সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


ভয়েস রেফারেন্ডাম ও সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি


প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:০৮

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৫:১৭

 

টিটো সোহেল: পৃথিবীর ইতিহাসের এক বিরল অধ্যায় হলো যে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা বিনম্র ভাবে গণভোটের মাধ্যমে এদেশের অভিভাসীদের কাছে, অর্থাৎ আমাদের কাছে, অস্ট্রেলিয়ান সংবিধানে নিজেদের স্বীকৃতি চাচ্ছে। এটি বিরল এজন্য যে পৃথিবীতে সব দেশেই আদিবাসীরা হলো প্রথম শ্রেণীর নাগরিক আর অভিভাসীরা হলো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। উদাহরণস্বরূপ মালয়েশিয়াতে মালয়রা হলো প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। চীনারা দ্বিতীয় এবং অন্য ভারতীয়রা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। অস্ট্রেলিয়ায় বাস্তবতা হলো উল্টো: এখানে এককালীন বন্দুকধারী ব্রিটিশ (colonial settlers) ও ইউরোপিয়ান সাদারা (WOG) হলো প্রথম, অন্য সাদারা (লেবানিজ, মাল্টিজ) দ্বিতীয়, ব্রাউন বা ভারতীয়রা তৃতীয়, কালোরা চতুর্থ এবং আদিবাসীরা সর্বশেষ এবং সংবিধানে অদ্যাবধী অস্বীকৃত। দেখা যাক এ বর্ণ বৈষম্যের ঐতিহাসিক কারণ গুলো কি?

আদিবাসীদের দৃষ্টিতে অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা এদেশের প্রথম জাতি বা প্রাচীনতম অধিবাসী।আদিবাসী সংস্কৃতি হলো ৬৫,০০০ বছরের পুরোনো। পৃথিবীর প্রাচীনতম সংস্কৃতি যা কিনা সুমেরীয়, মিশরীয় বা বঙ্গ/ভারতীয় সভ্যতার চেয়েও পুরোনো। মজার ব্যাপার হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম সংস্কৃতি হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসীদের মধ্যে দাসত্ব প্রথা বা জেল হাজত (prison system) ছিল না। এতে প্রমাণিত হয় যে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী সংস্কৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক সমাজের মধ্যে অন্যতম।


১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন কুক বোটানি বেতে (Botany bay) এসে তিন আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করে অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ পতাকা উড়িয়ে দিয়ে এদেশটিকে ব্রিটিশ কলোনী বলে দাবি করে টেরা নুলিয়াস (Terra Nullius) আইনের মাধ্যমে। টেরা নুলিয়াস মানে হলো এদেশটি জন বিহীন অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা মানুষ নয়, বরং এরা হলো গাছ পালা ও প্রকৃতির অংশ।

পরবর্তী পাঁচ থেকে দশ বছরে ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের সংখ্যা ১% এর নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে নির্মাণ ভাবে গণহত্যা চালিয়ে। দখল করে নেয় এদের সব জমি ধ্বংস করে দেয় আদিবাসীদের ভাষা ও সামাজিক কাঠামো। পৃথিবীর মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সবচেয়ে নির্মমরূপ নেয় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। বেঁচে থাকা ১% আদিবাসীদের আটকে রাখে বিভিন্ন মিশনে: পুরুষদের দিয়ে কাজ করায় জমিতে, মেয়েদের দিয়ে বাড়িতে। আদিবাসীদের বাচ্চাদের তুলে নেয়া হয় জোর করে এবং কাজ করানো হয় সাহেবদের বাড়িতে।

 

আইন করে বন্ধ করা হয় আদিবাসীদের সকল অধিকার। "বিয়ে করার, বাড়ি কেনার, বাচ্চা নেয়ার। ১৯৬০ পর্যন্ত আদিবাসীদের মিশন ছেড়ে কোথাও যেতে হলে অনুমতি নিতে হতো। অধিকাংশ সময় কাজের কোনো মজুরি ছিলোনা। " (মাসিমা বারবারা সিম্স, লে পেরুয, Aunty Barbara Simms, Le Perouse) ।



বিশিষ্ট নৃতত্ববিদদের মতে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা হলো সবচেয়ে বঞ্চিত ও নিঃসম্বল জনগোষ্ঠী । আফ্রিকানদের মতো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা একটি মহাদেশের মালিক হওয়া সত্বেও বিশ্ব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি যাদের নিজ ভূমিতে কোনো স্বাধিকার নেই।

পেমালওয়ে


মাস্টারদা সূর্য সেন

অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন যে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের এই নির্মম অত্যাচার নীরবেই মেনে নিয়েছিল। না নেয়নি একেবারেই। প্রতিটি রাষ্ট্রেই গড়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন।সিডনিতে আদিবাসী নেতা পেমালওয়ে গড়ে তোলে আদিবাসী গরিলা বাহিনী এবং কমান্ডো আক্রমণ চালায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক দশক ধরে। কাম্বারল্যান্ডে রয়েছে পেমালওয়ে নামে এক পল্লী, পেমালওয়ের স্মৃতি হিসেবে| বাঙালি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে পেমালওয়ের। দুজনেই চালিয়েছেন গেরিলা যুদ্ধ। বাংলা, ভারত স্বাধীন হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এখনো চাচ্ছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি। অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের ১২২ বছর পরে |



এডওয়ার্ড ম্যাবো দীর্ঘ দু দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্টে চালিয়েছিয়েন আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের মামলা। ১৯৯২ সালে ম্যাবোর মৃত্যুর পরে ম্যাবো এই মামলায় জয়লাভ করেন। আদিবাসীরা পায় জমির মালিকানা বা জমি কেনার অধিকার। চিন্তা করুন আপনার নিজ দেশে আপনি জমি কিনতে পারছেন না, বাড়ির মালিকানা পাচ্ছেন না, বাচ্চার পিতামাতা হতে পারছেন না কিন্তু দেশটির সব জমির মালিক হলো ব্রিটিশ রানী (এখন রাজা)। নিচে দেয়া হলো অস্ট্রেলিয়ান সংবিধানে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
ইতিহাস : ভয়েস রেফারেন্ডাম (time line)
১৯৩৮: উইলিয়াম কুপার প্রথম গণ আবেদনের মাধ্যমে সংসদে আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব নিয়ে আসেন
১৯৭২: জাতীয় আদিবাসী কমিটি (NACC) প্রতিষ্ঠিত হয়
১৯৭৫: সরকার জাতীয় আদিবাসী কমিটি (NACC)বিলুপ্ত ঘোষণা করে
১৯৭৭: জাতীয় আদিবাসী কনফারেন্স (NAC) প্রতিষ্ঠিত হয়
১৯৮৫: সরকার জাতীয় আদিবাসী কনফারেন্স (NAC) বিলুপ্ত ঘোষণা করে
১৯৯০: জাতীয় আদিবাসী ও টরে স্ট্রেইট আইল্যান্ড কমিশন (ATSIC) গঠিত হয়
২০০৫: জাতীয় আদিবাসী ও টরে স্ট্রেইট আইল্যান্ড কমিশন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়
২০১০: জাতীয় আদিবাসী কংগ্রেস (NCAFP) গঠিত হয়
২০১৬: জাতীয় আদিবাসী কংগ্রেস অর্থায়ন বন্ধ করা হয়
১৯৯০: জাতীয় আদিবাসী ও টরে স্ট্রেইট আইল্যান্ড কমিশন গঠিত হয়
২০০৫: জাতীয় আদিবাসী ও টরে স্ট্রেইট আইল্যান্ড কমিশন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়
২০১০: জাতীয় আদিবাসী কংগ্রেস গঠিত হয়
২০১৬: জাতীয় আদিবাসী কংগ্রেস অর্থায়ন বন্ধ করা হয়
২০১৭: ২৫০ আদিবাসী প্রতিনিধি মিলিত হয়ে ভয়েস কমিটি গঠন করে
২০২১: প্রতিনিধিরা সংসদে ভয়েস কমিটি রিপোর্ট উপস্থাপন করেন
২০২২: লেবার সরকার ভয়েস কমিটি গঠনের অঙ্গীকার করে
২০২৩: ভয়েস গণভোট ১৪ অক্টোবর ২০২৩
Thomas Mayo Presentation at City of Sydney Town Hall (July, 2023)
(চলবে)


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top