সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের ছড়ার বোল শেখানো : মীম মিজান


প্রকাশিত:
৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:২১

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০১

ছবি : মীম মিজান

 

কবি আসাদ চৌধুরী(১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩) স্বনামে খ্যাত। তাঁর কোবিদ ও ব্যক্তিত্বের তুলনা তিনি নিজেই। কবিতার জমিনের এক সফল চাষি। কবিতা লিখলেও তিনি শিশুসাহিত্যিক হিশেবে প্রোজ্জ্বল। বিশের অধিক শিশুসাহিত্যগ্রন্থ তাঁর।
২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কর্তৃক কবির একটি ছড়াগ্রন্থ প্রকাশ হয়। শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থটির নাম ‘তারায় বোনা আকাশ’। চার রঙের আঁকিবুঁকিসহ চমৎকার ছড়াগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘ভাষা ও দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ দিলেন’ তাঁদের।
মোট এগারোটি ছড়া আছে এতে। প্রথম ছড়াটির শিরোনাম, ‘জানাজানি’। ভাষা আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের মহিমাগাথা এই ছড়াটি। পাখিরা ডেকে ডেকে উৎসর্গিত প্রাণগুলোকে স্মরণ করে। যেমন:

“জানি, জানি, জানি।
পাখির ভাষার মান দিতে যে
বাঙালি দেয় জান,
পাখি যে তা জানে,
তাইতো পাখি পাগল করে
বিহান বেলার গানে।”

দ্বিতীয় ছড়াটির ভাব ও কথা চমৎকার। গোলাপের সুবাস আছে। সেই গোলাপের মালার সুবাস থাকবে ক্ষণ। তবে তাতে যতই পানি ঢালি তা মরে শুষ্ক হবে সত্বর। কিন্তু কোনো অনাথ ছেলেকে যদি আদরে যতেœ লালন করা যায় তাহলে সে একদিন বিশাল বড় মানুষ হবে। গোলাপের সুবাসের থেকে আগামীর প্রজন্ম শিশুকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান কবির:

‘পেলে আদর, যতœ, সোহাগ
শিক্ষা-দীক্ষা, দরকারে রাগ,
সে যে
মানুষ হবে, অনেক বড় মানুষ
বুঝলে কিছু বুঝলে?
সত্যিকারের মানুষ হ’লে বাঁচবে হাজার বছর।
যতই ঢালো গোলাপ-পানি গোলাপ-মালার
ওপর
ক’দিন পরে আর পাবে না খুঁজলে।'”
(কোনটা নেবে)

আমার এ দেশ অপরূপা। শ্যামলিমায় পূর্ণ। অতুলনীয়া। আমার তাই গর্ব অনেক। বিশ্বসেরা কতকিছু আছে আমাদের। ভাষার জন্য একমাত্র প্রাণ দিলাম আমরা। রক্ত দিলাম, প্রাণ দিলাম স্বাধীনতার জন্য। সোনালী পাট আছে, আছে শীতলপাটি। বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতু আছে। এরকম অনেক কিছুই আমাদের গৌরব করার মতো। কবি বলছেন:

“গর্ব আমার অনেক কিছুর
কোনটা বলি আগে?
একটা বলার আগেই দাঁড়ায়
আরটি পুরোভাগে।

দেশের মাটি? বলছি শোনো
সোনার চেয়ে খাঁটি,
সারা বছর অন্ন জোগায়;
কেমন পরিপাটি।”
(গর্ব আমার অনেক কিছুর)

চতুর্থ ছড়াতে কবি কাউকে হেয় বা ছোটচোখে দেখতে বারণ করেছেন। আমাদের দেশমাতৃকার অসম সাহসী ছেলে ছিল সাত বীরশ্রেষ্ঠ। তাদের অন্যতম মতিউর। মতিউরের বীরত্বপূর্ণ কৃতি আমাদের শিশুদের জানিয়ে দিয়ে কবি তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের মৃত্যুহীন বীজ বপন করতে প্রয়াসী হয়েছেন ‘শহীদ মতিউর’ নামক ছড়ায়। ছড়াটির প্রারম্ভ এভাবে:

“ ছেলেটা বড় ভালো ছিলো,
মাথায় কালো চুল ছিলো।
শ্যামলা বরণ, পাতলা গড়ন
স্বপ্নে, ধ্যানে দুলছিলো।
ছেলেটা বড় ভালো ছিলো
মাথায় কালো চুল ছিলো।

কেমন করে পারল জানতে
সূর্যটাই তো ভা-ারী,
শক্তি বলো, গতি বলো
সকল কিছুর কা-ারি।
কেমন করে পারলো জানতে
সূর্যটাই তো ভা-ারী।”

ছয়লাইনের ‘একাত্তরের ছড়া’তে কবি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ উৎসর্গ আর জিন্নার সাথে রক্তাক্ত সম্পর্কচ্ছেদের কথা বলেছেন। যাতে কচিকাঁচারা জানতে পারে কাদের সাথে কীভাবে যুদ্ধ হয়েছে। সপ্তম ছড়া ‘খুকির খাতা’তে কবি আনমনে এঁকে যাওয়া এক কিশোরীর অংকিত ছবির সংলাপ লিখেছেন।

সদ্য মরহুম বাংলাসাহিত্যের প্রধানতম কবি আল মাহমুদ(১১ জুলাই, ১৯৩৬- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) তাঁর সাড়াজাগানো কিশোর মনের ছড়া ‘পাখির মতো’তে লিখেছেন:

‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।’
এই কিশোর মনের ঘুরে বেড়ানোর অভিলাষ কবি আসাদ চৌধুরীকেও নাড়িয়েছে। তাই তিনি কিশোর মনের ছুটাছুটি, ভোঁ দৌড়, পড়াতে মন না বসা, রাখালের বাঁশি শোনা, বনবাদাড়-চিড়িয়াখানায় ঘুরে বেরা, নদীতে সাঁতার কাটা ইত্যাদি ‘সে তো তোমার জন্যেই’ ছড়ার জমিনে বুনেছেন। বলেছেন এই সবকিছু, সবুজ দেশ তোমারই বিচরণক্ষেত্র। কবির ছড়ার বর্ণনায়:

‘সবাই বলেন, আমার নাকি
পড়াতে আর মন নেই,
গানের পাখি, প্রাণের পাখি
সে তো তোমার জন্যেই।

যখন আমি ব্যস্ত ভীষণ
বড়ই কঠিন অঙ্কে
তখন কেন উড়াল ডানায়
ওড়াতে চাও মনকে।’

নবম ছড়া ‘চোখের বাহিরে’তে কবি এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কিশোরের দিনলিপি এঁকেছেন। দশম ছড়া ‘সব তোমাদের জন্য’তে কবি স্বাধিকার ও স্বাধীনতার স্বপ্নের সারথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কীর্তি বর্ণনা করেছেন। তাঁর(বঙ্গবন্ধুর) ছোট্ট কিশোর ছেলে শেখ রাসেলের বাবাকে নিয়ে মজার কথা তুলে এনেছেন।
শেষ ছড়া 'এই মেয়েটা ঘুমোয় সবার শেষে'। এখানে একটি মেয়েকে তুলে ধরা হয়েছে যে অন্যের বাড়ির কাজের মেয়ে। ঠিকভাবে খেতে পায় না। ঘুমোতে পারে না। কাজ আর কাজ। বাবাও এসে শুধু মাসান্তের বেতনটা নিয়ে যায়। ধুকে ধুকে দিনাতিপাত করছে সারাদেশেই এরকম অসংখ্য নাম না জানা লাইলি, রহিমা, পুতুলেরা। তাদের জন্য মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলার এই ছড়া দিয়ে সমাপ্তি হয়েছে গ্রন্থটির।
কবি শিশু কিশোরদের পাঠের অভ্যাস গঠনের জন্য ছড়া লিখেছেন। তাদের মুখে বোল তুলে দিতে চেয়েছেন ছড়ার। এই ছড়াগুলো হয়ত ততোটা ছন্দের মাধুর্যযুক্ত নয় তবুও শিশু মানস গঠনে কার্যকরী।
বর্তমান কিশোর প্রজম্ম ইউটিউব, মটু পাটলু, ভিডিও গেম ইত্যাদিতে আসক্ত। তারা চলাফেরার স্টাইলেও ওগুলোর মতো অঙ্গভঙ্গি করে। মানবিক গুণাবলি অর্জনের যে পাঠ তা থেকে প্রায় দূরেই অবস্থান তাদের। ফলে কী প্রজন্ম যে উপহার পেতে যাচ্ছে জাতি তা অনুমেয়। এরকম মানবিক গুণাবলী অর্জন ও চর্চা খরার যুগে কবি আসাদ চৌধুরীর এই ছড়াগ্রন্থটি নিশ্চয় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। শিশু কিশোররা পড়ুক। ফিরুক তারা পড়ার টেবিলে। জানুক তাদের শেকড়। বুঝুক তাদের মতো কত শিশু আজ অসহায়। বাংলাদেশ শিশু একাডেমিকে সাধুবাদ জানাই এরকম একটি ছড়াগ্রন্থ উপহার দেয়ার জন্য।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top