সিডনীতে বসন্ত ঋতুর অপরূপ মাধুর্য্য : শাহান আরা জাকির
প্রকাশিত:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৪৪
আপডেট:
৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:০৩
সিডনীতে এখন বসন্তের আমেজ চারদিকে । সবুজ বনান্তে ঘেরা এখানকার প্রকৃতিতে এই শীত আবার এই বৃষ্টি। এই ঝলমল রৌদ্র। বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে গভীর একটা খাপ খাওয়ানোর সামঞ্জস্য দেখা যায় এখানে। অস্ট্রেলিয়ার পঞ্জিকা অনুযায়ী, এখানে বসন্তকাল শুরু হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে। তাই ঘুম ভাঙলেই ভোরের বাতাসে বসন্তের বার্তা পাওয়া যায় । এখনকার আবহাওয়াকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে বলা চলে মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন শুরু হয়েছে। ভোরে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা, কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা বাড়তে থাকে। বেলা ১০টার পর তাপমাত্রার পারদ অনেক উপরে উঠে যায়। আবার সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে তাপমাত্রা পড়ে যায়। তখন আবার ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। এভাবেই বোঝা যায় ঋতু পরিবর্তনের বিষয়টা। সকালের বাতাস থাকে নাতিশীতোষ্ণ ও কোমল। এ বাতাস খুব গায়ে মাখতে ইচ্ছা করে।
মাঝেমধ্যে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে গাছের পাতার নড়াচড়া দেখে
মনের মধ্যে বেজে চলে কবিগুরুর গানের কলি۔۔۔۔۔
‘ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল,
দ্বার খোল, দ্বার খোল।’
বসন্ত শুরু হবার আগে শীতের সিডনীকে মনে হয় নির্জীব এক শহর। গাছগুলো তখন পাতা ঝরিয়ে যেন বিশ্রাম নেয় আর তৈরি হয় বসন্তের জন্য।প্রকৃতির নিয়মে সময়ের ডানায় ভর করে শীতের পরপরই আসে বসন্ত।
গাছে গাছে নতুন পাতা আর ফুলের সুশোভন মেলা বসে যায়।
জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে ۔۔
এ সময় পুরো সিডনী শহর এর প্রকৃতি নতুন রূপে ভেজা ভেজা শীতল সবুজে যেন সেজে ওঠে। অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের সিগনেচার ফুল জ্যাকারান্ডা। এখন অপরূপ সেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। শীতের নির্জীব গাছে পাতা আসার আগেই বেগুনি রঙের এই ফুল ফুটে গাছটাকে একেবারে পুরোপুরি বেগুনি রঙের চাদরে ঢেকে দেয়। শিল্পীর চোখে তখন সিডনি শহরকে দেখলে মনে হবে যেন কোন শিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে অপার আনন্দে সিডনি শহরকে বেগুনি রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন।
বসন্তের একেবারে শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ফুল ‘দ্য ইয়েলো ওয়াটল’ ফুটে তখন চারপাশটা সোনালি রঙে ছেয়ে যায়। এর পাশাপাশি আরও হাজারো রকমের ফুল ফোটে গাছে গাছে। ‘ফ্লেম ট্রি’ বলে একধরনের গাছে আসে আগুন রঙের লাল ফুল। বাংলাদেশের যেমন ‘পলাশ–শিমুল বনে আগুন লাগে’, এখানে ঠিক তেমনি পাতাবিহীন ফ্লেম ট্রিতে আগুন লেগে যায়। এ জন্যই হয়তোবা এই গাছের এমন নামকরণ।
এখানেও পাখি গান গায়!কোকিলের কুহু গান এ মুখরিত হয় এখানেও।
কোকিলের এই গান মনে করিয়ে দেয়۔۔۔۔
‘কুহু কুহু শোনা যায় কোকিলের কুহুতান-
বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে’-
এখানে এখন বসন্তের আগমনে ফুটেছে চাইনিজ জেসমিন।
বসন্তের ‘লিলুয়া বাতাস’–এ ভেসে আসে বিভিন্ন ফুলের মৌ মৌ সুবাস। মাঝে মাঝে রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতেই থমকে দাঁড়াতে হয় ফুলের সুবাসে।
এ সময় ফোটে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ফুল গোল্ডেন ওয়াতল। দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের বাবলা ফুলের মতো। বাংলাদেশের বসন্তের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও দেশীয় অনেক ফুলের দেখা মেলে, যেমন কামিনী, মান্দার ইত্যাদি। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় বাংলাদেশেই আছি। ঝিরঝির বাতাস বয় । কখনো দমকা বাতাসে সব উড়িয়ে নিয়ে যায় যেন। ঝর্নাধারায় চলে পাহাড়ের সাথে নৃত্য। কখনো আচমকা বৃষ্টির ঝুমুর তাল-মনে হয় যেন বর্ষার আবার শুরু। লেকের টলমলে জলে ঢেউ খেলে। নয়ন জুড়িয়ে যায়!জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখি। বাতাসের দোলায় উথাল পাথাল সারি সারি দীর্ঘ বৃক্ষগুলির তান্ডব নৃত্য উপভোগ করি। চোখ বন্ধ করে থাকি আমি তখন অনেক ক্ষণ। যেন আমি পৌঁছে গেছি আমার দেশে, আমার স্বপ্নের বেলাভূমিতে ।
চারদিকে ঘিরে আছে আমার আপনজন, প্রিয়জন .....
ফিরে পাই ফেলে আসা দিনগুলো!অদ্ভুত মিষ্টি একটা সান্যিধ্যের ছোয়া অনুভব করি। স্পর্শ পাই খুব কাছের সুহৃদজনদের। সোদা মাটির কাছে টানার একটা মায়াবি গন্ধ এসে লাগে নাকের চারপাশটায়।
মৌ মৌ ফুলের সুবাস। এখানেও দেখতে পাই দোয়েল শ্যামার নাচন । ঘুঘুর ডাক আর ভ্ৰমরের চুলবুলানি গুন্ গুন্ গুন্ গানের মহড়া। আচানক দমকা বাতাসে আবার ফিরে আসি প্রবাসের বাসভুমিতে। আসলে প্রকৃতি সবখানেই মায়াবি । ছোট্ট দুটি চোখে যেন এতো মাধুর্য্য ধরেইনা আমার!মনে হয় তখন ۔۔۔۔۔ইস যদি আকাশজোড়া চোখ দুটি থাকতো আমার!আর এক সমুদ্র হৃদয়খানি۔۔۔۔۔
তাহলে ঠিক ঠিকই আমি যেখানে যে দেশেই যাই বা থাকিনা কেন, প্রকৃতির সবটুকু মাধুর্য্য হৃদয়ের লাগেজটিতে আর দুচোখের সমুদ্রে টইটম্বুর করে ভরে রাখতাম।
সিডনীতে এখন টানটান বসন্তের আমেজ। হঠাৎ রৌদ্র আবার হঠাৎ মেঘলা আকাশ।
আর বাংলাদেশে এখন শরতের কাশবন আর হেমন্তের নবান্ন উৎসবে মেতে উঠেছে গ্রামবাংলা!
দুদেশের প্রকৃতি আমাকে একসাথে সঙ্গ দেয় ।
কখনো বাসন্তী ছোয়ায় মনে সুর তোলে۔۔۔۔۔۔
আহা ۔۔আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে ۔۔۔কত পাখি গায় ۔۔য়۔۔ য়۔۔۔
আবার এখান থেকেই আমার জন্মভূমির স্পর্শ শরতের শেষে হেমন্তের ছোয়া পাই গ্রামবাংলার গুচ্ছ গুচ্ছ কাশবনের স্নিগ্ধ রূপের মহিমায়।
এখানেও রাস্তার ধারে আছে লালচে রঙের কাশ ফুলের ঝাড়।
দুহাত ভোরে কাশফুলগুলো মনের আনন্দে চেপে ধরি আর অনুভব করি আমার স্বদেশের হেমন্তের স্পর্শ ۔۔۔
"হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী
পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
বকুল ডালের আগায়
জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়"۔۔۔۔
রবি ঠাকুরের গানের দোলায় মন প্রানে নাচন লাগে আমার সিডনীতে বসে বসেই। চোখ বুজে অনুভাব করি, ঠিক যেন বসে আছি আমার দেশের মাটিতেই!আসলে প্রকৃতি সবদেশেই অপরূপ সুন্দর। শুধু দেখার জন্য মন ও মনন চাই।
রাব্বুল আমাদের উপভোগ ও আনন্দের জন্য অফুরন্ত সৌন্দর্য্যের ভান্ডার উজাড় করে দিয়েছেন। যেখানে যে যেভাবেই থাকিনা কেন আসুন ভালোবাসি প্রকৃতিকে ।
ভালোবাসি ও কৃতজ্ঞতা জানাই সৃষ্টিকর্তাকে।
"এই সুন্দরও ফুল সুন্দরও ফল মিঠা নদীর পানি۔۔۔۔
খোদা ۔۔۔তোমার মেহেরবানী"۔۔
কথা সাহিত্যিক, নাট্যকার ও গবেষক
বিষয়: শাহান আরা জাকির পারুল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: