সিডনির বাংলাদেশীদের একাল সেকাল : সোলায়মান আশরাফী দেওয়ান
প্রকাশিত:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:০১
আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৪৪
আজ আমার সিডনিতে আসার ২৭ বছর পূর্ন হলো। নিজের চোখের সামনে দেখেছি আমার এই প্রানের শহরটা বদলে যেতে। এই শহরে এখন আম, জাম, লিচু, কাঠাল পাওয়া যায়। পাওয়া যায় লাল শাক, সীম, মূলা, ঝিংগা, বেগুন, ফুলকপি সহ নানা দেশীয় সবজি। আছে দেশের অনেক প্রকারের মাছ। স্বাদে গন্ধে কখনো মনে হয় না বাংলাদেশ থেকে দূরে আছি । সব জায়গাতেই হালাল খাবার আর নামাজের ব্যবস্হা আছে। ডাক্তারখানা, হাসপাতাল, ব্যাংক, পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি সব অফিসে রয়েছে উপমহাদেশীয় আর এশিয়ার মানুষজন। বিভিন্ন জাতির সমাবেশে এক অদ্ভুত সুন্দর বৈচিত্রময় সংস্কৃতির প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান, ন্যায় বিচার, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, সার্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সাম্যতা, সকল মানুষের সমান অধিকার, ঘুষ দুর্নীতিহীন সমাজ ব্যবস্হা এই দেশের মানুষকে মানুষের মত করে জীবন ধারন করার সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা দক্ষ এবং সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহে এখানে কোন না কোন বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। থাকছে বিয়ে, জন্মদিন, পারিবারিক দাওয়াতের অনুষ্ঠান। যারা সময় পাচ্ছেন, ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ছেন নদী, সমুদ্র আর পাহাড়ের কাছে। চারদিকে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর রোদ, বৃষ্টির খেলা মনে করিয়ে দেয় আমাদের ছেড়ে আসা শ্যামল বাংলাদেশকে।
এক সময় এখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে টেলেস্ট্রার ফোন বুথ থাকত। বেশীর ভাগ মানুষের কাছে মোবাইল ফোন ছিল না। এই ফোন বুথে কয়েন ঢুকিয়ে বা ফোন কার্ড কিনে আমরা দেশে কথা বলতাম।
কার্ড দিয়ে দেশে ফোন করতে প্রতি মিনিটে ৪ ডলার খরচ হতো। ২ মিনিট কথা বললে ৮ ডলার বেড়িয়ে যেত যা আমাদের ১ ঘন্টা কাজ করে উপার্জন করতে হতো। বেশীর ভাগ বাংলাদেশিরা ট্যাক্সি চালানো, হোটেল এটেন্ডেন্ট, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, ক্লীনিং এর কাজ এবং দেশীয় গ্রোসারি দোকানে কাজ বা ব্যবসা করতেন, যা ব্লু কালার জব হিসেবে পরিচিত ছিল।
তখন তো যাদু টিভি বা বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো দেখার কোন সুযোগ ছিল না। সবাই তখন দেশী গ্রোসারি দোকান থেকে ভিসিআরের ক্যাসেট বা সিডি ভাড়া নিয়ে এসে দেশের নাটক দেখতো। তখন গ্রোসারি দোকানগুলি চলতই এই নাটকের ক্যাসেট এবং সিডির জন্য। সেই সাথে চাল ডাল টুকিটাকি বাজার মানুষ করত।
বাংলাদেশিদের মধ্যে ৩ রকমের স্ট্যাটাস ছিল। ট্যাক্সি চালক সহ ব্লু কালার জবের কর্মীরা, শিক্ষিত ইমিগ্র্যান্ট এবং আমরা বাংলাদেশী ছাত্ররা। এখানে তখন অনেক বাংলাদেশি, মিডল ইস্ট, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং অনেক দেশ থেকে এসে রিফিওজি ভিসাতে এপ্লাই করেন। একমাত্র ভোট দেওয়া এবং দেশে যাওয়ার সুযোগ ছাড়া, এরা সব ধরনের নাগরিক সুযোগ সুবিধা পেতেন। এরা খুব একটা শিক্ষিত ছিলেন না। উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার প্রতি উনাদের তেমন কোন আগ্রহও ছিল না। তারা মন প্রান দিয়ে চেষ্টা করে ট্যাক্সি ড্রাইভিং এর লাইসেন্স নিয়ে নিতেন। এদের বেশীর ভাগ ছিলেন অবিবাহিত অথবা স্ত্রী পরিবার দেশে থাকত। ট্যাক্সি চালানোর কারনে এদের হাতে থাকত নগদ অর্থ । এই নগদ অর্থের কারনে এরা এখানে বিভিন্ন এসোসিয়েশন তৈরি করে, এর প্রেসিডেন্ট- সেক্রেটারি হতেন এবং এসোসিয়েশন চালানোর জন্য উদার হস্তে খরচ করতেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, খেলা ধুলার আয়োজনেও এরাই হর্তা কর্তা ছিলেন । তাদের সমাজে ট্যাক্সি চালানোটা তখন খুব গৌরবের পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তারা সেটা বুঝানোর জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দাওয়াতে ট্যাক্সির ইউনিফর্ম পড়ে আসতেন। এদের বেশীর ভাগ আবার রগচটা টাইপেরও ছিলেন । অল্প কারনে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এরা মারামারি- ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়তেন। এদের মধ্যে যারা ক্লীনিং, রেস্টুরেন্ট, শপে কাজ করতেন তারা এই ট্যাক্সি চালক ভাইদের সমীহ করে চলতেন। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন গন্ডগোল হলে এই ট্যাক্সিওয়ালা ভাইদের কাছে মীমাংসার জন্য যেতেন। এরা আমাদের মত ছাত্রদের প্রতি বেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। বিনিময়ে আমরা তাদের এসোসিয়েশনে অংশগ্রহন করে দলটা ভারী করে তুলতাম এবং ছোটাছুটি করে তাদের বিভিন্ন কাজ করে দিতাম। বর্তমানে কমিউনিটিতে আমাদের সংস্কৃতির যে প্রসার দেখা যায় এবং বাংলাদেশিদের এত যে অনুষ্ঠানমালা হচ্ছে, এর পিছনে এদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
শিক্ষিত ইমিগ্র্যান্টরা ছিলেন অনেকটা বেকারের মত। তাদের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা এখানে এসে কাজে লাগাতে পারছিলেন না। তার উপর তখন রেইসিজম ছিল অনেক প্রকট। বাধ্য হয়ে এরা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি তে ভর্তি হোন। পি এইচ ডি এবং এসিস্যান্টশীপের টাকায় তারা কোনরকমে চলতেন। কেউ কেউ নিজেদের ফিল্ড ছেড়ে বিভিন্ন সরকারী বা বেসরকারি এন্ট্রি লেভেলের জবের চেষ্টা করতেন এবং একটা জব পেলে মোটামুটি সেটাতেই সেটেল্ড হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন । এরা সবাই পরিবার নিয়ে থাকতেন। নিজেদের পরিচিত গন্ডি ছাড়া কারো সাথে মিশতেন না। আমাদের মত ছাত্রদের সাথে পরিচয় হলে, তারা যে কত শিক্ষিত এবং কত ভাল অবস্থানে আছেন সেটা বুঝানোর চেষ্টা করতেন এবং সেই সাথে এটাও বুঝিয়ে দিতেন, এই দেশে থাকার কোন যোগ্যতা আমাদের ছাত্রদের নেই। আমরা তাদের জ্ঞান এবং সফলতার প্রশংসা করলে, সেটা শুনে তারা বেশ তৃপ্তি বোধ করতেন এবং আমাদের দুরাবস্তার জন্য তখন কিছু সহানুভূতি দেখাতেন। এরা বেশ কৃপণ (হিসেবি) ছিলেন । আমাদের মত ছাত্রদের জন্য (তা যত কাছেরই হোক) আতিথিয়তার জন্য কোন খরচ করতেন না। ৫ ডলার সেইভ করার জন্য ছোটাছুটি করতেন । তখন মুরগির রান (ড্রাম স্টিক) ১.৫ - ২ ডলারে পাওয়া যেত। গিলা, কলিজা, মাথা ছিল ফ্রি। বড়জোর তারা তাই দিয়ে রান্না করে খাইয়ে দিতেন। মুখে মুখে একটা জব বা চাকুরির ব্যবস্হা করে দিবেন বললেও কখনোই কোন উপকার করতেন না। আসলে তখন না বুঝলেও, এখন বুঝতে পারি, পরিবার নিয়ে কতটা অসহায় অবস্থার মধ্যে তারা ছিলেন। আজ যে বাংলাদেশিরা বিভিন্ন সেক্টরে এন্ট্রি থেকে অনেক উপরের লেভেলে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন, তার পিছনে এই স্ট্রাগল করা শিক্ষিত ইমিগ্র্যান্টদের বড় ভুমিকা রয়েছে। তাদের দক্ষতা, কর্ম নিষ্ঠা এবং সততার কারনে অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে কর্মস্হলে পরবর্তীতে আমাদের গ্রহনযোগ্যতা বেড়ে যায়।
আমরা ছাত্ররা ছিলাম খুব অসহায়। সপ্তাহে ২০ ঘন্টার বেশী কাজ করার কোন অনুমতি ছিল না। তখন ইমিগ্রেশন পুলিশ বাসা, বাস /ট্রেনে, এবং কাজের জায়গাতে রেইড দিত। আমার এক বন্ধুকে এক ঘন্টা বেশী কাজ করার জন্য ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে আটকে রাখা হলো। অনেক ভাগ্য ভাল হলে রেস্টুরেন্টে বা ক্লীনিং এর জব পাওয়া যেত। জব পাওয়া গেলেও কোন নিয়মনীতি না থাকাতে মালিক ইচ্ছে মত মজুরি দিত। কোন প্রতিবাদ করলে জব তো চলে যেতই, ইমিগ্রেশন পুলিশকে ফোন করে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত। কাজের অভাবে আমাদের অনেকেই কান্ট্রি সাইডের বাগানে চলে যেত কাজ করার জন্য। সারাদিন প্রখর রোদে ১০ ঘন্টা কাজ করার পর ৩০ -৪০ ডলার পাওয়া যেত যা দিয়ে কোনরকমে পেটে ভাতে থাকা যেত। এক রুমে ৪ -৫ জন গাদাগাদি করে থাকা হতো। রিফিওজি ভাইরা কোনকারনে আমাদের উপর ক্ষেপে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিত। Coles, Woolworth সহ শপিংমল গুলি ৪টার ভিতরে বন্ধ হয়ে যেত। শনিবার -রবিবার শপিং মলগুলি বন্ধ থাকত। শনিবার -রবিবার রাস্তা ঘাট থাকত গাড়িহীন -জন মানুষবিহীন এক নিস্তব্ধপুরী।
এয়ারপোর্ট, বীচ সংলগ্ন রেস্টুরেন্ট, ইউনিভার্সিটি এবং অন্য এলাকা থেকে ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম হওয়াতে বাংলাদেশিদের একটা বিশাল অংশ সিডনির বোটানি, হিল্সডেল, কেনসিংটন, ইস্ট লেকস এবং মাসকটে থাকতেন।
সেখানে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটা দেশী গ্রোসারি শপ যেখানে অনেকেই আড্ডা দিতে আসতেন। শহরের কেন্দ্রে সারে হিলস মসজিদের আশে পাশে বিভিন্ন লজিং এবং মেসে থাকতেন খেটে খাওয়া মানুষজন ।তখন সবাই ছিলেন কম বেশী নিম্ন আয়ের মানুষ। পুরনো গাড়ি চালাতেন, বাসে, ট্রেনে করে চলাফেরা করতেন। সেলভেশন আর্মির দোকান থেকে পুরনো ফার্নিচার কিনে ঘর সাজাতেন। সস্তা ব্র্যান্ডের দোকান কেমার্ট বা বিগ ডব্লিওতে কাপড় শপিং করা ছিল বিলাসিতার মত। সবাই দেশ থেকে কাপড় আনিয়ে পড়তেন।
এদের মধ্যে একদিন এক পরিচিত ভাই নতুন টয়োটা কেমরি কিনে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দেন। সমাজে তার মান সম্মান যেমন বেড়ে যায় তেমনি তাকে দাওয়াত দেওয়ার পরিমানও বেড়ে যায়।
তখন তো ফেইসবুক ছিল না। সবার মোবাইল ফোনও ছিল না। কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা মেলার জন্য আয়োজকরা সবার বাসায় হাতে লিখে চিঠি পাঠাতেন। দেশী গ্রোসারি শপে “মেলার খবর” হাতে লেখা নোটিসের মত টাংগিয়ে রাখতেন।
দেশের খবর পাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত শনিবারে প্রচারিত আধা ঘন্টার কিছু কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলগুলো ছিল ভরসা। একটা দুইটা লোকাল বাংলা পত্রিকা অনিয়মিত ভাবে বের হতো যেখানে দেশের ১৫-২০ দিনের পুরনো খবর ছাপা হতো। সিডনিতে তখন বিভিন্ন গ্যাংদের উৎপাত ছিল। এর মধ্যে লেবানীজদের গ্যাং বাংলাদেশিদের জীবনটা দূর্বিষহ করে তুলেছিল। আর ছিল এবরোজিনালদের অত্যাচার । এরা সিডনির কেন্দ্র রেডফার্ন এরিয়াতে থাকত। টাকা পয়সার জন্য বাদামি চামড়ার সাধারণ যাত্রীদের ছিনতাই /মারধর করত কিন্তু পুলিশ এদের কিছুই বলত না। তখন খুব কম ছাত্রই ছিল যারা এই এবরোজিনাল বা লেবানীজদের আক্রমণের শিকার হয়নি। লেবানীজরা তখন লাকেম্বায় থাকত। ভয়ে অন্যরা সেখানে কেউ থাকত না। এই জন্য এই এলাকার ভাড়া এবং বাড়ির দাম ছিল খুব কম। শুধুমাত্র ভাড়া কম এবং মসজিদের জন্য বাংলাদেশিদের একটা বিশাল অংশ সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। পরে পুলিশের স্ট্রিং অপারেশনের কারনে লেবানীজরা সিডনির মেরিল্যান্ড, জর্জেস হল এবং ক্রোনোলাতে সরে গেলে বাংলাদেশিরা এদের দোকান পাট সস্তায় লীজ নিয়ে দেশী দোকান এবং রেস্টুরেন্ট বানিয়ে আজকের বাংলা টাউন গড়ে তোলে। তবে আজকের এই শহরে হালাল দোকান, হিজাব পড়ে চলাফেরা, মুসলিম কালচারের পরিচিতি এবং প্রতিষ্ঠার পিছনে লেবানীজদের অবদান অনস্বীকার্য ।
এই সময় কিছু দেশী মাইগ্রেশন ল ইয়ার বা এজেণ্টদের উত্থান হয়। তখন দুই দিনের একটা কোর্স করে মাইগ্রেশন এজেণ্ট হওয়া যেত। এদের ক্লায়েন্ট ছিল মূলত রিফিওজি ভাইয়েরা। অস্ট্রেলিয়ানরা তখন বাংলাদেশিরা যা বলত বা দেখাত তাই বিশ্বাস করত। এদের এই সরলতার সুযোগ নিয়ে, এই মাইগ্রেশন এজেন্টরা একটা বিশাল রেকেট বা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। তাদের দালালদের কাজ ছিল কোন টুরিস্ট বা স্টুডেন্ট এলে তাদেরকে রিফিওজি ভিসাতে এপ্লাই করার জন্য কনভিন্সড করে এই এজেণ্টদের কাছে নিয়ে আসা। এই এজেণ্ট বা তথাকথিত ল ইয়াররা তখন তাদের হয়ে রিফিওজি ভিসাতে এপ্লাই করত। তারা শুধু মাত্র নামটা বদল করে একই এপ্লিকেশনের কপি বারবার চালিয়ে দিত। রাজনৈতিক আশ্রয়, খ্রিস্টান বানিয়ে আবেদন, গে ম্যারেজ, কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করানো -সব কিছুই তারা করত। অনেক সময় আবেদনকারী জানতোও না সে কি জন্য এপ্লাই করেছে। পুরো সিস্টেমকে এরা এক্সপ্লয়েট করে ফেলে।
১৯৯৮-১৯৯৯ সালের মাঝে এসে অস্ট্রেলিয়ার জন হাওয়ার্ড সরকার এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এই পরিবর্তনের হাত ধরেই আজকের অস্ট্রেলিয়া এক অনন্য মাল্টি কালচারাল দেশ হিসেবে গড়ে উঠে। জন হাওয়ার্ড সরকার (লিবারেল পার্টির) প্রথম অস্ট্রেলিয়াতে পড়তে আসা ছাত্রদের অগ্রাধিকার ভিওিতে স্কীল্ড মাইগ্রেশন দেওয়ার ঘোষনা দেন। তখন আমাদের মত অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী পড়াশোনা শেষ করে বেশ সহজেই এই দেশের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হতে থাকে। অন্য দিকে রিফিওজিদের ব্যাপারে সরকার চরম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করে। এর সাথে জড়িত সিন্ডিকেট এবং তথাকথিত মাইগ্রেশন এজেন্টদের ধরপাকড় করতে শুরু করে। অনেক এজেণ্টদের লাইসেন্স ক্যানসেল সহ জরিমানা করা হয়। অনেককে কোর্টে তোলা হয় যাদের বেশীর ভাগ ভয়ে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। প্রথমদিকে যেসব রিফিওজি আবেদনকারীরা পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পেয়ে গিয়েছিলেন তারা ভাগ্যবান ছিলেন কিন্তু ১৯৯৯ এর পর এক এক করে রিফিওজিদের ভুয়া আবেদন বাতিল করে দেওয়া হতে থাকে । তখন অনেকেই আত্মগোপন করে খুব মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন এবং সমাজ থেকে দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকেন । আমাদের মত ছাত্ররা পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাওয়ার পর প্রথম যে জিনিসটা নিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়ে তা হচ্ছে - হোয়াইট কালার জবের জন্য অভিজ্ঞতার অভাব এবং দেনা (বিশেষ করে ক্রেডিটকার্ড এবং ব্যাংকের)। পড়াশোনা করতে গিয়ে সবাই কম বেশী দেনায় আক্রান্ত । এরমধ্যে যারা দেশে টাকা পাঠিয়ে পরিবারকে সাপোর্ট দিত, তাদের উপর চাপটা ছিল আরো বেশী । তখন ভাল জব খোঁজার চেয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে দেনা শোধ করা এবং পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পাওয়াটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য । তাই বাধ্য হয়ে সবাই ট্যাক্সি চালানো, 7-11, Coles, Woolworths, Petrol stations শপগুলাতে রাতদিন কাজ করতে থাকল। তখন বলা হতো, সিডনির ট্যাক্সি ড্রাইভাররা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের তুলনায় অনেক উচ্চ শিক্ষিত।
এর আগে হাতে গোনা কয়েকজন বাড়ি কিনলেও, মূলত আমাদের পূর্ববর্তী ইমিগ্র্যান্ট বাংলাদেশিরা ২০০২ সালের দিকে সিডনিতে বাড়ি কেনা শুরু করেন। সিডনির কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে ইংগলবার্ন ও মিন্টোতে বাংলাদেশিরা বাড়ি কিনে স্হায়ী হতে থাকেন। তখন এই এলাকাগুলো খুব আইসোলেটেড এবং গ্রামের মত ছিল। মনে আছে এক পরিচিত ভদ্রলোক ইংগলবার্নে ৮০ হাজার ডলারে ৩ রুমের একটা বাড়ি কিনেছে শুনে, চেনা অচেনা সবাই দল বেধে তার বাড়ি দেখতে যেত। শনিবার রবিবার এলে, তার বাড়ির আশে পাশে মেলার মত ভীড় হতো।
২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার কেভিন রাড ( লেবার পার্টির) সরকারের আরেকটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ আমাদের মত নব্য ইমিগ্র্যান্টদের জীবন বদলে দেয়। সারা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল তখন অস্ট্রেলিয়া সরকার বিদেশি ছাত্রদের জন্য বর্ডার খুলে দেয়। প্রচুর মানুষকে স্কীল্ড, ওয়ার্কিং, ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে মাইগ্রেশন দিয়ে আনা হয়। ম্যাক্রো ইকোনমিতে পরিবর্তন আনা যেমন পাবলিক এক্সপিন্ডিচার বাড়িয়ে দিয়ে অনেক জবের পজিসন তৈরী করা হয়। এই সুযোগে আমাদের অনেকেই সরকারি বেসরকারি অর্গানাইজেশনগুলিতে প্রফেশনাল জবে ঢুকে যায়। অনেকে প্রপার্টি বিজনেস সহ আইন, আইটি, এডুকেশন, একাউন্টিং, মর্গেজ ব্রোকারের ব্যবসাতে জড়িয়ে সফল হতে থাকে। অনেক বাংলাদেশী লাইসেন্স পেয়ে ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করেন। অস্ট্রেলিয়া একমাত্র উন্নত দেশ ছিল যে দেশে সেই সময় কোন অর্থনৈতিক মন্দা কখনো স্পর্শ করেনি।
সকালে ঘুমিয়ে আমার এই প্রিয় শহরের ২৭ বছরের পরিবর্তনের কথা ভাবছি। বউ আমার পরম মমতায় বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । হঠাৎ ওর হাসির শব্দে চোখ খুলে বললাম “কি হয়েছে?” বলল, “জনাব, আপনার বুকের কয়েকটা লোম সাদা হয়ে গেছে”। মুখে এমন ভাব করলাম যেন এটা কোন বিষয় না। বউ সকালের নাস্তা বানাতে গেল। আমি বাথরুমে ঢুকে আয়নার দিকে তাকালাম । সব কিছু ছাপিয়ে,আজ আমার পরিচয় আমি একজন বাবা, এক মমতাময়ী নারীর স্বামী । ভয়ডরহীন এই মানুষটির প্রতিটা দিন এখন উৎকন্ঠায় কাটে প্রিয়জনদের ভবিষ্যত আর নিরাপত্তার কথা ভেবে । আয়নার সামনে দাড়িয়ে বুঝলাম পন্চাশ ছুই ছুই এই মানুষটা আজ সময়ের কড়াল থাবায় ক্লান্ত । যে নাবিক একদিন জাহাজে করে অচেনার পথে উওাল সমুদ্রে বেড়িয়ে পড়েছিল, আজ তাঁর জাহাজের নোঙ্গর তীরে ফেলার সময় হয়ে গেছে ।
বিষয়: সোলায়মান দেওয়ান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: