কয়েকবার দেগে দিল। কিন্তু ওই বন্দুকে কি হবে! ডাকাতদের কাছে বন্দুক ছাড়া, চকচকে সব মারণাস্ত্র ঝন ঝন করে উঠল। আমার চোখের সামনে একটার পর একটা লাশ পড়তে লাগল। নারী-পুরুষের মরণ চিৎকার আমাকে পাগল করে দিল। আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সেই প্রকান্ড ঘরে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াতে লাগলাম, কিন্তু সেই অমোঘ বন্ধন কেটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলাম না। ডাকাতদলের সমবেত অট্টহাস্যে যেন ঝাড়বাতির আলোগুলো ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়তে লাগল। গোটা ঘর জুড়ে মানুষের টাটকা রক্তের নদী বয়ে যেতে লাগল। আমার পা ডুবে গেল, রক্ত আস্তে আস্তে হাঁটু ছাড়িয়ে কোমরে উঠে এলো। আমি হাঁচরপাঁচর করতে করতে এই ঘর থেকে বেরোনোর দরজার দিকে এগোতে চাইলাম। কিন্তু চটচটে সেই তরল আমাকে এগোতে দিচ্ছেনা, আমি আস্তে আস্তে রক্তস্রোতে আটকে যাচ্ছি। এবার রক্তনদী বাড়তে বাড়তে আমার গলা পর্যন্ত ডুবে গেল। আমি কোনোরকমে মুখ উঁচু করে নাকটা রক্তনদীর বাইরে রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একসময় রক্ত নাক স্পর্শ করল, তারপর আর কিছু জানিনা।

গোটা ঘটনাটা প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করে স্যার হাঁফাতে লাগলেন। বিছানা ছেড়ে উঠে বললেন, তোরা আজ যা। আমার খুব ক্লান্তি লাগছে। মাথাটাও ধরেছে, আলো নিভিয়ে একটু শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। আমরা কোনো কথা না বলে উঠে পড়লাম। বাইরে কখন দিনের আলো মুছে গিয়ে অন্ধকার নেমেছে টের পাইনি।

পরে হাফিজের মুখে শুনেছি। সেরাত্রে কেউ সেই বাড়ির আশপাশে পাহারায় ছিলোনা। যাদের যাওয়ার কথা ছিল তাদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেয়নি। পরের দিন ভোরবেলা হাফিজের আব্বু, চাচু আর বড়ভাই গিয়ে স্যারকে ওই জলসাঘরে খুঁজে পায়। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে ধুলোর মধ্যে পড়ে ছিলেন। সারা গায়ে আর জামাকাপড়ে কালো কালো ছোপ দাগ ছিল। আর স্যারের গা থেকে তীব্র আঁশটে গন্ধ আসছিল।

 

গৌতম সরকার
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top