সিডনী শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


সাহারা খাতুন আর নেই, এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান


প্রকাশিত:
১০ জুলাই ২০২০ ১৭:০০

আপডেট:
১৮ মে ২০২৪ ০০:৩৩

 

প্রভাত ফেরী: সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

ঢাকা-১৮ আসনের এই সংসদ সদস্য বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২৫ মিনিটে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মারা যান। তার ব্যক্তিগত সহকারী মুজিবুর রহমান বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। অসুস্থ সাহারা খাতুনকে গত ৬ জুলাই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়।

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পৃথক শোকবার্তায় মরহুমার রুহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তারা।

সাহারা খাতুন জ্বর ও অ্যালার্জির সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় অসুস্থ হয়ে গত ২ জুন ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। কিডনি ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতাও ছিল তার। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৯ জুন তাকে প্রথম দফায় আইসিইউতে নেওয়া হয়।

অবস্থার উন্নতি হলে ২২ জুন তাকে আইসিইউ থেকে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) স্থানান্তর করা হয়। ২৬ জুন সকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবারও আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে গত সোমবার থাইল্যান্ডে নেওয়া হয় তাকে। পরে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান: বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সফল রাজনৈতিক সংগঠকের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতেন।

১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলা গ্রামে বাবার বাড়িতে তার জন্ম। সাহারা খাতুনের বাবার নাম মরহুম আবদুল আজিজ ও মায়ের নাম তুরজান নেছা। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ইস্ট-পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। সিটি নাইট কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর জগন্নাথ কলেজে বিএ কোর্সে ভর্তি হন। পরে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ (ডিগ্রি) অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি কোর্স শেষ করেননি। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতিতে নাম লেখান। আইনপেশায় আসার পর সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যখন গঠিত হলে তাতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন এবং সারা ঢাকা শহরে মহিলাদের আইভি রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত করতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জাতীয় নেতা মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা গঠন করে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই মিছিল মিটিং সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করেছেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা তখনকার ছাত্রলীগ নেত্রীর সাথে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মহিলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক, পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদিকা এবং একই সাথে নগর আওযামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-আইন সম্পাদিকা, পরে তিনি আইন সম্পাদিকা নির্বাচিত হন, তখন তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদ এবং মহিলা আওযামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ আর গ্রহণ করেননি। অতঃপর তিনি পরবর্তী কাউন্সিলে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। এখনও তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আছেন।

রাজপথের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সরব। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, আইয়ুব-ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলন, দেশ স্বাধীনের আন্দোলন, ৭৫’র পর অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং খালেদা জিয়ার নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন করেছেন রাজপথে। রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে হরতাল, সভা-সমাবেশ করতে গিয়ে একাধিকবার গ্রেফতার এবং নির্যাতিত হয়েছেন।

আইনপেশায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের বহ সংখ্যক নেতাকর্মীর মামলা বিনাপয়সায় লড়েছেন। যারা আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন তারা জানতেন জামিনের জন্য অ্যাডভোকেট সাহারাসহ আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা আছেন। আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের কাছে ভরসার জায়গা ছিলেন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। এমনিভাবে সারাজীবনের আইনপেশায় তিনি আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর পেছনে লড়েছেন এবং তাদের জেল থেকে মুক্ত করেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর আগে ফখরুদ্দিন, মঈনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতার করা হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার সঙ্গে আবারও গ্রেফতার হন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তিনি ছিলেন কল্যাণমূলক রাজনীতির অগ্রদূত ও ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার খুব প্রিয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাহারা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০৮ এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর মন্ত্রিসভা গঠনের সময় ডাক পড়ে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের। তিনি শপথগ্রহণ করেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে তার দফতরে প্রবেশ করেন। ২০১২ সালে মন্ত্রণালয়ের রদবদল ঘটলে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

২০০৯ সালের অওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এর আগে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন সদ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হলে তিনি দ্বন্দ্ব সমাধানে নেতৃত্ব করেন। বিদ্রোহীদের খারাপ দিকটার সুরাহা করেন। যেটা সৈনিকদের পক্ষে ও বাংলাদেশ রাইফেল অফিসারদের বিরুদ্ধে যায়। যারা বাংলাদেশের আধাসামরিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তিনি সেখানে বাংলাদেশ রাইফেলের ক্যাম্পাসের কাছে গিয়েছিলেন। তাদের মাঝে আপসের জন্য উদ্দীপনামূলক কথা বলেন এবং বিদ্রোহীদের অস্ত্র জমা দিতে বলেন।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top