সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত

নেতাজি ভবন ও সুভাষ গ্রামের অকথিত ইতিবৃত্ত : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২৫ জানুয়ারী ২০২১ ২০:০২

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫৪

 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু -- নামেই এক অপার শ্রদ্ধা, এক প্রাণ গর্ব আমাদের। তাঁর জন্য অহঙ্কারের শেষ নেই আপামোর বাঙালির।আর যেখানেই  তিনি পদার্পণ করেছেন, সেই জায়গা যেন তীর্থভূমি হয়ে গিয়েছে আমাদের কাছে । বাংলার এমনই এক  তীর্থভূমিতে  পৌঁছে গিয়েছিলাম গত কালিপুজোর পরেরদিন। নাম-  কোলকাতার এলগিন রোডের নেতাজি ভবন ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়া, বর্তমান নাম সুভাষ গ্রামে। ঘরের কাছে বলা যেতেই পারে। দূরত্ব মাত্র ২৮ কি মি বিরাটি থেকে। এই দুই বাড়িতে  তাঁর নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। শুনেছিলাম কোদালিয়ার বাড়িতে দুবার এসেছিলেন। এই দু' বাড়ির ইতিহাস বলতে শুরু করলে শেষ হওয়ার নয় । তাই ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে না গিয়ে, বাস্তবটুকু  নিয়েই এগিয়ে চললাম আমরা। বিখ্যাত বহু মণীষীদের বসত ভিটেতে যাওয়ার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার জীবনের এগুলো সেরা প্রাপ্তি। বেশ কিছু দিন আগে হঠাৎ মনে হলো তিলোত্তমা কোলকাতায় অবস্হিত এলগিন রোগের পৈতৃক বসতবাড়ি ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কোদালিয়া অধুনা সুভাষ গ্রামে ঘুরে আসি। বহুদিনের অধরা স্বপ্নপূরণে উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বিরাটি থেকে আমরা পঞ্চপান্ডব। সময়টা গতবছরের কালিপুজার দু'দিন আগে। বিরাটি স্টেশন থেকে দমদম স্টেশনে পৌঁছলাম, সকাল সাড়ে সাতটায়। তারপর মেট্রোরেলে চড়েবসলাম, ঐতিহাসিক নেতাজি ভবন দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য জীবনে ঘটতে যাচ্ছে, সে নিয়ে রোমাঞ্চিত হয়ে পড়লাম।

গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্রসদন  স্টেশনে। সময় লাগলো ৪০ মিনিট। সবাই একটু চা-টিফিন করে নিলাম। পায়ে হেঁটে চললাম নেতাজি ভবন ও ঐতিহাসিক এলগিন রোডের দিকে। রবীন্দ্রসদন ও নন্দন ও পিজি হসপিটাল রেখে এগিয়ে চলেছি। কোলকাতার বৃহৎ ফ্লাইওভার মা-এর উপর দিয়ে চলছে নানা ধরনের গাড়ি‌,  কিছু দূরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল অতিক্রম করে এগোতে লাগলাম। সামনে প্রশস্ত এলগিন রোড। মনটা হঠাৎ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। এই রোড দিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র একদিন দেশের মানুষের মুক্তির জন্য রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। সামনে পড়ল রাজ্যের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পীঠস্থান  ডাঃ প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ও গবেষণা কেন্দ্র। বিশাল এলাকা জুড়ে তার কর্মকাণ্ড। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে তার সুখ্যাতি। পি, ব্যানার্জী হিসাবে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।  দূর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী নেতাজি ভবনকে। এলগিন রোডের শপিংমল'ফোরাম'--এর ঠিক বিপরীতে নেতাজি ভবনের অবস্হান। এছাড়াও মিন্টোপার্ক থেকে শরৎবোস (ল্যান্সডাউন) রোড ধরে এগিয়ে ডানদিকের প্রথম রাস্তাটি  বিখ্যাত এলগিন রোড। এই রোড দিয়ে হেঁটে বেড়ালে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

এক সময় বহুবার এই রোডে এসেছি নানা কারণে কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখার সুযোগ ও সময় হয়নি। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আজ সেই অপরাধ মোচনের সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস। হেঁটে সময় লাগলো মিনিট দশেক।বেশ রোমাঞ্চিত হলাম। বাড়ির নামে মেট্টো রেলের স্টেশন! হ্যাঁ, তাও সম্ভব। কারণ, সেটি যে সে বাড়ি নয়। সে বাড়ি আপামর বাঙালির নয়নমণি, আপোসহীন অগ্নিপুরুষ, দেশের জাতীয় ও বরেণ্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটে, 'নেতাজি ভবন'।

এই বাড়িকে ঘিরে একসময় ভারতের জাতীয় ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। একথা ভারত তথা গোটা বিশ্বের সন্ধানী দৃষ্টি ছিল এই বাড়ির দিকে। ব্রিটিশরাজের সময় তো বটেই, সম্প্রতি এমনও শোনা গেছে, স্বাধীনতার পরেও এই বাড়ির প্রতি সরকারের শ্রদ্ধা ও নজর ছিল। তাই ভবানীপুর অঞ্চলের কোলকাতা মেট্রো স্টেশন টির নাম এই বাড়ির নামানুসারে 'নেতাজি ভবন' রাখা হয়েছে। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গান্ধীজি ও  জহরলাল নেহরু নেতাজি ভবন পরিদর্শনে এসেছিলেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- সহ দেশ ও বিদেশের বহু বিখ্যাত মানুষ এই বাড়ি দর্শন করে ধন্য  হয়েছেন। ওটেনের বর্ণবিদ্বেষী উক্তির প্রতিবাদ করে সুভাষ চন্দ্র বসু তখন কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন তখন তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। পরে অবশ্য তাঁকে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি করা হয়। সময়টা ১৯১৬। এর ৩বছর পরে ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে তিনি আই সি এস পরীক্ষা দিতে বিলেতে পাড়ি দেন। ১৯২০ সালে সেই পরীক্ষায় দারুণ ফল করেও তিনি  ব্রিটিশ রাজের অধীনে চাকরি করেননি এবং সোজা এলগিন রোডের এই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। এরপরে তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন থাকেন। ১৯৩০ সালে হন কোলকাতার মেয়র। ১৯৩৮-এ জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯৪০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপরাধ রাজদ্রোহিতা। ২রা জুলাই থেকে ৫ -ই ডিসেম্বর জেলবন্দি থেকে মুক্ত হন। তবে বাড়ির ভিতর কী হচ্ছে, সে খবর দেওয়ার জন্য বাড়ির আসেপাশেই রাখা হয়েছিল ডজনখানেক ব্রিটিশ গুপ্তচর এসবের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র পরিকল্পনা শুরু করে ফেলেছিলেন দেশ থেকে পালানোর। উদ্দেশ্য মাতৃভূমির স্বাধীনতা আনা। এই সমস্ত কিছুই সুভাষ চন্দ্র বসুর এই পৈতৃক বাড়িকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল। ১৯৪১ সালের ১৬ই জানুয়ারি রাত ১টা ৩০ মিনিটে দেশের অন্য এক ইতিহাস রচিত হল। উর্দিপরা ও সাদা পোশাকের পুলিশ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সদাসতর্ক নজরদারি এড়িয়ে গৃহবন্দি সুভাষচন্দ্র বসু এই পৈতৃক বাড়ি থেকেই নানা পথ ধরে রাতের অন্ধকারে বার্লিনে চলে যান। দেখা করেন বিশ্বত্রাস হিটলারের সঙ্গে।

সে--মহানিষ্ক্রমণে  সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গী ছিলেন ভাইপো শিশির চন্দ্র বসু। আঁটঘাট বেঁধে নিখুঁত পরিকল্পনামাফিক বাড়ি ছাড়লেন সুভাষচন্দ্র বসু। ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কেউ। এমনকী নিজের মা--ও জানতে পারেনি তাঁর পালানোর কথা। ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ি চালিয়ে তাঁর আদরের ভাইপো  রাঙাকাকাকে গোমো স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি নিখুঁত ভাবে এক উত্তর ভারতীয় পাঠানের ছদ্মবেশ গ্রহন হয় করেন। পরিচয়পত্রে নাম মহম্মদ জিয়াউদ্দিন। নীচে লেখা,বিএ,এল বি, ট্রাভেলিং ইন্সপেক্টর,দ্য এম্পায়ার অফ ইন্ডিয়া লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।তারপর তো অন্য ইতিহাস রচিত হল। এরপর তিনি (জার্মান ইউ--বোট ইউ--১৮০ এবং জাপানি সাবমেরিন আই-২৯এ) জাপান--অধিকৃত দক্ষিণ--পূর্ব এশিয়ায় এসে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন এবং জাপানে বন্দি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এইসব ভাবতে ভাবতে ভাবতেই নেতাজি ভবনের ভিতরে প্রবেশ করলাম। পুরো বাড়িটি নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো ও সংগ্রহশালায় রূপলাভ করেছে।

১৯৪৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি শরৎ চন্দ্র বসু নেতাজির এই পৈতৃক বাড়িটিকে জাতির উদ্দেশে দান করেন। বর্তমানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক বাড়িতে 'নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো'র তত্ত্বাবধানে একটি সংগ্রহশালা, লেখ্যগার ওগ্রন্থাগার রয়েছে। এই স্মারক ভবন ও গবেষণা কেন্দ্র এখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন ও কর্মকাণ্ড বিষয়কগবেষণা চলে। সারা বিশ্বের নেতাজি  গবেষকদের কাছে এই ভবনের গুরুত্ব অপরিসীম। একেএকে বিভিন্ন ভবন পরিদর্শনে অগ্রসর হলাম।আমি এক বিস্ময়কর ঘোরের মধ্যে  অবস্থান করছি। তথ্যসূত্র থেকে জানতে পারলাম সংগ্রহশালাটি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়‌। উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপে থাকা বিশ শতকের  প্রথম দিকের ক্লাসিক থামওয়ালা ত্রিতল লব্মাটে ধাঁচের বাড়ি।পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। বাড়ির বাইরে প্রবেশপথের ডানদিকে শ্বেতপাথরের ফলকে জেএন বোস লেখা, বাঁদিকে নেতাজি ভবন ও বাড়ির নম্বর।একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম, বাঁদিকে সেই ঐতিহাসিক গাড়ি, যে গাড়িতে চেপে ধরে সুভাষচন্দ্র বসু এই পৈতৃক বাড়ি থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলেন সবার চোখে ধুলো দিয়ে। গাড়ি দেখে আমি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। গাড়ির গাঁ ছুঁয়ে দেখার দুর্লভ সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে  হল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বেশকিছু সময়। বাকরুদ্ধ হয়ে  পড়লাম।কালো রঙের সেই ওয়ান্ডারার গাড়িটি (বি এল এ ৭১৬৯) দেখে আমার গা-ছমছম করে উঠলো। শিহরিত হলাম।গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই বাড়িতে এক সময় নেতাজি ছিলেন, এটা ভেবেই রোমাঞ্চিত  ও বিস্মিত হলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো যতচেয়ে দেখি আর স্মরণ করছি সেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের,যাঁরা হাসতে হাসতেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। আমি যেন তখন অন্য ভুবনে বিচরণ করছি।গাড়ি কোন পথ দিয়ে, কীভাবে গিয়েছিল, তার ও একটি সচিত্র মানচিত্র দেখলাম। এটা দেখার পর আরো বিস্মিত হয়ে পড়লাম। তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধু অনুভবের যোগ্য। এতদিন যা শুধুই বইয়ে পড়েছি, ইতিহাসের শিক্ষকের মুখে শুনেছিলাম, আজ চর্মচক্ষু দিয়ে তা দেখলাম। শুধু রোমাঞ্চিত নয়, পুলকিত নয়, একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। একটা সময় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি কি দেখলাম! ঘোর ও আচ্ছন্নতা কেটে গেল। সুস্হির হলাম। তন্নতন্ন করে পুরো এলাকা ঘুরে দেখবো এটা আমাদের প্রত্যেকের ভাবনার ছিল।হাতে ছিল অফুরান সময়। একতলায় জানকীনাথ, শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র বসুর ব্যবহৃত ঘর, বিছানা- সহ আসবাবপত্র দেখলাম,সব পরিপাটি করে সাজানো গোছানো রয়েছে। এছাড়াও সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য সংগ্রহ করে রাখা দেখলাম। এবার কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে পড়লাম। একেএকে দেখলাম কাচবন্দি নেতাজির শোওয়ার ঘর, অবিকল তেমন করেই সাজানো তেমন তাঁর মহানিষ্ক্রমণের দিনটিতে ছিল। তাঁর সাদামাটা জীবন যাপনের ছবি আমাকে  আচ্ছন্ন করে ফেললো। সাদামাটা বিছানা, ঘড়ি, জামাকাপড়, জুতো, এমনকি আয়ুর্বেদিক ওষুধ ও গীতা পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মার্বেল পাথরের তৈরি এক জোড়া থালা ও বাটি দেখে খুব ভারাক্রান্ত ও বেদনাহত হয়ে পড়লাম।

এই চালাতে এ বাড়ির শেষ খাবার খেয়ে তিনি দেশান্তরী হয়েছিলেন। পাশের ঘরে সাজানো গোছানো রয়েছে শরৎ বসুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও আসবাব। কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন যে ঘরে বসে তিনি কাজকর্ম ও অভ্যাগতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, সে ঘর তেমনিই রাখা আছে। সেই ডেস্ক, ঘোরানো চেয়ার, বিয়ের আলমারি। ঘরের দেওয়াল আজও ত্রিবর্ণরঞ্জিত। এবার দোতলা থেকে চললাম তৃতীয় তলায়। এখানে রয়েছে বহুমূল্য ছবি, নথিপত্র, চিঠি ও নেতাজির জীবন ও কর্মপন্থা সংক্রান্ত কালানুক্রমিক সজ্জিত বহু প্রবন্ধ। এই সব দেখতে দেখতেই আমার মানসপটে ভেসে উঠলো তাঁর ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার বর্ণময় বিচিত্র অধ্যায়। একটি শোকেসে সাজানো গোছানো আছে তাঁর ইউরোপ সফরে সংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ইউরোপে ব্যবহৃত গরম পোশাক ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি  হওয়া, জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির উদ্বোধন, গান্ধীজির সঙ্গে তার বিভাজন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দেশনায়ক' পদে বরণ, শেষবারের মতো কারাগারে থাকাকালীন লেখা প্রবন্ধ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত যাত্রাকালে পরিহিত পোশাক, কাবুলে অবস্হানকালে লেখা থিসিসের অংশবিশেষ প্রদর্শিত হয়েছে। পাশের ঘরে তাঁর পরবর্তী ইউরোপীয় পর্ব। সেখানে ইউরোপীয় রাষ্ট্রপতি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক বিষয়ক কয়েকটি মূল্যবান ছবি, ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার দ্বারা মুদ্রিত ডাকটিকিট, আজাদ হিন্দ জার্নাল ও জার্মান সামরিক গ্রন্ত্রগুলির অনুবাদ, কিয়েল থেকে সব়ং পর্যন্ত বিপজ্জনক সাবমেরিন যাত্রার নাটকীয় ফটোগ্রাফ ইত্যাদি।

শরৎবসুর নামে আধুনিক একটি প্রেক্ষাগৃহ দেখলাম। এক সঙ্গে ১৫০ জন মানুষ বসতে পারেন। গালিবের কাছ থেকে জানলাম, মূলত নেতাজির ওপর বক্তৃতা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয় এই প্রেক্ষাগৃহে। ঘুরতে ঘুরতে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসলো। দেশনায়কের জন্যগর্বে বুক ভরে উঠলো। প্রতিদিন বহুপর্যটক ও গুণীজনের এবং দেশ --বিদেশের গবেষকরা এসে অনুপ্রাণিত ও আলোকিত হন। সংগ্রহশালা সোমবার ছাড়া খোলা থাকে বেলা ১১ থেকে বিকেল ৪টা ৩০পর্যন্ত। টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে যায় ৪ টে ১৫মিনিটে। নেতাজি ভবনের স্মৃতি বুকে নিয়ে রওনা হলাম  ২৮ কি মি দূরে কোদালিয়া অধুনা সুভাষ গ্রামের উদ্দেশে। নেতাজি ভবন স্টেশনে মেট্টো চেপে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্টেশনে পৌঁছে টোটো করে পৌঁছলাম সুভাষ গ্রামে। সময় লাগলো প্রায় এক ঘন্টা। বেলা ৪টে বাজে তখন। বারুইপুর শহরে এক বন্ধুর বাসায় সবাই থাকলাম।

পরেরদিন সকালে বারুইপুর শহর ঘুরে ঘুরে দেখে পৌঁছলাম  সুভাষ গ্রামে‌। তারপর  শুরু করলাম  পুরো বাড়িটি ভালো করে দেখতে। দেখলাম তাঁর পৈতৃক বাড়ি, ঠাকুর দালান। এই বাড়িতেখুব বেশি সময় থাকেন নি। পুকুর পাড়ে ও বাগান বাড়িতে বসবাস গুপ্ত সমিতির অনেক সভা করেছেন। সেই কারণেই এই বাড়ির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দোতলায় টানা বারান্দা পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম তাঁর থাকার ঘরে। হঠাৎ মনে হল কানে যেন ভেসে আসছে 'তোমরা  আমাকে রক্তদাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব'। আজো ঠাকুরদালানে দুর্গোপুজো হয়। বোস পরিবারের উত্তরসূরিরা পুজোর দিনগুলিতে একত্রিত হন। শুনলাম এই বাড়িতে এসে সুভাষচন্দ্র অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতেন। পাশেই দেখলাম তাঁর দাদু হরনিথ বসুর নামে ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত' হরনাথ বীণাপাণি লাইব্রেরি'। সমস্ত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে বসু  পরিবারের নানান বর্ণময় স্মৃতি। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভরা পুরো এলাকাটি।

সুভাষচন্দ্র বসুর বাবা ও দাদুর নামে রাস্তা আছে এখানে। সুভাষ গ্রাম কোন অখ্যাত গ্রাম‌ নয়। এক মহাপবিত্র গ্রাম। ভারতের স্বাধীনতা --ইতিহাসের সব তীর্থভূমিতেই বারবার মাওয়া উচিত আপামর ভারতবাসীর। স্বাধীনতার অগ্রপথিক যেখানদিয়ে হেঁটে গিয়েছেন ও পদচিহ্ন রেখে গেছেন সে সব  স্হান হোক আমাদের পূণ্যভূমি। তাই এক বিরল পাওনা মনে হয়েছে এলগিন রোডের নেতাজি ভবন ও কোদালিয়ার (সুভাষ গ্রাম)  তার পৈতৃক বসত বাড়িটি।  অজান্তে দু' চোখ বুজে এলো। প্রণাম করলাম মনে মনে। শিহরিত মনে স্পর্শ করলাম  ঘরের দরজা যে ঘরে  সুভাষচন্দ্র বসু থাকতেন, এই ভেবে যে কখনও হয়তো তিনি হাত রেখেছিলেন এখানে। দরজা দিয়ে দেখলাম দুটি খাট, কাঠের আলমারি, কিছু চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি রয়েছে ঘরের মধ্যে বড় অযত্নে ও অবহেলায়। যেন ইতিহাসের এক স্মৃতিভার বহন করে চলেছে এই বাড়িটিয়ও সুভাষ চন্দ্রের থাকার ঘরটি। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম, অনুভবের ডাকে বাস্তবে ফিরলাম।

একরাশ অপার্থিব তৃপ্তি ও মুগ্ধতা নিয়ে  সন্ধ্যার আগেই  সুভাষ গ্রাম স্টেশনে এসে শিয়ালদহ গামী ট্রেনে চেপে রওনা দিলাম বিরাটির দিকে। সারা দিনের অমলিন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পৌঁছে গেলাম নিজেদের শহরে। শিয়ালদহ থেকে নামখানা, বারুইপুর,ডায়মণ্ডহারবার, লক্ষীকান্ত পুর গামী লোকাল ট্রেনে চেপে সুভাষগ্রাম স্টেশান। তারপর টোটো করে সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক বাড়ি। সামান্য কিছু দূরে বারুইপুর শহর ও সোনারপুর জংশন। ভাড়া মাত্র ১৫ টাকা। দূরত্ব ৩০কিমি। সময় লাগবে কম বেশি ৪০ মিনিট।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প ও ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top