শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫) : সেলিনা হোসেন
 প্রকাশিত: 
 ১৯ জুলাই ২০২২ ০২:৫৭
 আপডেট:
 ১৯ জুলাই ২০২২ ০৩:৫৩
                                
মারুফ বলে, আমরাওতো এভাবে ছুটে এলাম। আমাদের ভাগ্য যে আমরা নিশ্চয়তা পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মানবিক বোধের তুলনা হয়না। তিনি সীমান্ত খুলে রাখতে বলেছেন। আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কোনোদিন যদি আমি সামনে পাই তাঁকে তাহলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব। 
- বাহ, তোমার কৃতজ্ঞতার কথা শুনে আমরা খুবই খুশি হলাম। 
ওরা তিনজন একসঙ্গে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে চলে যায়। মারুফ ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই রাস্তায় কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়। এমন সময় ও দেখতে পায় রঘু রাই ফিরে আসছে। তাকে দেখে কথা বলার জন্য উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মারুফ। রঘু রাই কাছে আসতেই বলে, আমি আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কি ছবি তুলেছেন? 
- অনেক ছবি তুলেছি। শরণার্থীদের জীবন আমার কাছে একদম অন্যরকম। এমন জীবন আমি দেখিনি। 
- আপনার ছবি ইতিহাসের ছবি হবে। 
- হ্যাঁ, তা হবে। বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হবে তারপরতো শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবে। 
- অবশ্যই। আমি যুদ্ধ করে দেশে যাব। শুধু শরণার্থী হব না।
- তাই, দাঁড়ান আপনার একটা ছবি তুলি। 
মারুফ নিজেরদের তাবুর দিকে পিঠ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রঘু রাই তাবুসহ চারপাশের লোকজন নিয়ে ছবি ওঠায়। পুরো শরণার্থী শিবিরের চমৎকার একটি ছবি ওঠে। দেখে খুশি হয় রঘু রাই। মারুফকে বলে, আজকে আমি যাচ্ছি। এরপরে কখনো-কোথাও দেখা হতে পারে। আমিতো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরি। বেশ অনেক শরণার্থী শিবির আমার দেখা হয়েছে। যশোর রোডে আমি আবার আসব। আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়িটা ছাড়তে হবে সেজন্য চলে যাচ্ছি। ছবিগুলো বিভিন্ন কাগজে ছাপা হবে। 
- আপনাকে সালাম জানাই যে আপনি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস সজীব রাখছেন। 
রঘু রাই হেসে মাথা নাড়ে। মারুফের হাত ধরে বলে, গুড বাই। ভালো থাকুন, বীর যোদ্ধা হন। স্বাধীন দেশের মানুষ হন। যাচ্ছি। 
মারুফের হাত ছেড়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে রঘু রাই। গাড়ি ছেড়ে যায়। মারুফ তাকিয়ে থাকে। নিজেকে বলে, ও আমার শরণার্থী জীবনের বড় অভিজ্ঞতা। রঘু রাই তোমাকে আমি ভুলবনা কোনোদিন। 
মারুফ নিজের তাঁবুতে এসে ঢোকে। আসমানী ঘাসের ওপর বিছিয়ে দেয়া একটি শাড়ির উপর শুয়ে আছে। মাথার নিচে বালিশ নেই। শুকনো মুখে তাকায় মারুফের দিকে। মারুফ ওর মাথার কাছে গিয়ে বসে কপালে হাত রাখে। পাশে বসে আছে দুলাল। 
- মা কৈ রে দুলাল? 
- বাইরে গেছে। আমাকে বলেছে আপুর কাছে বসে থাকে। একটু পরে লোক এসে আমাদেরকে খাবার দিয়ে যাবে। সেজন্য বলে গেছে সবাই যেন তাঁবু থেকে বেরিয়ে না যায়। 
- তোর খিদে পেয়েছে দুলাল? 
- না, পায়নি। মায়ের কাছে যেটুকু ভাত ছিল তাতো আমরা সবাই খেলাম দুলাভাই। আপনার খিদে পেয়েছে? 
- হ্যাঁ, আমার খুব খিদে পেয়েছে। আসমানী তোমার খিদে পেয়েছে?
- না, আমার খুব খিদে পায়নি। আমিও মায়ের কাছ থেকে দুই মুঠো ভাত খেয়েছি। 
- শরীর ভালো বোধ করছ? 
- আগের চেয়ে একটু বেশি ভালোলাগছে। বিশ্বাস পাওয়ার পরে। কিন্তু ছেলে হারানোর কষ্ট আমাকে ছাড়ছে না। 
- কিছু করার নেই গো। আমাকেও ছাড়ছে না। 
দুলাল কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকেও ছাড়ছে না, দুলাভাই। এই ছোট্ট মানুষটি থাকলে এই তাঁবুটা আমার কাছে ফুলের বাগান হয়ে থাকত। 
- কাঁদিস না রে ছোট্ট সোনা। 
মারুফ নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বলে। কাঁদতে শুরু করে আসমানীও। সবাই দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। কেউ কারো দিকে তাকায়না। 
তখন তাঁবুতে ঢুকে আকাশী। ওদের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কি হয়েছে ওদের। সন্তানের জন্য কাঁদছে মারুফ। আকাশী আসমানীর পায়ের দিকে বসে পড়ে। আসমানী চোখ খুলে বলে, মা, মাগো।
- তোকে সব কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মা। কষ্ট ধরে রাখলে শরণার্থী শিবিরের কষ্টও বেড়ে যাবে। 
আসমানী কথা বলেনা। চুপ করে থাকে। মারুফ দু’হাতে চোখ মুছে শাশুড়ির দিকে তাকায়। 
- চারপাশে একটু হেঁটে দেখলাম এখানকার সবার কি অবস্থা। 
- আমাদেরকে নাকি ভাত দেয়া হবে? 
- হ্যাঁ, বলে গেছে। একটু পরে আসবে। 
- আমি ইন্দিরা গান্ধীর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করতে চাই বাবা। শুনতে পেলাম অনেকের মুখে যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢুকছে ভারতে। তিনি তাঁদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। হায় আল্লাহ, এমন একজন মানুষকে চোখে না দেখলে আমার কষ্ট ফুরাবেনা। 
কথা শেষ করে আকাশী হাঁটুর উপর মাথা রাখে। অন্যরাও নিশ্চুপ থাকে। শরণার্থী জীবনের এমন একটি সময় গ্রাম ছেড়ে আসা কয়েকজন ভাবে, স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে গেলে প্রাণপ্রিয় ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের দেশে নিয়ে অনেক সম্মান দেখাব। বলব, আপনি আমাদের মা। আকাশী নিজের ভাবনায় অন্যদের কথার সঙ্গে নিজেকে এক করে। ভাবনা গেঁথে থাকে মাথায়। 
তখন তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ায় একজন। মারুফ উঠে সামনে যায়। লোকটি খাবারের পোটলা দিয়ে বলে, আপনাদের খাবার। 
- আপনারা কয়জন আছেন তাঁবুতে? 
- পাঁচজন। 
- হয়ে যাবে। সবাই পেট ভরে খেতে পারবেন। 
- খাবারের পোটলাটি হাতে নিয়ে মারুফ ভাবে, লোকটি সান্ত¡নার কথা বলে গেল। কোনোরকম খাওয়া হবে। পেট ভরানো নয়। কারণ পোটলার ওজন তেমন নয়। যাহোক, তবুতো কিছু খাবার পাওয়া গেছে। লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম কি দাদা? 
- হরিহর। দু’একদিনের মধ্যে আমি আবার আসব। আপনাদেরকে শরণার্থী কার্ড দেয়া হবে। এই কার্ডের প্রমাণে আপনাদের চাল, ডাল, আলু, তেল ইত্যাদি রিলিফ দেয়া হবে। আপনাদের থালা, গøাস, হাঁড়ি, বালতি ইত্যাদি দেয়া হবে। নিজেরা রান্না করে খাবেন। আমি যাচ্ছি এখন। 
লোকটি চলে যায়। মারুফ তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পার হয়ে যশোর রোডে ঢুকছে। ও চারদিকে তাকিয়ে নিজের শ^শুর রবিউলকে খোঁজে। তিনি কোনদিকে গেছেন এখনো জানতে পারেনি। মারুফ হঠাৎ করে দেখতে পায় তার শ^শুর আসছে। ও দ্রæত পা চালিয়ে তার কাছে যায়। 
- আব্বা আপনি কোথায় ছিলেন? 
- খানিকটা দূরে ওই পাশে ছিলাম। আমার এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সেজন্য কিছু সময় কাটালাম ওর সঙ্গে। ওর এখানে আসার অভিজ্ঞতা খারাপ। 
- কি হয়েছিল আব্বা? 
- ওরা যশোর-সাতক্ষীরা রোড পার হওয়ার সময় পাকসেনাদের গাড়ি দেখতে পায়। ওরা তাড়াতাড়ি গরুর গাড়ি থেকে ওরা যে কয়জন ছিল সবাই বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। রাস্তার পাশের গর্তে নেমে পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ধানক্ষেতে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে শুয়ে পড়ে। এরপরে পাক সেনাদের গাড়ি চলে গেলে আমরা হেঁটে সীমান্ত পার হই। আল্লাহর রহমত যে ওরা আমাদের দেখেনি। সেজন্য গুলি ছোঁড়েনি। এখন যতদিন লাগে দেশের স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করব। আর শরণার্থী হয়ে বেঁচে থাকব। 
- হ্যাঁ, এমন কথা আমাদের সবার জন্য একই রকম। 
- ঠিকই বলেছেন। আপনি কোথায় আছেন? 
- আমি এই যশোর রোডেই তাঁবু পেয়েছি। 
- তাহলে আপনি তাঁবুতে চলে যান। আমরা ওদেরকে নিয়ে বনগাঁ যাব। আমি অসিত, অধর ও দীপক ও অজয়। 
- ঠিক আছে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম। তারপর দেখলাম ওরা একটা ট্রাকে উঠে চলে গেল। 
- ভালোই সময় কাটিয়ে এসেছেন আব্বা। আপনার খিদে পেয়েছে। 
- অসিত ওদেরকে দুধ-পাউরুটি খাইয়েছে। একই সঙ্গে আমাকেও দিয়েছে। সেজন্য তেমন খিদে পায়নি। 
- ঠিক আছে, আমরা তাঁবুতে যাই। আপনার জন্য ভাত রাখা হয়েছে। আপনি খাবেন। 
- চলো যাই। মেয়েটার দিকে তাকালে বুক ভেঙে যায়। কষ্টে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা। 
- এসব কথা থাক আব্বা। আমারওতো একই কষ্ট হয়। 
- হ্যাঁ, হবেই। তা জানি। চলো এই গাছের নিচে একটু বসে থাকি। তারপর তাঁবুতে যাব। চারদিক থেকে ছুটে আসে মৃদু বাতাস। সামনে দিয়ে বয়ে যায় ছোট নদী বাতাসে তরঙ্গ তুলে। হঠাৎ রবিউল দূরে তাকিয়ে বলে, মারুফ দেখো নদীর ধারে একটি মেয়ে পড়ে আছে। 
- তাইতো, তাইতো - বলতে বলতে মারুফ উঠে দাঁড়ায়। পরে বলে, আব্বা চলেন দেখি মেয়েটার কি হয়েছে। 
- হ্যাঁ, চলো।
(চলবে)...........
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
বিষয়: সেলিনা হোসেন

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: