সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের স্মৃতিমাখা স্বপ্নসুন্দরী মুকুটমণিপুর : ডঃ সুবীর মণ্ডল        


প্রকাশিত:
১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৮

আপডেট:
১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৫০

ছবিঃ স্বপ্নসুন্দরী মুকুটমণিপুর

 

আজ আপনাদের শোনাবো পশ্চিমবঙ্গের সেরা পর্যটন কেন্দ্র মুকুট মণিপুরের ভ্রমণ ও অকথিত জন্মবৃত্তান্তের এক রোমাঞ্চকর কাহিনীর কথা। এশিয়ার সর্ববৃহৎ নদী বাঁধ নিয়েই  কংসাবতী প্রকল্প। এই মুহূর্তে সারা দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র। বহুদিনের ভালোলাগা এই জায়গা। আমার শহর থেকে দূরত্ব ১০ কিমি। সব ঋতুতেই লক্ষ লক্ষ ভ্রমণবিলাসী মানুষের স্বপ্নপূরণের এক আদর্শ ঠিকানা অপরূপা -সুন্দরী মুকুটমণিপুর, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি।  বহু  জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে, অমরকণ্টক, রাজারাণী- বাদশা, ঈশ্বর -পরমেশ্বর, নীল নির্জনে, বেহুলা, শেষ আঘাত প্রভৃতি।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষের কাছে  আজ অত্যন্ত জনপ্রিয় জায়গা। উৎসবমুখর শীতে তিলধারনের জায়গা পাওয়া যায় না। লোকজ শিল্পের ও সংস্কৃতির আকরভূমি। পরতে পরতে জড়িয়ে আছে গর্বর্দীপ্ত এক মহান সুপ্রাচীন ইতিহাস। এটি প্রাগ- ঐতিহাসিক  যুগের এক প্রত্নস্হল। পরেশ নাথের মন্দির তার পাথুরে প্রমাণ। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কংসাবতী জলাধার ও তার সন্নিহিত অঞ্চল। গত বছর শীতের  এক  কুয়াশা মাখা সকালে দু'টি বাইক  নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম  মুকুটমণিপুরের দিকে। সারাদিনের পরিকল্পনা। একেএকে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা গুলো ঘুরতে শুরু করলাম। বারঘুটু, ডিয়ারপার্ক, দোলাডাঙা, অম্বিকানগর, গোড়াবাড়ি, অতুল্য ঘোষের বাগান বাড়ি। দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম স্হানীয় আরণ্যক লজে।তারপর চললাম রাণীবাঁধ, সুতান, বাংলার  বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর বারিকুল-ছেঁদাপাথর, প্রকৃতির স্বপ্নরাজ্য রাণীবাধের ১২ মাইল, তালবেড়ে লেক, সীমান্ত বাংলার অসাধারণ একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা ঝিলিমিলি। সারা দিনের ক্লান্তির ও অফুরান  তৃপ্তি নিয়ে   স্মৃতি রোমন্থন  করতে করতে ফিরে আসলাম খাতড়া শহরে। এই অসাধারণ মনোমুগ্ধকর মুকুটমণিপুর একদিন গড়ে ওঠেনি। এর একটি ঐতিহাসিক জন্মবৃত্তান্ত আছে। ইতিহাস আর অতীত বর্ণময় ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে  আজ ভারত তথা বিশ্বের মানচিত্রে  মুকুটমণিপুর অনন্য। নদীপ্রকল্পের মাধ্যমে এই পর্যটন কেন্দ্রের আত্মপ্রকাশ। এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি জলাধার ও সেচ প্রকল্প। এই প্রকল্প কংসাবতী সেচ প্রকল্প বা কংসাবতী জলাধার প্রকল্প নামেও পরিচিত।

১৯৫৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে বর্তমান পশ্চিম-পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও হুগলী জেলার ৩,৪৮৪.৭৭ বর্গকিমি এলাকায় জলসেচের উদ্দেশ্যে ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে এই মহাপ্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পে কংসাবতী নদীর পাশাপাশি শিলাবতী ও ভৈরববাঁকি নদীর জলও সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। কংসাবতী বা কাঁসাই দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী। কালিদাসের “রঘুবংশম-এর চতুর্থ সর্গে উল্লিখিত” এবং অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যগ্রন্থে এই নদী ‘কপিশা’ নামে উল্লিখিত। মহাভারতীয় যুগের নদী  হিসাবেও ধরা হয়। কিংবদন্তী অনুসারে, সমুদ্রের কাছে বাগদত্তা কংসাবতী কৃষ্ণদামোদর নদের রূপে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলে কংসাবতী দ্রুত ধাবমান হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়। খাতড়া মহকুমা শহর থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে মুকুটমণিপুর এলাকায় অবস্থিত এই প্রকল্পটি।

মুকুটমণিপুর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার একটি গ্রাম ও পর্যটনকেন্দ্র। এর প্রধান আকর্ষণ কংসাবতী বাঁধ ও তার দৃষ্টিনন্দন জলাশয়। বাঁধের কল্যানেই আজ সবুজের স্নিগ্ধাতা পেয়েছে। দূর -দিগন্তে সবুজের সমারোহে হারিয়ে যাওয়া যায় । বাঁধটির উপর বসলেই আপনার মন প্রসন্ন হয়ে উঠবেই।  বিকেলের রক্তিম জলাধার কখন যে আপনার চিত্তটি রাঙিয়ে দিয়েছে খেয়ালই করতে পারবেন না।

সূর্য ডোবার দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।প্রিয় জনের হাত ধরাধরি করে হাঁটতে পারেন বাঁধের উপর দিয়ে। দিনের সঙ্গে রাতের মুকুট মণিপুরের রূপের পার্থক্য অনেক। বর্ষায় কিংবা শীতের মুকুট মণিপুরে শুধু আপনি,এই তারা -ভরা রাতে। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে মুকুটমণিপুর অপরূপা ও মায়াবী হয়ে ওঠে। জলাশয়ের  জলে ইচ্ছা করলে ভেসে বেড়াতে পারেন। বাঁধের উপর থেকে দেখা মিলবে পাহাড়ের অসাধারণ ল্যাণ্ডস্কেপ । কখনো মনে হবে এ-যেন জনমানবহীন কোন স্বপ্নের দেশ। জীবনের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন গুলো  আপনাকেও আপ্লুত করবেই । রাতের গভীরে লজের বারান্দায় একটি চেয়ার নিয়ে বসুন। নৈঃশব্দ্যের জগতে আপনি ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার অনেক কিছুই  হৃদয়কে উদ্বেলিত করে তুলবে। মুকুট মণিপুরের নক্ষত্রখচিত আকাশ কখন যে আপনার শৈশব- যৌবনের কোন নীরব চাপা বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে তাও বুঝতেও পারবেন না। জোছনাধোয়া বর্ষার রাতে, হেমন্তের বহতা  হাওয়া, কাঁসাই-কংসাবতীর অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য, পাখপাখালির সিম্ফনি জানান দেবে'রাত এখনও অনেক বাকি'। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসুন অম্বিকানগর ৩ কিমি দূরে। দেখুন অম্বিকানগরের রাজাদের রাজপ্রাসাদ, হাজার বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী আর মা অম্বিকার মন্দির, অরণ্য সুন্দরী রাণীবাঁধ ২০ কিমি ঝিলিমিলি ৪৫ কিমি, অতুল্ ঘোষের বাগান বাড়ি। সুতান ও তালবেড়িয়ার লেক ৪০ কিমি, ৩০ কিমি দূরে বারিকুল, শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর স্মৃতি বিজড়িত এক অসাধারণ জায়গা।

অতীত ইতিহাস ছুঁয়ে আছে। দক্ষিণ বঙ্গের নেতারহাট স্বপ্নসুন্দরী ঝিলিমিলি। গাছ বাড়িতে রাত্রিবাস করতে পারেন। ফেরার পথে ঘুরে নিন খাতড়া শহর, মসক ও লেদি পাহাড়, মা রঙ্কিণীর থান ও শ্মাশানকালী মন্দির। বহু লোকমুখে  শুনেছি যে, এই স্থানটির নামকরণ অম্বিকানগরের রাণী মুকুটমণির নামানুসারে হয়েছিল। ঝাড়খণ্ড সীমান্তের নিকট কংসাবতী ও কুমারী নদীর সংযোগস্থলে এই গ্রামটি অবস্থিত। মৌজার নাম ভালুকমারি, থানা খাতড়া, ব্লক খাতড়া ও রাণীবাঁধ। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম মাটির তৈরি দীর্ঘ বাঁধ। গঠনপ্রণালীতে অভিনবত্বের ছাপ লক্ষ করা যায়। মাটির উপরে পাথর দিয়ে বাঁধটি নির্মিত হয়েছে। ৩৮ মিটার উঁচু এবং ১০,০৯৮ (আনুমানিক ১০কিমি ৯৮ মিটার) মিটার লম্বা। এই বহুমুখী নদী প্রকল্পের গোড়াপত্তনের সুমহান ইতিহাস অনেকেরই অজানা, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা হল সেই ইতিহাসের অন্বেষণ।

গঙ্গার পবিত্র জলধারাকে বহন করে নিয়ে গিয়ে ভগীরথ যেমন কপিল মুনির অভিশাপে সাগর রাজা ষাট হাজার সন্তানের শাপমুক্তি ঘটিয়ে ছিলেন, তেমনি এই বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিবিদ্গণ বহুমুখী নদীপ্রকল্পের বাস্তব রূপায়ণে বন্ধ্যাত্ব অভিশাপে অভিশপ্ত ধরিত্রীকে করেছে শস্যশ্যামল, ঘন তমসাকে করেছে আলোকিত।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর পর যখন বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর বাঁধ দেওয়ার কাজ শেষ হল, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরবর্তী প্রয়াস হল কংসাবতী পরিকল্পনা রূপায়ণ। ১৯৫২ সাল থেকে কংসাবতী অববাহিকা অঞ্চল অর্থাৎ মেদিনীপুর, হুগলী জেলার ব্যাপক এলাকা জুড়ে শুরু হয়েছিল জরিপের কাজ।

সাধারণভাবে পরিচিত কাঁসাই। পোশাকি নাম কংসাবতী। তারই আর একটি উপনদী ‘কুমারী’ মিলিত হয়েছে দক্ষিণ বাঁকুড়ার রাণীবাঁধ থানার অন্তর্গত অম্বিকানগরে। মা অম্বিকার নামে গ্রামের নাম। পার্বত্য ছোটনাগপুরের কোনো এক স্রোতধারা নানান জলধারায় সমৃদ্ধ হয়ে পুরুলিয়া জেলা অতিক্রম করে বাঁকুড়ায় প্রবেশ করে এবং চলার পথে কুমারী সহ আরও দুটি উপনদী ভৈরববাঁকি ও তারাফেনীকে নিয়ে স্ফীতোদরা হয়ে প্রবেশ করে মেদিনীপুরে। বাঁকুড়ার সীমান্ত এলাকা থেকে দীর্ঘ ৮০/৯০ মাইল ব্যাপী এলাকা প্রায় প্রতিবছর (অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে) প্লাবিত হয়ে ভেঙ্গে যেত ঘরবাড়ি, ভেসে যেত গবাদি পশু, ক্ষতি হত শস্য ক্ষেত। রাক্ষুসী কংসাবতী তার হাজার হাজার কিউসেক জলে নিশ্চিহ্ন করত মেদিনীপুরের বিনপুর থানা, সদর থানা, ময়না, কাঁথি ও ঘাটাল। অবশেষে ক্লান্ত স্রোতস্বিনী প্রবেশ করত হুগলী নদীর বঙ্গোপসাগরে।

এই সব কারণেই ধ্বংসশালিনী কংসাবতীকে তার চলার পথে বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে বাধ্য হয় তদানিন্তন সরকার। শুধু তাই নয়, এই হাজার হাজার কিউসেক জলকে অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করে সেচের কাজে প্রয়োগ করলে খরা প্রবণ দক্ষিণ বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল শস্যশ্যামলীমায় ভরে উঠবে – এই ভূমিকাটিও পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটে ক্রিয়াশীল ছিল।

তাই সদ্য সমাপ্ত ময়ূরাক্ষী পরিকল্পনার বাঙ্গালী প্রযুক্তিবিদ, দক্ষকর্মী ও কারীগরদের মনে অসীম উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায় এই পরিকল্পনার রূপায়ণে। জলধারার স্থান নির্বাচন ও নির্ধারণ করতে এক মর্মান্তিক জীপ দুর্ঘটনায় নিহত হন অধিক্ষক বাস্তুকার সরল সেন ১৯৫১ সালের ৫ মে। এই কংসাবতী নদীরই পার্শ্বস্থ এলাকায় আজও তাঁর স্মৃতিফলক কাঁকড়াদাঁড়া গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে রক্ষিত আছে। ময়ূরাক্ষী প্রকল্পের ভারী ভারী যন্ত্র সমূহের গন্তব্যস্থান হল দক্ষিণ বাঁকুড়ার এক পাহাড় সংকুল প্রস্তরাকীর্ণ অঞ্চল গোড়াবাড়ী ও মুকুটমণিপুর গ্রাম। এই সঙ্গে এলেন অভিজ্ঞ দক্ষ প্রযুক্তিবিদ ও কর্মীগণ তাঁদের নবীন উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে। শুরু হল এক বিরাট কর্মকাণ্ড ১৯৫৬ সালে। বন্যাক্লিষ্ট মেদিনীপুর জেলার সুসন্তান তদানীন্তন পশ্চিমবাঙলার সেচমন্ত্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় ১৯৫৭ সালের জানুয়ারী মাসের এক শুভদিনে প্রস্তাবিত খালের মৃত্তিকা খনন করেন। পশ্চিমবাংলার রূপকার তথা মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় ১৯৫৯ সালের ২৪ জানুয়ারী মাসের আর এক শুভ দিনে কংসাবতী জলাধারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

কি বিশাল এক কর্মকাণ্ডের অবতারণা, এক বিরাট কর্মযজ্ঞের আহ্বান, কি এক কঠিন জাতীয় উদযাপন। প্রথম পর্যায়ে কংসাবতী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ ও জলাধার গঠন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কুমারী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ ও জলাধার গঠন, পরে দুই জলাধারের একত্রীকরণ এই ছিল উদ্দেশ্য। কয়েকটি পাহাড়ের প্রাকৃতিক অবস্থিতি এই বাঁধ নির্মাণ ও জলাধার গঠনের উপযোগী হয়ে উঠে। উল্লেখ্য কোনো ঠিকাদার প্রথা এই বাঁধ ও জলাধারের নির্মাণ কার্যে ব্যবহৃত হয়নি। শুধুমাত্র বিভাগীয় কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই এই বিশাল কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছিল।

প্রস্তাবিত সেচসেবিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হল বাঁকুড়া জেলার খাতড়া, রাণীবাঁধ, রাইপুর, সিমলাপাল, তালডাংরা, ইন্দপুর, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, ওঁদা, জয়পুর ও কোতুলপুর থানা। মেদিনীপুর জেলার বিনপুর, গড়বেতা, শালবনী, মেদিনীপুর সদর, ঝাড়গ্রাম, সাঁকরাইল, খড়গপুর, কেশিয়াড়ী, ঘাটাল, চন্দ্রকোণা, কেশপুর, নারায়ণগড় ও জামবনী এবং হুগলী জেলার গো-ঘাটা থানা।

যে প্রতিশ্রুতি ও লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৬ সাল থেকে কাজ আরম্ভ হয়েছিল তা রূপায়িত হল ১৯৬৪ সালে। প্রথম পর্যায়ের কংসাবতী নদীর বাঁধ নির্মাণ সহ জলাধার নির্মাণ তথা মূল খালগুলির অধিকাংশের নির্মাণ কাজ প্রাথমিকভাবে সমাপ্ত হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক শুভদিনে কংসাবতী জলাধার থেকে প্রথম জল ছাড়া হল নিয়ন্ত্রিত গেটের মধ্য দিয়ে, মূল খাল দিয়ে প্রবাহিত হল সেচের জন্য। ধ্বংসের উদ্দেশ্যে নয়, সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘করুণাধারা’ এল ঊষর প্রান্তরের বুকে জলসিঞ্চনের বার্তা নিয়ে। শুভ উদ্বোধন করলেন পশ্চিমবাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার সেন। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। কুমারী নদীর বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ। উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করতে দিবারাত যন্ত্রদানবগুলির গর্জন, কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতায় সেই বহু আকাঙ্খিত কাজ সমাপ্ত হল। কুমারী নদীর বুকে পড়ল বন্ধন। স্ফীতকায় হয়ে উঠল জলাধার। জলাধার থেকে নিয়ন্ত্রিত গেটের সাহায্যে জল ছাড়া হল মূল খাল দিয়ে, যা কংসাবতী নদীর দক্ষিণ পার্শ্বস্থ প্রবাহিত ঝাড়গ্রাম ও খড়গপুর অভিমুখী। উদ্বোধন করলেন পশ্চিমবাংলার তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় ১ আগস্ট, ১৯৭৬ সালে। এর পর এই দুই কংসাবতী ও কুমারী জলাধারের উৎপত্তি হয়, নাম হয় – কংসাবতী জলাধার, যার আয়তন ৫২.৭৫ বর্গমাইল। ধ্বংসকারী কংসাবতীর জল নিয়োজিত হল শস্য ক্ষেতের সমৃদ্ধি আনতে। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ও হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা হল সেচসেবিত। কংসাবতী নদীর বন্যাকেও কিছুটা  নিয়ন্ত্রণ করা হল। মেদিনীপুর জেলা রক্ষা পেল বিশাল ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে। ইতিমধ্যে কংসাবতীর উপনদী ভৈরববাঁকি, তারাফেনী নদীগুলির ওপর ও শিলাবতী নদীর ওপর ব্যারেজ নির্মাণ করে জলাধার তৈরী করা হল এবং কংসাবতী জলাধারের জলস্রোত মূলখাল দুটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করিয়ে উপরিউক্ত ব্যারেজগুলিকে সমৃদ্ধ করা হল এবং শাখা প্রশাখাগুলোর মাধ্যমে সেচযোগ্য জমিতে জলের ধারা বইয়ে দেওয়া হল। এই অধ্যায়ের সাথে সাথে মূল খাল এবং শাখা প্রশাখা খালগুলির ওপর নানা রকমের স্ট্রাকচারগুলির নির্মাণ কাজ অব্যাহত ছিল।

বর্তমান মূল খালগুলির দীর্ঘতা ৩৮৭.৫০ মাইল। শাখা প্রশাখা খালগুলির দীর্ঘতা ২০০০ মাইল। মূল খালগুলি প্রধানত প্রস্তরাকীর্ণ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কোথাও কোথাও ৭০ ফুট থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত খননের প্রয়োজন হয়েছিল এবং এই কার্যে বিস্ফোরক দ্রব্য (Explosive Magazine) বারুদ প্রায়শই ব্যবহার করতে হয়েছিল।  আনুমানিক কমবেশি ১৭৩ টি মৌজা (রাণীবাঁধ, খাতড়া, মানবাজার, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া) এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এই প্রকল্পে। এই সমস্ত মানুষদের জন্য জনদরদী দুই কৃষক নেতা, শ্রী নকুল মাহাত এবং শ্রী জলেশ্বর হাঁসদা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাদের পরবর্তী ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিল তদানীন্তন সরকার। অনেকেই বর্তমানে খাতড়া মহকুমা শহরে বসবাস করছে। 

খালগুলির ওপর নানাবিধ স্ট্রাকচার এর সংখ্যা ৭৫০০ টি, এই সব কাজ সুষ্ঠভাবে পরিচালনা ও নির্মাণের জন্য বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রধানত শহরে ও গ্রামাঞ্চলেও কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। বাঁকুড়া সদরে কংসাবতী মূল অফিস – কংসাবতী সার্কেল অফিস এবং তৎসহ দুটি ডিভিসন অফিস অবস্থিত। অন্যান্য ডিভিসন অফিস বাঁকুড়া জেলার খাতড়া, গোড়াবাড়ী, বিষ্ণুপুর এবং মেদিনীপুর জেলার আমলাগোড়া, মেদিনীপুর সদর এবং ঝাড়গ্রামে অবস্থিত। এছাড়া এদের অধীন বহু সাবডিভিসন অফিসও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। এই পরিকল্পনা রূপায়নে বহু ইঞ্জিনীয়ার, টেকনোলোজিস্ট ও সাধারণ কর্মচারী এবং প্রশাসন বহির্ভূত কর্মচারীরা যুক্ত ছিলেন । কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩০০০।

কংসাবতী পরিকল্পনার পূর্বে দক্ষিণ বাঁকুড়া জেলার তালডাংরা, সিমলাপাল, রাইপুর, খাতড়া ও দুটি থানা রাইপুর ও রানীবাঁধ আদিবাসী অধ্যুষিত চাষের অবস্থা ছিল বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত এখানে ৪০ সেমি থেকে ৪৫ সেমি। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল হলেও মাঝে মাঝে অনাবৃষ্টির দরুন  মাঠের ফসল মাঠেই শুকিয়ে যেত। চাষী হত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। পূর্বে কেবল একটিমাত্র ফসল ধানই উৎপন্ন হত। অন্য ফসল উৎপন্ন করার মত জলের নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু কংসাবতী জলাধারের জল সেই অনিশ্চয়তা দূর করেছে, চাষীদের নিশ্চিন্ত করেছে, এলাকাকে করেছে সেচসেবিত। এক ফসলের জায়গায় খারিব, বোরো ও রবিশস্য তিনটি ফসল উৎপন্ন করতে চাষীরা সচেষ্ট হয়েছে। কারণ তাদের জলের উৎস ও আশ্রয়স্থল কংসাবতী জলাধার। প্রতিবছরেই সেচসেবিত জমির পরিমাণ উর্ধমুখী এবং তাঁর লক্ষ্যমাত্রা ৮,৪২,০০০ একর পূরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়া প্রায় প্রতিবারে বোরো ধানের চাষের জন্য বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার কিছু অংশ ছাড়া মেদিনীপুর জেলায় কংসাবতী নদীর মাধ্যমে সেচের জল দেওয়া হয় পাঁশকুড়া, বালিচক ও ডেবরা অঞ্চলকে। ঘাটাল অঞ্চলে বোরো ধানের চাষের জন্য কংসাবতী নদীর জল শিলাবতী নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত করা হত। পূর্বে যা অচিন্ত্যনীয় তা আজ বাস্তবে রূপান্তরিত। কংসাবতী ও কুমারী নদীর সম্মেলনে কংসাবতী জলাধার মাতৃসমা এই কংসাবতী ও কুমারীর স্তন্যধারায় বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল আজ শস্য শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ। অপরূপ প্রকৃতির শোভার আধার মুকুটমণিপুর তার সন্নিহিত এলাকা সৌন্দর্য্য ও ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তিদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। খাতড়া মহকুমা শহরের সৃষ্টির মূলে এই প্রকল্প। আন্তরিক আশা ও বিশ্বাস সম্বল করে একথা বলতে আমাদের দ্বিধা নেই যে, জনসাধারণের সার্বিক সহযোগিতা, সান্নিধ্য ও শুভেচ্ছা পাথেয় করে ভারপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ ও অগণিত কর্মচারীদের নিরলস প্রয়াস ও পরিশ্রমের ফলের ফসল, কংসাবতী পরিকল্পনার নব রূপায়ণ অদূর ভবিষ্যতে মানব কল্যাণে আরও সুদূর প্রসারী ভূমিকা পালন করার সুযোগ লাভ করে সার্থক হবে। 

পরিশেষে বলা যায় এই বহুমুখী নদী প্রকল্পের বর্তমান বয়স ৭০ বছরের কাছাকাছি। বহুদিন কোনো সংস্কার সাধন হয়নি। জল বহন করার ক্ষমতাও কমছে। সেই সঙ্গে পলি পড়ে নদীর নাব্যতা অনেকখানি কমে গেছে। বিজ্ঞান ভিত্তিক সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয়তা আছে। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ইকো-টুরিজমের এবং ছোটো ছোটো শিল্পের মাধ্যমে বহু তরুণ-তরুণীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব এই চরম বেকারত্বের যুগে। বিজ্ঞান ভিত্তিক মৎস্য চাষ করা যেতে পারে। বহু মৎস্যজীবী পরিবারের অর্থনৈতিক উৎস ভূমি হতে পারে এই প্রকল্প। বর্তমানে আদর্শ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে মুকুটমণিপুর তথা কংসাবতী প্রকল্প জাতীয় স্তরে একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমান রাজ্য সরকার বহু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রভূত উন্নতিসাধন ঘটেছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল এখানকার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই ব্যাপারে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করলে, এই এলাকার সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

একমাত্র মুকুটমণিপুর-বাঁকুড়া রেল সংযোগের মাধ্যমে এই প্রকল্পকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। এই ব্যাপারে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি।  খুব দুঃখের বিষয়, এই প্রকল্পের যিনি রূপকার, তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়, তাঁর ভিত্তিপ্রস্তর ফলক বর্তমানে অনেকটাই অস্পষ্ট এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে। সেইহেতু, এই ফলককে নতুন রূপে পুনঃস্থাপন করা প্রয়োজন। ৭০ বছর পূর্বের ফলকটিতে উল্লিখিত ছিলঃ “কংসাবতী জলাধার ভিত্তিপ্রস্তর ফলক – পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কতৃক ১০ই মাঘ ১৩৬৫ সালে স্থাপিত হইল”। কিন্তু বর্তমানে এই অক্ষরগুলি অত্যন্ত জীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়াও, সম্মানার্ঘ্য-স্বরূপ স্মরণীয় রূপকার, ডাঃ রায়ের একটি আবক্ষমূর্তি প্রতিষ্ঠা একান্তই প্রয়োজন।  রাজ্য সরকার ইতোমধ্যে এই জায়গায় সার্বিক বিকাশে আগ্রহী।মুকুটমণিপুর উন্নয়ন পর্যদ কাজ করে চলেছে।

বেশ কিছু আকর্ষণীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে মুকুট মণিপুরের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে বৃদ্ধি পাবে (১) রোপওয়ে (২) হস্তশিল্পের গ্যালারি ও হাব (৩) পরেশনাথে একটি নান্দনিক সৌন্দর্যের মন্দির নির্মাণ (৪) বারঘুটু এলাকায় হোম স্টের ব্যবস্হা (৫) ছোট চিড়িয়াখানা নির্মাণ (৬) দ্বীপগুলো কে আকর্ষণীয় করে সাজানো পরেশনাথের ধারে ডিয়ার পার্কে অতি সহজেই যাওয়ার জন্য নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ। এর ফলেএখানথেকে মানবাজার হয়ে পুরুলিয়া জেলায় সহজেই যেতে পারবে পর্যটক (৭) লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও লোকশিল্প সংগ্রহশালা (৮) মুকুটমণিপুর-অম্বিকানগর-বান্দোয়ান উন্নতমানের সড়কনির্মাণ করে জামসেদ পুর-ঘাটশিলার সঙ্গে সংযোগ সাধন।

বিভিন্ন স্থান থেকে দূরত্বঃ

(১) কোলকাতা থেকে ২৭০কি,মি, (ট্রেনে   বাঁকুড়া ও দুর্গাপুরে এসে সরকারি-বেসরকারি বাসে অতি সহজেই আসি যায়, সরাসরি প্রাইভেট কারে  আসা সুবিধা জনক)। ৯০ কি,মিঃ, পুরুলিয়া ৯০, ঝাড়গ্রাম, জামশেদ পুর, ঘাটশিলা, অযোধ্যা পাহাড় থেকেদূ রত্ব ৯০ কি,মি। বিষ্ণুপুর থেকে ৭০ কি,মি। থাকবেন-ছোট-বড় লজ ও হোটেলে। পিয়ারলেস, অপরাজিতা, সোনালী, গ্রীনপার্ক, আরণ্যক, পিংরোজ, মোনালিসা, পঞ্চায়েতের ও পঞ্চায়েত সমিতির লজ, সরকারি সোনাঝুরি, অবকাশ, ইউথহোস্টেল, এবং খাতড়া শহরের ঐশি প্লাজাও অন্যান্য লজ। মুকুট মণিপুর ট্যুরিজমে যোগাযোগ করতে পারেন। অনলাইনে বুকিংয়ের সুযোগ আছে।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প ও ভ্রমণ লেখক)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top