বসন্তে লাল পাহাড়ির দেশ- জজহাতুতে : ডঃ সুবীর মণ্ডল
প্রকাশিত:
৮ মার্চ ২০২৩ ০৩:৪৪
আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০২
ও পলাশ ও শিমুল কেনো এ মন মোর রাঙালে"
রূপসী বাংলার ঋতু নাট্যের রূপশিল্পী বসন্ত আজ জাগ্রত দ্বারে।অশোক-পলাশ-শাল- মহুয়া-শিমুলের রঙিন বিহ্বলতায় কোকিলের কুহতানে নীলদিগন্তে যখন বিহ্বল উল্লাসের পরশ ঠিক তখনই দোলের আগের রবিবারের ছুটির হাত ধরে এই পাগলকরা মনটা যেন পাড়ি দিতে চাইল সবুজ উপত্যকা আর পলাশের আকরভূমি পুরুলিয়ার অপরূপা অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্নের জজহাতু-কুকি আর লায়েক ড্যামে। বসন্তে জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার উজাড় রূপমাধুর্য এককথায় তুলনাহীন, বিশেষ করে ঝালদা সার্কিটের। রাস্তার দুপাশের পলাশের আগুণে রূপ। শুধু মুগ্ধতার আবেশে এক অন্যভুবন। লোকচক্ষুর আড়়ালে থাকা এক মনোমুগ্ধকর জঙ্গল- নদী আর পাহাড়ের অপূর্ব মেলবন্ধন ঝালদা শহরের কাছে অবস্থিত জাজহাতু, কুকি আর স্বপ্নের লায়েক ড্যাম। কাছেই ভালোবাসার রুপাই নদী বয়ে চলেছে। সামান্য দূরে ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী গজাবুরু পাহাড়।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সীমাহীন ব্যস্ততা আর সময়ের টানাটানিতে অবসর মেলে না সহজে। তাই মন কেমন করা দোলের আগের রবিবারের এক কাকভোরে 'দ্যুত্তেরি' বলে, কেজো জীবনকে গুডবাই জানিয়ে কাঁধের ঝোলাটি তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পলাশের দেশ অনাঘ্রাত জজহাতুতে। পুরুলিয়ার ঝালদা ছাড়া আর কোন জায়গায় কাছাকাছি এক সঙ্গে এত পাহাড় আর ড্যামের সমাবেশ লক্ষ করা যায় না। এ যেন সীমান্ত বাংলার এক টুকরো স্কটল্যান্ড।
মনোমুগ্ধকর সবুজ উপত্যকা পাহাড় দিয়ে ঘেরা সমস্ত ড্যাম-জলাধার গুলো আর দিগন্ত জুড়ে সবুজের সমুদ্র। বসন্তে নির্মল অনাঘ্রাত মায়াবী প্রকৃতির আকর্ষণ অনুভব করার আদর্শ অফবিট ঠিকানা। ঝালদা শহর থেকে দূরত্ব মাত্র বার কিলোমিটার। মসৃণ স্বপ্নের পথ। চারিদিক জুড়েই আদিবাসীদের গ্রাম। জায়গাটা আদিবাসীদের স্বপ্নের গ্রাম জজহাটু। তবে জজহাতু নামেই পরিচিতি বেশি। আঞ্চলিক মানুষজনের উচ্চারণে জজাতু। এই মুহূর্তে আট থেকে আশির মানুষজনের স্বপ্নপূরণের অফবিট ভ্রমণ ঠিকানা পুরুলিয়ার জজহাতু। রাঢ়বঙ্গের পলাশ রাঙান পুরুলিয়াকে আবিষ্কার করতে হলে ভরা বসন্তে জজহাতুতে আসতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সীমানা-ঘেঁষা জজহাতু সারা বছরই বনজ গন্ধে ম’ ম’ করে। শীতের পাতা ঝরার রিক্ততা, বসন্তে পলাশ, শিমুল, কুসুমের রক্তিমাভায় রঙিন প্রকৃতি - দুর্দান্ত সিল্যুয়েট নিয়ে তুলনাহীন পুরুলিয়ার এক টুকরো রূপকথার জগৎ জজহাতু, পারডি ড্যাম আর গজাবুরু পাহাড়।
ফাল্গুনে, অর্থাৎ মাঝ-ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পলাশের লাল রঙে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে জজহাতু। বসন্তে পলাশের সাম্রাজ্য বলে জজহাতুকে। শীত -বর্ষা আর বসন্তে অনন্য জজহাতুর মায়াবী প্রকৃতি। বর্ষায় জজহাতু ঘন সবুজ, মাটি আরও লাল। জলাধারগুলো টইটম্বুর। তবে বর্ষায় জল খানিকটা ঘোলা। শীতে আকাশ নীল। সেই সুনীল আকাশের প্রতিফলনে সবুজে ঘেরা জলাধারগুলি এক একটা রূপকথার অন্যভুবনের ছবি তৈরি করে। কুকি, নরহরা, লায়েক, মরুভাসা, লকড়াকুড়ি, এগুলো সব ড্যাম ও জলাধার ঘিরে আছে চার পাঁচটি ছোটছোট পাহাড়। জজহাতুর ভৌগোলিক অবস্থান অসাধারণ। যত্রতত্র বাঁধ আর বাঁধভাঙা সৌন্দর্য। জলাধারগুলোকে ঘিরে আছে সবুজ সবুজ টিলা-পাহাড়। তার ছায়া পড়ে জলে। শীতে পাখির দেখা মেলে জলে-জঙ্গলে। শীতে কুকি, লায়েক বাঁধের জলাধারের পাড়ে পিকনিকের আসর জমে ওঠে।
ফেব্রুয়ারির শেষে, বসন্তে সীমান্ত বাংলার জঙ্গলমহলের প্রকৃতি নবসাজে সজ্জিত। কোলাহলমুখর খাতড়া শহর থেকে সামান্য দূরে আসতেই পথের দুপাশে পেলাম লাল পলাশের অযাচিত উষ্ণ অভ্যর্থনা। এযেন পলাশের মন মাতাল করা বন্যরূপ। পূবদিকে সূর্যদেব কাঁচাসোনা রঙ ছড়িয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে। এক মায়ামাখানো পরিবেশ। শুধু মুগ্ধতার পরশ।
জঙ্গলমহলের মসৃণ রাস্তা দিয়ে লাল মাটির হৃদয় ছুঁয়ে হাতিরামপুর হয়ে মানবাজার শহরের দিকে গাড়ি চলেছে খুব গতিতে। চটপট প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। শেষমেশ হাতিরামপুর, মানবাজার, বরাবাজার- বলরামপুর-বাঘমুন্ডি হয়ে তিন'ঘন্টায় পৌঁছলাম ঝালদা শহর ছাড়িয়ে ১২ কিমি দূরে জজহাতুতে। একটু চা -পানের ক্ষণিক বিরতি। বসন্তের ঝকঝকে মেঘমুক্ত সকাল, ইতিউতি ফুটে আছে পলাশ। মন ভরে উঠল। গাড়িতেই টিফিনপর্ব সারলাম। ঢেউ খেলানো মসৃণ স্বপ্নের রাস্তা। ইতিউতি তিনখানা কীর্তনিয়া-জারিয়া -সিন্দ্রিয়া আর গজাবুরু পাহাড়ের হাতছানি আর চোখ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতি। ভালোলাগা অনেকটাই বাড়িয়ে দিল এখানকার দূষণমুক্ত নির্মল অনাঘ্রাতা প্রকৃতির মায়াবী রূপ। পুরুলিয়ার নতুন পর্যটনস্থল জজহাতু ড্যাম, কুকি, লায়েক বাঁধে আর গজাবুর পাহাড়। খুব বেশিদিন প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়নি। তবে পাশের জায়গা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। শুধু সুবিস্তৃত জলরাশি নয়, এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় আর সোনাঝুরি-শালের জঙ্গলে যেন এক অদ্ভুত মাদকতা রয়েছে। তাই একান্তে কোনও সকাল, বিকেল বা গোধূলি দারুণ কাটতে পারে। বর্ষা, শীত আর বসন্তে পর্যটকদের ভিড় বাড়ে। রাতের জ্যোস্নায় রোমাঞ্চকর বলে মনে হল। নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর এক অদ্ভুত নির্জনতা নজর কাড়বেই।
ঝালদা থেকে ইচাক মোড় হয়ে গাড়ি যখন জজহাতুর। ছোট পাহাড়গুলো সবুজ শাড়ি গায়ে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ, সবুজ জঙ্গলের কোল ঘেঁষে আমরা পঞ্চপাণ্ডব গন্তব্যস্হলের দিকে চলেছি। গাড়ি এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের বুক ভেদ করে। এতক্ষণ পাহাড়গুলো লজ্জায় দূরে থাকলেও অবশেষে তারা হাজির চোখের সামনে। সিন্দ্রিয়া, জারিয়া, কীর্তনিয়া-তিন পাহাড়ের কোলে তখন আলো আঁধারির লুকোচুরি। জজহাতু গ্রামটি তিনটি পাহাড়ের সান্নিধ্যে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসভূমি। সহজ -সরল মানুষগুলোর সঙ্গে তিন পাহাড়ের সহাবস্থানে জজহাতু যেন পুরুলিয়ার এক টুকরো স্কটল্যান্ড।
ঝালদা মোড় থেকে বামদিকে বেঁকে ইচাগ মোড়। ইচাগ থেকে জজহাতু গ্রামের রাস্তায় পড়লো গাড়ি। মাটির বাড়ি, মুরগি, ঝুড়ি, সাইকেল, লালচে মাটি, পুরোনো মানুষ সব মিলিয়ে খাঁটি পুরুলিয়ার গ্রামের অপরূপ ছবি। ইচাগ মোড় থেকে জজহাতু যাওয়ার পথে দুটো গ্রাম পেরোলাম, এক দিকে পাথরের অল্প উঁচু টিলা,চারদিকে পলাশের জঙ্গল; মাঝখান দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। যেতে যেতে দেখি এক জায়গায় অনেক ছোট-বড় মুরগি, আনাজ নিয়ে লোকজন জড়ো হয়েছে; প্রশ্ন করতে জানা গেলো হাট বসবে সন্ধ্যায়,তার তোড়জোড় চলছে। এইসব দেখতে দেখতেই হুস করে গাড়ি পিচরাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে এক অজ গাঁয়ের মাটির রাস্তায় নেমে গেলো।
লাল মাটি, দুদিকে মাটির বাড়ি,কুয়ো, বাঁশঝাড় এসব একটু পেরিয়েই ঢুকে পড়লাম বনপাহাড়ি ইকো স্টেতে। গ্রামের নাম জজহাতু। তার মধ্যেই অনেকটা জায়গা নিয়ে পাঁচিলঘেরা ইকো পর্যটক আবাসস্থল। একটি একতলা পাকাবাড়ি, তাতে লাগোয়া টয়লেটসহ দুটো ঘর। পাশে আরো তিনটে সুবৃহৎ টেন্ট। একটি টেন্ট একদমই নতুন। এই পাঁচটি জায়গা পর্যটক রয়েছেন। সকাল আটটার মধ্যেই পৌঁছলাম। একে একে দেখলাম-
১) লাকরাকুঁদি বাঁধ
জজহাতু থেকে মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথে লাকরাকুঁদি ড্যাম। 'লাকরা' অর্থ নেকড়ে আর 'কুঁদি'র অর্থ পুঁতে ফেলা। কথিত, একদা নেকড়ে মেরে পুঁতে ফেলা হয়েছিল এখানে। জারিয়া, সিন্দ্রিয়া, কির্তনিয়া-এই তিন পাহাড়ের থেকে বয়ে আসা বৃষ্টির জল দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ড্যাম।নানান প্রজাতির নানান রঙের পাখি চোখে পড়ছে জলাশয় ও তার আশপাশে। করচে বুক, শামুকখাল, নীলকণ্ঠ, জলমোরগ, হলদে টিট্টি, হুপো, ঘুঘু, মুনিয়া, আরও কত! নিখাদ পক্ষীপ্রেমীদের কাছেও এক দারুণ আকর্ষণীয় জায়গা লাকরাকুঁদি। রংবেরঙের পাখিদের জলকেলি। মুগ্ধ হয়ে দেখছি এইসব মনমাতানো দৃশ্য, হঠাৎই মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাক শামুকখোল।
২) পারডি বাঁধ
আমাদের পরবর্তি গন্তব্যস্হল ছিল পারডি ড্যাম। পর্যটকদের কাছে পারডি ড্যাম অনাঘ্রাত এখনও। এক দিকে গজাবুরু এবং অন্য দিকে চেমটি পাহাড়ের মাঝের পিচ কালো রাস্তা ধরে পারডি ড্যামের পথ, পথের মধ্যেই সাক্ষাৎ হয়ে গেল সুন্দরী রূপাই নদীর সঙ্গে। সম্প্রতি পারডি ড্যাম অবধি রাস্তাও হয়েছে পর্যটকদের জন্য। পারডি ড্যামের পরিবেশ বেশ মনোরম। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা জলাধার। পাখিদের স্বর্গরাজ্য।
৩) জেলেংসিড়িং হয়ে অযোধ্যা পাহাড়
পাদরি ড্যাম থেকে অযোধ্যা পাহাড় যেতে হয় জেলেংসিড়িং, রুগরুকুটু হয়ে। দূর থেকে নীল পাহাড়িয়া ঢালে ধূসর মেঘেদের বসত, লালমাটির ধার ঘেঁষে শাল, সেগুন পলাশের বাসভূমি মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অনুভূতি এক অন্য রূপকথা। জেলেংসিড়িং হয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার রাস্তা আপনার স্মৃতিতে চিরদিন রয়ে যাবে।
৪) চাতমঘুঁটু ও নরোহারা ড্যাম
জজহাতু থেকে নরোহারা ড্যামের রাস্তা গিয়েছে চাতমঘুঁটু হয়ে। জঙ্গলের বুক চিরে হরিণ, ময়ূরের ডাক কানে নিয়ে পৌঁছে গেলাম চাতমঘুঁটু। ঘন অরণ্যে নিজেকে পাওয়া যায় এই চাতমঘঁটুতে। সেখানে গাড়ি রেখে এগিয়ে গেলাম নরোহারা ড্যামের দিকে।
চামটাবুরু, গজাবুরু, জারিয়া, সিদ্রালিয়া, কীর্তনীয়া, রানিগজর, বুরুটুংরি, এগুলো জজহাতুকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের নামাবলী। সবুজ-রঙা পাহাড় সব। শীতে নীল আকাশ, নীল জলাশয়, সবুজ পাহাড়ের সারি, সব মিলেমিশে চোখে ও মনে যে ছবি এঁকে দেয় তা শান্তির, তা সুন্দরের। বর্ষায় জজাহাতু যদি হয় বিরাট প্রেক্ষাপটে আঁকা এক আশ্চর্য জলছবি, তবে বসন্তের বনপলাশী জজাহাতু যেন তেলরঙে আঁকা আরেক ছবি। শীতে রৌদ্র-ছায়ার জজহাতু বড় রোমান্টিক।
জজহাতু, লায়েক বাঁধ-নরোহারা-পাদরি ড্যাম, চার দিক থেকে চলে শাসন চার পাহাড়ের, রানিগজর-কীর্তনিয়া- জারিয়া- সিন্দ্রালিয়া এই চারের কড়া অনুশাসনে জজহাতুর রূপাই নদী গেঁথে চলেছে রূপকথা কাহিনী।
নীল জলের ওপারে ঘাড় উঁচু করে থাকা গজাবুরু পাহাড়ের ঠিক নীচেই রয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর ড্যাম গুলো। এক কাব্যিক নাম জজহাতু। আসলে জজহাতু হল আদিবাসীদের একটা স্বপ্নের গ্রামের নাম। দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করলাম এখানকার বনপাহাড়ি ইকো স্টেতে। পড়ন্ত বিকেলে গজাবুরুর উদ্দেশ্যে চললাম। সবুজ উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছলাম গজাবুরুর কাছে।
জনপদ ছাড়িয়ে সবুজ গাছের আড়ালে নিজের সৌন্দর্যকে লুকিয়ে রেখেছে গজাবুরু পাহাড়। প্রকৃতির নিভৃত আঁচলের তলায় মুখ লুকানো গজাবুরু পাহাড় দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। ভীষণ মনকাড়া। চোখে পড়ল পলাশের উজাড় করা অপার সৌন্দর্য্য। নকশা করা মাটির বাড়ি। বাড়ির উঠোনে মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। একটা ছোট্ট চায়ের দোকান দেখলাম। সবাই চা ও বিস্কুট খেলাম। দেখলাম আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর ঘরবাড়ি। এই সবকিছুকে ঘিরেই জজহাতু গ্রামের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আর এরই কোলে গড়ে উঠেছে মনহরণকারী চার-পাঁচ খানা পাহাড়। আমরা প্রত্যেকে পাহাড় প্রেমিক। এই পাহাড়ের উল্টোদিকে বেশ দূরে উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, পুরুলিয়ার স্বপ্নের পাহাড় গজাবুরু আর চামটাবুরু। বাইরের পৃথিবীর থেকে মনে হয়, যেন অনেক দূরে। পাহাড়কে জড়িয়ে রেখেছে পলাশ, শিমুল, হরিতকি আর করঞ্চের দল। এক সঙ্গেই বলে উঠলাম-'গজাবুরু তুমি কত সুন্দর'! পাহাড় থেকে দূরে দেখলাম তিনটি আদিবাসীদের গ্রাম। প্রকৃতির এই সুন্দর শান্ত পরিবেশ থেকে ঘরে ফিরতে কার- ই বা মন চায়! ফিরতেই হবে, কেন না, আমরা সবাই সময়ের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা। বিদায়ী মন ফিরে ফিরে চায়। রাত কাটাবো মুরগুমার সেচ বিভাগের গেস্ট হাউসে। এবার ফেরার পথ ধরলাম। ঝালদা শহরে এসে গাড়ি এগিয়ে চলল বেগুনকোদর বাজারের দিকে। এখান থেকে দূরত্ব তিন কিমি। বাজার ছাড়াতে ধুলো ওড়া পথ। পথ ছবিতে সবুজের সঙ্গে আদিবাসী মানুষজনের ঘর-দুয়ার।ঝলক দর্শনেই মেলে স্হানীয়দের রোজ নামতার ছবি। গ্রাম ফুড়ে় রাস্তা উঠেছে বাঁধের উপরে। অবশেষে মুখোমুখি হলাম মুরগুমার সঙ্গে। সাহেবজোর নদীর উপর কৃত্রিম লেক। সবুজে ঘেরা এই লেকের দৃশ্য অতুলনীয়। একটি, দুটি পাহাড় ঢুকছে দৃশ্যমান হয়ে। আর দূরে সর্ষে ফুলের খেতটি যেন, পাহাড়ের পায়ের উপরে মেলে দেওয়া হলুদ বর্ডারে সবুজ শাড়িটি মাঘের রৌদ্রে শুকোচ্ছে। পথের ধারে পাহাড়তলিতে শিমুল-পলাশের দাবানল। দূরে দলমা পাহাড়ের হাতছানি। গোধূলির আলোয় মুরগুমা বড় মায়াময়, অপার্থিব সুন্দর। মায়াবী নীলাঞ্জন মাখানো ছবির মতো সুন্দর। অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায় গোটা রাত। রাতের খাওয়ার শেষ হলো দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে। সবাই চলে এলাম লেকের পাড়ে। সৌভাগ্য বশত দিনটি ছিল ভরা চাঁদের রাত। এক মায়াবি জগৎ। মন ছুঁয়ে যায়় কল্পলোকে। পরতে পরতে প্রকৃতির অকৃপণ উজাড় করা অপার সৌন্দর্য্য।আমরা লেকের অন্যপ্রান্তে চলে এলাম। রাতে দৃশ্যমান হল দলমারেঞ্জ। মৌনতার নীরব সাক্ষী। মায়াবী চাঁদের আলো এখানে পথে পথে আল্পপনা এঁকে এঁকে চলেছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো।
পূর্ণিমা রাত-মায়াবী আস্তরণ। সম্পূর্ণ আঁধার হলে দিগন্ত হয়ত চোখে পড়ত না সে ভাবে। কিন্ত্ত নিকষ কালো নয়, চারদিকের মায়াবী জ্যোৎস্নায় আকাশ -লেক-অরণ্য নীলের নানা ছায়ে যেন প্রকাণ্ড এক স্বপ্নময় ক্যানভাস। জীবন শিল্পীর তুলিতে আঁকা অপরূপ নিসর্গ। মুরগুমা ড্যামের অন্য প্রান্তে চোখ মেলে দেখছি সবুজ বনানীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মন ভরে গেল। গভীর রাতে এই পাগলামি বহুদিন মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকবে। রাত গভীর হতে লাগল, এবার ফেরার পালা। ফিরে এসে সবাই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম।
নতুন সকালের জন্য অপেক্ষা। সময় যেন কিছুতেই কাটছে চাইছে না। পরেরদিন, নতুন ভোরে এক অন্যরূপ দেখলাম মুরগুমার। শান্ত,স্নিগ্ধ। ভোরের সূর্যোদয়ের দৃশ্য এককথায় অতুলনীয়।টিফিন করে গোটা ঝালদা শহরটা ঘুরে নিলাম। ছোট্ট পৌরসভা। জনসংখ্যা ২০০০০। একে একে শিকার, শিলফোর, কালিপাহাড়, নহবাহড়়া ড্যাম, বহুপ্রচীন মন্দির- সব কিছুই দেখলাম। দুপুরের খাওয়া পর্ব এখানকার একটি হোটেলে সারলাম। বেলা২টায় ঘরে ফেরার পথ ধরলাম। অন্য পথে ফিরছি। ঝালদা- বাগমুণ্ডি-মাঠা পাহাড়-ছড়িদা-বলরামপুর, বান্দোয়ান, ঝিলিমিলি-রানীবাঁধের পথে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। শীত, বসন্ত ও বর্ষায় অপরূপা জজহাতু ও গজাবুরু আর মুরগুমা। বিভিন্ন জনপদভূমি ছুঁয়ে এগোতে লাগলাম। দূরত্ব ১৫০ কিমি। এই অঞ্চলটি যেন পলাশের আর কুসুম ফুলের বাড়াবাড়ি উপস্থিতি। মন পাগল করে দেয়। ফলে এই প্রকৃতি রঙের দাবানল দেখতে দেখতেই ফিরছি। সময়ের হাত ধরে সূর্য ডোবার পালা এসে গেলো। বসন্তের পড়ন্ত বিকেল বেলায় পলাশের জঙ্গলের সঙ্গে আকাশের এই রঙের খেলার সাক্ষী আমরা। একে একে গজাবুরু, জজহাতু আর মুরগুমার বিরল স্মৃতিকে সঙ্গী করে গাইতে লাগলাম ঘরে ফেরার সুর। এই পথ যদি না শেষ হয়-কিছুক্ষণ বাদে সবাই সমবেতভাবে গেয়ে উঠলাম 'ও শিমুল, ও পলাশ দাও রাঙিয়ে দাও'--
দুই দিনের প্রাপ্তির স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বিভিন্ন জনপদভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা ফিরছি। গোটা অঞ্চল জুড়ে পলাশ আর কুসুম ফুলের বাড়াবাড়ি রকমের উপস্থিতি। মন পাগল করে দিল। সময়ের হাত ধরে সূর্য ডোবার পালা এসে গেল। বাসন্তীর পড়ন্ত বিকেলে পলাশের জঙ্গলের সঙ্গে আকাশের এই রঙের খেলার সাক্ষী আমরা পঞ্চপাণ্ডব। সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠলাম 'ও শিমুল, ও পলাশ দাও রাঙিয়ে দাও'।
মন ভারাক্রান্ত। আবার সেই কেজো জীবনে প্রত্যাবর্তন। ঘড়িতে রাত দশটা বেজে গেছে। মন জুড়ে একটা মুগ্ধতা ও বিষন্নতা। রাত বাড়ে, পাহাড়, জঙ্গল আর নদীর গান শেষ হয় না। বান্দোয়ানের যমুনা ব্রিজের ওপরে পূর্ণিমার চাঁদ চুপিসারে উঠেছে, সবুজ অন্ধকারে। আকাশ ভরা তারায় তারায় শেষ হল বসন্তে পলাশের দেশের জঙ্গল জীবনের বর্ণময় এক ভ্রমণের জীবন।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে রাঁচি শতাব্দী এক্সপ্রেস বা রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ধরে মুরি জংশন। সেখান থেকে গাড়িতে ২৪ কিমি।
আদ্রা- চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ধরে পুরুলিয়া৷ সেখান থেকে জজহাতু প্রায় ঘন্টা দুয়েক। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে কলকাতা- বর্ধমান- দুর্গাপুর- আসানসোল- পুরুলিয়া -গড়জয়পুর- কোটশিলা, ঝালদা হয়ে দূরত্ব প্রায় ৩৭০ ।
থাকার জন্য- জজহাতুর বনপাহাড়ী ইকো স্টে অন্যতম। এছাড়াও ঝালদা শহরে বেশ কয়েকটি হোটেল ও লজ আছে। ঝালদা ছাড়াও মুরগুমাতে থাকার জন্য ভাল ব্যবস্থা আছে।
ডঃ সুবীর মণ্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
বিষয়: ডঃ সুবীর মণ্ডল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: