অস্ট্রেলিয়াতে সন্তানের স্কুলের সাথে পিতামাতার সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা
 প্রকাশিত: 
 ২০ জুন ২০১৯ ০৪:৫৫
 আপডেট:
 ১ এপ্রিল ২০২০ ০২:৫৫
 
                                বাংলাদেশ থেকে যারা সপরিবারে প্রবাসী হয়ে থাকেন, অথবা প্রবাসী কোন পরিবারের একটি শিশু যখন কিছুটা বড় হয় সাধারণত তখনই আমরা বিদেশের স্কুল পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া শুরু করি। প্রবাসী বাংলাদেশী পরিবারের শিশুটি যখন ক্রমান্বয়ে ডে-কেয়ার, প্রাইমারী স্কুল এবং পরবর্তীতে আরো বড় হয়ে হাইস্কুলে যায়, সময়ের সাথে সাথে পিতামাতাও তাদের সন্তানের পড়ালেখার খোঁজ রাখতে গিয়ে সেদেশের স্কুলিং ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হতে থাকেন।
অস্ট্রেলিয়ায় সন্তানের পড়ালেখার জন্য নানা ধরণের স্কুল আছে। এর মাঝে সরকারী স্কুলগুলোতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু-কিশোর-কিশোরী পড়ালেখা করে থাকে। সাধারণত একটি পরিবার যে এলাকায় বসবাস করে, সে এলাকার স্কুলগুলোতে সে পরিবারের সন্তানরা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বিশেষায়িত স্কুলও এদেশের রয়েছে, এছাড়াও আছে ধর্মীয় স্কুলের ব্যবস্থা। তবে এদেশে সব ধরণের স্কুলেই একটি সাধারণ বিষয় পরিলক্ষিত হয়, তা হলো ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকের সাথে স্কুল প্রশাসন এবং শিক্ষকদের যোগাযোগের উপর গুরুত্বারোপ।
শৈশবে বাংলাদেশে পড়ালেখা করেছেন এমন অভিভাবকদের সাথে তাদের সন্তানদের স্কুলিং প্রসঙ্গে কথা বললে তারা বেশ কিছু ব্যতিক্রমী বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন। তার মাঝে দু’টি বিষয় প্রায় সবার সাথেই আলোচনায় উঠে আসে। তা হলো স্কুলে পড়ানো বিষয়ের সংখ্যা এবং অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণী থেকেই সাত-আটটি বিষয় পড়ানো শুরু হয়, প্রাইমারী পর্যায় শেষ করতে করতে পঠিত বিষয়ের সংখ্যা কখনো দশও ছাড়িয়ে যায়। তার বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার স্কুলগুলোতে হাতেগোণা তিন বা চারটি বিষয় পড়ানো হয়। শিক্ষাব্যবস্থার এ পার্থক্য যদিও একটি কৌতুহলউদ্দীপক এবং গবেষণার বিষয়, তথাপি আজকের এ প্রবন্ধে অভিভাবকের সাথে স্কুলের যোগাযোগ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা থাকবে।
বাংলাদেশী অভিভাবকদের অনেকেই বলেন স্কুলগুলো থেকে প্রায়ই টিচার-প্যারেন্টস মিটিং এর জন্য ডাকা হয়। এসব মিটিং এ তাদের সন্তানের পড়ালেখা, ব্যক্তিত্ব, আচরণ ইত্যাদি সহ নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা ক্লাশ শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীর পিতামাতার সাথে আলোচনা করেন। অনেক অভিভাবক এসব মিটিংকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, তবে বেশিরভাগ অভিভাবকই এ যোগাযোগের উপকারিতা এবং সুফলের কথা বলে থাকেন।
অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ এলায়েন্স ফর চিলড্রেন এন্ড ইয়থ (এআরএওয়াইসি) পরিচালিত ২০১২ সালের এক গবেষণায় পরিস্কার দেখা যায়, যখন কোন অভিভাবক তার সন্তানের স্কুল এবং পড়ালেখার সাথে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট থাকেন তখন সে সন্তানেরা পড়ালেখায় ভালো ফলাফল করে, স্কুলে যেতে এবং বেশি সময় কাটাতে আনন্দ অনুভব করে।
অন্যদিকে এই সম্পর্ক একজন অভিভাবকের জন্যও নিঃসন্দেহে উপকারী। বিশেষ করে অভিবাসী বাবা-মা’দের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। এর মাধ্যমে তারা সরাসরি বুঝতে পারেন কিভাবে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কাজ করে। একই সাথে তারা অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সাথেও যোগাযোগের সুযোগ পায়।
তবে এ স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় সুফল তারা পেয়ে থাকেন সন্তানদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এ যোগাযোগের কারণে সন্তানদের পড়ালেখার অগ্রগতি এবং সমস্যা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল থাকার কারণে বাড়িতে সেই সন্তানের পড়ালেখার বিষয়গুলো যথাযথভাবে তত্ত্বাবধান করতে পারেন। শৈশব এবং বয়োসন্ধির বয়সগুলোতে একজন মানুষের মানসিক গড়ন বিকাশপ্রাপ্ত হয়। এসময় তাদের মানসিকতা অনেক নাজুক এবং সংবেদনশীল থাকে। এমনি সময়ে যখন একজন অভিভাবকের অজ্ঞানতা প্রকাশ পেলে তা পরোক্ষভাবে সন্তানের মনে সম্মানের ঘাটতি তৈরী করতে পারে, এটি যত ক্ষুদ্র বিষয়েই হোক না কেন। সুতরাং তার বিপরীতে যদি পিতামাতার সচেতনতা এবং জ্ঞানগত ক্ষমতা সন্তানের সামনে উপস্থাপিত হয় তখন সেই অভিভাবক ও সন্তানের মাঝেও পারস্পরিক বুঝাপড়া ও শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্পর্ক সহজে তৈরী হয়।
সন্তানের শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার দু’টি পর্যায় রয়েছে।
প্রথমত, আপনাকে বাড়িতে কিছুটা সময় দিতে হবে। তাদের স্কুলের কর্মকান্ড, পড়ালেখা, বাড়ির কাজ ইত্যাদি সম্পর্ক প্রশ্ন করুন। তাকে বুঝতে দিন যে, আপনি এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সত্যিকারভাবেই জানতে আগ্রহী এবং প্রয়োজন হলে তাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক।
প্রবাসের ব্যস্ত জীবযনযাত্রায় সবসময় পর্যাপ্ত সময় বের করে নেয়া সব অভিভাবকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। সুতরাং যদি আপনি আপনার সন্তানের বাড়ির কাজ করার সময় সরাসরি সাহায্য করতে পারেন তাহলে তা খুবই ভালো, তবে তা সবসময় করতে না পারলে অন্তত যখনই সম্ভব হয় তখন তার বাড়ির কাজ ও পড়ালেখা সম্পর্কে অল্প কয়েক মিনিট কথা বলে হলেও ধারণা নেয়ার চেষ্টা করুন। তাকে পড়ালেখার উপযুক্ত নিরিবিলি পরিবেশ ও স্থান দিতে চেষ্টা করুন। অনেক সময় নানা আর্থিক ও সামাজিক কারণে যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে সময় করে স্থানীয় লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে হলেও পড়ালেখা করতে সাহায্য করুন।
এদেশের নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি আপনার মাতৃভাষা শিখতে ও মাতৃভাষায় কথা বলতে তাকে উৎসাহ দিন। সারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষাবিদ ও মনস্তত্ববিদরা একমত যে, কোন শিশু যখন একাধিক ভাষায় কথা বলে তখন তার মানসিক বিকাশ ও মেধাচর্চার জন্য তা সহায়ক হয়।
দ্বিতীয়ত, বাড়িতে সময় দেয়ার পাশাপাশি তাকে স্কুলেও সময় দিন, স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত হোন। প্যারেন্ট-টিচার মিটিংগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিন। এছাড়াও স্কুলের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর নানা উপায় রয়েছে। স্কুল এসেম্বলিগুলোতে আপনি উপস্থিত হতে পারেন কিংবা স্কুলের ক্যান্টিনে হয়তো স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সময় দিতে পারেন, অথবা স্কুলের নানা অনুষ্ঠানে সম্ভব হলেই এবং সুযোগ থাকলেই আপনি উপস্থিত হতে পারেন।
যদি ভাষাগত সমস্যা অনুভব করেন তাহলে আপনি স্কুলের স্টাফদের সাথে বিষয়টি আলোচনা করলেই তারা ইন্টারপ্রেটর বা দোভাষীর ব্যবস্থা করবেন। অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে প্রথম পদক্ষেপটি নেয়া। এরপর সে সম্পর্ককে আরো ফলপ্রসু করতে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিতে অস্ট্রেলিয়ার স্কুলগুলোতে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা সবসময়েই আগ্রহী থাকেন।
বিষয়:

 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: