সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৫ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ব্লু মাউন্টেইন ও তিন বোন দর্শন

নীলাম্বরী অস্ট্রেলিয়া (তৃতীয় পর্ব) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৪ জানুয়ারী ২০২৪ ১৪:০১

আপডেট:
৭ জানুয়ারী ২০২৪ ১০:২৪

ছবিঃ ব্লু মাউন্টেইন

 

এরপরের সপ্তাহ ছুটির দিন আমরা বিখ্যাত ব্লু মাউন্টেইন দর্শনে যাবো সবাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো!
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেটের দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি হলো ব্লু মাউন্টেন।এই পাহাড়ের তিন বোনের কাহিনী পড়েছি বইতে!খুব দেখার ইচ্ছে ছিল!
আমরা সকাল সকাল রওয়ানা হয়ে গেলাম!
রাস্তার দুপাশের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে পৌছে গেলাম আমরা!
গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের অপূর্ব দৃশ্য দেখে আরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম! কি যে অপূর্ব মনোমুগ্ধকর!যেদিকে চোখ যায় শুধু নীল আর নীল!কেন ব্লু মাউন্টেইন বলা হয় তার আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই!আকাশ পাহাড় দিগন্তের বর্ণচ্ছটা ۔۔সবকিছুই এখানে নীল !গাড় নীল!প্রকৃতির এই অপরূপ রূপের বর্ণনা দেয়া কঠিন!এটা অন্তর দিয়ে উপলদ্বি করা যায়!ঠিক লিখে বোঝানো সম্ভব নয়!
গাড়ি পার্ক করে আমরা একটা পার্কে বসে ঘুরাঘুরি করে ছবি তুললাম মনমতো!এরপর বাসা থেকে নিয়ে আসা নাস্তা পার্কের মধ্যেই বসবার সুন্দর ব্যবস্থা আছে ,সেখানে বসে সবাই নাস্তা সেরে নিলাম!
রাজধানী সিডনির সিবিডি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে এই ব্লু মাউন্টেন পাহাড়।
একটু জিরিয়ে নিয়ে এবার আমরা বেশ কিছুদূর হেটে হেটে ব্লু মাউন্টেইন এর নান্দনিক দৃশ্য দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গেলাম!
জায়গাটা অপরূপ গোছানো! এয়ারপোর্ট টারমিনাল এর মতো করে বানানো বিশাল একটা গোল ঝুলন্ত চত্বর!এই চত্বরের মধ্য দিয়ে একে একে চারধাপ উপরে উঠে গেলাম সব্বাই!
আহা۔۔۔
এখান থেকে আমরা পুরো নীল পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছি এখন! সামনে আদিগন্ত নীল চাদরে মোড়া চোখ ধাঁধানো নীল পাহাড়!আর নিচে খাদ!তাকালেই গা ছমছম করে শিউরে ওঠে!দুর্ঘটনাবশত কোন কারনে পড়ে গেলে আর নিস্তার নেই ۔۔۔
আর মাথার ওপর বিস্তীর্ন আকাশ!সবই নীল কিংবা নীলাভ!টার্মিনাল এর শেষপ্রান্তে রেলিং দেয়া!হৃদয় ব্যাকুল করা রূপ! চারদিকে শুধু নীল۔۔ নীল আর নীল!
এখান থেকে সামনে বাম দিকে ইকো পয়েন্ট রয়েছে!এখানেই একসাথে পাশাপাশি তিনটি পাহাড় দাঁড়ানো!তিনটিই আলাদা আলাদা!এত নীলের মাঝে এই পাহাড়ের রংটা একটু ভিন্ন!কিছুটা বাদামি ও লালচে!এরাই হচ্ছে সেই ব্লু মাউন্টেইন্স এর বিখ্যাত তিন বোন! যাদের একসঙ্গে থ্রি সিস্টারস বলা হয়। এই তিন পাহাড়ের উচ্চতা ছোট থেকে বড় ক্রমান্বয়ে ৯০৬, ৯১৮ ও ৯২২ মিটার।
এই তিন বোন বা থ্রি সিস্টারস নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি
হচ্ছে কাতুম্বা গোষ্ঠীর তিন বোন মিহমি (Meehmi), উইমলাহ (Wimlah) এবং গুননেডু (Gunnedoo)!
কথিত আছে,তারা বাস করত জামিসন উপত্যকায়। এই তিন বোন প্রেমে পড়েছিল প্রতিবেশি আরেক উপজাতি বা গোষ্ঠীর তিন ভাইয়ের সঙ্গে। উপজাতীয় আইনে তাদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই তিন ভাই এই নিয়ম মানতে রাজি ছিল না, যেভাবেই হোক তিন বোনকে তারা বিয়ে করবেই। অবশেষে তারা যুদ্ধ বাঁধাল দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। যুদ্ধের মধ্যে তিন বোনের সমূহ বিপদ দেখে কাতুম্বা গোষ্ঠীর এক জাদুকর মন্ত্র বলে তাদের জাদু করে তিনটি পাথর বানিয়ে রাখে—!
জাদুকরের উদ্দেশ্য ছিল যে, যুদ্ধ শেষ হলে আবার তাদের আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জাদুকর নিজেই যুদ্ধে নিহত হয়। কিন্তু ঐ তিন বোনের পাথর আগের রূপে ফিরিয়ে আনার মন্ত্র একমাত্র জাদুকরই জানত। সেই থেকে এই তিন বোন তিনটি পাহাড় রূপে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রেম আর যুদ্ধের স্মারক হিসেবে।

শুনেছি থ্রি সিস্টার্স এর কাছে অনেকে যান!উপর থেকেই দেখলাম মাটির কাঁচা পথ পাড় হয়ে থ্রি সিস্টার্স এর কাছে যেতে হয় !এর পরের ডিরেকশন۔۔৮০০ পা পাহাড়ের নিচে নামতে হবে!নিচে নামার সিড়ি আছে!উপর থেকেই দেখা যাচ্ছে সেই সিড়ি ভয়াবহ সরু ও এবড়োথেবড়ো!অনেক পুরনো ও খুব খাড়া ভীতিকর!
দেখলাম বেশ মোটাসোটা একজন হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে!
নিচের দৃশ্য আরো ভীতিকর!গভীর খাদ!
কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ও সম্ভাবনা আছে!আর পড়ে গেলে নিস্তার নেই!
এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তিন বোনের কাছে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই রইলোনা আমাদের!
আমরা চাটপাশটা বরং হেটে হেটে দেখতে থাকলাম!
ব্লু মাউনটেইন্স এলাকায় বেশ কিছু টুরিস্ট স্পট ও ক্যাবল কার ও আছে!
আমরা ওখান থেকে ফিরে এলাম ইকো পয়েন্টে। সেখানে কিছু শপ আছে!স্যুভেনির, কার্ড, খেলনা, চাবির রিং—এসব কিনতে পাওয়া যায়। আমরাও কিছু স্যুভেনির, চাবির রিং আর খেলনা কিনলাম। বিকেল হয়ে এলো! কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছিলো তখন!রৌদ্র পড়ে এসেছে!নীল পাহাড়টা যেন আরো ঘন নীল হয়ে যাচ্ছে!
ফেরার সময় হয়ে এলো আমাদের !
ফেরার পথে আমরা ক্যাবল কার এ করে ওপরে ঘুরলাম। নিচে পাহাড়ের খাদ দেখা যাচ্ছে!আমরা অনেক ওপরে উঠছি,একপাশ থেকে অপর প্রান্ত! এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
ওপাড়ে নেমে পাহাড়ি রাস্তায় বেশ কিছু ছবি তুলে আবার দৌড়ে উঠলাম ক্যাবল কার এ!চলে এলাম ওপাড়ে!যাদের প্রেসার বা শারীরিক সমস্যা থাকে ,তাদের ক্যাবল কার এলাউড নয়!তাই পরানবন্ধু উঠতে পারে নাই!সে এপারে বসে নানারকম দৃশ্য উপভোগ করেছে!
আমরা একসঙ্গে হলাম!
সন্ধ্যে হয়ে এলো!
আর দেরি না করে অপার আনন্দ সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম! (চলবে)

 

নীলাম্বরী অস্ট্রেলিয়া (প্রথম পর্ব)

নিলাম্বরী অস্ট্রেলিয়া (দ্বিতীয় পর্ব)

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top