সিডনী শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ৩) : হাবিবুর রহমান স্বপন


প্রকাশিত:
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৫৯

আপডেট:
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০২:০৫

ছবিঃ হাবিবুর রহমান স্বপন

 

ষাট এর দশকে সাঁথিয়ার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ছিল মন্থর গতির। বেশিরভাগ সড়ক ছিল কাঁচা। গরু-মহিষের গাড়ি এবং ঘোড়ার গাড়ি ছিল অন্যতম যান। বর্ষায় নৌকা চলতো জলপথে।
মাধপুর থেকে সাঁথিয়া সড়কটি তখন ছিল কাঁচা। ১৯৬১-'৬২ সালে পাবনা-নগরবাড়ি সড়ক পিচ ঢালা হয়। মাধপুর থেকে সাঁথিয়া সড়কটি তখন হেরিন বন বন্ড করা হয়। ১৯৬৬ সালের দিকে মাধপুর থেকে জোড়গাছা বাজার পর্যন্ত সিমেন্ট ঢালাই সড়ক নির্মিত হয়। জোড়গাছা থেকে সাঁথিয়া পর্যন্ত হেরিন বন বন্ড থেকে যায়। ১৯৬৯-'৭০ সালে সাঁথিয়া থেকে বেড়া পর্যন্ত হেরিন বন বন্ড করা হয়। এর আগে সাঁথিয়া থেকে পাবনা বাস যাতায়াত করতো। ডজ (উঙউএঊ) ইঞ্জিন চালিত বাসগুলো চলতো পেট্রোলে। কাঁচা রাস্তায় ধূলা উড়িয়ে চলতো বাসগুলো। বাস স্ট্যান্ড ছিল আমার বাড়ি লাগোয়া। ঘোষ কম্পানি ও দাস কোম্পানির বাস ছিল ৪/৫ টি। বৃষ্টি হলে কর্দমাক্ত সড়কে বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটতো।


বর্তমান বালিকা বিদ্যালয় সড়কের সংযোগ স্থলে ছিল বিশাল খাল। খালটিতে বর্ষাকালে পানি থাকার কারণে বাস চলতো ডাকবাংলো প্রাঙ্গণ পর্যন্ত। বাঘাবাড়ি থেকে কাশিনাথপুর হয়ে পাবনা-ঈশ্বরদী সড়ক নির্মান হওয়ার পর বেড়া এলাকার লোকজন বাসে যাতায়াত করতে শুরু করে নতুন সড়ক পথে। তখন শুধুমাত্র সাঁথিয়া থেকে পাবনা পর্যন্ত ডজ বাস চলাচল করতো। সকাল ৮ টায় ও ১০ টায় দুটি বাস যেতো পাবনায় ফিরতো বিকালে।
জোড়গাছা এবং নন্দনপুরের মধ্যবর্তী স্থানেও সড়ক ছিল ভাঙা। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮ সালে সেখানে একটি ব্রিজ নির্মিত হয়।
হেরিন বন বন্ড এর ইট উঠে সড়কের বেহাল অবস্থা হতো।
বর্তমান গৌরীগ্রাম সড়ক, সাঁথিয়া থেকে গোপীনাথপুর হয়ে ২৪ মাইল সড়ক, আফড়া-পুন্ডুরিয়া সড়ক, দৌলতপুর-ধূলাউড়িসহ সকল সড়ক ছিল কাঁচা। গ্রীষ্মকালে ধূলা আর বর্ষায় কাদাতে সড়কে চলাচল ছিল দারুণ কষ্টের।
সাঁথিয়া থেকে মাধপুর ঘোড়ার গাড়ি বা টমটমে এবং রিক্সায় যাতায়াত করতে হতো। সন্ধ্যার পর কোন যানবাহন মিলতো না। ১৯৭৭-'৭৮ সালে সাঁথিয়া-মাধপুর সড়কে স্কুটার চলাচল শুরু হয়।
বর্ষার সময় সাঁথিয়া থেকে মাধপুর হয়ে-আতাইকুলা পর্যন্ত লঞ্চ চলতো।
লঞ্চ বেড়া হয়ে নাকালিয়া পর্যন্ত চলাচল করতো।
হাটের দিনে যেসব বড় বড় মালবাহী নৌকা পণ্য বোঝাই করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর যেতো সেসব নৌকায় অনেকে ঢাকা যেতো।
কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির জন্য হাটে আসতো গরু ও মহিষের গাড়িতে। বর্ষাকালে নৌকায় পণ্য পরিবহন করতো। অনেকে মাথায় করে এবং কাঁধে বাকে করে বেতের ও বাঁশের তৈরি পাত্রে (বস্তা, ঝাঁকা, হাউটা) পণ্য আনতো হাট বাজারে। ধান, যব, গম বিক্রি হতো কাঠায় মাপ দিয়ে (বেতের তৈরি পাত্র যাতে পাঁচ সের, দুই সের পরিমান পণ্য ধরতো)।
এক কথায় বলা যায় তখন প্রতিটি মানুষকে কায়িকশ্রমের উপর নির্ভর করতে হতো।
স্বাধীনতার প্রায় এক দশক পর দেশে রিক্সা ভ্যানের প্রচলন হয়। সাঁথিয়া এলাকায় ক্রমান্বয়ে ভ্যান রিক্সার সংখ্যা বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকে দেশী প্রযুক্তির ফসল ভটভটি, নসিমন, করিমন তৈরি হয়৷
সাঁথিয়া সদরে বেশ কিছু তাঁতীর বসতী প্রাচীনকাল থেকেই। তবে তারা দরীদ্র। ষাট এর দশকে এখানকার তাঁতীরা মোটা শাড়ি কাপড় (মটুরি) এবং লুঙ্গি তৈরি করতো। চিত্তরঞ্জন ও খটখটি তাঁতে তৈরি এসব কাপড় ছিল খুবই টেকসই। কিছু তাঁতী গামছাও বুনতো। ছেঁচানিয়া (আফতাবনগর), সোনাতলায় অনেক তাঁতীর বসতী। এছাড়াও ধোপাদহ, সেলন্দা, ঘুঘুদহ, আফড়া ইত্যাদি গ্রামে তাঁতী সম্প্রদায়ের বসতী বহুকাল আগে থেকেই।


মূলত সাঁথিয়া এলাকায় গরীব জনগণের আবাস সেকাল থেকেই। নিম্ন জলাভূমি হেতু কোন ধনাঢ্য জমিদারের বসতি ছিল না সাঁথিয়া সদরে। এখানে বাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচুর হিন্দু বসতি ছিল। জেলে পাড়া, পাল পাড়া, দাস পাড়ায় বিভক্ত ছিল। প্রচুর জেলে সম্প্রদায়ের লোকজনের বসতি ছিল সাঁথিয়া সদরে। ছুতোর, মিস্ত্রী, নাপিত, মুচি, মালাকার, বৈরাগী নানা পেশার লোকের বসতী সাঁথিয়ায় অনেককাল আগে থেকেই। সাঁথিয়ায় সবসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কিম্বা তার আগে এবং পরে কোন অসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সাঁথিয়ায় হয়নি (আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে জেনেছি)। সাঁথিয়া বাজার ও বোয়াইলমারী বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবসা ছিল হিন্দুদের হাতে। মুদি দোকান, মিষ্টান্ন, মনোহারি দোকান থেকে শুরু করে পাট, সরিষা, গুড় ইত্যাদি পণ্য মজুদ ব্যবসাও করতো হিন্দু ব্যবসায়ীরা। সাহা,পাল ও দাস সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য।
এখানে কোন হিন্দুর উপর নিপীড়ন নির্যাতন জুলুম কখনোই হয়নি। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও কোন সংখ্যা লঘুর বাড়িঘর লুটপাট বা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
পূজা-পার্বণে উৎসব হয়ে আসছে নির্বিঘ্নে।

চলবে


হাবিবুর রহমান স্বপন
লেখক ও সাংবাদিক

 

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া: পর্ব ১
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব দুই)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top