সিডনী মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৮

আপডেট:
৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৮

ছবিঃ ক্রেতাদের সাথে হারুন রশীদ

 

দেশ এখন আর কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যেখানেই বাংলাদেশের মানুষ গিয়েছেন সেখানেই এক টুকরো বাংলাদেশ তৈরি হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়াতেও অনেক বাংলাদেশি বহু বছর ধরে সুনামের সাথে বসবাস করছেন বিশেষকরে সিডনিতে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। সিডনিতে বাংলদেশী মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশি দোকান, রেস্তোরা সংখ্যায় এখন অনেক। এসব দোকানে পাওয়া যায় বাংলাদেশ থেকে আসা 'ফ্রোজেন' শাকসবজি। সেগুলোর গুণমান নিয়ে প্রশ্ন নেই কিন্তু ফ্রোজেন হওয়াতে এগুলোর স্বাদ আসল স্বাদের কাছাকছি হয় না। অবশ্য অনেকেই নিজ বাড়ির আঙিনায় বাংলাদেশীয় সবজির চাষ করে থাকেন কিন্তু পরিমাণের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।


ছবিঃ রামিনস ফার্মের স্বত্বাধিকারী হারুন রশীদবাংলাদেশের তরতাজা শাকসবজি প্রবাসী বাঙ্গালদেশিদের হাতে তুলে দেবার ইচ্ছা থেকেই ২০১৬ সালে বাংলাদেশের একজন উদ্যমী তরুণ হারুন রশিদ গড়ে তোলেন রামিনস ফার্ম। শুরুতেই উনার সাথে পরিচিত হওয়া যাক। উনার জন্মভূমি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায়। ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের সংস্পর্শে। এরপর একসময় দেশান্তির হন। সেটা ২০০৯ সালের কথা। সিডনির 'ইউনিভার্সিটি অব ওলোংগং' থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর পেশাদার রংমিস্ত্রি (পেইন্টার) হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু মাটি এবং মানুষের কাছাকাছি শৈশব এবং কৈশোর পার করা হারুনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল আবহমান গ্রাম বাংলার মায়াবতী সবুজ প্রকৃতি।
এরপর সেই ভাবনাকে কাজে পরিণত করেন ২০১৬ সালে। আরো দুজন শুভাকাংখিসহ সিডনির লেপিংটনে মাত্র পাঁচ একর জমি ইজারা নিয়ে শুরু করেন বাংলাদেশি শাকসবজির ক্ষেত। অন্য দুজন অংশীদার থাকলেও ক্ষেতের বেশিরভাগ কাজকর্ম নিজের হাতেই করতেন। আর ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে নিতেন রঙ মিস্ত্রির কাজও। এভাবেই চলছিল প্রথম দুই বছর। কিন্তু এতেকরে কোনদিকেই তিনি ভালো ফল পাচ্ছিলেন না। আর ক্ষেতে কোনভাবেই লাভের দেখাও মিলছিল না। ক্ষেতের ক্ষতির ব্যাপারটা চাক্ষুষ হতেই দুই বছর শেষেই অন্য দুজন সরে পড়েন। কিন্তু তিনি ক্ষতি স্বীকার করেও আবেগ থেকে ক্ষেতটা ধরে রাখেন। এরপর একসময় তিনি রঙ মিস্ত্রির কাজটা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ক্ষেতে মনোনিবেশ করেন। সেটা ২০১৮ সালের কথা।

ছবিঃ রামিনস ফার্মে এসে প্রবাসী প্রজন্ম ফিরে যায় শিকড়ের কাছে
নিজে সম্পূর্ণ সময় ক্ষেতে দিয়েও কাজকর্মে কুলিয়ে উঠতে না পারায় আরও দুজন মানুষকে নিয়োগ দেন। এভাবেই একসময় ক্ষেতের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাশপাশি ততদিনে সিডনির বাংলাদেশি কমিউনিটিতে একটা আলাদা পরিচয়ও তৈরি হয়ে গেছে। যিনিই একবার রামিনস ফার্মে গেছেন তিনিই শুভাকাঙ্খী হয়ে উঠেছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে হারুন সাহেবের অমায়িক ব্যবহারের কারণে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা বিষয় আমার খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। সেটা হচ্ছে ক্রেতার সাথে তাদের দুর্ব্যবহার। প্রথম এক দুই দিন হয়তোবা তারা ভালো ব্যবহার করেন। এরপর অবধারিতভাবে কেন জানি খারাপ আচরণ চলে আসে তাদের ব্যবহারে। কিন্তু হারুন সাহেবের সদা হাসিমুখটা সবার কাছেই প্রিয় হয়ে উঠেছে সময়ের সাথে সাথে। এভাবেই বাংলাদেশি কমিউনিটিতে রামিনস ফার্ম বাংলাদেশি তরতাজা শাকসবজির এক নির্ভরযোগ্য নামে পরিণত হয়।
এভাবেই রামিনস ফার্মের নাম একসময় ছড়িয়ে পড়ে প্রবাসী অন্যান্য কমিনিটিতেও। বাংলাদেশিদের বাইরে নেপালি, ভারতীয়, চাইনিজ কমিউনিটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও স্থানীয় আদিবাসীদের কাছেও পৌঁছে যায় রামিনস ফার্মের নাম। তাদের উৎসবে রামিনস ফার্মের কচুর পাতা (তারো লিভস) অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এরপর রামিনস ফার্মের শাকসবজির নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো অস্ট্রেলিয়াজুড়ে। তাদের চাহিদা মেটাতে একসময় অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য রাজ্যে কুরিয়ারে সবজি পাঠানো শুরু হয়। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যাবনবেরা থেকে কিছু দোকান সরাসরি পণ্য সংগ্রহ শুরু করে। তারা খুব ভোরে ক্যানবেরা থেকে রওনা দিয়ে রামিনস ফার্ম থেকে সবজি নিয়ে আবার দুপুরের আগেই ক্যানবেরা ফিরে যায়। তারপর সেই সবজি শেষ হলে আবার একইভাবে এসে নিয়ে যায়।
সবজির বাড়তি এই চাহিদা যোগান দিতে পাশেই আরো পাঁচ একরের আরো একটি জায়গার ইজারা নিতে হয়। সেখানেও একইভাবে চাষ করা শুরু হয় বাংলাদেশি শাকসবজি। আর পাশাপাশি নতুন জায়গার মজা পুকুরটার সংস্কার করে সেখানে ছাড়েন মাছ। আর পুকুরপাড়ে বুনে দেন মিষ্টি আখ। ক্রমবর্ধমান সবজির চাহিদা পূরণে এ বছর আরো সাত একর জমি ইজারা নেয়া হয়েছে। আর এই তিন জায়গায় হাওয়ায় দোল খায় বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রজাতির লাউ এবং শিম, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, ধুন্দল, চিচিঙ্গা, কচু শাক, কচু, কচুর লতি, বিভিন্ন রঙের এবং আকারের বেগুন, মুলা, মুলাশাক, পালং শাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, সর্ষের শাক, মটরশুটির শাক, ফুলকপি, পাতাকপি, টমেটো, কচি এবং পাকা চালকুমড়া, উচ্ছে, আদাসহ আরো অনেক সবজি । পরীক্ষামূলকভাবে একবার চাষ করা হয়েছিল কাকুরও। এখন পরিকল্পনা করা হচ্ছে কাঁকরোল এবং পটল চাষের। তবে আলাদাভাবে বলতে হবে এখানকার মরিচ, ধনেপাতা, বৈথার শাক, মেথির শাক, পাটশাক আর কুমড়ো ফুলের কথা। রামিনস ফার্মের মরিচ ঝালের কারণে এখন সবার কাছেই আদরণীয়। আর ধনেপাতার সুবাসে এখন বাংলাদেশিদের হেঁসেলঘর মৌ মৌ করে। রামিনস ফার্মের কুমড়ো ফুলের কারণে এখন মানুষ প্রবাসেও ফুলের বড়া খেতে শিখে গেছে। আর বিলুপ্তপ্রায় বৈথার শাক এবং মেথির শাক এই প্রবাসেও ফিরে এসেছে সগর্বে।
রামিনস ফার্ম সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থানও করেছে। প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের কাছে এখন রামিনস ফার্ম এক ভরসার নাম। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক তরুণই এখন সেখানে কাজ করে নিজের ব্যয় নির্বাহ করে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্যোগের সময় রামিনস ফার্ম তার যথাসাধ্য নিয়ে এগিয়ে আসে। রামিনস ফার্ম শুরু থেকেই নিজেদের কাজের মানকে আরও কিভাবে ভালো করা যায় সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন রামিনস ফার্মে সুনির্দিষ্ট গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা আছে। প্রবেশপথের দুপাশে এবং বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে লাগানো হয়েছে সুন্দর সব ফুলের চারা। সবজির সবুজের পাশপাশি বিভিন্ন ফুলের বাহারি রঙ নিমেষেই ক্রেতাদের মনের ক্লান্তি দূর করে দেয়। আর সতর্কতাবাণীসহ বিভিন্ন সাইনবোর্ডও বসানো হয়েছে। এতেকরে ব্যস্ত সময়ে সবাই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কেনাকাটা করতে পারে। উদ্বৃত্ব সবজি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে ঠান্ডা ঘর। এছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদা মাথায় রেখে এখন বিভিন্ন গাছের চারাও সুলভ মূল্যে বিক্রয় করা হয়। পাশাপাশি ক্রেতারা যাতেকরে ঘরে বসেই কেনাকাটা করতে পারেন তার জন্য তৈরি করা হয়েছে ওয়েবসাইটও। তবে ক্রেতারা ফার্মে এসে সরাসরি কিনতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।



রামিনস ফার্মের এই যাত্রাপথ মোটেও সুগম ছিল না। প্রথম বাধা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার বৈরি আবহাওয়া। বলাহয়ে থাকে এখানে একইদিনে চার ঋতুর দেখা পাওয়া যায়। আবার কখনও শীতকাল প্রলম্বিত হয়। সাথে সাথে বেড়ে যায় শীতের মাত্রাও। আবার কখনও গরমের তীব্রতাও বেড়ে যায়। কখনও কখনও অতিবৃষ্টিতে দেখা দেয় হঠাৎ বন্যা (ফ্লাশ ফ্লাড)। এছাড়াও আছে স্থানীয় ক্যাঙ্গারুর আক্রমণ। এইসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে গাছ বড় করা এবং সেখানে ফল ফলানো রীতিমত ঝক্কির এবং ধৈর্যের ব্যাপার। করোনার সময়টায় ছিল টিকে থাকার আরেক ঝুঁকি। তখন হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে সবজি পৌঁছে দেয়া হতো বাড়ি বাড়ি। বাংলদেশের মাটিতে একটা বীজ ফেলে দিলেই চারা গজিয়ে যায়। একসময় সেই চারাগাছ বড় হয়ে ফুলেফলে ভরে উঠে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে একটা চারা তৈরি করা আবার সেটাকে বড় করা অনেকটা মানুষের বাচ্চা পালার মতো পরিশ্রমের ব্যাপার। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক মনোবল থেকে সেটা সম্ভব না বলেই আমার বিশ্বাস। এরজন্য দরকার সবুজের জন্য, গাছের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। কারণ অন্য অনেক পথেই সহজেই এখানে টাকা আয় করা সম্ভব। কিন্তু শাকসবজির খামার করে সেখান থেকে লভ্যাংশ তুলে আনা মুটামুটি অসম্ভব। এখন পর্যন্ত রামিনস ফার্ম কেবল অর্থনীতির 'ব্রেক ইভেন্ট' পার করতে পেরেছে। পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ।


রামিনস ফার্ম প্রবাসী বাংলাদেশি প্রজন্মকে তার শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এখানে যারা কেনাকাটা করতে আসেন তারা প্রায় সবসময় বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে আসেন। এতেকরে পরবর্তি প্রজন্ম বাংলাদেশের সবুজ সম্মন্ধে ধারণা পায়, সবুজের প্রতি ভালোবাসা জন্মা নেয় তাদের বুকে। আবার প্রবাসে বেড়াতে আসা প্রবীণরা আবেগী হয়ে পড়েন সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে একখন্ড সবুজ বাংলাদেশকে আবিষ্কার করে। হাত তুলে নাতি নাতনিদের দেখিয়ে বলেন, দাদুভাই এমনই সবুজ, মায়াময় এবং প্রাণবন্ত ছিল আমাদের শৈশব। অনেকসময় আবার উনারা ক্ষেতের মধ্যে বসে নিজ হাতে তুলে আনেন প্রয়োজনীয় পণ্য। এছাড়াও অন্যান্য দেশের প্রবাসী এবং স্থ্যনীয়দের কাছে এখন বাংলাদেশের অপর নাম রামিনস ফার্ম। শুরুতেই যে কথাটা বলেছিলাম সেখানে ফিরে আসি। দেশ আসলে এখন আর কোন নির্দিষ্ট ভুখন্ড নয়। আমি, আপনি, আমাদের আচার-ব্যবহারই দেশের পরিচয় বহন করে। আমি আপনিই বাংলাদেশের এক একজন ব্র্যান্ড এম্বাস্যাডর। রামিনস ফার্ম আর হারুন ভাইয়ের সদাহাস্যমুখ অস্ট্রেলিয়াতে এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্র্যান্ড।

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top