সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

ভূতুড়ে বাড়ির ঠিকানা : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৩ ডিসেম্বর ২০২১ ০২:১৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১৬

 

অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটিকে ভ‚তুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে রূপালির। নিজের বাড়িতে সন্ধ্যায় আলো জ্বালায় ও নিজে। আজ পাঁচ দিন ধরে বাড়িতে আলো জ্বালানো হচ্ছে না। অনেক দূর থেকে তাকিয়ে থাকে বাড়ির দিকে। মনে হয় বুকের ভেতর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকে। রূপালি দুহাতে চোখ মুছেও নিজেকে সামলাতে পারে না। প্রবল কান্নায় ভেসে যায় চারদিক। আশেপাশে কেউ নেই। গাছ-গাছালি ভরা নিরিবিলি এলাকা। দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে জোরে জোরে বলে, এ দেশ আমার, এ দেশ আমার। মাতৃভ‚মির পায়ে মাথা ঠেকাই। ধুম করে বসে পড়ে উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে মাথা সোজা করে।
- মাটি তুমি আমার বুকের ভালোবাসা।
মাথা সোজা করে নিঃশ্বাসে বাতাস টেনে বলে, বাতাস তুই আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস। গাছের উপর পাখির ডাক শুনে বলে, পাখি সোনামণিরা তোরা আমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
এমন ভাবনার মাঝে নিজের চিন্তা রেখে হাঁটতে শুরু করে রূপালি। ভাবে, অন্ধকারেই থাকুক আমার ঘরবাড়ি। আমি এখন থেকে অন্ধকারকে ভালোবাসব। যাদের নিষ্ঠুরতার জন্য বাড়ি অন্ধকার হয়েছে আমি তাদেরকে অভিশাপ দিব না। ওরা আমাকে পরাজিত করতে পারবে না। আমি অন্ধকার মাথায় তুলে নিলাম।
নিজেকে এমন চিন্তায় ডুবিয়ে দিয়ে চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে ছবি। মিথ্যা চুরির অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করে সন্তানসহ স্বামীকে। চোর সন্দেহে নির্যাতন করে দশ বছরের ছেলে পলাশকে। ওহ্, মারের চোটে প্রাণ ফাটিয়ে চিৎকার করে পলাশ। ওর চিৎকারে মাথায় ঘূর্ণি ওঠে রূপালির। স্বামী শ্রীকান্তকে নির্যাতনের সময় বেচারা ছেলের মতো চিৎকার করেনি। গোঁ- গোঁ শব্দে নির্যাতনের ডামাডোল জানান দিয়েছে। ওর সঙ্গে ছিল সাত বছরের শিমুল। বাবাকে নির্যাতন করতে দেখে ও চিৎকার করে কেঁদেছে। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ ওকে টেনে কাছে নেয়নি। আদর করে বলেনি, কাঁদিস না। ছোট্ট সোনা মানিক আয় আমার বুকে আয়।
রূপালি জোরে জোরে বলে, মানুষগুলো সব পাথর হয়ে গেছে। হয়ে যাক পাথর। এই পাথর দিয়ে আমার মাথা টুকরা করতে পারবে না। আমাকে গ্রাম ছাড়ার হুমকি দেয়। আমাকে গ্রাম ছাড়া করতে পারবে না। ওদের হুমকিতে আমি ভয় পাই না। আমরা তো এদেশের মানুষ। আমরা মায়ের ভ‚মি ছাড়ব কেন?
এভাবে নিজের সঙ্গে বোঝাপাড়া করে রূপালি। পরে ওর মনে হয় নিজে নিজে এসব কথা ভাবলে তো হবে না। ওর চারপাশের দানবরা কখনোই এসব কথা শুনবে না। ওদের মাথায় পাথর আছে, কলজের মধ্যে পাথর আছে। পাথর নিয়ে ভেবে বলে, কাউকে মেরে ফেলার জন্য ওদের মনে কোনো কষ্ট নাই। পরক্ষণে জোরে জোরে কাঁদে রূপালি। কাঁদতে কাঁদতে বলে, এমন পাথর হওয়া মানুষ আমি দেখতে চাই না। কেউ যেন পাথর না হয় একথা সবাইকে বলব। এমন কঠিন পাথর হওয়ার জন্য ওর ছয় মাসের মেয়েকে কোলে রাখার পরও গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল ওকে। ফয়েজ বলেছিল, এই মাইয়ামানুষ ভালো মানুষ হওয়া শিখ।
- তুই কি ভালো মানুষ?
একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ওর গালে থাপ্পড় মেরেছিল। গালি দিয়ে বলেছিল, হারামজাদী বেশি কথা বলে।
নিজের মাতৃভ‚মিতে এভাবে অপমানিত হবে এটা রূপালির ভাবনায়ও আসতে পারে না। ও মাতৃভ‚মিতে নিজেকে সোনার মানুষ মনে করে। ওতো কারো প্রতি কোনো অন্যায় করে না। কাউকে ভালোবাসা ছেড়ে ঘেন্নার চোখে দেখে না। তবে ও কেন এভাবে মানুষের খারাপ আচরণ পাবে। কোনো কোনো মানুষ ওকে মাটি থেকে উপড়ে তুলে ফেলে দিতে চায়।
রূপালি অনবরত নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। নিজেকে বলে, ধর্ম সবার পবিত্র বিশ্বাস। সবাই অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে। কখনো ধর্মের নামে জ্বালাও-পোড়াও করবে না। খুন করে রাস্তায় ফেলে রাখবে না। ওরা আমার বাড়ি খালি করে রেখেছে আমাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে দখল করে নেয়ার জন্য। এই শয়তানগুলোকে মেরে পুড়িয়ে ফেলা দরকার।
দু’হাত মাথার উপরে তুলে নাড়াতে থাকে। চারদিকে হাঁটে, তারপর মাঠের মাঝখানে বসে মাটিতে মাথা ঠেকায়। আবার উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে ঘুরতে থাকে। একটু পরে দেখতে পায় লোকজন আসা-যাওয়া শুরু করেছে। ও দ্রæতপায়ে হেঁটে বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছের মোটা কাÐের আড়ালে চলে যায়, যেন দূর থেকে কেউ ওেেক দেখতে না পায়। একসময় লোকজনকে চলে যেতে দেখলে গাছের কাÐে মাথা ঠেকিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে রাখে গাছের কাÐ। নিজের ওপর রাগ হয়। কেন ও নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? ওরা কি অপরাধ করেছে। হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে বলে কি নিজের দেশের মাটি থেকে তাড়িয়ে দেবে ওদের? তাড়িয়ে দিয়ে এই ছোট ঘর দখল করবে। নিজের একটা ঘর দিয়ে ওদের হয় না। একসঙ্গে অনেক ঘর লাগে। রূপালি নিজের ভাবনায় মন খারাপ করলে চোখে জল আসে। ও ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একসময় কান্না শেষ হলে বলে, বটগাছ তুই আমার চোখের জল বুকে ধরে রাখ। এই দেশ আমার। তারপর আমি কেন চোখের জল ফেলব শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে? কেন অন্য ধর্মের মানুষ মুসলমান আমাদেরকে বাড়ি ছাড়তে বলবে। আমি শুধু হিন্দু হওয়ার জন্য ইন্ডিয়া যাব কেন? কেন অন্যরা জমি-ঘর দখল করতে চায়?
রূপালি আবার চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। চারদিকে ছড়িয়ে যায় কান্নার শব্দ। বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার পথে শ্রীকান্ত দাঁড়িয়ে পড়ে - যতেœর সঙ্গে কান পেতে কান্নার শব্দ শোনে। বুঝতে পারে রূপালি কাঁদছে। ও কান্নার শব্দ ধরে বটগাছের দিকে এগিয়ে যায়। প্রবল কান্নার শব্দ দু’কানে আঘাত করে। ও জানে রূপালি কেন কাঁদছে। ওরা হিন্দু বলে ওদেরকে তাড়াতে চায় গাঁয়ের কেউ কেউ। তাড়িয়ে দিয়ে ওদের জমি-বাড়ি দখল করবে ওরা। কোনোদিন হয়তো রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। এই ভয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আতঙ্কে থাকে শ্রীকান্ত। রূপালির পেছন দিক দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রূপালিকে। ও দ্রæত পেছনে ঘুরে শ্রীকান্তর ঘাড়ে মাথা রাখে। শ্রীকান্ত বলে, চলো ঘরে যাই।
- ঘর কি আমাদের থাকবে?
- এর জন্য কাঁদতে হবে না।
- আমার দেশের মাটিতে আমি থাকব।
রূপালি শ্রীকান্তকে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে মাথা ঠেকায়।
- ওঠো, ওঠো। কেউ আমাদের এখান থেকে তাড়াতে পারবে না। আমার ঘর পোড়ালে আমিও অন্যের ঘরে আগুন দিব। আমাকে মারতে আসলে আমিও মারব। মরে গেলে গেলাম।
- ঠিক বলেছো। আমিও তাই মনে করি। মাতৃভ‚মি ছেড়ে অন্য দেশে থাকব না। এখানে যার যার ধর্ম নিয়ে সবাই থাকবে। আমরাতো ধর্ম পালন করি। আমাদের গায়ে ধর্ম লেখা নাই। আমরা মানুষ। মানুষের ধর্ম মানুষ থাকা। আমিতো সবাইকে তাই মনে করি।
- চলো ঘরে যাই। আজকে ঘরে আলো জ্বালাব।
রূপালি ভীত কণ্ঠে বলে, কেউ যদি পুড়িয়ে দিতে আসে?
- আসলে আসবে। দেখে নেবো।
- আমি ঠিক করেছি যে তোমার হাতে কুড়ালটা দিব। আমি দা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। বাড়ির কাছে কাউকে দেখলে কুপিয়ে শেষ করব।
- মাথা খারাপ, আমি এসব হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকব না।
- ওরা যদি আমাকে হত্যা করে তুমি তা মেনে নিবে?
শ্রীকান্ত চুপ করে থাকে। হঠাৎ করে মাটিতে মাথা ঠেকায়। একসময় মাথা উঠিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার দেশ, আমার ছায়া। আমার চৌদ্দগোষ্ঠী হিন্দু ছিল, সেজন্য আমিও হিন্দু। আমার ধর্ম নিয়ে আমি বেঁচে থাকার সত্য খুঁজি। আমিতো অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে যাই না। ওরা কেন যায়?
- ওরাতো আসলে ঠিক মানুষ না। ওদের কাছে লোভ বড়। সেজন্য অন্যের ঘর দখল করার জন্য অমানুষ হয়।
কথা শেষ করে আবার হাউমাউ করে কাঁদে রূপালি। কাঁদতে কাঁদতে আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে।
- চলো ঘরে যাই। বাতি জ্বালাই। আর লুকিয়ে থাকব না।
- আমার ছেলেমেয়েরা?
- ওরাতো তোমার বোনের কাছে আছে। থাকুক। ওদেরকে এখন আনব না।
- হ্যাঁ ঠিক। ওরা জ্বালাও-পোড়াওর মধ্যে আসুক এটা আমি চাই না।
দু’জনে হাত ধরে এগিয়ে যায়। বাড়ির কাছে এসে চারদিকে তাকায়। দু’জনের বুকের ভেতর ভয়ের যন্ত্রণা। অপমানিতও বোধ করে। নিজের মাতৃভ‚মি থেকে বিতাড়িত হবে কেন? শুধু ধর্মের বেড়াজাল মাথায় নিয়ে? এর বাইরে ওদেরতো কোনো অপরাধ নেই। বুকের ভেতরে প্রবল যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে রূপালি আঁচলে বেঁধে রাখা চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খোলে। শ্রীকান্ত পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে জ্বালায়। তিনটে কাঠি জ্বালানোর পরে রান্নাঘর থেকে কুপি খুঁজে নেয় রূপালি। কুপি জ্বালিয়ে শ্রীকান্ত রূপালির মুখের সামনে তুলে ধরে। রূপালি অবাক হয়ে বলে, কি হলো?
- কুপির আলোয় তোমাকে দেখছি।
- এটাতো নতুন দেখা। আগেতো কখনো দেখনি।
- আমার চোখে তুমি প্রায়ই নতুন মানুষ হও।
- কুপিটা আমাকে দাও। আমিও তোমাকে দেখি।
- নাও।
শ্রীকান্ত কুপি হাতে দিয়ে জড়িয়ে ধরে রূপালিকে। বলে, আমাদের এই ঘর আমাদেরই। আমরা ছেড়ে যাব না।
- আমিও তাই মনে করি। নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে থাকব না। তার আগে যেন ভগবান আমাকে মৃত্যু দেন।
- আহ্ চুপ কর। এসব কথা থাক। আর বলবে না। প্রবল আবেগে রূপালিকে জড়িয়ে ধরে শ্রীকান্ত।
- তোমার এই জড়িয়ে ধরা আমার জন্য ভগবানের আর্শীবাদ। তুমি আমাকে অনেক ভালোবাস।
রূপালি নিজেও শ্রীকান্তকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আনন্দের সৌরভ ছড়িয়ে যায় ঘরে। বেশ কিছু দিন পরে দু’জনের এমন নিমগ্ন প্রকাশে তোলপাড় করে ওদের শরীর। শ্রীকান্তের কাঁধে মাথা গুঁজে রেখে রূপালি নিজ মাতৃভ‚মির স্পর্শ পায়। পরক্ষণে ঘাড় উঁচিয়ে বলে, চলো দা আর কুড়ালটা তুলে এনে দরজার কাছে রাখি। কেউ যদি ঘরে আগুন দেয় তাকে মেরে শেষ করব।
শ্রীকান্ত রূপালিকে জড়িয়ে ধরা থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে, তাহলে ওরা কি আমাদেরকে ছেড়ে দেবে? আমাদেরকেও মেরে শেষ করবে।
- ভালোই হবে। এই মাটিতে মিশে থাকব। কেই যদি চিতায় না তোলে তাহলে কিছু হবে না। মাটি আমাদের জড়িয়ে রাখবে।
শ্রীকান্ত আর কথা বলে না। রূপালির কথায় শরীর শীতল হয়ে আসে। বলে, খিদে পেয়েছে আমার।
- ঠিক আছে। তেল-মরিচ দিয়ে তোমাকে মুড়ি মাখিয়ে দিচ্ছি।
- আমি ঘরের বাইরে ঘাসের উপর গিয়ে বসছি। ওখানে বসে মুড়ি খাব। তাড়াতাড়ি আন।
- হ্যাঁ, সুন্দর জায়গা ঠিক করেছ। আমিও তোমার সঙ্গে মাটির উপর বসব। যাও, আমি আসছি।
রূপালি পেয়াজ-মরিচ কেটে মুড়ি মাখিয়ে দুটো বাটিতে করে নিয়ে আসে। শ্রীকান্তের হাতে মুড়ির বাটি দিয়ে নিজেও বসে পড়ে ঘাসের ওপর। কোলের ওপর মুড়ির বাটি রাখে। দেখতে পায় চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে চড়–ই পাখি। একটু দূরে ঘুরছে শালিক। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় বকের ঝাঁক। রূপালি স্বামীর দিকে তাকালে দেখতে পায় সে মুঠিভরা মুড়ি মুখে পুরছে। মুহূর্তে ও মুড়ির বাটি পাশে রেখে ঘাসের ওপর মাথা ঘোরায়। শ্রীকান্ত বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি করছো?
- দেশের মাটি মাথায় রাখছি।
- বেশি বাড়াবাড়ি কর।
- তোমার কথা তোমার মনে রাখ। আমাকে বলতে হবে না।
- তোমার মাথায় এত চিন্তা কেন?
- এটা কি শুধু চিন্তা? এটা আতঙ্ক। স্বামী ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচব কিনা এই ভয়ে আছি। মানুষের লোভের বলি হতে হবে আমাদের।
- না, আমি এটা কিছুতেই মানতে পারব না।
শ্রীকান্ত আর কথা বলে না। চুপচাপ মুড়ি খায়। রূপালিকে গড়াগড়ি করতে দেখে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি কোথাও চলে যায় না। একসময় রূপালি উঠে বসে। বলে, এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?
- তোমার কষ্ট দেখছিলাম।
- তুমিতো আমাকে দেখছিলে? কষ্ট কি দেখা যায়?
শ্রীকান্ত শব্দ করে হেসে ওঠে। বলে, কষ্ট দেখা যায়। তোমার মুখের দিকে তাকালে আমিও কষ্ট পাই।
- বেশ কথা।
রূপালি প্রাণ খুলে হাসে। শ্রীকান্ত ওর পিঠে হাত রেখে ওকে থামাতে চায়। রূপালি থামে না। হাসতে হাসতে বলে, এখনো কি কষ্ট দেখতে পাও।
- পাই। তোমার হাসি তোমার কষ্টের ছবি। এই কষ্টের হাসিমুখ দেখতে আমার আরও সুন্দর লাগছে। ভাবছি আমাদের কষ্টের কথা থাকবে না। সেই কষ্ট হবে হাসির কষ্ট।
- থাক, তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না।
রূপালি ঘাসের মধ্যে মুখ উপুড় করে। শ্রীকান্ত চারদিকে তাকায়। কোথাও তেমন কোনো লোকজন নেই। নিরিবিলি হয়ে আছে এলাকা। যারা ওদেরকে হুমকি দিচ্ছে ভারতে চলে যেতে তাদের সঙ্গে শৈশব থেকে পরিচয়। এখন ওরা ডাকাত হয়ে উঠেছে। কি রকম মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ওদেরকে নাজেহাল করা হচ্ছে। ছেলেদের মারধোর করেছে। অথচ ওরা কোনো চুরি করেনি। এজন্যই রূপালির এত কষ্ট। ছেলেমেয়েগুলো রূপালির বোনের কাছে কেঁদেকেটে দিন কাটাচ্ছে। হঠাৎ করে ওর চোখেও জল এসে যায়। দেখতে পায় রূপালি ঘাসে মুখ ঢুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ও মাথায় হাত দিয়ে রূপালিকে প্রশ্ন করে, কাঁদছ কেন?
- আমার চোখের জল আমার মাটিতে রাখছি।
- চলো, আমরা ঘরে যাই।
- না, যাব না। এখানে থাকব।
- সারা রাত থাকবে?
- থাকতে পারি।
- তাহলে আমি উঠলাম। ওই দেখ চারদিকে লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে।
- করুকগে, আমার কি? গ্রামের লোকজন তো হাঁটবেই।
- ওদের দিকে তাকিয়ে আমার ভয় লাগছে।
- উঠে বস। চল অন্যদিকে যাই।
- না, যাব না। নিজের ঘর ছেড়ে কোথাও যাব না।
- তোমার সঙ্গে আমি পারি না। আমার ভাগ্য ভালো যে ছেলেমেয়েগুলো এখন এখানে নাই।
দুজনে দেখতে পায় তিনজন লোক এগিয়ে আসছে। হাতে মশাল। দূর থেকে ছুঁড়ে মারে ঘরের চালে। দাউদাউ জ¦লে ওঠে আগুন।
শ্রীকান্ত দুহাতে রূপালিকে টেনে তোলে। টানতে টানতে দূরে সরিয়ে নেয়। যারা আগুন ছুঁড়েছে তারা সরে পড়েছে। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
খানিকটা দূরে গিয়ে দুজনে বসে পড়ে। তাকিয়ে থাকে ঘরের দিকে। পুড়ছে ঘর।
রূপালি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার ঘর আমাদের চোখের সামনে শ্মশান হয়ে গেছে। আমাকে ছেড়ে দাও আমি চিতায় উঠে যাই।
শ্রীকান্ত শক্ত করে ধরে রাখে রূপালিকে।

******

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top