সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

এক শরণার্থীর নোবেল জয় : মু: মাহবুবুর রহমান


প্রকাশিত:
৯ অক্টোবর ২০২১ ১৯:০৭

আপডেট:
৯ অক্টোবর ২০২১ ১৯:৩১

 

নিজে শরণার্থী, লিখেছেন শরণার্থীদের নিয়ে আর তা দিয়েই করলেন বাজিমাত, জিতলেন সাহিত্যে নোবেল। কার কথা বলছি পাঠকরা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন। হাঁ ২০২১ এর সাহিত্যে নোবেল জিতে বিশ্বকে তাকে লাগিয়ে দিয়েছেন শরণার্থী হিসেবে লন্ডনে আশ্রয় নেয়া তানজানিয়ার বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আব্দুল রাজাক গুরনাহ (Abdulrazak Gurnah)।

সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর ২০২১) বিকেলে এক অনুষ্ঠানে নোবেল কমিটি আব্দুল রাজাক গুরনাহর নাম ঘোষণা করে। নোবেল কমিটি তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘শরণার্থীদের বিড়ম্বনা এবং ঔপনিবেশিকতার প্রভাবের প্রতি আপোষহীন ও সহানুভূতিশীল সমালোচনা’ উঠে এসেছে গুরনাহর লেখায়। প্যারাডাইজ নামে তাঁর চতুর্থ উপন্যাসের জন্য গুরনাহ এ সম্মাননা পান।

সাহিত্য বিষয়ক নোবেল পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান আন্দ্রেস ওলসন আবদুর রাজাক গুরনাহকে 'বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ঔপনিবেশ পরবর্তী লেখক' হিসেবে প্রশংসা করেন। ওলসন বলেন, ‘‘গুরনাহ ধারাবাহিকভাবে এবং পরম মমতায় পূর্ব আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া অভিবাসীদের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে নিবিড়ভাবে আলোচনা করেছেন।’’

যতটুকু জানা যায়, আব্দুল রাজাক গুরনাহ লন্ডনে তার রান্না ঘরে যখন কাজ করছিলেন তখন তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবার খবরটি পান। রয়টার্সকে গুরনাহ বলেন, ‘‘এটা সত্যিই বিস্ময়কর সংবাদ ছিল আমার জন্য, নোবেল কমিটির ঘোষণায় নিজের নাম শোনার আগ পর্যন্ত আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনি।’’

তানজানিয়ার জানজিবারে ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল রাজাক। ভারত মহাসাগরের দ্বীপ জানজিবার ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। ১৯৬০ দশকের শেষ দিকে সেখানে আরব বংশোদ্ভূত নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। প্রেক্ষিতে সেই সময় স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ১৮ বছর বয়সে আব্দুল রাজাক দেশ ছেড়ে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে লন্ডনে আশ্রয় নেন।

১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত আব্দুল রাজাক যুক্তরাজ্য থেকে তাঁর জন্মস্থান জানজিবারে ফিরতে পারেননি। কেবল বাবার মৃত্যুর আগে তাকে একবার দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন আব্দুল রাজাক। সম্প্রতি ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের ইংরেজি ও ঔপনিবেশিক-উত্তর সাহিত্যের (English and Post-colonial studies) অধ্যাপনা থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন।

ইংল্যান্ডে প্রবাস জীবন যাপনকালে ২১ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন আব্দুল রাজাক। সোয়াহিলি তার মাতৃভাষা। তবে ইংরেজি ভাষাই তাঁর লেখার মাধ্যম হয়ে ওঠে। আব্দুল রাজাকের সাহিত্যে শরণার্থীদের দুর্দশা এবং আফ্রিকান অঞ্চলের রাজনীতি স্থান পেয়েছে। মোট ১০টি উপন্যাস ও বেশ কয়েকটি ছোট গল্পের সংকলন রয়েছে তাঁর।

তাঁর প্রথম উপন্যাস বিদায়ের স্মৃতি (Memory of Departure) প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তাঁর চতুর্থ উপন্যাস প্যারাডাইজ (Paradise) এর জন্য এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পান আব্দুল রাজাক। প্যারাডাইজ উপন্যাসটি ১৯৯৪ সালে সাহিত্যের বুকার পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলো।

সুতরাং বলাই যায় আব্দুল রাজাকের সবচেয়ে বেশি সুনাম অর্জন করা উপন্যাসটির নাম হলো প্যারাডাইজ (Paradise) (বাংলায় স্বর্গ)। প্যারাডাইজ হলো একটি আফ্রিকান ছেলে ইউসুফের গল্প। তার বয়স বাড়ার গল্প, একটি করুণ প্রেমগাঁথা এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদের আফ্রিকাতে শোষণ, অত্যাচার ও দুর্নীতির কাহিনী।

জার্মান সেনারা কিভাবে তখন তানজানিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং কিভাবে জোর করে আফ্রিকান পুরুষদের সৈন্য হিসাবে নিয়োগ করা হতো সেইসব হৃদয় বিদারক কাহিনী প্যারাডাইজ উপন্যাসে লিখেছেন আব্দুর রাজাক। প্যারাডাইজ উপন্যাসের মূল চরিত্র ইউসুফ জার্মান আর্মির সদস্য হিসেবে নিজ জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। সেটি করতে যেয়ে ইউসুফের আত্মগ্লানি আর তার অসহায়ত্বের গল্প দিয়ে আব্দুর রাজাক তাঁর ২৫৬ পৃষ্ঠার বইটিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঔপনিবেশবাদের অত্যাচার কত জঘন্য ছিলো।

প্যারাডাইজ ও তাঁর প্রথম উপন্যাস বিদায়ের স্মৃতি ছাড়া আব্দুল রাজাকের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে আছে তীর্থযাত্রীর পথ (Pilgrims Way) (১৯৮৮), দত্তাই (Dottie) (১৯৯০), নীরবতার প্রশংসায় (Admiring Silence) (১৯৯৬), সমুদ্র সৈকতে (By the Sea) (২০০১), নির্জনতা (Desertion) (২০০৫), শেষ উপহার (The Last Gift) (২০১১) ও পারলৌকিক (After lives) (২০২০)। তার অন্যতম ছোটগল্পের বই- আফ্রিকার এক খামারে থাকতেন আমার মা (My Mother Lived on a Farm in Africa) (২০০৬)।

১৯৮৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী ওলে সোয়েনকার পর অর্থাৎ ৩৫ বছর পর আব্দুল রাজাক প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান লেখক যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। আর শুধু কালো বর্ণ (কৃষ্ণাঙ্গ) হিসেব করলে ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ লেখক টনি মরিসনের পরে আব্দুল রাজাক প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ (কালো কিংবা ধূসর বর্ণের) লেখক যিনি সাহিত্যে নোবেল জিতলেন। নোবেল বিজয়ের পর এক টুইটে আব্দুল রাজাক তাঁর পুরস্কার আফ্রিকা ও আফ্রিকার মানুষ এবং তাঁর সকল পাঠকের প্রতি উৎসর্গ করেন।

আব্দুল রাজাক গুরনাহ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তাঁর নোবেল পুরস্কার পাবার মধ্যে দিয়ে বর্তমান বিশ্বের শরণার্থী সংকট এবং ঔপনিবেশবাদের মতো বিষয়গুলি, যার মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেগুলি আরো বেশি "আলোচিত" হবে। তিনি বলেন, ‘‘এগুলি এমন জিনিস যেগুলো নিয়েই আমরা বেঁচে আছি। মানুষ মারা যাচ্ছে, সারা বিশ্বের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে - আমাদের অবশ্যই এই সমস্যাগুলি সবচেয়ে ভালভাবে মোকাবেলা করতে হবে।’’

বিশ্বের নানাপ্রান্তে শরণার্থী সংকট রয়েছে৷ কেউ জীবন বাঁচাতে, কেউ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন৷ কেউ আবার অবৈধপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে তৈরি করছেন নানা সংকট৷ একজন শরণার্থীর নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটসহ বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী সংকট নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হবে যাতে এ সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

 

মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top