সাহিত্যে নোবেল বিজয়িনী হান কাং -গৌতম সরকার
প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ২০:০৫
আপডেট:
৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০১:০১
"আমি বিশ্বাস করি, মানুষের গাছ হওয়া উচিত।"
--ই সাং
তাঁর লেখায় উঠে আসে মানবজীবনের দুঃখ-কষ্ট, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংকট, মানবতার অন্ধকার দিক, সহিংসতা, অস্তিত্বের জটিলতা। তাঁর লেখা একদিকে সরল, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর। তিনি তাঁর লেখনীতে কাব্য এবং কল্পনার মিশ্রণে অনায়াসে সর্বজনীন আখ্যান তৈরি করতে পারেন। তাঁর প্রতিটি দৃঢ় গদ্যের মধ্যে মিশে থাকে কাব্যিক সুষমা, যেটি তাঁর গদ্যকে আরও শক্তিশালী ও বাঙ্ময় করে তোলে। তাঁর তীব্র কাব্যিক গদ্য ঐতিহাসিক নানা ক্ষতের মুখোমুখি করে আর মানবজীবনের ভঙ্গুরতাকে প্রকট করে। তিনি হলেন দক্ষিণ কোরিয়ার বিশিষ্ট লেখক হান কাং, যিনি ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তিনি যখন কলেজে পড়তেন তখন কোরিয়ার আধুনিকতাবাদী কবি ই সাং-এর একটি পংক্তি তাঁকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল, "আমি বিশ্বাস করি, মানুষের গাছ হওয়া উচিত।" এই লাইনটি কবি জাপানের উপনিবেশ থাকাকালীন ঔপনিবেশিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কোরিয়ার প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে লিখেছিলেন। এই পংক্তিটি পরবর্তীতে হান কাংকে তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' উপন্যাসটি লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
গল্প উপন্যাস লিখলেও কবিতাকে হান কাং চিরদিন তাঁর কন্ঠের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দেখে এসেছেন। সেই কারণে তাঁর গদ্যেও কবিতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নোবেল অ্যাকাডেমির মতে তিনি দেখিয়েছেন, সাহিত্য কিভাবে শক্তিশালী এবং পরীক্ষামূলক শৈলীর মধ্যে দিয়ে সত্য কথা বলতে পারে। ১৯৯৩ সালে ‘সাহিত্য ও সমাজ’ পত্রিকায় পাঁচটি কবিতা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে লেখালিখিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। এর মধ্যে ছিল বিখ্যাত কবিতা 'উইন্টার ইন সিওল'। পরের বছর 'স্কারলেট অ্যাঙ্কর' ছোটগল্পের মধ্যে দিয়ে কথাসাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন। ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্প সংকলন, 'ইয়োসুর প্রেম', যেটি নিখুঁত ও কাব্যিক বর্ণনার জন্য সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। এরপর তাঁর কলমে পরপর উঠে এসেছে, ফ্রুটস অফ মাই উওম্যান (২০০০), স্যালামান্ডার (২০১২)-এর মত ছোটগল্পের সংকলন, এছাড়া ব্ল্যাক ডিয়ার (১৯৯৮), ইওর কোল্ড হ্যান্ডস (২০০২), দ্য ভেজিটেরিয়ান (২০০৭), ব্রিদ ফাইটিং(২০১৯)-এর মত উপন্যাসসমূহ। তাঁর ফ্লাগশিপ উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান'-এর জন্য ২০১৬ সালে ‘ম্যান বুকার পুরস্কার’ জিতে নেন, তারপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এছাড়া ২০২৩ সালে প্রকাশিত 'আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল' উপন্যাসের জন্য ফ্রান্সের তরফে 'মেডিসিস পুরস্কার' পেয়েছেন।
২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় হান কাং-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারে হান জানিয়েছিলেন কিভাবে সদ্যোজাত দিদির মৃত্যু এবং ক্রনিক মাইগ্রেন তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর লিখিত উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্টস'-এ অবচেতনেই একটি সংলাপ লিখেছিলেন, "মরে যেয়ো না, মরে যেয়ো না প্লিজ"। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর বোনের জন্মের পর এই কথাগুলোই তাঁর মা বারংবার বিড়বিড় করে বলতেন। দিদির মৃত্যুর কষ্ট তাঁর বাবা-মা সারাজীবন বহন করে চলেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, প্রথম সন্তানের মৃত্যুই তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে বাবা মায়ের কাছে আরও মূল্যবান, আরও আদরের করে তুলেছিল। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের পারিবারিক জীবনে প্রায়শই তাঁর মৃতা দিদির প্রসঙ্গ উঠে আসত। "আমাদের জীবনে কখনও আনন্দ, কখনও বেদনা, এই দুইয়ের মিশ্রণই তো মানুষের জীবনের অনুভূতি।" সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক হান্না বেকারম্যান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কৈশোর থেকেই আপনি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন, এটা কি লেখালেখিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল?’ উত্তরে হান জানান, “এই সমস্যাটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি একজন মানুষ, আমি কোনও অবিনশ্বর, অমর জীব নই। প্রচণ্ড মাথাব্যথায় যখন পড়া, লেখা সব বন্ধ হয়ে যেত তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আত্মানুসন্ধান করতাম। এইভাবে জীবনে আমি নম্র-ভদ্র হতে শিখেছি, মানবজন্মকে মূল্যবান ভাবতে শিখেছি”৷ তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, "আমি একশোভাগ সুস্থ থাকলে, কখনোই একজন লেখক হতে পারতাম না।"
হান কাংয়ের বাবা হান সিউং-ওন নিজে একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। ফলে শৈশব থেকেই হান একটি সাহিত্যিক পরিমন্ডলে বড় হয়ে ওঠেন। বাড়িতে প্রচুর বই ছিল, যেটি তাঁর বই পড়ার খিদে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। নোবেল পুরস্কার জেতার পর তাঁর বাবা জানিয়েছেন, 'আমার মেয়ের লেখা খুবই সুক্ষ্ম, জীবন্ত, এবং দুঃখজনক। তার লেখায় যেমন বর্তমানের জীবনবোধের চালচিত্র রচিত হয়, তেমনি লজ্জাজনক ইতিহাসকে নির্মমভাবে টেনে এনে কাটাছেঁড়া করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে।' তিনি আরও জানান, ‘আমার মেয়ে সাহিত্যের সেবক। সে প্রতি মুহূর্তে সমাজ ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চায়।'
তাঁর লেখা 'গাঢ় কালো আলোর ঘর' কবিতার এক জায়গায় বলছেন,
‘আকাশ ছিল কালো,
আর সেই অন্ধকারে
উড়ে গিয়েছিল কিছু আবাসিক পাখি
শরীরের ভার ঝেড়ে ফেলে
কতবার মরতে হবে যদি চাই এভাবে উড়তে?’
এই প্রশ্ন শুধু কবিতায় নয়, তাঁর লেখা একাধিক উপন্যাসে বারবার ছুঁয়ে গেছে। তাঁর লেখা 'হিউম্যান অ্যাক্টস' উপন্যাসটির পটভূমি হল ১৯৮০ সালে ঘটে যাওয়া গোয়াংজু বিদ্রোহ। এই উপন্যাসটি দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে প্রতিবাদী ছাত্রদের গণহত্যার গল্প বলে। উপন্যাসের একের পর এক যন্ত্রণাদীর্ণ পর্বগুলোতে এই ছাত্রদলের কন্ঠেও বারংবার উচ্চারিত হয়েছে, ‘আর কতবার মরতে হবে যদি চাই উড়তে!’ হান কাং ইতিহাসের শহীদ মানুষগুলোকে প্রতিবাদের এমন একটা কন্ঠ দিয়েছিলেন যা তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও মানসিক কাঠিন্যের পরিচায়ক। তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস হল ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’। এটি একটি সামাজিক উপন্যাস। গল্পের মূল চরিত্র একজন মহিলা। ঘটনা আবর্তিত হয়েছে ওই মহিলার মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। এই সিদ্ধান্তে নিজের পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে মহিলা চরম প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। লেখক গল্পটির ছত্রে ছত্রে নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা, প্রতিরোধ ও সহিংসতার গতিপথ অন্বেষণ করে ফিরেছেন। আরেকটি উপন্যাস ' দ্য হোয়াইট বুক'-এ পারিবারিক যন্ত্রণার বার্তা ফুটে উঠেছে। মৃত বোনের স্মৃতির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় নিবেদিত বইটি সমালোচকদের মতে একটি 'দুঃখের ওপর ধ্যান', যার প্রকাশ ঘটেছে সাদা সব বস্তুর উপস্থাপনায়, সাদা হল হারানোর যন্ত্রণা ও স্মৃতির প্রতীক। ২০১১ সালে প্রকাশিত 'গ্রীক লেসন' উপন্যাসটি একটি মহিলার গল্প বলে যে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। একই সাথে তাঁর শিক্ষক দৃষ্টিশক্তি হারায়। গোটা উপন্যাস জুড়ে লেখক হারানোর যন্ত্রণা, অঙ্গ হারানো দুটো মানুষের সম্পর্কের রসায়ন, ভাষা ও পরিচয়ের মধ্যে যোগসূত্রের সন্ধান করে গেছেন। পুনরায় ইতিহাস, আবার গণহত্যা চিত্রিত হয়েছে তাঁর অপ্রকাশিত উপন্যাস 'উই ডু নট পার্ট' বইটিতে। এখানে হান কোরিয়ান ইতিহাসে লুকোনো একটি গণহত্যাকে দিনের উজ্জ্বল আলোয় নির্ভীকভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯৪৮-৫৪ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলনে জেজু দ্বীপের প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়েছিল। উপন্যাসের দুই কেন্দ্রীয় মহিলা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি তামাম মানুষের তীব্র মানসিক কষ্ট, আঘাত, যন্ত্রণা, প্রতিবাদকে কাব্যিক সুষমায় উন্নীত করেছেন।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কেন লেখেন?’ তাঁর উত্তরে সাহিত্যে এশিয়ার প্রথম মহিলা নোবেল বিজয়িনী জানান, "আমি লিখি কারণ আমি পৃথিবীকে আলিঙ্গন করতে চাই, জীবনের সঙ্গে কোলাকুলি করতে চাই। কিন্তু সত্যি সত্যি তা করতে পারিনা। তাই আমার লেখার মধ্যে দিয়ে সেটা করে চলি।" সেই ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতার ধ্বনিই উচ্চারিত হয় তাঁর বিখ্যাত ‘সিওলের শীত’ কবিতায়,
“আমার অতল অন্তর ঠাসা
তোমার ভালোবাসায়,
শ্বাস নিতে পারবো না ঠিকঠাক
আমি তোমার শ্বাসক্রিয়া হবো,
কালো কালি লেপা তোমার ঠোঁটে
হবো শ্রান্ত নিশ্বাস।"
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: