সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১৬

আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১৭

ছবিঃ অমর মিত্র

 

এই সময় তো সপ্ত ঋষিরা আকাশে থাকেন না।

হ্যাঁ, আপনি তো আকাশ চেনেন মহারাজ। মৃদুস্বরে বললেন আচার্য বৃষভানু, মাঘ মাসে উত্তর আকাশে আবার দেখা দেবেন সপ্ত ঋষিরা, মহাঋষি বশিষ্টের স্ত্রী অরুন্ধতী।

রাজা ভর্তৃহরি শুনতে পেলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি ঊর্ধ্বমুখী, আকাশে তাকিয়ে। দৃষ্টি যেন এই চরাচর, আকাশমণ্ডল, গ্রহ নক্ষত্রের সীমা পেরিয়ে, এই বিশ্বলোক পার হয়ে অনন্তগামী। সন্ধ্যায় একাকী রাজা ভর্তৃহরি দেবপথ ধরে রাজপ্রাসাদ থেকে শিপ্রাতীরে মঙ্গলনাথের মন্দিরের কোলে আচার্য বৃষভানুর আশ্রমে এসেছেন। আজ কার্তিক পূর্ণিমা। পূর্ণচন্দ্র মধ্য গগনে। হিমেল রাত্রি জ্যোৎস্নায় আবৃত। চাঁদের আলোয় শিপ্রা নদীটি যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা দুধ নদী হয়ে গেছে। বিড়বিড় করছেন রাজা ভর্তৃহরি, ওই উত্তর পুবে বৃষ রাশি, বৃষের ঈষৎ পশ্চিমে মেষ, তার ওপরে মীন রাশির তারকামণ্ডল।

বৃষভানু বললেন, মধ্য গগনে তাকান, একটু দক্ষিণ ঘেষে মকর ও কুম্ভরাশিকেও দেখতে পাবেন। ওই যে দেখুন মহারাজ।

রাজা ভর্তৃহরি দেখলেন অতি উজ্জ্বল শ্রবণা নক্ষত্রকে ঠিক মাথার উপরে, একটু পশ্চিম ঘেষে। উত্তরে রয়েছে অভিজিৎ। তিনি আকাশের তারাদের আবার চিনে নিচ্ছিলেন। আচার্য বৃষভানুর কাছে অনেক সন্ধ্যায় বসে তিনি আকাশ চিনেছেন।

বৃষভানু বলছিলেন, কার্তিক পূর্ণিমায় চন্দ্র কৃত্তিকা নক্ষত্রে থাকেন, কৃত্তিকা নক্ষত্রকে কি দেখতে পাচ্ছেন মহারাজ?

রাজা জবাব দিলেন না। মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গায়ের পশম চাদরটি একটু আলগা করে দিলেন। কার্তিক মাসেই অবন্তীদেশে শীত নেমে যায়, এ বছর শীতের প্রকোপ কম হবে মনে হচ্ছে। কই তেমন ঠান্ডা তো নেই। বৃষ্টি হয়নি, মাটি আর্দ্র নয়, শীত আসবে কোথা থেকে? উত্তরের বাতাস এখনো অবন্তীদেশে প্রবেশ করেনি। রাজা বললেন, শুক্রগ্রহকে তো এই সময় দেখা যাবে না।

না, আর কয়েকদিন বাদে, এই মাসের শেষে সূর্যোদয়ের আগে ভোরের আকাশে শুক্র দেখা দেবেন। দেবগুরু বৃহস্পতি এ মাসের প্রথমে সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে ছিলেন, এখন আর তিনি আকাশে নেই, মহারাজ ভিতরে আসুন হিম পতনের সময়, শরীর সহ্য নাও করতে পারে।

আঙিনা থেকে অবন্তীরাজ আশ্রমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তাঁর বসার জায়গাটি সাজিয়ে রেখেছে তাম্রধ্বজ। প্রদীপ হাতে সে রাজা ভর্তৃহরিকে পথ দেখালো। মৃদু, নরম আলোয় এখন রাজা ভর্তৃহরি এবং আচার্য বৃষভানু মুখোমুখি। বাতায়ন খোলা ছিল। খোলা বাতায়ন পথে চাঁদের আলো এসে প্রবেশ করছিল ভিতরে। জ্যোৎস্না এসে পড়েছে রাজার গায়ে। তিনি হাত নেড়ে প্রদীপটি নিভিয়ে দিলেন। বেশ তো জ্যোৎস্না আছে।

হ্যাঁ, এখনো কুয়াশা প্রবল হয়নি, আকাশ কীরকম পরিষ্কার তা তো দেখলেন।

রাজা চুপ করে থাকলেন। তাম্রধ্বজ ঘরের কোণে অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে বসে আছে। সে এখানে আসার পর এই তৃতীয়বার এলেন ভর্তৃহরি। এবার কেমন বিষণ্ণ। আজ কার্তিক পূর্ণিমা, দীপাবলী গেছে এই মাসের প্রথমে। এক পক্ষ বাদেই উজ্জয়িনী নগরে আবার মেলা। এই মেলাটি পশুর। কিন্তু এই মেলায় বৈচিত্র্য তো বেশি। আজ সকালেই আচার্য বলছিলেন, এবারে বেশি পশু আসেনি। উজ্জয়িনীর এই মেলায় মরুদেশের উট, পূর্বদেশের হাতি, তিব্বতের টাঙ্গন অশ্ব, এমনকি কম্বোজের বেগবান অশ্বও আসে। এ ব্যতীত ময়ূর, কবুতর, নানা পাখি প্রচুর বিক্রি হয়। মেষ, গো-মহিষাদি, রাসভ আসে প্রচুর পরিমাণে। কার্তিক পূর্ণিমার সকালে শিপ্রাতীর অসংখ্য পশুর হাঁক ডাকে ভর্তি হয়ে যায়। পূর্ণিমার আগের রাতটি শুক্লা চতুর্দশীর সমস্ত রাত জুড়ে পশু নিয়ে ব্যাপারিরা প্রবেশ করে নগরে। আচার্য কতরাত পর্যন্ত জেগে নদীর পারের পথ অতিক্রম করা পশুর পালকে দ্যাখেন জ্যোৎস্নায়। তাদের ডাকে চতুর্দশীর রাতের স্তব্ধতা ভেঙে যায়। তাদের সঙ্গে আসা, বিশেষত রাসভ নিয়ে আসা গ্রাম্য মানুষজন আশ্চর্য সুরে গান ধরে। সে গান তাদের গলাতেই শোনা যায়। আচার্যর কানে তা লেগে আছে। গত রাত কিন্তু স্তব্ধই ছিল।  পশুর পাল যে যায়নি তা নয়, কিন্তু খুবই কম।

রাজা বললেন, অনাবৃষ্টির কারণ জানতে পেরেছেন?

বৃষভানু বললেন, শুক্রগ্রহ...! থেমে গেলেন বৃষভানু, কয়েকদণ্ড বাদে বললেন, না মহারাজ। 

রাজা বললেন, গো-ধূম বপনের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, মৃত্তিকায় আর্দ্রতা নেই, এমন তো কখনো হয়নি, গো-ধূম যারা বপন করেছিল, বলছে, অঙ্কুরোদ্গম হয়নি।

বৃষভানু বললেন, কখনো এমন হয়, অনাবৃষ্টি, ফসলহানি, এসব প্রকৃতির খেয়াল।

শুধুই খেয়াল, আর কিছু নয়?

বৃষভানু বললেন, হয়ত তাও নয়, এও বোধহয় প্রাকৃতিক নিয়ম, অনাবৃষ্টি কি আমরা দেখিনি?

পরপর দুটি বর্ষা মেঘহীন, এমন অনাবৃষ্টি কি সিংহাসনে আরোহণের পর হয়েছে কখনো?

বৃষভানু বললেন, মহারাজ উদ্বিগ্ন হবেন না, মানুষের শরীর যেমন প্রতিটি দিন একরকম থাকে না, কখনো আলস্য আসে, কখনো তপ্ত হয় শরীর, কখনো অসুস্থ হয়, প্রকৃতিও তো সেইরকম।

ভর্তৃহরি মাথা দোলাতে লাগলেন, কিন্তু শরীরের তপ্ততা, শীতলতা, আলস্যর তো কারণ থাকে, বৈদ্যরা তা জানেন, সেই মতো বিধান দেন, তাতে শরীর পূর্বাবস্থায় ফেরে, আমি জানতে চাই সেই কারণটি কী, আপনি গণনায় কী পাচ্ছেন?

বৃষভানু কিছুই পাননি। তিনি গণনা করে, আকাশের গ্রহ তারার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে তেমন কিছু পাননি যা দিয়ে অনাবৃষ্টির কারণ নির্ণয় করা যায়। গ্রহদের সঞ্চরণে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।

রাজা ভর্তৃহরি বললেন, এবারেও  আশ্বিনের আরম্ভে হিমপতন দেখা গেছে।

জানি। বললেন বৃষভানু, দেখে বিস্মিত হইনি।

হিমপতন তো বর্ষা অবসান সূচিত করে, গতবারের মতো এবারেও বর্ষা হলো না, অথচ...।

বৃষভানু বললেন, বৃষ্টি হয়নি বলেই শরতের আরম্ভে হিমপতন, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, আমি দেখছি অনাবৃষ্টির কোনো সূত্র যদি বের করা যায়। 

আপনি কি গত শ্রাবণ মাসে বৃশ্চিক মণ্ডলের তারা জ্যৈষ্টা নক্ষত্রটিকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন?

বৃষভানু বিস্মিত হলেন কেন?

কোনরকম ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেছিলেন?

মাথা নাড়লেন বৃষভানু, না, আপনি তো জানেন, গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান, সঞ্চরণ সবই মহাজাগতিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ, তা ভাঙা তো সহজ নয়, ব্যতিক্রম নজরে আসেনি।

অবন্তীরাজ অধরোষ্ট দংশন করলেন। আচমকা উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, বৃশ্চিক রাশিকে এখন কি দেখা সম্ভব?

দক্ষিণ পশ্চিম দিগন্তে দেখেছি গতমাসে, এই মাসের প্রথমেও দৃষ্টি গোচরে ছিল, এখন নেই সূর্যাস্তের সঙ্গেই অস্তমিত হয়েছে।

রাজা বললেন, শ্রাবণে দক্ষিণ আকাশে বৃশ্চিক রাশির তারাগুলিকে দেখেছিলাম আমি, এবার মেঘহীন আকাশের কারণে দেখা সম্ভব হয়েছিল, আমার মনে হয়নি কিন্তু একজন বলছেন ওই সময় বৃশ্চিক রাশিমণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল হরিদ্রাবর্ণের জ্যৈষ্ঠা  নক্ষত্রটির রং পরিবর্তিত হয়েছিল, নক্ষত্রটি নাকি নীলাভ শ্বেত বর্ণের হয়ে গিয়েছিল, এর অর্থ ওই নক্ষত্র তপ্ত হয়েছিল তখন, অবন্তীর মাটিতে তাই বৃষ্টি নামেনি।

বৃষভানু দাঁড়িয়েছেন। অবাক হয়ে অবন্তীর রাজা ভর্তৃহরির কথা শুনছেন। এ এক আশ্চর্য কথা। জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্রের রং বদলে গিয়েছিল। কে বলেছে এই কথা? এও কি সম্ভব? নতুন কোনো জ্যোতির্বিদ এলেন নাকি এদেশে? তিনি জানবেন না?

রাজা বললেন, নতুন কোনো তারা দেখেছেন কি আপনি?

জৈষ্টা নক্ষত্রের রঙ বদলের কথা, নতুন তারার কথা কে বলেছে আপনাকে?

ভর্তৃহরি চুপ করে থাকলেন। নিঝুম পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আঙিনায়। নরম শীতের ভিতরে শিপ্রা নদীর দিকে হাঁটছেন রাজা। তাঁকে অনুসরণ করেছেন বৃষভানু। বৃষভানুর পিছনে,একটু তফাতে তাম্রধ্বজ। হাজার হাজার তারার কয়টিকেই বা চেনে মানুষ, এর ভিতরে নতুন তারার খবরও পেয়েছে। গ্রহ নক্ষত্রাদির বয়স কত সহস্র কোটি বছর। তাঁরা নতুন করে কি আবার জন্মাবেন?

বৃষভানু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় সেই তারা?

আষাঢ়, শ্রাবণ, দুই মাসে পশ্চিম দিগন্তে শুক্র অস্তগামী হলে জেগে উঠত পূর্ব আকাশে, তারপর সমস্ত রাত্রি ধরে পশ্চিম গমন করত, ভোরের আগেই, মধ্যরাতে অস্ত যেত। রাজা বললেন।

দ্রুত সঞ্চরণ করত?

হ্যাঁ।

কে বলেছে, সেই জ্যোতির্বিদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই, আপনি কি দেখেছেন মহারাজ, কোনো নিয়মেই  এমন তারা দৃষ্ট হতে পারে না, সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের একটি নির্দিষ্ট ক্ষণ আছে, দিবস ও রাত্রির কাল আছে, আমি দেখেছি আকাশের গ্রহ তারার উদয় অস্ত, সঞ্চরণ সবই অনন্ত কালের সঙ্গে শৃঙ্খলে বাঁধা। শুক্রগ্রহ যখন অস্ত যান সেই সময়ে উদয় হলে, মধ্যরাতে সেই তারা অস্তগামী হবে কীভাবে? পূর্ব দিগন্ত হতে পশ্চিম দিগন্ত ভ্রমণ করতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের  ব্যবধান তো থাকবেই।

ঘুরে তাকালেন ভর্তৃহরি। কথা থামিয়ে দিয়েছেন আচার্য। ভর্তৃহরির দুটি চক্ষু দীপ্ত হয়ে নিভে গেল যেন। তিনি ঈষৎ নত হয়ে বললেন, আমি এবার যাব, আমি যা শুনেছি তা বললাম, কথাটি আপনার কাছেই রাখবেন।

কিন্তু সেই জ্যোতির্বিদকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই আপনার সম্মুখে।

হাসলেন ভর্তৃহরি, থাক, কথাটা সত্য কিনা আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনার কথায় প্রত্যয় হলো, আমি নিশ্চিন্ত হলাম।

রাজা চলে গেলেন। জ্যোৎস্নার ভিতরে শিপ্রাতীর ধরে হেঁটে  নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে তিনি গুপ্তপথ দেবপথে প্রবেশ করবেন। সেখানে পাথরের আড়ালে তিনি রেখে এসেছেন ঘৃতের প্রদীপ। সুড়ঙ্গ পথটি বড় অন্ধকার। এই পথের কথা তিনি জানেন। জানেন রাজমহিষী ভানুমতী। এই পথ রাজা-রানীর পথ। এই পথের খোঁজ রাজা তাঁর উত্তরাধিকারীকে দিয়ে যাবেন। যদিও প্রধান সেনাপিতর জানা উচিত এই পথের দিক নিশানা। অবন্তীর প্রধান সেনাপতি, রাজা ভর্তৃহরির বৈমাত্রেয় অনুজ বিক্রম জানেন না পথটি কোথায়। সে, কৌতূহলও প্রকাশ করেননি তাঁর কাছে। 

রাজা ভর্তৃহরি চলে গেলে তাম্রধ্বজ এসে দাঁড়ায় বৃষভানুর সামনে, গণনায় কিছুই বেরোয়নি আচার্য?

মাথা নাড়লেন বৃষভানু, কোনো ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি আমার।

তাম্রধ্বজ বলল, উনি যে নতুন তারার কথা বলছেন।

জানি না।

বর্ষার মেঘ অন্তর্ধান করেছে অবন্তী থেকে, আষাঢ় শ্রাবণের রাশি, গ্রহের সন্নিবেশ কী প্রকার ছিল?

সে তো আষাঢ় শ্রাবণেই দেখিয়েছিলাম।

আপনি যে আবার গণনা করছিলেন?

বৃষভানু জবাব দিলেন না। তিনি জ্যোৎস্নালোকিত চরাচর, আকাশ দেখছিলেন। তাম্রধ্বজ চুপ করে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে তাম্রধ্বজ জিজ্ঞেস করল, মানুষ যদি নিরুদ্দিষ্ট হয়, তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব কোন গণনায়?

বৃষভানু ফিরলেন তাম্রধ্বজের দিকে, জিজ্ঞেস করলেন, কে নিরুদ্দিষ্ট হলো?

তাম্রধ্বজ বলল, আপনি চেনেন, আপনার কাছে সে আকাশ চিনেছিল, গম্ভীরা থেকে দীপাবলীর সকালে একজন এসেছিলেন, তাঁর পুত্র এবং সখাপুত্র দুজনেই...।

বৃষভানু বুঝতে পারলেন। তিনি এও জানেন না। তিনি যে এ বিদ্যা জানেন তা তো কখনো বলেননি। বৌদ্ধ মহাযানি তান্ত্রিকরা এসব গণনা জানে, তিনি শুনেছেন তা।  তাম্রধ্বজ বৃষভানুর পিছনে পিছনে হাঁটছে। বৃষভানুর নিজেকে কেমন অজ্ঞানী মনে হচ্ছে। রাজার জিজ্ঞাসার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এখন তাম্রধ্বজের কথার কোনো জবাব দিতে পারছেন না। আবার আকাশে তাকালেন তিনি।  আকাশের লিখন পড়ার ক্ষমতা তাঁর নেই।

তাম্রধ্বজ বলল, অবন্তী দেশে, এই উজ্জয়িনীতে দশার্ণদেশের এক ব্যাপারি এসেছিল দীপাবলীতে, তার যাবতীয় খাদ্যশস্য লুট হয়ে গেছে আসার পথে।

সে কী! ঘুরে তাকালেন বৃষভানু।

আর এক বণিক ক্রয়বিক্রয়ের পর ফিরছিল নিজ দেশে, তারও সব গেছে

তুমি কী করে জানলে?

আজ সকালে পশুমেলায় শুনেছি, বলছিল অনেকে।

এমন তো কখনো হয় না অবন্তীদেশে।

হয়েছে, রাজাকে কেমন বিপন্ন মনে হয়নি আপনার?

মনে হয়েছিল বৃষভানুর। তাম্রধ্বজের কথা যদি সত্য হয়, রাজা তো বিপন্ন বোধ করবেনই। দুজনে এখন আঙিনায়। তাম্রধ্বজ বলল, মাসে মাসে, ঋতুতে ঋতুতে কত তারা আকাশ থেকে অদৃশ্য হয়, এই যেমন এখন সপ্তর্ষি আকাশে নেই, কবে আবার ফিরবে তা তো আপনি জানেন।

জানি। বললেন বৃষভানু, তুমিও তো জান।

জানি, মাঘ মাস থেকে আত্মপ্রকাশ করেত শুরু করবেন সপ্ত ঋষিরা, ফাল্গুনে সাত মহাজ্ঞানী ঋষিকে  উত্তর পুব আকাশে দেখা যাবে, আকাশগঙ্গা  তখন দিক বদল করবে, উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হবে। কিন্তু আকাশের গ্রহতারা কখন কোন সময়ে দৃশ্য হবেন, অদৃশ্য হবেন, নিরুদ্দিষ্ট তারা কখন কোন ঋতুতে ফিরে আসবে আকাশমণ্ডলে তা যদি জানা যায়, একটি মানুষ নিরুদ্দিষ্ট হয়ে কখন ফিরে আসবে তা কেন অজানা থাকবে?  বৃষভানু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন শিষ্যের দিকে। তিনি  প্রাঙ্গণে শিউলি গাছটির নিচে বসেছেন শিশিরে সিক্ত মাটিতে। তাম্রধ্বজ তার সামনে বসে। বৃষভানু তাকে বললেন, তাঁর পুত্রটি হুন যুদ্ধে নিরুদ্দিষ্ট, সখা  ধ্রুবের পুত্র ত্যাগ করেছে অবন্তী দেশ, তা তুমি জান? কেন সে চলে গেছে তা জান?

শুনেছি।

বৃষভানু বললেন, আকাশের গ্রহ তারা এক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ, তার ব্যত্যয় ঘটতে আমি দেখিনি এ জীবনে, মানুষের জীবন তো তা নয়।

মানুষ তো গ্রহ তারার অধীন।

তাই তো জানি! বৃষভানু আকাশে তাকালেন। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা টের পাচ্ছেন তিনি। তাম্রধ্বজ যে ভাবে বলছে, তা কি সত্যিই জানা সম্ভব? জন্ম মুহূর্তের গ্রহ, রাশির সন্নিবেশ কি মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে? এ বিদ্যায় কি মানুষের জীবন, জন্মের সব সত্য জানা যায়? তাম্রধ্বজকে তিনি বললেন, কী বলেছ তুমি শিবনাথকে?

আমি গম্ভীরায় গিয়েছিলাম, দুইদিন আগে।

কেন?

এমনি, সাধও ছিল গম্ভীরা নদীটিকে দেখি, কৌতূহল আরো ছিল।

কেমন দেখলে?

তাম্রধ্বজ চুপ করে থাকে। সে গিয়েছিল, গিয়ে দেখে এসেছে তাপসী উমার মতো দুই নারীকে,  মা ও কন্যা। মা রেবা, কন্যা গন্ধবতী। দুটিই দুই নদী। তাম্রধ্বজ তারপর তাদের কাছ থেকে দুজনের, ধ্রুবপুত্র এবং কার্তিককুমারের জন্মপত্র লিখে এনেছে। লিখে এনেছে তাদের গৃহত্যাগের দিনক্ষণ। কিন্তু শুধু এইটুকু। এ সব নিয়ে সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কী সুন্দর মা ও মেয়ে। দু’জনে পাশাপাশি বসেছিল দাওয়ায়। সে বসেছিল আঙিনায় একটি  আসনে। তার মুখোমুখি বসেছিল বৃদ্ধ শিবনাথ। সে যখন উঠে আসে, দুই নারী নেমে এসেছিল আঙিনায়। তাদের চোখেমুখে ছিল কাতর প্রার্থনা। গন্ধবতী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এমন কোনো বিদ্যা সে জানে কিনা, যার বলে নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে দেখা যায়।

এ বিদ্যার কথা গন্ধবতী কোথা থেকে শুনেছে? জিজ্ঞেস করেছিল তাম্রধ্বজ।

শুনেছে সে, বৌদ্ধ তান্ত্রিকরা নাকি ভূত ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পান। গম্ভীরা পার হয়ে আরো দূরে এক বিজন অরণ্য পাহাড়ের কোলে নাকি এমন এক মহাজ্ঞানী এসেছেন, তার কাছে যাবে কি না মা ও মেয়ে তা ভাবছে। 

বৃষভানু, বললেন, ওইসব মহাযানি তান্ত্রিকদের চেয়ে অজ্ঞানী আর কেউ হয় না।

তাম্রধ্বজ বলল, কিন্তু জন্মপত্র, অন্যান্য দিনক্ষণ সব এনে আমি তো কিছুই করতে পারছিনা, কেমন বিপন্ন বোধ করছি, কার্তিক পূর্ণিমার পরে যাব বলেছি, তারা অপেক্ষা করবে।

বৃষভানু কিছু বললেন না। তিনি গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন, কার্তিককুমারের কন্যাটির বয়স কত?

ত্রয়োদশী হবে।

আকাশে তাকালেন বৃষভানু। ত্রয়োদশী আর পূর্ণিমার তফাৎ আর কতটুকু! বরং ত্রয়োদশী ক্রমশ ভরে উঠে পূর্ণিমার দিকে যাবে। তাম্রধ্বজের চোখে তাকালেন তিনি। চোখ নামিয়ে নেয় যুবক। চোখের মণি ছলছল করছিল তা চোখে পড়েছে তাঁর।

তার কি বিবাহ স্থির? জিজ্ঞেস করলেন বৃষভানু।

মাথা নাড়ে তাম্রধ্বজ। বৃষভানু ভিতরে ঢুকে গেলেন। তাম্রধ্বজ ভিতরের আঙিনাটিতে দাঁড়িয়ে থাকল। আকাশের তারা অভিজিৎ, শ্রবণাকে মাথার উপরে পর পর দেখল। ঘুরে ঘুরে নক্ষত্র, গ্রহগুলিকে দেখতে থাকে। চাঁদের আলোয়  আকাশে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে। ক্রমশ তার দৃষ্টি থেকে আকাশ সরে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক শ্রীময়ী মুখশ্রী। অপলক দৃষ্টিতে আকাশ থেকে দেখছে তাম্রধ্বজকে। সে অপেক্ষা করেছে ধ্রুবপুত্রের জন্য। কে ধ্রুবপুত্র, যে নাকি নগরের প্রধান গণিকার প্রেমে অজ্ঞান হয়ে, অপমানিত অবস্থায় ত্যাগ করেছে এই অবন্তীদেশ। কী সুন্দর ওই কন্যা। ভাবতেই থরথর করে কেঁপে উঠে তাম্রধ্বজ। যতবার ভাবছে গম্ভীরা নদীর কথা, মন পড়ে যাচ্ছে গন্ধবতী নদীর কথা। যতবার শিপ্রাতীর থেকে পুবে গন্ধবতীর কুলে দাঁড়ান মহাকালেশ্বর মন্দিরের স্বর্ণচূড়া দেখছে মনে পড়ে যাচ্ছে গ্রাম-বালিকাটির কথা। সে একা একাই এগিয়ে এসে বলেছিল, আপনি বলুন সে কোথায় আছে, সে হুন রাজ্যে আশ্রিত হয়নি তো?

উত্তরটি দিতে পারলে কী সুন্দরই না হতো? বালিকা, কিশোরী নিশ্চিন্ত হয়ে হাসতে পারত। ফিরতে ফিরতে আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাম্রধ্বজ দেখেছিল পথের ধারে নিমগাছটিকে বেড় দিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে গন্ধবতী।

চলবে

 

অমর মিত্র
লেখকসাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারবঙ্কিম পুরস্কার এবং যুগশঙ্খ পুরস্কার প্রাপ্তভারত

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top