সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২): সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২২ জুন ২০২২ ০৩:৩৯

আপডেট:
২২ জুন ২০২২ ০৩:৪৬

ছবিঃ : সেলিনা হোসেন


রবিউল ভাত খেয়ে উঠে চলে যায়। আকাশী রান্নাঘর থেকে যা নেবার তা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। আসমানীও নিজের প্রস্তুতি শেষ করেছে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে মারুফ। বলে, গরুর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছেনা। চলেন আমরা হেঁটে রওনা করি। রাস্তায় দেখলাম অনেক লোকজন যাচ্ছে। একজন আমাকে ডেকে বলল, ঘরে বসে পুড়ে মরার চেয়ে অথবা গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শরণার্থী হওয়া ভালো। ওখানে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিতে পারব। এজন্য আমি আর গরুর গাড়ির অপেক্ষায় না থেকে চলে এসেছি।
রবিউল সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, হ্যাঁ ভালো করেছ। চলো আমরা যাত্রা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে খোঁজখবর রাখব যাতে কোথাও গরুর গাড়ি পাওয়া যায়।
আসমানী মৃদুস্বরে বলে, মাগো আমি কি হাঁটতে পারব? আমারতো এই মাসেই প্রসব হওয়ার কথা।
- মা রে আমিতো জানি। তারপরও শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে গেলে তোর ব্যথা উঠলে একটা কিছু করতে পারব। মন খারাপ করবিনা। ওদের কিছু বলবিনা।
- আচ্ছা মা, চলো। যা হবার হবে। সামাল দিতে পারাটাই হবে জরুরি কাজ। পরক্ষণে নিজে নিজে ভাবে, বাচ্চাটা বের হওয়ার সময় হলে সামাল দেয়ার সাধ্য ওর থাকবেনা। তখন কি পথের মধ্যে -। আর ভাবতে পারেনা আসমানী। সবার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে।
মারুফ বলে, বেনাপোল পার হলে ভারত। সেখান থেকে শুরু হয়েছে যশোর রোড। অনেকের কাছে শুনেছি যশোর রোডে শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প করা হয়েছে। ওখানে গেলেই আমরা ঠাঁই পাব মা। তখন আসমানীকে নিয়ে আপনি ক্যাম্পে থাকবেন। আমি আর আব্বা খাবার খুঁজব।
- আচ্ছা বাবা। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। চলো আগে।
সবাই মিলে পোটলাগুলো মাথায় তুলে হাঁটতে শুরু করে। চারদিকে অনেক লোকজন। রাস্তায় মানুষের লাইন। সবাই তটস্থ হয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটছে সীমান্তের দিকে। আসমানীর জন্য দ্রুত হাঁটা হচ্ছেনা ওদের। আকাশীর মনে আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। আসমানীর মুখের দিকে তাকালে ভয় পায়। কিছুক্ষণ পরে আসমানী বলে, মাগো আমার পানি ভেঙে গেছে। ব্যাথাও উঠেছে। আমি আর এক পাও হাঁটতে পারবনা। আমি এই বটগাছের নিচে শুয়ে পড়ি।
- কি বলিস মা?
- এটাই কথা, আর অন্য কোনো কথা নাই।
আসমানী বটগাছের নিচে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
রবিউল জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে ওর?
- বাচ্চাটার জন্ম হবে। মারুফ তুমি ওই পোটলা থেকে দুটো শাড়ি বের করে চারদিক ঘেরাও করে দাও।
মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলে, রাস্তায় লোকজন কমে গেছে। সবাই অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। আমরা কিছুক্ষণ নিরিবিলি থাকতে পারব।
কথা বলতে বলতে মারুফ চারদিকের ছোট ছোট গাছ ধরে শাড়ি পেঁচিয়ে দেয়।
মাটিতে শুয়ে আসমানী কঁ-কঁ শব্দ করছে। আকাশী ওকে একটি শাড়ি বিছিয়ে দিয়ে শুইয়েছে। ওর শব্দ শুনে আকাশী বুঝে যায় যে প্রবল ব্যথা উঠেছে। বাচ্চাটা বোধহয় অল্পক্ষণে বেরিয়ে আসবে। নাড়ি কাটার জন্য ব্লেডটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে আকাশী। একসময় ভূমিষ্ঠ হয় শিশু। কান্নার শব্দে জানান দেয় নিজের আগমনের খবর। রবিউল আর মারুফ শাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কি বাচ্চা হলো? ছেলে না মেয়ে?
- ছেলে। বেশ বড়সড় হয়ে জন্মেছে।
- আলহামদুলিল্লাহ। রবিউল দুহাত উপরে তোলে। বলে, আল্লাহমাবুদ আমাদের নাতিটি সুস্থ থাকুক। ওকে কোলে নিয়ে আমরা সীমান্ত পার হব মাবুদ। ওর মাও যেন সুস্থ থাকে মাবুদ। যে ছেলে মুক্তিযুদ্ধকালে রাস্তায় জন্ম নেয় সে আমাদের স্বাধীনতার সৈনিক।
মারুফ বলে, মা আসমানী কি পানি খাবে?
- হ্যাঁ, বাবা দাও।
মারুফ পানি ভর্তি বোতলটা পর্দার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। আসমানী মাথাটা সোজা করে খানিকটুকু পানি খায়। ওর মনে হয় উঠে বসারও শক্তি নেই। বাচ্চাটাকে মা ধোয়া-মোছা করছে। কিন্তু ও কেমন জানি নেতিয়ে পড়ছে। চোখ খোলেনা। হাত-পা তেমন করে নাড়াচাড়াও করে না। আকাশী বিষণœ হয়ে যায়। কাউকে কিছু বলতে পারেনা। এই রাস্তায়ওতো চারদিকে মাঠের পরে মাঠ। কোথাও কোন ঘরবাড়ি নেই যে বাচ্চাটাকে সেখানে নিয়ে কোনো ঘরের মাঝে রাখতে পারবে।
হঠাৎ করে ও তীব্রস্বরে কান্না শুরু করে। আকাশী ওকে দুহাতে জড়িয়ে নানাভাবে দোলায়, কিন্তু ওর কান্না থামেনা। ওর কান্নায় আসমানীও কান্না শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, মাগো ও কি দুধ খাবে?
- খেতে পারে। কান্না থামুক তখন তোর কাছে দেব।
- এখনই দাও মা। ওকে আমি বুকে রাখব।
- নারে, তুই একটু শান্ত থাক মা। ওর কান্না থামুক।
আকাশী অনেক চেষ্টা করে শিশুর কান্না থামাতে পারছে না। ওর নিজেরও মন খারপ হয়ে যায়। আকাশীও কাঁদতে শুরু করে। জন্মের পরে কোনো শিশুকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি ও। একটু পরে কান্না থেমে গেলে শিশুটি মাথা কাত করে গড়িয়ে পড়ে ওর কোলের ওপর। চোখ বন্ধ, নাকে নিঃশ্বাস নেই। ও বুঝতে পারে মরে গেছে ছেলেটি। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে আকাশী। রবিউল আর মারুফ জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?
- মরে গেছে আমাদের নাতি।
- মরে গেছে? মারুফও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। রবিউলও। কান্নার ধ্বনি চারদিকে ছড়ায়। আসমানী জ্ঞান হারিয়েছে। রবিউল শাড়ির পর্দা খুলে ফেলে। শাড়ি ভাঁজ করে আসমানীকে ঢেকে দেয়। মাথা খোলা রাখে।
- ওর মাথায় পানি দিতে হবে মারুফ।
- আমিও তাই চিন্তা করছি। আমরাতো ছোট একটা বালতি এনেছি। সামনের এই ডোবা থেকে আমি পানি নিয়ে আসছি।
মারুফ বালতি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। রবিউল মেয়ের মাথায় হাত বোলায়। অল্প সময়ে ফিরে আসে মারুফ। রবিউল মেয়ের মাথা উপরে তুলে ধরলে মাথায় পানি দেয় মারুফ। বেশ কিছুক্ষণ পরে চোখ খোলে আসমানী। বাবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
- কাঁদিসনা মা। আর কাঁদিসনা। ধৈর্য ধর। আমাদের অনেক পথ যেতে হবে।
আসমানী বাবার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসে। পেতে দেয়া শাড়ি ভিজে ঘাসের সঙ্গে মিশে আছে। প্রবল অস্বস্তিতে ও চারদিকে তাকায়। দেখতে পায় ওর মায়ের কোলে রাখা মৃত শিশুর দিকে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে আছে ওর মা। আসমানী মাকে বলে, ওকে আমার কোলে দাও মা।
- আকাশী বলে, হ্যাঁ দিচ্ছি। তুই কিছুক্ষণ কোলে রাখ। ওকেতো কবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- এই রাস্তার ধারে?
- হ্যাঁ, এখানেই দিতে হবে। আর কোথায় যাব আমরা। মারুফ তুমি কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা কর।
মারুফ প্রথমে শব্দ করে কাঁদে। তারপর দুহাতে চোখ মোছে। রবিউল বলে দেয় কোন পোটলায় দা আছে। বিভিন্ন সময়ে দায়ের দরকার হয়। সেজন্য রবিউল পোটলায় ঘরের দাটি ভরে নিয়েছিল। একটি গর্ত করার জন্য দাটির প্রথমেই দরকার হবে, এই ভাবনা তাকে প্রবল কষ্ট দেয়। দুহাতে চোখ মুছতে থাকে। মারুফ ছোট আকারের গর্তটি করা শেষ করলে রবিউল আসমানীর একটি শাড়িতে পেঁচিয়ে গর্তের ভেতর শুইয়ে দেয়। তারপরে সবাই মিলে দোয়া পড়ে। কিচ্ছুক্ষণ দোয়া পড়ার পরে মারুফ মাটি চাপা দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধু করে দুহাত দিয়ে মাটি সমান করে দেয়। তারপর চারপাশের বুনো ফুল ছিঁড়ে দেয় সন্তানের কবরের উপর। একমুঠো ফুল আসমানীর হাতে দিয়ে বলে, তুমি ওর কবরের ওপর ছিটিয়ে দাও। ওর স্মরণে আমরা প্রতি বছরে ফুল দিব এখানে এসে।
রবিউল বলে, মনে হয়না পারবে। লোকজন কি রাস্তার ধারে এভাবে রাখতে দেবে? ওর একটা ছবিও রাখতে পারলাম না। পারলে আমরা ওর ছবিতে ফুল দিতাম।
- বাবাগো এইসব কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমি এই দিনে ওর জন্য নামাজ পড়ব দোয়া করব।
আসমানী কাঁদতে কাঁদতে বলে। ওর কান্না ফুরোয় না। সবাই বোঝে প্রথম সন্তানের এই মৃত্যু ওকে জীবনভর কষ্ট দেবে। মারুফ এসে ওর পাশে বসে। আকাশী চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এই মৃত্যু শরণার্থী জীবনের বড় দিক। এতদিনে নানাভাবে আশেপাশের মানুষের মৃত্যু দেখেছে, কিন্তু শরণার্থী জীবনের যাত্রায় মৃত সন্তান কোলে নিয়ে বসে থাকার স্মৃতি থেকে ও রেহাই পাবেনা। দেশ স্বাধীন হলে এই মুত্যু ওর সামনে স্বাধীনতার পতাকা হয়ে উড়বে। এই ভাবনায় আকাশীর মন প্রফুল্ল হয়। দুঃখ কাটিয়ে শক্তি সঞ্চয়ের জায়গা পায়। মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে এই ভাবনা ওকে আবার আতঙ্কিত করে। আসমানীর পাশে বসে থাকা মারুফ ওর হাত ধরে নাড়াচাড়া করে। একসময় বলে, আমাদের জীবন থেকে শরণার্থী জীবন শেষ হলে আমরা আবার সন্তান নেব। ভালো থাকার চেষ্টা করো। মন ভেঙে ফেলোনা।
আসমানী দুহাতে মুখ ঢােেক। মারুফের কথার কোনো উত্তর দেয়না। মারুফ উঠে দাঁড়ায়। দূরে তাকালে দেখতে পায় একটি গরুর গাড়ি আসছে। রবিউল নাতির কবরের কাছে বসেছিল। মারুফ জোরে জোরে বলে, আব্বা দেখেন একটা গরুর গাড়ি আসছে। ওদেরকে অনুরোধ করব, জায়গা থাকলে ওরা যেন আসমানীকে নেয়। আমরা হেঁটে যাব গরুর গাড়ির সঙ্গে। রবিউল সায় দিয়ে বলে, ভালোই চিন্তা করেছ। আমরা দুজনে গরুর গাড়ির সামনে দাঁড়াব। দেখি ওরা থামে কিনা। আসমানীকে নিলে আমাদের মেয়েটার জন্য চিন্তা করতে হবে না। আকাশী ওদেরকে বলে, তোমরা একটু সামনের দিকে যাও। আমি ওকে পরিষ্কার করি।
দুজনে বেশ খানিকটা সামনে গিয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়ায়। দুজনেই বুঝতে পারে যে গাড়িটা আসতে বেশ সময় লাগবে। দূরত্বটা এখনও অনেক। মারুফ মনে মনে স্বস্তি বোধ করে। সময় লাগাই ভালো, তাহলে আসমানীকে পরিস্কার করে ফেলতে পারবে ওর মা। গর্ভের পানি ও রক্তে ভিজে আছে ও। আহারে আসমানী! সবার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো আজ। সন্তানটির জন্ম ও মৃত্যু ঘটে গেল মাটিতে এবং আকশের নিচে। এই স্মৃতি মৃত্যু পর্যন্ত কেউ ভুলবেনা। দূর থেকে দেখতে পায় আসমানীকে অন্য একটি শাড়ি পরাচ্ছে ওর মা।

চলবে

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top