সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবী (সা:) - মোঃ শামছুল আলম
প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:৪৫
আপডেট:
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:৪৬
যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এ ধরাপৃষ্ঠের কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না, যার পদচারণে পৃথিবী ধন্য হয়েছে, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য্য, ক্ষমতা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিতাচার, আমানতদারি, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ। যিনি ছিলেন একাধারে ইয়াতিম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত। যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, মহৎ রাজনীতিবিদ। তিনি হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল।
ভয়াবহ দুশ্চরিত্রে সমাজ যখন বেধড়ক খারাপ। অসহায়ত্ব নিয়ে যখন মানুষ মানুষকে নিয়ে পশুত্বে মেতে ছিল, যখন জীবন্ত মানুষকে কবর দিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতো তখনই এ ধরাতে আসেন তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)। মানুষকে শুনান সুখের বাণী। মানুষ হওয়ার কথা। তিনি জীবনপণ চেষ্টা করে পৃথিবীর বুকে শান্তির ফিরিয়ে এনেছিলেন। মহান আল্লাহ পাক তাকে প্রেরণ করেছেন পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ। ইরশাদ হচ্ছে "আমি আপনাকে পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি"। (সূরা হাজ : আয়াত ১০৭)।
নবী (সাঃ) এর জন্মঃ
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার প্রত্যুষে আরবের মক্কা নগরীতে সমভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মাতা আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রচলিত ধারনা মোতাবেক, উনার জন্ম ৫৭০ খৃস্টাব্দে। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মন্টগোমারি ওয়াট তার পুস্তকে ৫৭০ সনই ব্যবহার করেছেন। তবে উনার প্রকৃত জন্মতারিখ বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। তাছাড়া মুহাম্মদ (সা.) নিজে কোনো মন্তব্য করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি. এজন্যই এ নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি জন্মমাস নিয়েও ব্যপক মতবিরোধ পাওয়া যায় । যেমন, এক বর্ণনা মতে, উনার জন্ম ৫৭১ সালের ২০ বা ২২ শে এপ্রিল। সাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকির গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে প্রথমোক্ত মতই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য।
নবী (স.) এর বংশ পরিচয়ঃ
কুরাইশ বংশ ছিল তৎকালীন আরব সমাজে সবচেয়ে প্রভাবশালী বংশ। রাসুল (সঃ)-এর পিতার নাম আবদুল্লাহ্, মাতার নাম আমিনা, চাচার নাম আবু তালিব, দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিম এবং নানার নাম ওহাব বিন আবদে মানাফ।
নবী (স.) এর শৈশব ও কৈশোর কালঃ
মহানবী (সা.) হচ্ছেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারি। তার জীবনের প্রতিটি পর্যায় মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা। জন্ম থেকে শৈশব, কৈশোর থেকে যৌবন- জীবনের যে কোনো স্তরে তিনি ছিলেন আদর্শের ধারক। শুধু নবুয়তি জীবনই নয়, নবুয়তপূর্ব জীবনে রাসুল (সা.) আদর্শের যে নমুনা স্থাপন করেছেন, তা কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য, সত্য ধারণে উর্বর হৃদয়ের জন্য অদ্বিতীয় আলোর উৎস হয়ে থাকবে।
রাসুল (স.) সম্পর্কে "Mahatma Gandhi" এর সুন্দর মুল্যায়ন- I wanted to know the best of the life of one who holds today an undisputed sway over the hearts of millions of mankind.... I became more than ever convinced that it was not the sword that won a place for Islam in those days in the scheme of life. It was the rigid simplicity, the utter self-effacement of the Prophet the (SM) scrupulous regard for pledges, his intense devotion to his friends and followers, his intrepidity, his fearlessness, his absolute trust in God and in his own mission. These and not the sword carried everything before them and surmounted every obstacle. When I closed the second volume (of the Prophet's biography), I was sorry there was not more for me to read of that great life.( প্রকাশিত হয় Young India,'1924.)
রাসুলে করীমের (সা.) জন্মের আগে এমন কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল যা দ্বারা বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল যে, পৃথিবীতে এমন এক মহা মানবের আবির্ভাব হতে যাচ্ছে, যিনি হবেন অনুপম চরিত্রের অধিকারি ও আলোর দিশারি। যেমন মা আমিনা (রা.) বলেছেন, যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তখন দেহ থেকে একটি আলো বের হলো। সেই আলোয় শ্যাম দেশের মহল উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
প্রসিদ্ধ সিরাত গ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুম পৃষ্ঠা ৭১-এ এসেছে, নবী করিম (সা.) জন্ম গ্রহণের সময় কেসরার রাজপ্রাসাদের ১৪টি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। অগ্নি উপাসকদের অগ্নিকুণ্ড নিভে গিয়েছিল। বহিরার গির্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
মা হালিমা (রা.) বলেন, আমি শিশু মুহাম্মদকে (সা.) ঘরে আনার পর আমার সব অভাব দূরীভূত হয়ে গেল, আমার উভয় স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে গেল ও উটনীর স্তনগুলো দুধে ভরে গেল। আমাদের দুর্বল গাধাটি দ্রুত গতিসম্পন্ন হয়ে গেল। বকরিগুলো চারণভূমি থেকে ভরা পেটে ও ভরা স্তনে ফিরে আসতে লাগলো। এভাবেই শিশু মুহাম্মদের (সা.) এর মহিমা এক এক করে প্রকাশ হতে থাকল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্টা ১৬২)
শিশু মুহাম্মাদ (সা.) যখন হালিমার স্তন্য পান করতেন, তখন মাত্র একটি স্তন্যই পান করতেন। অপর স্তনটি তার দুধভাই হালিমার আপন শিশুপুত্রের জন্য রেখে দিতেন। অবুঝ শিশুর অধিকার প্রদানের এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। শিশু মুহাম্মদ (স.) প্রথম কথা শুরু করেছিলেন এ বাক্যটি দিয়ে-"আল্লাহু আকবার কাবীরা ওয়া ছুবহানাল্লাহি কাছীরা।" অর্থাৎ আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আর সর্বাধিক পবিত্রতা আল্লাহর জন্য।"
রাসুল (সা.) শিশুকাল থেকেই অত্যন্ত লাজুক ছিলেন। তাঁর লজ্জাশীলতা সম্পর্কে একটি ঘটনা হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, কাবাঘর নির্মাণকালে রাসুল (স.) এবং তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (রা.) পাথর ভাঙছিলেন। আব্বাস (রা.) রসুলুল্লাহকে (সা.) বললেন- তহবন্দ (কোমর থেকে নিচের অংশের বস্ত্র বিশেষ) খুলে কাঁধে বাঁধো, ধূলাবালি থেকে রক্ষা পাবে। তহবন্দ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন এবং আকাশের দিকে তাকালেন ও হুঁশ হারিয়ে ফেললেন। খানিক পরেই হুঁশ ফিরে এলে বললেন, আমার তহবন্দ? এরপর তাকে তহবন্দ পরিয়ে দেয়া হয়।
সা’দ বংশের লোকেরা সে যুগে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল আরবি ভাষায় কথাবার্তা বলার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মহান আল্লাহ পাকের ইশারায় শিশু মুহাম্মদের (সা.) এর লালন-পালনের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল এই মার্জিত ও উন্নত রুচিবোধ সম্পন্ন সা’দ বংশের ওপর, যার কারণে হযরত মুহাম্মদ (স.) শিশুকাল থেকেই কথাবার্তায় মিষ্ট ও লালিত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন। শিশুকালেই আরবের মানুষেরা তাঁর মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করতে থাকেন।
আরবে দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ চলছিল। কুরায়েশরা বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে আবু তালিবের কাছে আবেদন জানালেন। আবু তালিব একটি বালক সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এবং কাবা ঘরের সামনে গিয়ে দোয়া করলেন। বালক তার হাতে আঙুল রাখলে সঙ্গে সঙ্গে আকাশে মেঘ এলো ও মুষলধারে বর্ষণ হলো! মৃত জমিন সজীব ও উর্বর হয়ে উঠল। আর সেই শিশুটি ছিলেন সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
শৈশব থেকেই রাসুল (সা.) ছিলেন পরম সত্যবাদী। তিনি কখনো সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি ছিলেন সবার চেয়ে অধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উন্নত চরিত্রের অধিকারি। সবার প্রিয় ও সম্মানিত প্রতিবেশী, পরম সত্যবাদী, সর্বাধিক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী।
নবী (স.) এর বিবাহঃ
প্রতিটি মানুষ আল্লাহর গোলাম। জীবনের সকল স্তরে আল্লাহর সমস্ত বিধি-বিধান পালন করার মধ্যেই রয়েছে মানব জাতির কল্যাণ এবং সফলতা। মানব জীবনে অনেকগুলো স্তর পার হতে হয়। যেমন শৈশব-কাল, কৈশোরকাল, যৌবনকাল এবং পারিবারিক জীবন। পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করার মাধ্যমে মানুষের পূর্ণতা ঘটে। পারিবারিক জীবনের সূত্র ধরেই মানব জীবনের যাত্রা শুরু হয়। এ পরিবারের প্রথম বিন্যাস স্বামী - স্ত্রী, সন্তান, মা, বাবা, ভাই-বোন নিয়ে পরিবার গঠিত। সকলের সাথে সুসম্পর্ক ও অধিকার নিশ্চিত করার ওপরই পারিবারিক জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। পারিবারিক পবিত্রতা ও সুস্থতার ওপরই নির্ভর করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বময় মানবজাতির কল্যাণ। আল্লাহর দেয়া বিধান মতে যারা এ অধ্যায় পরিচালনা করতে পারেন তাদের নেতৃত্বেই এ সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যারা পদচারনা ও দর্শন আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে তিনি হচ্ছেন প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। তার গোটা জীবন উম্মতের জন্য আদর্শ। তার জীবনে একাধারে সমুদয় মানবীয় জ্ঞানের বিকাশ হয়েছিল। বাল্যকাল থেকেই তিনি সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের পূর্ণ আদর্শ ছিলেন। পবিত্রতা, বিশ্বস্ততা, দয়া, ক্ষমা, ভালোবাসা, সরলতা, বিনয়, উদারতা, শিষ্টাচার, মহানুভবতার পূর্ণ প্রকাশ দিল তার গোটা জীবন।
রাসূল (সা:) মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। খাদিজাতুল কোবরা ছিলেন রাসূল (সা:) এর প্রথম স্ত্রী। একাধারে রাসূল (সা:) এর সাথী এবং তার নিজের অর্থকে দ্বীন প্রচারের কাজে ব্যয় করে দেখিয়েছিলেন ত্যাগের উজ্জল মহিমা। নবুওয়াতের সূচনা থেকে খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ছিলেন রাসূল (স.) এর পরিপোষক।
রাসূল (সা:) যে সকল নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাদেরকে উম্মা হাতুল মু’মিনীন অর্থাৎ মুসলমানদের মাতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। কোরআনে এসেছে -
“নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা” ( সূরা : আহযাব-০৬)
বিবি খাদিজার মৃত্যুর পর রাসূল (সা:) ১০ জন (মতান্তরে ১২ জন) নারীকে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীদের মধ্যে শুধু মাত্র আয়েশা (রা.) ছিলেন কুমারী। বাকী সব স্ত্রী ছিলেন বিধবা। রাসূলের জীবনকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়- মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মাক্কী জীবনে ২ জনকে বিয়ে করেন। আর বাকী সবগুলো বিয়ে ছিলো মাদানী জীবনে। রাসূল (সা:) এর বৈবাহিক জীবনে কোন তালাকের ঘটনা ছিলো না। যা উম্মতে মুহাম্মাদীদের জন্য এক বড় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল নবী (স.) এর আদর্শের খেলাপ করে জীবনসঙ্গী খোঁজার কারণে ও বিভিন্ন অনৈসলামি রীতিনীতি গ্রহণ করার কারনে বর্তমানে তালাক এক মহামারী আকার ধারণ করেছে, যা সমাজ-সংসারে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী।
নবী (স.) নবুয়ত পূর্ব জীবনঃ
আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই "হিলফুল ফুজুল" নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মাদ (স.) এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মুহাম্মাদ (স.) এর তেমন কোন পেশা ছিলনা। তবে তিনি (স.) বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। মুহাম্মাদ (স.) অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তার উপাধি হয়ে যায় "আল আমিন" এবং "আল সাদিক" যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। ব্যবসায় উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। নবী (স.) এর সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ (স.) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান। খাদীজা মাইছারার মুখে নবী (স.) এর সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংশা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদ (স.) কে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ (স.) বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মাদ (স.) তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদ (স.) এর বয়স ছিল ২৫ বছর ।
নবী (স.) এর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা’বা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবেন এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করেন, যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে প্রথম প্রবেশ করবে, তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন নবী (স.) সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে নবী (স.) অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করেন। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন। ফলে খুব সুন্দর ভাবে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
নবী (স.) এর নবুওয়ত প্রাপ্তিঃ
চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স.) নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুওয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। স্ত্রী খাদিজা (রা.) নিয়মিত নবী (স.) কে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল (আ) নবীর কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিব্রাইল (আঃ) তাঁকে এই পংক্তিটি পড়তে বলেন-
“পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না”( সুরা আলাক)।
উত্তরে নবী (স.) জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পংক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও নবী (স.) নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর নবী (স.) পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম ওহী অবতরণের পর নবী (স.) এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাবেন, “আমাকে আবৃত কর”। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবী (স.) । তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর নবী (স.) এর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ (স.)। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই কষ্টের এবং প্রতিকূলতা পূর্ণ এবং এই প্রতিকূলততার মধ্যেই নবী (স.) এর মক্কী জীবন শুরু হয়।
নবী (স.) এর মক্কা জীবনঃ
নবুওতের ১ম বৎসর হযরত আবু বক্কর, হযরত আলী, হযরত খাদীজা ও হযরত জায়েদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবু বক্কর (রা.) এর দাওয়াতে হযরত ওসমান, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তালহা, জুবায়েদ (রা.) প্রমূখ ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আরকাম ইবন আবুল আরকাম বিলাল, সোহাইব, সুমাইয়া, আবু ওবাইদা ইবনুল জাররা, সাঈদ ইবন জায়েদ, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) প্রমূখ এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেন।
নবুওতের ২য় ও ৩য় বৎসরে গোপনে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। ইসলামের ১ম মাদরাসা আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে রাসূল (সা.) ইসলামের দাওয়াত ও নও মুসলিমদের তালিম দেন। নবুওতের ৪র্থ বৎসরে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ বলেন-
হে রাসূল, আপনি উঠুন এবং সতর্ক করুন, আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন (সূরা মুদদাসসির : আয়াত ২-৩); হে রাসূল, আপনার নিকটাত্মীয়গণকে সতর্ক করে দিন (সূরা শুয়ারা; আয়াত ২১৪)।
নবী (স.) এর বিরুদ্ধে কাফেরদের শত্রুতা শুরুঃ
রাসূল (সা.) জাদুকর, গণক, কবি, উন্মাদ ইত্যাদি ভাষায় গালিগালাজ শুরু করা হল। আবু লাহাবের স্ত্রী কর্তৃক রাসূল (সা.) এর চলার পথে কাঁটা বিছানো, নামাজ আদায়ের সময় কাফের যুবক কর্তৃক নবীজী (স.) এর গলায় উটের নাড়িভুঁড়ি তুলে দেয়াসহ ইত্যাদি উৎপীড়ন শুরু করে। ইসলাম গ্রহণ করার অপরাধে হযরত সুমাইয়া (রা.) নামীয় মহিলা সাহাবীকে বর্শা নিক্ষেপে শহীদ করা হয়। হযরত জুবাইদ (রা.) খেজুরের চাটাইয়ে জড়িয়ে আগুনের ধোয়া দিয়ে কষ্ট দান। হযরত বেলাল (রা.) কে উত্তপ্ত বালুতে শোয়ানোর পর বুকে ভারী পাথর চাপা দেওয়া গলায় রশি বেঁধে টানা-হেচড়া করা, কাফেররা এমনি ধরণের নানা অত্যাচার শুরু করে।
নবুওতের ৫ম বৎসরে রাসূল (সা.) কর্তৃক সাহাবীদের নিজ নিজ সামর্থ অনুসারে গোপনে ইথিওপিয়ায় হিজরতের পরামর্শ দান ও হযরত ওসমান (রা.) স্বীয় স্ত্রী ও নবী কন্যা হযরত রোকাইয়া (রা.) সহ গোপনে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।
নবুওতের ৬ষ্ঠ বৎসরে বীর শ্রেষ্ঠ হযরত হামজা (রা.) ও ৩ দিন পর অপর স্বনামধন্য বীর হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। নবুওতের ৭ম বৎসরে ইসলাম গ্রহণ ও প্রচারের অপরাধে গোটা বনি হাসিম সম্প্রদায়কে কাফিররা বয়কট করে। তাদের সাথে লেনদেন, উঠা, বসা, আত্মীয়তা, ক্রয়, বিক্রয় ইত্যাদি যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে। অগত্য মুসলমান ও বনী হাসিম সম্প্রদায় শিহাবে আবু তালিব নামের গিরিগুহায় বন্দীত্ব বরণ করেন। ক্ষুধায়, পিপাসায় তারা নিদারুণ কষ্টের সম্মুখিন হন। ক্ষুধা নিবারণ করতে গাছের বাকল, পাতা এবং এমনকি চামড়া সিদ্ধ পানি পর্যন্ত পান করতে বাধ্য হন। নবুওতের ১০ম বৎসরে কুরাইশ গণ বয়কট প্রত্যাহার করায় মুসলমানগণ ও বনি হাসিম সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যগণ শিহাবে আবু তালিব গুহা থেকে জনপদে ফিরে আসেন। মহানবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত দিতে তায়েফে গেলে তায়েফ বাসী ও তাঁকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে। পাথর মেরে মেরে তাঁর পবিত্র দেহ রক্তাক্ত করে দেয়। তা স্বত্বেও তিনি (সা.) তাইয়েফ বাসীর জন্য হেদায়েত ও মাগফেরাতের দোয়া করেন। নবুওতের একাদশ বৎসরে মদীনার ১ম কাফেলার ইসলাম গ্রহণ তথা আকাবার ১ম শপথ গ্রহণ করেন। নবুওতের দ্বাদশ বৎসরে ২৭ রজব সোমবার রাসূল (সা.) এর মেরাজ গমন। এ সময় ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়। মদীনায় ২য় কাফেলার ইসলাম গ্রহণ তথা আকাবার ২য় শপথ। নবুওতের ত্রয়োদশ বৎসরে ২৭ সফর প্রিয় নবী (সা.) ও হযরত আবু বক্কর (রা.) আল্লাহর নির্দেশে মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন।
আবিসিনিয়ায় হিজরতঃ
ধীরে ধীরে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম রূপ ধারণ করে, তখন নবী কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে পাঠান। সেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার চেষ্টা করে, যদিও তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কারণে তা সফল হয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণঃ
ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। নবী সব সময় চাইতেন যেন আবু জেহেল ও উমরের মধ্যে যেকোন একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করেন। তার এই ইচ্ছা এতে পূর্ণতা লাভ করে। আরব সমাজে উমরের বিশেষ প্রভাব থাকায় তার ইসলাম গ্রহণ ইসলাম প্রচারকে খানিকটা সহজ করে। এরপর একসময় নবীর চাচা হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণে আরবে মুসলিমদের আধিপত্য কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ইসলামের কাজ যখন এগিয়ে চলছে তখন মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ (স.) ও তার অনুসারী সহ গোটা বনু হাশেম গোত্রকে একঘরে আটক করে। তিন বছর আটক থাকার পর তারা মুক্তি লাভ করেন।
নবী (স.) এর দুঃখের বছরঃ
মুক্তির পরের বছরটি ছিল মুহাম্মাদ (স.) এর জন্য দুঃখের বছর। কারণ এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তার স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিব মারা যান। দুঃখের সময়ে নবী মক্কায় ইসলামের প্রসারের ব্যাপরে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। হতাশ হয়ে তিনি মক্কা বাদ দিয়ে এবার ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান। কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে মুহাম্মাদের (স.) এর পিছনে লেলিয়ে দেয়; তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে নবীকে রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি, নব নব সম্ভবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন।
নবী (স.) এর মি‘রাজঃ
এমন সময়েই কিছু শুভ ঘটনা ঘটে। ইসলামী ভাষ্যমতে এ সময় মুহাম্মাদ (স.) এক রাতে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান; এই ভ্রমণ ইতিহাসে ইসরা নামে পরিচিত। মসজিদুল আকসা থেকে তিনি একটি বিশেষ যানে করে উর্দ্ধারোহণ করেন এবং মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন, এছাড়া তিনি বেহেশ্ত ও দোযখ সহ মহাবিশ্বের সকল স্থান অবলোকন করেন। এই যাত্রা ইতিহাসে মি’রাজ নামে পরিচিত। এই সম্পূর্ণ যাত্রার সময়ে পৃথিবীতে কোন সময়ই অতিবাহিত হয়নি বলে বলা হয়। অর্থাৎ পৃথিবী একি জায়গায় স্থীর ছিল।
নবী (স.) এর মাদানী জীবন শুরুঃ
এরপর আরও শুভ ঘটনা ঘটে। মদীনার বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা মূলত হজ্জ্ব করতে এসে ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন। এরা আকাব নামক স্থানে নবী (স.) এর কাছে শপথ করেন, যে তারা যে কোন অবস্থায় নবীকে রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবে। এই শপথগুলো আকাবার শপথ নামে সুপরিচিত। এই শপথগুলোর মাধ্যমেই মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদকে (স.) এর মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মদীনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকেই গোত্রে গোত্রে এবং ইহুদীদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকত। বিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটে। এ থেকে মদীনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারেনা। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যে সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবে। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদ (স.) কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। এই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যান। সব শেষে মুহাম্মাদ (স.) ও আবু বকর (রা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। তাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা মুহাম্মাদ (স.) কে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তা সফল হয়নি। এভাবেই মক্কী যুগের সমাপ্তি ঘটে।
নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হত। এটি তখনকার যুগে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে দিন গণনা শুরু হয়। এজন্য ইসলামী পঞ্জিকার বর্ষের শেষে AH উল্লেখিত থাকে যার অর্থ: After Hijra।
স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়নঃ
মুহাম্মাদ (স.) মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস ও খাযরাজ। তিনি তার দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেন। মদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভুতি সৃষ্টি করা হয়। আওস, খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র (বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির) সহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদীনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ (স.) হন তার প্রধান।
মক্কার সাথে বিরোধঃ
মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সাথে এর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুহাম্মাদ (স) মদীনায় এসে আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ক্রোক করে। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ (স.) ৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাঠান। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়া হয়। আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ "বদর যুদ্ধ" নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে আল্লাহ পাক মুসলিমদের সহায়তা করেছিলেন। আর এই সময় থেকেই ইসলামের বিজয় ইতিহাসের সূচনা ঘটে। এরপর ৬২৫ সালের ২৩ মার্চে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিতে হয়। এতে প্রথম দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। কুরাইশরা বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দূর্বলতার কারণে পরাজিতের বেশে মক্কায় প্রবেশ করে। ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও "খন্দকের যুদ্ধে" মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধ বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে আশেপাশের অনেক গোত্রের উপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।
কিন্তু এ সময় মদীনার বসবাসকারী ইহুদীরা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দেখা দেয়। মূলত ইহুদীরা বিশ্বাস করতনা যে, একজন অ-ইহুদী শেষ নবী হতে পারে। এজন্য তারা কখনই ইসলামের আদর্শ মেনে নেয়নি এবং যখন ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বুঝতে পারে তখন তারা এর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বনু কাইনুকা ও বনু নাদির গোত্র সপরিবারে মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়; আর খন্দকের পর সকল ইহুদী মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়।
মুসলমানদের মক্কা বিজয়ঃ
দশ বছর মেয়াদি "হুদাইবিয়ার সন্ধি" মাত্র দু’ বছর পরেই ভেঙ্গে যায়। খুযাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র, অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র। একরাতে বকর গোত্র খুযাআদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে অন্যায়ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সহয়োগিতা করে। কোন কোন বর্ণনামতে কুরাইশদের কিছু যুবকও এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ (সঃ) কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র প্রেরণ করেন এবং কুরাইশদেরকে এই তিনটি শর্তের যে কোন একটি মেনে নিতে বলেন। শর্ত তিনটি হলো;
কুরাইশ খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে।
অথবা তারা বকর গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে।
অথবা এ ঘোষণা দিবে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
কুরাইশরা জানালো যে, তারা শুধু তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করবে। কিন্তু খুব দ্রুত কুরাইশ তাদের ভুল বুঝতে পারলো এবং আবু সুফয়ানকে সন্ধি নবায়নের জন্য দূত হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করলো। কিন্তু মুহাম্মাদ (সঃ) কুরাইশদের প্রস্তাবে সারা না দিয়ে মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি শুরু করলেন।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ (সঃ) দশ হাজার সাহাবীর বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। সেদিন ছিল অষ্টম হিজরীর রমজান মাসের দশ তারিখ। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ছাড়া মোটামুটি বিনাপ্রতিরোধে মক্কা বিজিত হলো এবং মুহাম্মাদ (সঃ) বিজয়ীবেশে সেখানে প্রবেশ করলেন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। তবে দশজন নর এবং নারী এই ক্ষমার বাইরে ছিল যারা বিভিন্নভাবে ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সঃ) এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাত। তবে এদের মধ্য হতেও পরবর্তীতে কয়েকজনকে ক্ষমা করা হয়। মক্কায় প্রবেশ করেই মুহাম্মাদ (সঃ) সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করেন এবং সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস করেন। মুসলমানদের শান-শওকত দেখে এবং মুহাম্মাদ (সঃ) এর ক্ষমাগুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম গ্রহণ করেন। কোরআনে এই বিজয়ের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।
শেষ ভাষণঃ
দশম হিজরি। জিলহজ মাস। ২৩ বছর আগে হেরাগুহায় জ্বলে উঠেছিল সত্যের আলো। আজ তা পূর্ণতায় উপনীত। এক কঠিন দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন এ পৃথিবীতে। ২৩ বছর কঠিন পরিশ্রম, সংগ্রাম, অপরীসীম কোরবানি ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। তা আজ সমাপ্তির পথে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন মানুষের কাছে দূত হিসেবে তা আজ পূর্ণতার পথে। দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি সাধনা করে একটি রাষ্ট্র গঠন করলেন। গঠন করলেন শোষণমুক্ত জুলুমহীন ন্যায়বিচারের সমাজ। গড়ে তুললেন তাওহিদ ভিত্তিক নব সভ্যতার এক নতুন জাতি মুসলিম উম্মাহ।
তাই নবী করীম (সাঃ) সঙ্গী-সাথী সহ হজের উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে গমন করেন এবং হজ সম্পাদন করেন। আজ লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে "লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক"। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) যেখানে দাঁড়িয়ে কাবার প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে এক মুসলিম উম্মাহ গঠনের জন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে দোয়া করেছিলেন। মুসলমানরা আজ মাকামে ইবরাহীমে সমবেত। ৯ জিলহজ রাসূল (সাঃ) সব মানুষের সামনে দাঁড়ালেন। মহানবী (স.) প্রথমে আল্লাহ তা’য়ালার প্রশংসা করলেন। এরপর তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করলেন তিনি বললেন, সমবেত জনতা-
১. আজ সকল প্রকার কুসংস্কার অন্ধ বিশ্বাস এবং সকল প্রকার অনাচার আমার পদতলে দলিত-মথিত হয়ে গেল।
২. তোমরা তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার করো। তাদের সাথে তোমরা খারাপ ব্যবহার কোরো না। তাদের ওপর নির্যাতন করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তোমরা তাই খেতে দিবে। তোমরা যে বস্ত্র পরিধান করবে তাদেরকে তাই পরিধান করতে দিবে। মনে রেখো তারাও মানুষ তোমরাও মানুষ। এরাও একই আল্লাহর সৃষ্টি।
৩. সাবধান! নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তাদের ওপর কখনো অন্যায়-অত্যাচার করবে না। কেননা তারা হলো অবলা। কেননা তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপরই। তোমাদের যেমন নারীদের ওপর অধিকার আছে। তেমনি তোমাদের ওপরও নারীদের অধিকার আছে। দয়া ও ভালোবাসার মাধ্যমে তাদের সাথে আচরণ করবে।
৪. আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে সে কুফুরি করল।
৫. সুদ ঘুষ রক্তপাত অন্যায় অবিচার জুলুম নির্যাতন করো না। কারণ এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। আর মুসলমান পরস্পর ভ্রাতৃসমাজ।
৬. তোমরা মিথ্যা বলো না। কারণ মিথ্যা সব পাপ কজের মূল। কারণ মিথ্যাই বিপদ ডেকে আনে।
৭. চুরি করো না। ব্যভিচার করো না। সর্বপ্রকার মলিনতা হতে দূরে থেকো। পবিত্রভাবে জীবনযাপন করো। সাবধান! শয়তান থেকে তোমরা দূরে থেকো। তোমরা কোনো একটি কাজকে খুব সামান্য মনে করবে, কিন্তু শয়তান এসবের মাধ্যমে তোমাদের সর্বনাশ করিয়ে ছাড়বে।
৮. তোমরা তোমাদের আমীরের আদেশ অমান্য করবে না। যদিও হাবশি নাক কাটা গোলাম হয়। তোমরা তার আনুগত্য করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহর দীনের ওপর থাকবে।
৯. ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কোরো না। কারণ তোমাদের পূর্ব-পুরুষেরা এই কারণে ধ্বংস হয়েছে।
১০. বংশের গৌরব করো না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয় প্রতিপন্ন করে অপর বংশের পরিচয় দেয় তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।
১১. তোমরা তোমাদের প্রভুর এবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে। রোজা রাখবে, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে, তবেই তোমরা জান্নাতি হতে পারবে।
১২. আমি আমার পরে তোমাদের জন্য যা রেখে যাচ্ছি তা তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে। তার ওপর আমল করবে। তাহলে তোমাদের পতন ঘটবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কুরআন ও নবী (স.) এর সুন্নাহ।
১৩. তোমরা ভালোভাবে জেনে রাখো আমিই সর্বশেষ নবী আমার পরে আর কোনো নবী আসবেন না।
আমার এই সকল বাণী তোমরা যারা শুনেছ তারা যারা অনুপস্থিত তাদের নিকট পৌঁছে দিবে।
মহানবী (সাঃ) ভাষণ শেষ করলেন। এবং তাঁর চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি করুণ স্বরে করুণভাবে আকাশ পানে তাকালেন এবং তিনি বললেন, ‘হে মহান প্রভু! হে পরওয়ার দিগার! আমি কি তোমার দীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আপনার দীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন। তখন তিনি আবার বললেন যে, ‘হে প্রভু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এরা বলেছ আমি আপনার দীনকে লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি।
নবী (স.) নীরব হলেন। জান্নাতি নূরে তাঁর চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে কুরআনের শেষ আয়াতটি
নাজিল হয়।
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩]
হজরত রাসূল (স.) কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। জনতা নীরব। কিছুক্ষণ পর হজরত (সাঃ) জনতার দিকে তাকালেন এবং করুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়।
নবী (স.) এর ইন্তেকালঃ
হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রাঃ) এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল, মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। অবশেষে ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ সন্ধায় তিনি মৃত্যবরণ করেন। এ সময় নবী (স.) এর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। আলী (রাঃ) তাকেঁ গোসল দেন এবং কাফন পরান। আয়েশ (রাঃ) এর কামরার যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, জানাযার পর সেখানেই তাকেঁ দাফন করা হয়।
বিশ্বনবী (সা.) এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, ‘He was the mater mind not only of his own age but of all ages’ অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।
উইলিয়াম মুর সহ পৃথিবীর বুকে যত মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান বাণী পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- "তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।" (সূরা-আহযাব, আয়াত-২১)।
বর্তমানে অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্বমুখর আধুনিক বিশ্বে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকে অনুসরণ করা হলে বিশ্বে শান্তি ও একটি অপরাধমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে সম্ভব।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: