সিডনী মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ডাইনি ও জাদুবিদ্যার চর্চাভূমি কামাখ্যা : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৪৪

আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১৯

 

কামাখ্যা মন্দিরের  রহস্যে ভরা আখ্যানের কথা শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই উপমহাদেশ তো বটেই সমগ্র বিশ্বে কামরূপ কামাখ্যার আশ্চর্যে ভরা আখ্যানের আলাদা কদর রয়েছে আজও। কামরূপ কামাখ্যাকে বলা হয় জাদুটোনা, তন্ত্র-মন্ত্রের অনুপম এক রূপকথার  দেশ। বর্তমানে ভৌগোলিকভাবে কামাখ্যা মন্দির হল ভারতের অসম (আসাম) রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দু দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। সর্ব কালের অন্যতম বর্ণময়- ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী মন্দির হলো কামাখ্যা মন্দির, চোখ জুড়ানো অসাধারণ স্হাপত্য শৈলীতে আজও অনবদ্য। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে খুব পবিত্র ও জাগ্রত মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাস বহু বর্ণিল। পরতে পরতে রহস্যের মায়াচুম্বক। এই মন্দির ঘিরে আছে নানান ধরনের কিংবদন্তি। একটা অকথিত বর্ণময় ইতিহাস আর তাকে নিয়ে হাজার জনশ্রুতি এবং কল্পনার বুনন। সেখানে খোলা আকাশের নীচে সযত্নে বেড়ে ওঠে কিংবদন্তি- লোককথার গল্পরা। রাতের অন্ধকারে হেঁটে বেড়ায় ইতিহাসের কল্পকথার অশরীরী চরিত্ররা। রহস্যময় ও বিস্ময়কর কামাখ্যা মন্দিরের পাথরের খাঁজে খাঁজে ওরা বেঁচে আছে জনশ্রুতিতে। ওরা বেঁচে আছেন ইতিহাস ও কিংবদন্তির হলুদ পাতায়।


কামাখ্যা মন্দির (অসমীয়া: কামাখ্যা মন্দির) হল ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দু দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা – এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।মন্দিরটি নাগারা স্থাপত্যশৈলীর মন্দির ছিল। মধ্য আসামে এই ধরনের শিখর বা চূড়া অনেক মন্দিরেই দেখা যায়। এর চারপাশে বঙ্গীয় চারচালা স্থাপ্তত্যে অঙ্গশিখর থাকে। অন্তরাল নামে এক ধরনের স্থাপত্য দেখা যায়, যা আটচালা মতো দেখতে। 

তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র হওয়ায় বার্ষিক অম্বুবাচী মেলা অনুষ্ঠানে এখানে প্রচুর মানুষ আসেন। এছাড়া বার্ষিক মনসা পূজাও মহাসমারোহে আয়োজিত হয়, দুর্গাপূজা কামাক্ষ্যা মন্দিরের একটি অন্যতম প্রধান উৎসব।  ৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটিতে এবং ৪টি আদি শক্তি পিঠগুলির মধ্যে, কামাখ্য মন্দিরটি বিশেষ কারণ দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি এখানে পড়েছিল এবং এইভাবে দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বা "রক্তক্ষরণকারী দেবী" বলা হয় এই মন্দির চত্বরে  দশমহাবিদ্যার  মন্দিরও  আছে। 

বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে: গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ (যেগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির)। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত।  অন্যগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। নিম্ন আসামের বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়।গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়।গর্ভগৃহটি ছোটো ও  অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে যেটি যোনির আকৃতিবিশিষ্ট। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরগুলিতেই একই রকম (৩৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং সপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং-এর রচনাতেও কামাখ্যা উপেক্ষিত হয়েছে। সেই সময় কামাখ্যাকে অব্রাহ্মণ কিরাত জাতীয় উপাস্য দেবী মনে করা হত। নবম শতাব্দীতে ম্লেচ্ছ রাজবংশের বানমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার শিলালিপি-উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল।                                 

জনশ্রুতি অনুসারে, সুলেমান কিরানির (১৫৬৬-১৫৭২) সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতা রাজ্য আক্রমণ করার সময় (১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কথিত আছে, কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ এই ধ্বংসাবশেষ খুজে পান। তিনিই এই মন্দিরে পূজার পুনঃপ্রবর্তন  করেন। তবে তার পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পুনর্নির্মাণের সময় পুরনো মন্দিরের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড়ো করে তোলেন। অন্যান্য মন্দিরগুলি পরে নির্মিত হয়। অনুমিত হয়, প্রাচীনকালে কামাখ্যা ছিল খাসি উপজাতির বলিদানের জায়গা। এখনও বলিদান এখানে পূজার অঙ্গ। এখানে অনেক ভক্তই দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগলবলি দেন। কালিকা পুরাণ অনুসারে, কামাখ্যায় পূজা করলে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়। শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রী শক্তিই কামাখ্যা নামে পরিচিত।

১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নীলাচল পর্বতে মঙ্গোলরা আক্রমণ করলে প্রথম তান্ত্রিক কামাখ্যা মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় তান্ত্রিক মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল মুসলমান আক্রমণের সময়। আসামের অন্যান্য দেবীদের মতো, দেবী কামাখ্যার পূজাতেও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখা যায়। দেবীকে যেসব নামে পূজা করা হয় তার মধ্যে অনেক স্থানীয় আর্য ও অনার্য দেবদেবীর নাম আছে।যোগিনী তন্ত্র অনুসারে, এই যোগিনী পীঠের ধর্মের উৎস কিরাতদের ধর্ম। বাণীকান্ত কাকতির মতে, গারো উপজাতির মানুষেরা কামাখ্যায় শূকর বলি দিত। এই প্রথা নরনারায়ণ-কর্তৃক নিযুক্ত পুরোহিতদের মধ্যেও দেখা যেত।কামাখ্যার পূজা বামাচার ও দক্ষিণাচার উভয় মতেই হয়। সাধারণত ফুল দিয়েই পূজা দেওয়া হয় মাঝে মাঝে। 

পুরাণ ও ইতিহাস অনুসারে, কোচবিহার রাজপরিবারকে দেবী কামাখ্যাই পূজার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। কোচবিহার রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ভিন্ন এই মন্দির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ১৬৫৮ সালে অহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ নিম্ন আসাম জয় করলে এই মন্দির সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। অহোম রাজারা শাক্ত বা শৈব ধর্মাবলম্বী হতেন। তারা এই মন্দির সংস্কার ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নিতেন। কামরূপ রাজ্যের বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে ৩৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ এবং সপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং-এর রচনাতেও কামাখ্যা উপেক্ষিত হয়েছে। সেই সময় কামাখ্যাকে অব্রাহ্মণ কিরাত জাতীয় উপাস্য দেবী মনে করা হত। নবম শতাব্দীতে ম্লেচ্ছ রাজবংশের বানমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার শিলালিপি-উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, সুলেমান কিরানির ১৫৬৬-১৫৭২ সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতা রাজ্য ক্রামণ করার সময় ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কথিত আছে, কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ এই ধ্বংসাবশেষ খুজে পান। তিনিএই মন্দিরে পূজার পুনর্প্রবর্তন করেন। তবে তার পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পুনর্নির্মাণের সময় পুরনো মন্দিরের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড়ো করে তোলেন। অন্যান্য মন্দিরগুলি পরে নির্মিত হয়।

ইতিহাসে অহোম রাজত্বে কামাখ্যা: জনশ্রুতি অনুসারে, কোচবিহার রাজপরিবারকে দেবী কামাখ্যাই পূজার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কোচবিহার রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ভিন্ন এই মন্দির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ১৬৫৮ সালে অহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ নিম্ন আসাম জয় করলে এই মন্দির সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। অহোম রাজারা শাক্ত বা শৈব ধর্মাবলম্বী হতেন। তারাএই মন্দির সংস্কার ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নিতেন। রুদ্র সিংহ রাজত্বকাল ১৬৯৬-১৭১৪ বৃদ্ধবয়সে গুরুর নিকট দীক্ষাগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু প্রজা ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করতে পারবেন না বলে তিনি পশ্চিমবঙ্গে দূত পাঠালেন। নদিয়া জেলার শান্তিপুরের কাছে মালিপোতার বিশিষ্ট শাক্ত পণ্ডিত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যকে তিনি আসামে আসার অনুরোধ জানালেন। কৃষ্ণরাম জানালেন, কামাখ্যা মন্দিরের দায়িত্ব দিলে, তবেই তিনি আসাম যাবেন। রাজা নিজে দীক্ষা না নিলেও, তার পুত্রদের ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কৃষ্ণরামের কাছে দীক্ষা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রুদ্র সিংহের মৃত্যুপর তার জ্যেষ্ঠপুত্র শিব সিংহ রাজত্বকাল ১৭১৪-১৭৪৪ রাজা হন। তিনি কামাখ্যা মন্দির ও পার্শ্ববর্তী বিরাট একটি ভূখণ্ড কৃষ্ণরামকে দেবত্তোর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন। তাকে ও তার বংশধরদের পর্বতীয়া গোঁসাই বলা হত। কারণ তারা নীলাচল পর্বতের উপর থাকতেন। কামাখ্যা মন্দিরের অনেক পুরোহিত ও আসামের অনেক আধুনিক শাক্ত এই পর্বতীয়া গোঁসাইদের

রুদ্র সিংহ রাজত্বকাল ১৬৯৬-১৭১৪ বৃদ্ধবয়সে গুরুর নিকট দীক্ষাগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু প্রজা ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করতে পারবেন না বলে তিনি পশ্চিমবঙ্গে দূত পাঠালেন। নদিয়া জেলার শান্তিপুরের কাছে মালিপোতার বিশিষ্ট শাক্ত পণ্ডিত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যকে তিনি আসামে আসার অনুরোধ জানালেন। কৃষ্ণরাম জানালেন, কামাখ্যা মন্দিরের দায়িত্ব দিলে, তবেই তিনি আসাম যাবেন। রাজা নিজে দীক্ষা না নিলেও, তার পুত্রদের ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কৃষ্ণরামের কাছে দীক্ষা নিতে  অপার রহস্যের নাম ‘কামরূপ -কামাখ্যা।’ কথিত আছে একসময় এখান থেকে কেউ ফিরে আসতো না! মন্ত্র ও যাদুবিদ্যার এক রহস্যময় স্থান বলা হয় কামাখ্যা মন্দিরকে।

মেঘালয় দেখার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু বছর আগে আসাম যাওয়া হয়েছিল হঠাৎ করেই। আসাম হয়ে মেঘালয়ের দিকে চলে যাব, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। একদম ভোরে প্লেন থেকে নামলাম আসামের গুয়াহাটিতে। এখানেই বিশ্বখ্যাত কামাখ্যা মন্দিরের অবস্থান। ভাবলাম এতো কাছে এসে কামরূপ কামাখ্যা না দেখে চলে যাওয়ার কোনও মানে নেই। সকাল সকালই তাই রওনা দিলাম মন্দির দেখার উদ্দেশ্যে। 

এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীর জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা মন্দির। তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।কামাখ্যাকে নিয়ে  জনশ্রুতি আছে, একসময় এখানে গেলে কেউ ফিরে আসতে পারতো না। এখানে মন্ত্র বলে পুরুষদের বশ করে রাখা হতো। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, শিবঠাকুরের স্ত্রী ছিলেন সতী। সতীর মৃত্যু হলে তার দেহ নিয়ে প্রবল আস্ফালনে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেন শিব। শিবের স্পর্শে পবিত্র হয়ে ওঠে সতীর অঙ্গ। বিষ্ণু বা সৃষ্টিকর্তা জগতের মঙ্গল কামনার্থে সতীর দেহ একান্ন খণ্ডে বিভক্ত করেন। দেবীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধরাধামে পড়তে থাকে এক এক করে। যেখানে যেখানে পড়ে সেই পবিত্র অঙ্গ, সেখানেই পাথরে পরিণত হয়। এইসব স্থানকেই পবিত্র মহাপীঠ বলা হয়। একান্নটি মহাপীঠ ছাড়াও রয়েছে ছাব্বিশটি উপপীঠ। যেখানে দেবীর যোনি পতিত হয়েছিল সেই স্থানকে বলা হয় তীর্থচূড়ামণি। সব তীর্থের মধ্যে সেরা এই তীর্থচূড়ামণি। এ কারণেই কামাখ্যাকে বলা হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পীঠ। কয়েকজন প্রবীণ পুরোহিত মহাশয়ের কাছ থেকেই জানলাম, কামাখ্যা মন্দির ও অম্বুবাচী বলতেই যে ছবিটা মনে ভাসে- তা হল মন্দির চত্বরে নাগা বাবাদের হুঙ্কার। গাঁজার ধোঁয়ায় ঢাকা চাতালে কোথাও মন্ত্রপাঠ, কোথাও বাউল গান। কিন্তু  বর্তমানে  অম্বুবাচী মেলায় দলৈ সমাজ ও কামরূপ মহানগর প্রশাসনের নির্দেশে কামাখ্যা চত্বর তামাক বর্জিত। চলবে না মাদক সেবনও। তার উপরে দলৈ সমাজ ফতোয়া জারি করেছে, মন্দির চত্বরে সাধুদের নগ্ন হয়ে ঘোরা চলবে না। অনেকেই সপরিবারে আসেন। তাঁদের কাছে এমন দৃশ্য মোটেই নয়নসুখকর হয় না। এই ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে আমার। কামাখ্যা মন্দিরের  সঙ্গে  তন্ত্রসাধনা ও জাদুচর্চা জড়িয়ে আছে। সুপ্রাচীন কাল থেকেই  অসম জাদুনগরী হিসাবে পরিচিত। এখানকার  আকাশে-বাতাসে  যেন  মিশে আছে গা ছমছমে রহস্যময়তা, শিরশিরে এক হাওয়ার টান। এখানকার  পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে  হাড়হিম করা যেন লোককাহিনী-উপকাহিনীর চরিত্রা দাাঁড়িয়ে থাকে।রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনুভব করা যায় তাদের নিঃশ্বাস।এখানকার  রাতজাগানিয়া  বাতাসে তাই রহস্যময়  এক শিরশিরে অমোঘ টান।

আসলে পুরাকাল থেকেই নানান গল্পগাথা অসমকে নিয়ে। জাদুবিদ্যা ও ডাইনিবিদ্যা চর্চার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত, সেই তখন থেকেই। অসমের আগে নাম ছিল কামরূপ। তারও আগে রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে, 'প্রাগজ্যোতিষপুর'। মহাভারতের হরিবংশ, কালিকাপুরাণেও এই নামটিই রয়েছে। কবি কালিদাস তাঁর রঘুবংশে রঘুরাজার দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে যে দুর্গম দেশের কথা বলেছেন, সেটাই আজকের অসম। মোঘল ইতিহাসেও রয়েছে হিন্দুদের ইন্দ্রজালের পাঠশালা হিসাবে অসমের কথা। কামরূপের মায়াং গ্রামের জাদুচর্চা ও মেয়েদের নিয়েও বিচিত্র রূপকথা। অসমের সুন্দরী রমণীরা নাকি কোনও পুরুষকে ফিরতে দেয় না আর চিরসঙ্গী করে রাখে। বিবাহিত কোনও পুরুষকে পছন্দ হলে মেয়েরা তাদের খোঁপায় গোঁজা ফুল ছুঁইয়ে বশ করে নেয়- এমন সব নানা লোককথা অসম জুড়ে আজও শোনা যায়। তাই কামাখ্যা মন্দিরের তান্ত্রিক ক্রিয়া ও তন্ত্র সাধনার গোপন ক্রিয়ার সঙ্গে মেয়েদের এমনতর জাদু সম্মোহনও চিরকালই বাইরের মানুষের কাছে অপার রহস্যের বিষয়। বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য ও  উন্নতির যুগেও এই ধারণা থেকে মুক্ত হতে পারেনি এখানকার লোকজীবন। দীর্ঘদিনের লালিত- পালিত বিশ্বাসে অটল রয়েছে লোকসমাজ। এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার বলে মনে হয়, এই অভাবনীয় প্রযুক্তির যুগেও। আলাপচারিতায় ও পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে চিরকাল লালিত বিশ্বাসে ভাঁটা পড়েনি, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। মন্দিরের ঐতিহ্য ও পরম্পরা আজো বজায় রেখে চলেছে, এটিও কম রহস  নয় বলে মনে হয়।

শেষকথাঃ কালাজাদুর পীঠস্থান মায়াবিদ্যার মায়াময় গাঁ জিয়াং গুয়াহাটি শহর থেকে চল্লিশ কিমি দূরে। যাকে বলা হয় কামাখ্যাতন্ত্রবিদ্যার আদিভৃমি তথা আঁতুড়ঘর। অতীত ইতিহাস অন্বেষণে জানতে পারা যায় যে মায়াংয়ের তান্ত্রিকরাই নাকি এক সময়ে রুখে দিয়েছিলেন ইসলামিক আক্রমণ! কারণটা ওই মায়াংয়ের তান্ত্রিকদের কলকাঠি- মারণ, উচাটন, বশীকরণ সম্মমোহন, স্তম্ভন। আজও সেই একই উদ্দেশে অনেকেই ছুটে যান এই জাদুবিদ্যার গ্রামে। গ্রাম নামে জড়িয়ে আছে নানান ধরনের কিংবদন্তি, প্রবাাদ, লোকাহিনী। কামাখ্যা মন্দিরের মতোই মায়াং দেবীশক্তিরই অংশ। কামাাাখ্য মন্দিরের মতোই কালাজাদু এবং ডাইনি বিদ্যার চর্চাভৃমি। এখানকার প্রকৃতি যেন সেই রহস্য আজও ছড়িয়ে রেখেছে। শোনা যায় নানা মানুষ জন্তুতে রূপান্তরিত হতো মায়াংয়ের নারী- তান্ত্রিকদেরই হাতে। পাতলা বায়ুর মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতেন তাান্ত্রিকেরা। জাদু ও  ধর্ম আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই। পূর্বপুরুষের ধর্মাচারের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে। আমরা এই চুড়ান্ত আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও একটি থেকে আর একটিকে আলাদা করতে তো আজও পারিনি।

আমরা সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়ে সভ্য হয়ে যাওয়ার দীর্ঘকাল পরও পৃথিবীর সব জায়গায় ধর্মের সঙ্গে জাদুবিদ্যা, মায়াচর্চার একটা সংযোগ ছিল। আজও যে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এমনটাও বলা চলে না। এমনকী লোকায়ত ধর্মের বাইরে যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের স্রোত, যাকে সারস্বত সমাজ বিশুদ্ধ ধর্ম বা শাস্ত্রীয়বিধি বলে ডাক পাড়েন তার ভিতরেও রয়ে গেছে মায়াজাদুর ভালোরকম এক সংমিশ্রণ।

তথ্যসূত্র: অসমের কামাখ্যা মন্দিরের ও আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, ছোটগল্প, রম্যরচনা, ফিচার এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত  

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top