সিডনী শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব চার) : হাবিবুর রহমান স্বপন


প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:১২

আপডেট:
১৭ মে ২০২৪ ২১:২৩

 ছবিঃ হাবিবুর রহমান স্বপন


খেলাধুলা ও শিল্প সংস্কৃতিতে সাঁথিয়া বেশ অগ্রগামী ছিল। ফুটবল, হাডুডু ছিল অন্যতম খেলা।
সাঁথিয়া ফুটবল মাঠে প্রতিদিন নিয়মিত ফুটবল গড়াতো। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা হতো প্রতিবছর। গ্রামে গ্রামে হাডুডু খেলা হতো। প্রতিযোগিতামূলক হাডুডু খেলায় প্রচুর দর্শক সমাগম হতো। প্রায় প্রতিটি গ্রামে ছিল হাডুডু দল।
সাঁথিয়ায় ছিল কয়েকটি ফুটবল টিম। সাঁথিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ইয়ং ক্লাব, মর্নিং স্টার, ইলেভেন স্টার ফুটবল টিম তাদের মধ্যে অন্যতম। ছেঁচানিয়া, পুরানচর, ধোপাদহ, পুণ্ডুড়িয়া, গোপিনাথপুর মাঠে ফুটবল খেলা হতো নিয়মিত। ছেঁচানিয়া একাদশ ছিল অত্র এলাকার ভালো টিম। ভালো ফুটবল খেলোয়ারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দৌলতপুরের নরেশ সেন, পরেশ সেন, বোয়াইলমারীর মোসলেম উদ্দিন, খোদাবক্স, মকবুল হোসেন মুকুল, মজিবর শেখ, আবু জাফর, লোকমান হোসেন প্রমুখ।
ছেঁচানিয়া টিমের দীর্ঘকায় খেলোয়ার সোলায়মান ছিলেন অত্রাঞ্চলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়।
স্বাধীনতার আগে ও পরে সাঁথিয়া ফুটবল মাঠে দেশের বিভিন্ন স্থানের উল্লেখযোগ্য ফুটবল টিম ফুটবল খেলতে আসতো। রাজশাহী, বগুড়া, সৈয়দপুর, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী রেলওয়ে টিম আলহাজ্ব টেক্সটাইল টিমের খেলা ছিল উল্লেখযোগ্য। ফুটবল খেলায় কমবেশি মারামারি হতো। বর্ষাকালে নৌকা বাইচের সময়ও মারমারির ঘটনা ঘটেছে। তবে বড় কোন অঘটন এসব খেলাকে কেন্দ্র করে হয়নি।
সাঁথিয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল জমজমাট। যাত্রা, নাটক এবং সার্কাস দল ছিল সাঁথিয়ায়। মাস্টার অপেরা ছিল উল্লেখযোগ্য একটি যাত্রা দল। এ ছাড়া নাটক করতো সবুজ সংঘ, ইয়ং ক্লাব। স্বাধীনতার পর এসব সাংস্কৃতিক সংগঠন কিছুদিন কার্যকর ছিল। তারপর বিলুপ্ত হয়ে গেছে সৌখিন সাংস্কৃতিক চর্চা।
সত্য সরকার ছিলেন মাস্টার অপেরার প্রাণপুরুষ। তিনি সত্য মাস্টার নামে সুপরিচিত ছিলেন। সারাদেশে তিনি যাত্রাপালায় অভিনয় এবং পরিচালনা করতেন। বেশ কয়েকজন শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন সাঁথিয়ায়। তাদের মধ্যে উল্লখযোগ্য ছিলেন, গাজী মাস্টার, গোলজার হোসেন, পাশু মাস্টার, রাজা মাস্টার, হারুণ মাস্টার, গাইস্যা নাপিত, উপেন্দ্রনাথ পাল, বিনয় হালদার প্রমুখ। সোনাতলার আব্দুস সাত্তার ও সাঁথিয়ার গোকুল পাল নারী চরিত্রে দারুণ অভিনয় করতেন।
শীতকালে প্রতিবছর বড় মাঠে যাত্রাপালা হতো। নারী পুরুষ দলে দলে যাত্রা দেখতে যেতো। সারারাত চলতো যাত্রা। বড় বড় সার্কাস পার্টি আসতো সাঁথিয়ায়। সত্য মাস্টারের বড় ছেলে দুলাল বাবু একটি সার্কাস পার্টি গঠন করেছিলেন।দৌলতপুরের রবি পাটনি ছিলেন তার পরিচালক।
স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে সৌখিন নাট্য চর্চা হতো। এসব নাটক মঞ্চস্থ হতো সাঁথিয়া বড় ফুটবল মাঠে, বোয়াইলমারী বাজারের মধ্যে। নাটক দেখতে বিভিন্ন গ্রামের লোকজন আসতো। যথেষ্ট নারী দর্শক সমাগম হতো। এখন তা কল্পনারও অতীত।
সাঁথিয়ায় আরও একটি উল্লেখযোগ্য খেলা ছিল তাস খেলা প্রতিযোগিতা। তাস খেলা হতো ঢোল বাদ্য বাজিয়ে। ব্রিজ কমপিটিশন। প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতা হতো আমাদের বাড়ির বহিরাঙ্গনের বৈঠক ঘরে।
সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে লিগ পদ্ধতিতে খেলা হতো। সপ্তাহব্যাপী খেলায় অংশ নিতেন বোয়াইলমারীর রওশন মিয়া, তেঁতুলিয়ার জব্বার মিয়া, কালিপদ সাহা, বুদ্ধিশ্বর নাপিত, গোলজার মিয়া প্রমুখ। ফাইনাল খেলার দিন ব্যান্ড পার্টি বাজনা বাজাতো। বিজয়ী দলকে পুরস্কার দেয়া হতো এবং মালা পড়িয়ে প্রদক্ষিণ করা হতো।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে নানা প্রকার খেলাধূলার আয়োজন করা হতো। ফুটবল, হাডুডু, নৌকা বাইচ ছাড়াও হতো ভলি ও ওয়াটার পোলো খেলা প্রতিযোগিতা। পানির মধ্যে কলাগাছের ভাসমান গুড়িতে গোলপোস্ট তৈরি করে সাঁতরে হাত দিয়ে গোল করার নাম ওয়াটার পোলো। খেলাটি বড়রা খেলতো আর আমরা বেশ উপভোগ করতাম। নদীতে হতো সাঁতার প্রতিযোগিতা।
আমাদের শিশুকালে এসব খেলাধুলা এবং নাটক যাত্রাই ছিল চিত্তবিনোদন। আমরা মার্বেল ও লাটিম খেলতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই লাটিম এবং মার্বেল নিয়ে মেতে উঠতাম।
নৌকা বাইচ ছিল অন্যতম বিনোদন। গৌরীগ্রাম ইউনিয়নের সাধু চেয়ারম্যান, আফড়ার আমানত, পোয়ারিয়ার নৌকা ছিল প্রসিদ্ধ। নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় সেরা দল ছিল শরিষা, ভিটাপাড়া এবং আফড়া গ্রামের। নৌকা বাইচের আগে ও পরে মাঝিরা মজার মজার সারি গান গাইতো মধুর সুরে। নৌকা বাইচ উপলক্ষে তিন/ চারদিনব্যাপী মেলা বসতো নদী তীর বরাবর এবং বোয়াইলমারী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে। প্রচুর দর্শক সমাগমে বাজার এলাকা জমজমাট হয়ে থাকতো।
তখন সাংস্কৃতিক চর্চা বা চিত্ত বিনোদন ছিল সরাসরি। সিনেমা বা টেলিভিশন এখনকার মতো এতো সহজলোভ্য ছিল না।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সাঁথিয়ায় মাত্র তিন/চারটি রেডিও ছিল। দৌলতপুরের মাজেদ মিয়া, জিতু দারোগা, সাঁথিয়া বাজারের শান্তি মাস্টার (জ্যাতিন্দ্রনাথ পাল) এবং আমাদের। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের খবর শুনতে বহু শ্রোতা সমাগম হতো আমার পিতার ডিসপেনসারিতে।
১৯৭৯ সালে সাঁথিয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া শুরু হয়।

 


হাবিবুর রহমান স্বপন
লেখক ও সাংবাদিক

 

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া: পর্ব ১
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ২)
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ৩)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top