সিডনী মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ভালো আছো, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ! (২য় পর্ব) : ড. গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২১ ২০:৫১

আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৪

ছবিঃ মন্দির ও মসজিদ

 

মূল ফটক পেরিয়ে স্টেশনের ভিতরে এলাম৷ বাঁদিকে স্টেশন মাস্টারের ঘর তারপর যাত্রী প্রতীক্ষালয়. ডানদিকে মেশিন ঘর আর স্টকরুম; কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে প্লাটফর্ম আর সঙ্গে রেললাইন৷  এই সময় স্টেশনে লোকজন নেই বললেই চলে, কয়েকজন আছে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে; দূরে কয়েকজন রেলকর্মী লাইনে কিছু সারাই করছে৷ প্লাটফর্মে নেমে মনে করার চেষ্টা করলাম আগেরবার কোথায় ছিলাম, যতদূর মনে পড়ছে স্টেশন থেকে লাইনের ওপর দিয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে বাঁদিকে ঢুকে যেতাম; লাইনের পাশেই ছিল হোটেলটা৷ কিন্তু যেদিকটা মনে হল সেদিকে তো দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি ধূ ধূ জঙ্গল৷ তবু প্লাটফর্ম ধরে রেল লাইনকে সঙ্গী করে সেদিকে এগিয়ে গেলাম, একটা সময় প্লাটফর্ম শেষ হল, রেললাইন গুলো আপন খেয়ালে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে চলেছে ; কিন্তু কোথায় আমার সেই পঁচিশ বছর আগেকার আস্তানা! যেখানে ঘরে বসে ট্রেনের আনাগোনা দেখতাম, আর সন্ধেবেলা ছাদে হ্যারিকেনের আলোয় আমি আর দীপক মিলে শক্তি, শঙ্খ, সুভাষের কবিতা পড়তাম; আর অবাক হয়ে দেখতাম যে বাড়ীর ছেলে, বুড়ো এমনকি মহিলারাও একবিন্দু বাংলা না বুঝেও কেমন সারি সারি বসে আমাদের সেই বালখিল্যতায় সামিল হত৷

কি জানি হয়ত ভুল করছি, এদিকে তো কোনো বসতই দেখছি না, শুধু জঙ্গল, কোনোদিন ছিল বলেও তো মনে হচ্ছে না৷ অগত্যা উল্টোমুখে ফিরি, ইচ্ছে হল দু নম্বর প্লাটফর্মে যাই, কিন্তু একটা কলকাতামুখী মালগাড়ি দু নম্বর লাইনে দাঁড়িয়ে আছে যার শেষ দেখা যাচ্ছে না৷ তাই সামনের দিকেই যেতে হয়, আস্তে আস্তে এসে পড়ি কাল রাতের সেই ভয়ংকর জায়গায় যেখানে ট্রেন থেকে আমাদের অবতরণ ঘটেছিল, উল্টোদিকে খাদ হয়ত নয় তবে প্রায় ৫-৬ ফুট গভীর গর্ত, অন্ধকারে পড়ে গেলে হাত-পা ভাঙ্গার যথেষ্ট সম্ভাবনা৷ যাই হোক লাইন পেরিয়ে মেল ট্রেনটার সামনে গিয়ে উঠলাম, তিন নম্বর দিয়ে একটা ইঞ্জিন আসছে, আমি খোয়া পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, এমন সময় আমাকে চমকে দিয়ে মালগাড়ির ড্রাইভার কেবিন থেকে বলে উঠলো, "বাবুসাব হঠ্ যাইয়ে, নেহি তো পথ্থর লাগ যায়েগা৷" ধন্যবাদ জানিয়ে একটু সরে এলাম, ইঞ্জিন চলে গেলে পাশের প্লাটফর্মে এলাম৷ এদিকটা আরও নির্জন, বসার কয়েকটা বেঞ্চ আছে৷ সেরকমই এক বেঞ্চ জুড়ে দেখি রেলের অস্থায়ী কর্মচারীদের রন্ধন পর্ব চলছে৷ এমাথা ওমাথা চক্কর দেওয়ার পর চোখে পড়ল দূরে একটা মেঠো পথ জঙ্গলের মধ্য থেকে উঁকি মারছে৷

ছবিঃ সীতাকুন্ড

মোহময়ী ম্যাকলাস্কির হাতছানি উপেক্ষা করি সে শক্তি কোথায়! তাই মেঠো পথের নিশি ডাকে সাড়া দিয়ে চটপট লাইন টপকে পৌঁছে গেলাম৷ জঙ্গলের মধ্যে রাস্তাটি অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে গেছে, এগিয়ে চলি, কিছু দূরে একটি গাছের তলায় একটি আদিবাসী পরিবার বিশ্রাম নিচ্ছে৷ তাদের কৌতুহলি দৃষ্টি পিছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাই, কিছুটা যাবার পর জঙ্গলের মধ্যে একটা বাড়ি চোখে পড়ল, তার আশে পাশে আরও কয়েকটি, আস্তে আস্তে একটা গোটা গ্রামের মধ্যে উপস্থিত হলাম৷ এখন দুপুর তাই হয়ত বিশেষ কাউকে দেখতে পেলাম না, আজ আকাশে মেঘবালিকারা সূর্যদেবের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে৷ কখনও ঝাঁ ঝাঁ রোদ আবার কখনওবা মোলায়েম ছায়া, আমি সেই আলোছায়ার মধ্যে হাঁটতে থাকি৷ দুপাশের পলাশ, শিমুল, মহুয়া গাছগুলো ভালো ছেলের মতো সভ্যভব্য হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, অথচ এই রুপ দেখে কে বলবে মাত্র কয়েক মাস আগে এরাই আগুনধরা ফাগুন রঙে সমগ্র চরাচর, পুরুষ, প্রকৃতি, নারী, ধরিত্রী সবাইকে মাতাল করে দিয়েছিল, পঁচিশ বছর আগে আমি তার সাক্ষী ছিলাম৷ গাছের পাতার আড়াল থেকে নাম না জানা পাখির ডাক আর বর্ষণস্নাত সবুজ পাতার মিষ্টি গন্ধ উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যাই; রাস্তা তার খেয়াল খুশিমতো একবার বাঁয়ে একবার ডাঁয়ে চলতে লাগল, আর প্রত্যেক বাঁকে বাঁকে নতুন পসরা সাজিয়ে আমাকে যেন পদে পদে অবাক করার খেলায় মেতে উঠল৷ কিছু দূরে গিয়ে একটা নদীর দেখা পেলাম, নদীর ওপর ছোট্ট একটা ব্রিজ, নিচ দিয়ে তির তির করে বয়ে যাচ্ছে স্ফটিকস্বচ্ছ জল, কিন্তু ব্রিজের অবস্থা খুব শোচনীয়, মাঝ খানে বিশাল গর্ত৷ সাবধানে পেরিয়ে গেলাম৷ এবার জঙ্গল একটু ঘন হতে শুরু হল, মাটির রংও হয়ে গেল গাঢ় লাল, দূর পাহাড়ের জঙ্গল থেকে হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে, কি জানি ঝড় উঠবে কিনা! আকাশে সবটা সুর্য মেঘের কোলে মূখ লুকিয়েছে, দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম একটা জায়গায় যেখানে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়েছে; বাঁ দিকের রাস্তাটা আরও ঘন জঙ্গলে ঢুকেছে আর ডানদিকেরটা কিছু দূরে গিয়ে একটা গ্রামে ঢুকেছে, ওখান থেকে সোজা পথে বেশ কিছুটা গেলে রেলের গেট পাওয়া যাবে৷ আর এগোলাম না, অনেক বেলা হয়েছে এবার ফিরতে হবে, ওরা সব আমার জন্য অপেক্ষা করছে৷        

হোটেলে ঢোকার মুখে গর্ডনজির সঙ্গে দেখা, বাইক নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, আমাকে দেখে বাইক থামিয়ে একগাল হেঁসে বলল, "সুক্রিয়া বাবুজী, ফোন মিল গয়া না, বহুত আচ্ছা" আমি প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ জানালাম এবং গাড়ি ভাড়ার টাকাটা দিতে গেলাম, তখন উনি বলে উঠলেন, "লেকিন স্যার আভি তো ইতনা মেহেঙ্গা মোবাইল মিল গ্যয়া, উও গাড়ি কা মালিক পঁচিশশো রূপেয়া মাঙ্গ রাহা হ্যায়." আমি অবাক হয়ে বলি, “সে কি! আপনি যে কাল বললেন পনেরো-ষোলশো টাকা লাগবে৷ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, "নেহি, আপ খুদ দেখা হাম কো কিতনা তকলিফ হুয়া গাড়ি কা ইন্তেজাম করনে কে লিয়ে, আভি মোবাইল মিলনে কা খবর শুনতে হি উও লোক জ্যাদা দাম মাঙ্গ রাহা হ্যায়"৷ আমি তো তখন বুঝতে পারছি শুধু গাড়ির মালিকই নয়, অনেকেই এই বেশি ভাড়া আদায়ের নেপথ্যে আছে৷ যাই হোক কি আর করা, 'পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে'৷ তবু অনুরোধ করলাম যাতে অন্ততঃ দু হাজারে হয়ে যায়৷ "সায়েদ হোগা নেহি, কোসিস করেঙ্গে৷" এই বলে বাইক চালিয়ে হাওয়া৷

ছবিঃ গর্ডন হাউস

হোটেলে ঢুকে দেখি আবহাওয়া বেশ গরম, সারা রাত জ্বালানোর পর আজও সকাল থেকে কারেন্ট নেই, লোকজনের বিরক্তি চরম সীমায় পৌঁছেছে৷ গিয়ে দেখি সবাই বারান্দায়, ঘরে টেকা যাচ্ছে না, বৃষ্টি না নামায় গুমোট গরমে দরদর করে সবার ঘাম হচ্ছে৷ আমাদের সাথে কাল যে আরেকটি দল এসেছে তাদের অবস্থা আরও খারাপ, আমাদের থেকে একটু বয়স্ক তার ওপর এক একজন বড় বড় কোম্পানীর বড় বড় পোস্টে আছেন, ওনাদের পক্ষে এরকমভাবে থাকা সত্যিই কষ্টকর৷ ওই দলের দুই ভদ্রলোক আমাদের সাথে নিচে ছিলেন তাঁদের একজন একটা প্রস্তাব নিয়ে এলেন, বললেন, “আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সঙ্গে একজন চলুন গর্ডনজিকে গিয়ে বলি আপনি জেনারেটর সার্ভিস দিন আমরা আপনাকে পে করবো”৷ প্রবীর সঙ্গে গেল, কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বলল গর্ডন বহু কষ্টে রাত বারোটা পর্যন্ত জেনারেটর চালাতে রাজি হয়েছে৷ এদিকে শোনা যাচ্ছে একটা মেজর ফল্ট হয়েছে, তার মানে কারেন্ট কখন আসবে কেউ জানেনা৷ মনে হচ্ছে অন্যদল এখান থেকে চলে যাওয়ার ডিসিশন নিচ্ছে, কিছুক্ষন পর শুনলাম ওরা চলে যাওয়ার কথা বলাতে গর্ডন এককথায় রাজি অথচ ওদেরও আমাদের মতই তিন রাত্রির বুকিং ছিল৷  গর্ডনকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি, পুওর সার্ভিসের কথা বলতে গেলে শোনাচ্ছে ওর আসল ব্যবসা হল ছাত্রদের হস্টেল, টুরিস্ট এলে ভাড়া দেয়, না হলে এটা নিয়ে ও মোটেই ব্যাস্ত নয়, তাই টুরিস্টদের ভালোমন্দ নিয়েও বেশি ভাবার অবকাশ নেই৷ যখন আমরা বোঝাতে চাইছি, কিন্তু তুমি যখন টুরিস্টকে ভাড়া দিয়েছ তখন তো বেসিক সার্ভিসগুলো দিতে হবে, তখন ওঁর বক্তব্য- এটা হল গ্রাম, এখানে শহরের সুখসুবিধা পাওয়া যাবে না৷

স্নান খাওয়া সেরে মনস্থ করলাম একটু ঘুমিয়ে নেব, কাল এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি৷ এখন একটু না ঘুমোলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে৷ বিছানায় শুয়ে ঘুমের প্রতীক্ষা করছি এমন সময় দুদ্দাড় করে দোতলা থেকে প্রবীর নেমে এল, "তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি সব গোটাও, ওপরের ঘরের দখল নিতে হবে, ওরা চলে যাচ্ছে, গর্ডনজী ওপরের একটা ঘর দিতে চাইছে না, জলদি কর, জলদি কর, চলো চটপট আমরা চারটে ঘরেই ঢুকে পড়ি৷" বলেই দৌড়ে অন্য ঘরগুলোতে তাড়া দিতে চলে গেল৷ শুনেই আমি আর সন্দীপ বিছানা থেকে দিলাম লাফ, যেখানে যা ছিল -জামা, প্যান্ট, তেলের শিশি, সাবান, শ্যাম্পু, জুতো, খোলা গেঞ্জি, গামছা, পেন, খাতা যা পেলাম দুহাতে সাপ্টে, দু কাঁধে ঝুলিয়ে উর্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম দোতলা অভিমুখে৷ দোতলায় উঠেই মনটা ভালো হয়ে গেল- প্রশস্ত বারান্দা, সুন্দর বসার ব্যবস্থা আবার একটা দোলনাও আছে, ঘরগুলোও নিচের থেকে অনেক বড়, সর্বোপরি একটা ঝুলবারান্দায় সুন্দর খাবার ব্যাবস্থা৷ এই যে একটা ছোট্ট চেঞ্জ আমাদের বেড়ানোর আনন্দকে আবার যেন ঠিক সুরে বেঁধে দিল৷ কাল থেকে ঘটে যাওয়া একটার পর একটা ঘটনা বেড়াতে আসার আনন্দকে পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে দিচ্ছিল না, কিন্তু এই হঠাৎ করে ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ দোতলার ঘরগুলো কষে যাওয়া আনন্দনাড়ুতে অনেকটা চিনি ঢেলে দিল৷ সবাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠেছে৷ এতক্ষণকার বেজার মুখে খুশির হাসি৷ এই ত চাই! বেড়াতে এসে সঙ্গীদের মুখ থেকে হাসি উবে গেলে খারাপ লাগে৷ আগে ভেবেছিলাম আজ আর কোথাও যাবোনা, দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে সবাই মিলে স্টেশনের দিকে যাবো৷ একটু চা-টা খেয়ে, ঘুরে আড্ডা মেরে সন্ধ্যা কাটিয়ে ফিরব৷ কিন্তু এখন নতুন আবহে সবাই খুব প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে, তাই কথা উঠল আজ কয়েকটা সাইটসিয়িং স্পট সেরে ফেলা যায় কিনা৷ ওই পার্টির লোকজন সকালে কয়লা খাদানে গিয়েছিল তবে শুনলাম রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, ফেরার সময় ওই খারাপ রাস্তা এড়াতে বেশ কয়েক কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়েছে৷ এছাড়া এখানে একটা সর্বধর্মস্থল আছে, একই চত্বরে মন্দির, মসজিদ আর একটা গুরুদোয়ার নির্মিত হয়েছে৷ কালকে রাত্রে যে ছেলেটি আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিল সেই নাকি আজ ওনাদের নিয়ে গেছিল, তাই সাব্যস্ত হল ফোন করে গাড়ির (টোটো) ড্রাইভারকে ডাকা হোক৷

দুটো টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, একটু দেরি হয়ে গেল, ওদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো ঠেকছে না৷ তাই আজ শুধু ধর্মস্থলে যাওয়া হবে কাল সকাল বেলা কোলমাইন আর দুগাদুগি নদী দেখতে যাবো, সেইভাবেই গাড়ির সাথে চুক্তি হল৷ বেশ অনেকটা রাস্তা, প্রায় ৪৫ মিনিট লাগল পৌঁছতে৷ গিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল, লোক বসতি থেকে দূরে শান্ত নির্জন পরিবেশ৷ অনেকটা জায়গা জুড়ে মন্দির, মসজিদ আর একটা অসমাপ্ত গুরুদোয়ার পাশাপাশি, একটা ছোট গির্জার চিহ্নও চোখে পড়ল৷ খুব ভালো লাগলো দেখে৷ এই হিংসা-জর্জর পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ যে এভাবে ভাবতে পারেন সেটা ভেবে কিছুটা সান্ত্বনা পেলাম৷ ঘুরে ঘুরে অনেক ছবি তোলা হল, কিছুটা সময় কাটিয়ে গেটের বাইরে এসে দেখি ডানদিকে একটা পায়ে চলা রাস্তা চলে গিয়েছে আর একটা পথ নির্দেশিকায় তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা "সীতা কুণ্ড"৷ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই সামনের গড়ানে রাস্তা ধরে, কিছু দূরে একটা পুকুর দেখতে পেলাম - এটাই সীতাকুন্ড৷ ফেরার পথে একজন স্থানীয় মানুষের সাথে দেখা, তাঁর মুখেই শুনলাম পুরাকালে কোনো এক সময় সীতা এই পুকুরে স্নান করেছিলেন৷  এবার ফেরার পালা, হোটেলে না ফিরে সবাই মিলে গেলাম রেলস্টেশনে, চারপাশ একটু ঘুরে একটা চায়ের দোকানে বসা হল৷ সন্ধ্যা নামছে সারা ম্যাকলাস্কি জুড়ে, দূরের নীল পাহাড়ের পটচিত্র আবছা হতে হতে সম্পূর্ণ মুছে যাবে কয়েক মুহূর্ত পর, পাখিদের ঘরে ফেরার কলরব ছড়িয়ে পড়ছে স্টেশন চত্বর জুড়ে, আর আমরা কজন হাতে গরম চায়ের কাপ নিয়ে দেখছি ম্যাকলাস্কির আরেক রূপকে- লালমাটির ম্যাকলাস্কির আকাশও সূর্যের অস্তাভা কিরণে লাল হয়ে উঠছে৷

 সন্ধ্যে বেলা হোটেলে ফিরে গর্ডনজির মুখ থেকে এই সর্বধর্মস্থলের ইতিহাস শুনলাম৷ সত্যি ঘটনা, নাম ধাম উল্লেখ না করে ঘটনাটা বলি : এক ভদ্রলোকের ওই জায়গায় প্রায় ৩০০ একর জমি ছিল, খুব সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন৷ তাঁর বেশ কয়েকটা কয়লাখনি এবং তার সাথে বিবিধ ব্যবসা ছিল৷ তিনি খুব সজ্জন ও গরীবদরদী ছিলেন৷ সাহায্যপ্রার্থীকে কখনও নিরাশ করতেন না৷ তিনি স্বপ্ন দেখতেন ম্যাকলাস্কিগঞ্জে সমস্ত ধর্মের মানুষ মিলে মিশে থাকবে৷ ওই ভদ্রলোকের একটি ছেলে ছিল, ছেলেকে নিয়ে অনেক উচ্চাশা পোষণ করতেন, উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে উনি বিদেশে পাঠিয়েছিলেন৷ ওদিকে ছেলে বাপের স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে দেশে ফিরে আসে৷ ঐ ঘটনায় ভদ্রলোক সাংঘাতিক মানসিক আঘাত পান, কিন্তু একমাত্র ছেলে বলে সব কিছু মেনে নিতেই হয় এবং ছেলেকে নিজের ব্যাবসার কাজে ঢুকিয়ে দেন৷ কিন্তু ছেলের ব্যবসার কাজে মোটেই মন বসলনা কারন বিদেশ থেকে সে প্রয়োজনীয় ডিগ্রীটা আনেনি কিন্তু বেশ কিছু বদ অভ্যাস সঙ্গে করে এনেছিল৷ ফলে খুব শীঘ্রই বাপের সাথে ছেলের সংঘাত শুরু হল, বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে শোধরাতে কিন্তু ওদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উদয় ঘটল এক মামার যিনি ভাগনার অধঃপতনের গতিকে ত্বরান্বিত করলেন৷ স্বাভাবিক কারণেই এই ধরনের মানুষের স্ত্রীর সাথেও সম্পর্ক ভালো হয়না৷ তাদের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল৷ একদিন স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে (হয়ত তখন স্ত্রী আলাদাই থাকতেন ) ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বাংলোয় ওই ব্যক্তি নিজের দুই ছেলেমেয়েকে খুন করেন, তারপর তাদের দেহ টুকরো টুকরো করে দুটো সুটকেসে ভরে ভোরের একটা ট্রেন ধরে বেনারস চলে যান এবং সেখানে গঙ্গার জলে সুটকেস দুটো ভাসিয়ে দেন৷ তারপর ওখান থেকে আকাশ পথে আসেন দিল্লী, দিল্লীতে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে খুন করে সেপটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে বডি লুকিয়ে রাখেন, তারপর স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেন৷ কিছুদিন পর সেই বিদেশিনীর বাবা মেয়ের কোনো খবরাখবর না পেয়ে এবং জামাইয়ের কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে ওদের বিদেশ মন্ত্রকে যোগাযোগ করেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়৷ দীর্ঘ দশবছর কেস চলার পর ওই ব্যক্তির ফাঁসি হয়৷ এই সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর ওই হতভাগ্য বাবা এখানে সর্বধর্ম আশ্রয়ের চিন্তাকে বাস্তব রূপ দিতে ওই মন্দির, মসজিদ আর গুরুদোয়ার বানানো শুরু করেন৷ মন্দির আর মসজিদটা শেষ করতে পেরেছিলেন কিন্তু গুরুদোয়ার অসমাপ্ত থাকা অবস্থায় ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান৷ আসলে ভিতরে ভিতরে সার্বিক ক্ষয় ঘটে গিয়েছিল মানুষটার; সারাজীবন সৎ পথে থেকে, মানুষের জন্য আপ্রাণ করে নিজের ছেলের কাছ থেকে শেষ বয়সে প্রাপ্তির অঙ্কটা উনি মেলাতে পারেননি৷ পৃথিবীটা ওনার কাছে ধীরে ধীরে অচেনা এক গ্রহে পরিণত হয়ে গিয়েছিল৷ তাই জীবনের শেষ কটা বছর চরম কষ্ট ভোগ করে চলে গেলেন সেই জগতে যেখানে তাঁকে সবচেয়ে ভালো মানায়৷

ছবিঃ ত্রিক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, রাত্রে ঘরের আলো নিভিয়ে শোওয়ার পর মনে হল অবোধ দুই শিশুর নিষ্পাপ চোখগুলো যেন গহীন অন্ধকারে ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ কি ভীষণ আর্তি সেই চোখগুলোতে! আমার বুকের মধ্যে থেকে একটা দলা পাকানো কষ্ট গলার দিকে উঠে আসতে লাগলো৷ বেচারীরা মৃত্যুর মুহূর্তেও বুঝতে পারেনি- যে বাবা তাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে এনেছে সেই হৃদয়হীন বাবা তার নিষ্ঠুর কালো হাতে তাদেরই খুন করছে৷ আস্তে আস্তে চোখের সামনে সব মুছে গেল, একটা নিকষ কালো পর্দা নেমে এল, ক্লান্তি, পরিশ্রম, মনখারাপ সব এক হয়ে মিলে মিশে আমাকে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল৷ সাক্ষী রইলো অবচেতনে চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া আবছা জলের দাগ৷

 



ড. গৌতম সরকার 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top