সিডনী মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আব্বাসউদ্দীন: পল্লী গানের সম্রাট : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:২১

আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১২

 

স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক,ভাওয়াইয়া গানের জনক হিসেবে পরিচিত সঙ্গীত জগতের একজন কিংবদন্তীর নাম আব্বাসউদ্দীন। তিনি গেয়েছেন আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান । পল্লীগীতিতেই যার সাফল্য সবচেয়ে বেশি ।আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জাফর আলী আহমদ এবং মায়ের নাম বেগম লুৎফুননেসা । তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই তার গানের গলা,ভাল ছিল। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ হাইস্কুল থেকে আব্বাসউদ্দীন ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। তার মন এবং স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না বলে তিনি রাজশাহী কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন কাছের শহর কুচবিহার কলেজে। ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি কোলকাতায় চলে যান এবং সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। ওস্তাদের তালিম ছিল না তাঁর জীবনে । নিজ প্রতিভাবলে সবার সামনে তুলে ধরেন তার গান । প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছিলেন। রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল চটকা গেয়ে আব্বাসউদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদী, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন। তার দরদভরা পল্লি গানের সুর মানুষের কাছে আজও অদ্বিতীয় এবং জনপ্রিয় । বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আব্বাসউদ্দীন আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য মুসলমান কবি-সাহিত্যিকরা তাদের রচনা দিয়ে মুসলিম চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কুচবিহারে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আব্বাস উদ্দীনের প্রথম পরিচয় ঘটে। নজরুল ইসলাম খুব স্নেহ করতেন আব্বাসউদ্দীনকে। কবি সকলের কাছে আব্বাসউদ্দীনকে পরিচয় দিতেন ‘আমার ছোট ভাই’ বলে। প্রায় বিশ বছর তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহচর্যে ছিলেন। আব্বাসউদ্দীন আহমদ এর নাতনি অধ্যাপক নাশিদ কামাল এক সাক্ষাতকারে বলেন , ‘দাদু ত্রিশ, চল্লিশের দশকে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মজাগরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তখন কলকাতার এইচএমভি রেকর্ডসে একজন মুসলমান শিল্পী গাইবেন, এ ছিলো অভাবনীয়। এইচএমভি রেকর্ডসের গ্রাহক হতে গেলে গুণতে হতো চার আনা। দাদু ওখানে ‘হিজ মাস্টার ভয়েজ’ থেকে বেশ ভালো রয়্যালিটিও পেতেন। কিন্তু দরিদ্র মুসলমানদের অনুরোধে টুইন রেকর্ডসে দাদু গান রেকর্ড করতে শুরু করলেন। ওই রেকর্ডসের গান নিতে গ্রাহককে গুণতে হত দু আনা। দাদু শুধু শিল্পের বিকাশই ঘটাননি, গানের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন মুসলমান সম্প্রদায়কে রাজনৈতিকভাবেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন৷ ওই সময় তার গানগুলো লেখা ও সুর করতেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নাশিদ কামাল আরো বলেন, ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাঁধলে তা আব্বাসউদ্দীনের মনে গভীর রেখাপাত করে৷ তিনি তখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছেন বাংলার পথে-প্রান্তরে। খোলা ট্রাকে চড়ে তিনি মানুষকে শুনিয়েছেন সম্প্রীতির গান ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’।
তার প্রথম রেকর্ডের গান ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল মরে গো’ ও অপর পিঠে ‘স্মরণ পায়ের ওগো প্রিয়’ বাজারে বের হবার পর পরই সাড়া পড়ে যায়। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলিম গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিকভাবে ভীষণ সফল। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাসউদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আব্বাসউদ্দীন ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন।
তিনি মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। এই ৪টি সিনেমা হলো ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘মহানিশা’ (১৯৩৬), ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’(১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাসউদ্দীন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এসব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন।
আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড করা গানের সংখ্যা প্রায় সাতশত। তার লেখা ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ (১৯৬০) একটি মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ আত্মচরিত গ্রন্থ। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের নিবিড় যোগাযোগ ছিল আব্বাসউদ্দীনের । মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে আব্বাসউদ্দীন আহমদ এক যুদ্ধ করেছিলেন। ভারতবর্ষ যখন বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানে বিভক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন চলছে, তখন আব্বাসউদ্দীন আহমদ কেবল গান গেয়েই এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি এইচএমভি রেকর্ডসে কে মল্লিক বা কিরণ কুমারের মতো নিজের নাম না বদলে আব্বাসউদ্দীন আহমদ নামেই গান করেছিলেন। এইচএমভি রেকর্ডস পল্লীগীতি রেকর্ড করতে চাইত না। কিন্তু তার গান তুমুল জনপ্রিয় হওয়ায় তারা পরে আব্বাসউদ্দীনকে দিয়ে অসংখ্য ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গান রেকর্ড করে নেয়। মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, শিল্পীরা দেশ-কাল-পাত্র ভেদ করে কালে কালে সময়োপযোগী হয়ে উঠেন, তা আব্বাসউদ্দীন আহমদ জীবনের পরতে পরতে প্রমাণ করে গেছেন। বাঙালি সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তাতে তাকে মহীরুহ বললে খুব বেশি ভুল বলা হবে না। পল্লীগানের সম্রাট ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন ।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top