সাদিয়া সুলতানার ছোট গল্পের সংকলন
মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ (বুক রিভিও) : মোঃ ইয়াকুব আলী
 প্রকাশিত: 
 ১৪ জুন ২০২২ ১৯:২৯
 আপডেট:
 ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:৪১
 
                                
সাদিয়া সুলতানার ছোট গল্পের সংকলন 'মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ' বই য়ে গল্প আছে মোট ১৭টা। অংশুমানকে আমি কখনো ভালোবাসিনি, আহুতি, অশ্রুগাছ, প্রোডাক্ট, মাটি, অ-সুখের শব্দ, সুখ ও প্রাপ্তি বিষয়ক, সো হোয়াট, জয়ন্তর সাদা বল, ডুবসাঁতার, সাং বেতুয়ান, একটা বেমানান পাখি, ফাল্গুনের ইশতেহার, গোলাইচাঁদের খাবনামা, নিহতস্বপ্নের শেষে, ত্রাণ এবং মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ। 
এই বইয়ের নাম গল্পটা দিয়ে পড়া শুরু করলাম। একটা গল্পের মধ্যে যেন সমগ্র বাংলাদেশের আর্থসামাজিক চিত্র আঁকা। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোন একটা সীমান্ত গ্রাম 'মেনকি ফান্দার'। পাহাড়ি এলাকা তাই বন্য জীবজন্তুর চলাচল অহর্নিশ। সেখানে একদিন সীমান্তের পাড়ে দেখা মেলে একটা বিরাট মৃত হাতির। 
এরপর গল্প এগিয়ে চলে তার নিজের গতিতে। মৃত হাতিকে ঘিরে গড়ে উঠে জনতার কোলাহল। সুরতহাল করতে আসে বন বিভাগের লোক। অনুসন্ধান করতে আসে পুলিশের দারোগা।শরীরের হারিয়ে যাওয়া অংশের সুত্র ধরে জনতার মনে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন অনুভব। গ্রামের প্রৌঢ় কুদ্দুসের নাতির অবুঝ প্রশ্নগুলো যেন সবার চোখের সামনে থেকে পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়। আর সবাই তাদের অতীতের কৃতকর্মের হিসাব করতে থাকে। 
এরমাঝে নেয়ামত এসে বেমক্কা প্রশ্ন তোলে - "মরা আতি লাখ ট্যাহা। মরা মানুষ দশ হাজার ট্যাহা।" এরপর লেখক স্ব প্রণোদিত হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন - 'অপরাধ কি? পাপই বা কি? সব অপরাধ কি পাপ? সব পাপ কি অপরাধ?' গল্পের শেষ লাইনটা এমন - তারপর পাপের ভারে কালো হয়ে থাকা আকাশে ধীরে ধীরে মেনকি ফান্দার মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অপরাধ আর পাপের খতিয়ান বিন্দুর মতো মিলিয়ে যায়। 
আমি আসলে কোন বোদ্ধা পাঠক নই। আমি আসলে যেকোনো গল্প বা উপন্যাসে জীবনবোধ খুঁজি, মানুষকে খুঁজি, প্রকৃতিকে খুঁজি৷ এই গল্পে তার সবগুলোই স্বমহিমায় উপস্থিত। আসলেই তো আমরা আমাদের জীবনের কোন না কোন এক পর্যায়ে মেনকি ফান্দার মানুষদের মতো নিজের কৃতকর্মের খতিয়ান দেখি এবং আবারও দুনিয়ার নিয়মে পথ চলতে থাকি। জীবন চলতে থাকে। 
এরপর পড়লাম 'সুখ ও প্রাপ্তি বিষয়ক।' এই গল্পে সুখের সংজ্ঞা খোঁজার আড়ালে আসলে জীবনের সংজ্ঞার অনুসন্ধান করেছেন লেখক। এই গল্পের কয়েকটা লাইন এমন - "গড়পড়তা বেশিরভাগ মানুষ আমরা একটা ফ্যান্টাসিতে বাস করি, সমস্যা এভয়েড কইরা। মোদ্দাকথা আমরা ভোগবাদী। যতটুকু করলে আমাদের অস্তিত্বে আঘাত আসবে না, আমরা ঠিক ততটুকুই করি - এই শ্রেণীর মানুষের জীবনে একটা সময়ে আর কিছু পাওয়ার থাকে কি? থাকে না। তখন তার সামনে দুইটা পথ খোলা থাকে। তখন মানুষ হয় চরম বিষণ্ণতায় ভোগে, হয়তো ক্রমাগত আত্মহত্যার দিকে আগায় নয়তো জীবনের গতিপথ পাল্টায় ফেলে। ধর, নতুন নতুন ডাইমেনশন আনে। তার যা খুশি তাই করে।"
বইয়ের প্রথম গল্পের নাম অংশুমানকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। গল্পের নায়িকা সেতুর সাথে একটা আবৃত্তির ক্লাশে পরিচয় হয় অংশুমানের। এরপর অংশুমান একসময় সেতুর প্রেমে পড়েন এবং একেকটা দীর্ঘ চিঠি লিখতে শুরু করেন। তার উত্তরে সেতু লিখতেন সম্বোধনহীন ধাঁধার চিঠি। এরপর একসময় অংশুমানের সাথে সেতুর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। শেষ চিঠিতে অংশুমান সেতুকে 'সুখী হবার' অভিশাপ দেন। এরপর পনেরোটা বছর কেটে যায় কিন্তু সেতু একটি দিনের জন্যও ভুলেন না অংশুমানের কথা। তাহলে কি সেতু সত্যিই অংশুমানকে কখনো ভালোবাসেননি?

পরের গল্প 'আহুতি'। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা একজন বা বহুজন বন্দি নারীর যুদ্ধসময়ের দুঃখগাঁথা। একটা ঘরে অনেকগুলো বিভিন্ন বয়সের নারীকে বন্দি করে রেখে পাক সেনারা যখন ইচ্ছা তখন জুলুম নির্যাতন চালান। তাদের সাথে মাঝেমধ্যে যোগ দেয় তাদের এদেশিয় দোসররা। তাদেরকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে সেই ঘরে দুটো দরজা আর একটি মাত্রা জানালা। দুটো দরজা দিয়ে একসঙ্গে বহু মানুষ ঢোকা যায় কিন্তু বের হওয়া যায় না। 
তাদেরকে রাখা হয়েছে অর্ধ উলঙ্গ করে কারণ এর আগে একজন নারী সিলিং ফ্যানের সাথে শাড়ি দিয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিলো। গল্পের মূল চরিত্রের মেয়েটি মনেমনে সেই মৃত মেয়েটিকে হিংসা করেন কারণ সে মরে যেয়ে বেঁচে গেছে কিন্তু তাদের কোন মৃত্যু নেই। এই ঘরের জানালাটা খোলা হয় মাত্র একবার। সকালবেলা যখন জমাদারনি এসে ঘরটা ঝাড়ু দেন তখন। বাইরের দুনিয়ার সাথে একমাত্র যোগসূত্র সেই জানালার ফাঁকটুকু। এই জানালা যেন মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার প্রতীক। 
পরের গল্পটি অশ্রুগাছ। যুগযুগ ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক জাতিস্মর বৃক্ষের গল্প। প্রোডাক্ট গল্পে প্রকাশ পেয়েছে একজন মেয়ের আকুতি। একজন মায়ের তার অনাগত সন্তানকে সন্তানকে 'প্রোডাক্ট' বলাতে খারাপ লাগে। জীবনের প্রয়োজনে কোন সন্তানকে বিসর্জন দিলেও কি মেয়েদের মনে তার জন্য ভালোবাসা তৈরি হয় না? এই গল্পটা একজন মেয়ের, মায়ের এবং চিরায়ত মাতৃত্বের। 
'মাটি' গল্পে লেখক মাটির মুখ দিয়ে মানব সভ্যতার বিধ্বংসী দিকগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে আমাদের যে গর্ব আবার সেই মানুষই নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসছে। তাহলে কি আসলেই মানব জন্ম সার্থক? এই গল্পের একটা লাইন এমন - 'প্রাণীকূল তাকে যতই অসম্মান করুক আর কষ্ট দিক, সবাই শেষকালে তার অতলেই ঠাঁই নেবে।'
'অ-সুখের শব্দ' গল্পটা এক ধরণের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার গল্প। 'সো হোয়াট' গল্পে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের তুলনামূলক চিত্র আঁকা হয়েছে। আমরা একজন অন্যজনের তুলনায় বিভিন্ন দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকি সবসময় কিন্তু আমরা ভুলে যায় দিনশেষে আমরা সবাই মানুষ। 'জয়ন্তর সাদা বল' স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা এক বৃদ্ধের গল্প। যার শৈশব স্মৃতি তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অথবা এই স্মৃতিই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। আসলে মানুষ বাঁচে তার শৈশবে এরপর বাকি জীবন সেই স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়ায়।
'ডুব সাঁতার' সমলিঙ্গের ভালোবাসার গল্প। এই ভালোবাসাটা আসলে কেমন? লেখক সেদিকে আলোকপাত করেছেন। 'সাং বেতুয়ান' গল্পটা সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর চিরায়ত দ্বন্দ্বের গল্প। পাশাপাশি উঠে এসেছে গ্রামীণ মানুষদের জীবন বোধ। এই গল্পের কয়েকটা লাইন এমন - 'হেকেক সময়ে ঠাকুরই মাইনষের কদর বাড়ায়, আবার কমায়। সেই লোভেই মানুষ বাঁইচে থাকে।'
'একটা বেমানান পাখি' একটা জীবনের আর্তনাদের গল্প।ফাল্গুনের ইশতেহার যেন নতুন এক ফাল্গুনের গল্প। ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত ছিলো আমাদের স্বাধীনতার বীজ। সেটাই কালে কালে যুগে যুগে যেন বিভিন্ন রূপে ফিরে ফিরে আসে। গোলাইচাঁদের খাবনামা যেন আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার চালায়। 'নিহতস্বপ্নের শেষে' গ্রামীণ জীবনের প্রতিবেশীদের সাথে চিরায়ত বিবাদের গল্প। কিন্তু সেই বিবাদ শিশুমন কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারে না। আর ত্রাণ তো একেবারে উত্তরাধুনিক একটা গল্প। যেখানে সবকিছুই শো অফ।
প্রত্যেকটা গল্পের চরিত্রের মানসিকতার বিশ্লেষণ থেকে দৃশ্যের বর্ণনার পুঙখানুপুংখ বিবরণ গল্পগুলোকে করে তুলেছে সুখপাঠ্য। পাশাপাশি আঞ্চলিক শব্দ চয়ন, উচ্চারণ, বাক্যগঠন প্রাসঙ্গিক কাল পাত্র গল্পের প্লটকে পাঠকের সামনে একেবারে মূর্ত করে তোলে। এই বই কেউ একবার পাঠ শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
মো: ইয়াকুব আলী
বিষয়: মোঃ ইয়াকুব আলী

 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: