সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


জুমার দিন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন : মোঃ শামছুল আলম


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:৪৭

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:১৩

 

প্রথম হিজরি সন। মহানবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেন। নবী (সা.) এর মদিনায় পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)। সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়ে যায়। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।
তবে জুমার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় আরো পরে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মদিনায় যাওয়ার পর এবং জুমার নামাজ ফরজ হওয়ার আগে একবার মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেন। তারা বললেন, ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট রয়েছে, যে দিনে তারা সবাই একত্র হয়। খ্রিস্টানরাও সপ্তাহে একদিন একত্র হয়। সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যে দিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, নামাজ আদায় করব।
অতঃপর তারা আলোচনায় বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রবিবার নাসারাদের জন্য নির্ধারিত। অবশেষে তারা ইয়াওমুল আরুবা শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এদিনকে ‘জুমার দিন’ নামকরণ করলেন। (সীরাতুল মুস্তাফা ও দারসে তিরমিজি)
জুমার দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমার দিনের ফজিলত বেশি। পবিত্র জুমার দিনের আমলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশেষ কিছু সওয়াব নিহিত করেছেন। এসব বিশেষ আমলের মাঝে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে গুণাহ মাফ ও বিভিন্ন নফল ইবাদতের সুযোগ।
মুমিনের জীবনে কোন অপ্রাপ্তি নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
‘তোমরা যদি (নিজেদের জীবনে) আল্লাহর নেয়ামত গণনা করো, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না।’
কিন্তু আমরা জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো নিয়ে পড়ে থাকি বলে প্রাপ্তির শুকরিয়া আদায় করতে পারি না। ফলে অশান্তি আমাদের জীবন থেকে যায় না। দ্বীনি এবং দুনিয়াবি এমন অনেক বিষয় আছে, উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে যা একমাত্র আমরাই পেয়েছি। অন্য নবীর উম্মতরা পাননি। তন্মধ্যে একটি হলো জুমার দিন। জুমার দিন শুধু এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজী (সা.) বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতকে জুমার দিন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অজ্ঞ রেখেছেন।
ইহুদিদের ফজিলতপূর্ণ দিবস ছিল শনিবার। খ্রিষ্টানদের ছিল রোববার। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠালেন এবং জুমার দিনের ফজিলত দান করলেন। সিরিয়ালে শনি ও রোববারকে শুক্রবারের পরে রাখলেন। দুনিয়ার এই সিরিয়ালের মতো কেয়ামতের দিনও ইহুদি খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের পরে থাকবে। আমরা উম্মত হিসেবে সবার শেষে এলেও কেয়ামতের দিন সব সৃষ্টির আগে থাকব (মুসলিম-১৪৭৩)।
জুমার দিন গুনা মাফের দিনঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে, যদি তার নিকট থাকে। তারপর জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়। নির্ধারিত নামাজ আদায় করে। তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে। তাহলে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হবে (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৩)।
জুমার দিন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিনঃ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজী (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর যত দিন সূর্য উদিত হবে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হলো শুক্রবার। এ দিনে আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে। এ দিনেই তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছিল। সর্বশেষ কেয়ামত সংঘটিত হবে শুক্রবার দিনে (মুসলিম-৮৫৪)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিন দিবসসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তা আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০৮৪)।
শুক্রবার মুসলমানদের ঈদের দিনঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, এই দিন অর্থাৎ জুমার দিনকে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন বানিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ-৯০৮)।
কবরের আজাব থেকে নাজাতঃ হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, কোনো মুসলমান শুক্রবারে রাতে কিংবা দিনে ইন্তেকাল করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন (তিরমিজি-১০৭৪)।
আজান হলেই কাজকর্ম বাদঃ মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! জুমার দিনে যখন (জুমার) নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ছুটে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা অনুধাবন করো।’ (সুরা জুমা, আয়াত : ৯)
আগে আগে মসজিদে যাওয়াঃ রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, ‘জুমার দিনে যে ব্যক্তি গোসল করে জুমার নামাজের জন্য যায় এবং সামর্থ্যানুযায়ী নামাজ আদায় করে, ইমাম খুতবা শেষ করা পর্যন্ত নীরব থাকে, এরপর ইমামের সঙ্গে নামাজ আদায় করে, তার এ জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০২৪)
মসজিদে আগে গেলে বেশি সওয়াবঃ রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘শুক্রবার দিন মসজিদের প্রতিটি দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করে এবং (জুমার নামাজের) আগমনকারীদের নাম ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করতে থাকে। এরপর ইমাম যখন (মিম্বরে) বসে, তারা লেখাগুলো গুটিয়ে নেয় এবং খুতবা শোনার জন্য চলে আসে। মসজিদে যে আগে আসে, তার উদাহরণ সে ব্যক্তির মতো, যে একটি উটনি কুরবানি করেছে। তার পরবর্তীজনের দৃষ্টান্ত তার মতো, যে একটি গাভি কুরবানি করেছে। তার পরবর্তীজনের দৃষ্টান্ত তার মতো, যে একটি ভেড়া কুরবানি করেছে এবং তার পরবর্তীজনের দৃষ্টান্ত তার মতো, যে একটি মুরগি দান করেছে। পরবর্তীজনের দৃষ্টান্ত তার মতো, যে একটি ডিম দান করেছে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০২১)
প্রতি কদমে নফল রোজা ও নামাজের সওয়াবঃ মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে সকাল সকাল গোসল করল, তারপর ইমামের কাছে বসে চুপ করে মনোযোগসহ খুতবা শুনল, প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে সে এক বছরের নফল রোজা ও নামাজের সওয়াব পাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৪৯৮)
খুতবায় মনোযোগী হওয়াঃ জুমার খুতবার সময় যে অমনোযোগী থাকল বা নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখল, সে নিশ্চয়ই মন্দ কাজ করল। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সে জুমার কোনো প্রতিদান পাবে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭১৯)
খুতবার সময় নিষেধ করাও মানাঃ রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি খুতবার সময় অপরকে কথা না বলতে বা নীরব থাকতে বলল, সেও জুমায় কোনো প্রতিদান পাবে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২০৩৩)
সুন্নতের গুরুত্বঃ জুমার ফরজের পরবর্তী সুন্নত অনেকে ছেড়ে দেয়। অথচ আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মাঝে যে জুমার নামাজে শরিক হলো, সে যেন জুমার নামাজ (দু’রাকাত) শেষে চার রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০৩৩)
সুরা কাহফ পাঠঃ রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে, একটি নুর তার পা থেকে আসমান পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। হাশরের দিনে এ নুর তার জন্য আলো হবে। এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (মুসতাদরিকে হাকিম, হাদিস : ২১২৫)
একটি গুরুত্বপূর্ণ আমলঃ জুমার দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে হজরত আবু হোরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত: রাসূল পাক (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর না উঠে ওই স্থানে বসা অবস্থায় ৮০ বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ শরীফ পাঠ করবে, তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হবে এবং ৮০ বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব তার আমল নামায় লেখা হবে। দোয়াটি হলো-
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়াসাল্লিম তাসলিমা’।
মহান আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাকে পবিত্র জুমাবারের অগণিত নিয়ামত বুঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top