সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


গ্যাস সংকটে ধুঁকছে সার কারখানা


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:৩৭

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০২:০০


দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইউরিয়া সার কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এই চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে প্রায় দ্বিগুণ দামে ইউরিয়া সার আমদানি করতে হচ্ছে। এতে আমদানি করা সারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এর পরও বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। ফলে কৃষিপণ্যে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।


কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত বছরের এপ্রিলে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ২৭ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে। অথচ দেশের যেসব করখানা রয়েছে, সেগুলো যদি পুরো সক্ষমতায় ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে পারে, তাহলে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে প্রায় ২০ টাকা।


কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস না পাওয়ার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানির অনুমতি দেয়, যেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব থেকে ৬০ হাজার টন ইউরিয়া আমদানি করছে সরকার। এর মোট দাম ২৫২ কোটি ৬৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ টাকা।

এই হিসাবে প্রতি মেট্রিক টন সারের আমদানি খরচ ৪২ হাজার ১০৫ টাকা।


প্রতি কেজি সারের দাম পড়ে ৪২ টাকা। কিন্তু সরকার কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার বিক্রি করে ২৭ টাকা। এতে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দিতে হয় প্রায় ১৫ টাকা।

সার উৎপাদন ও আমদানির ব্যবস্থাপনায় রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। দেশের চাহিদা অনুযায়ী কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে তারা ইউরিয়া সারের জোগান দিয়ে থাকে।


বিসিআইসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উৎপাদনের বাইরে প্রয়োজনীয় যে ইউরিয়া সার লাগে, তা আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে কৃষি মন্ত্রণালয়কে দিই।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কারখানার সক্ষমতা অনুযায়ী যদি ইউরিয়া উৎপাদন করা যায়, তাহলে সরকারকে অন্তত ইউরিয়ায় কোনো ভর্তুকি দিতে হবে না।

ইউরিয়া সার উৎপাদনের সক্ষমতা কত

দেশে প্রতিবছর ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর বিপরীতে দেশের কারখানাগুলোতে সরকারিভাবে উৎপাদিত হয় প্রায় ১০ লাখ টন। আমদানি করতে হয় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন। দেশে এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন, একইভাবে যমুনা ফার্টিলাইজার কম্পানি লিমিটেডের পাঁচ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কম্পানি লিমিটেডের পাঁচ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন এবং শাহজালাল ফার্টিলাইজার কম্পানি লিমিটেডের পাঁচ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টন। নরসিংদীতে গ্যাসনির্ভর কারখানা ঘোড়াশাল-পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কম্পানি চালু হয়েছে। এটির উৎপাদন সক্ষমতা ৯ লাখ ২৪ হাজার টন। যমুনা ও চিটাগাং সার কারখানায় গ্যাস না থাকার কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

যদি পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যায়, তাহলে ঘোড়াশাল-পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড ছাড়া মোট উৎপাদন হবে ২২ লাখ ৩১ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু গত অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টন। অর্থাৎ সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম উৎপাদিত হয়েছে। বাকি ১৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সরকারকে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে, ডলার খরচ করে আমদানি করতে হয়েছে। দেশের মোট পাঁচ কারখানা যদি সক্ষমতা অনুযায়ী ইউরিয়া উৎপাদন করতে পারে, তাহলে ৩১ লাখ ৫৫ হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হবে, যা দেশের চাহিদার চেয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টন বেশি।

ঘোড়াশাল কারখানার প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক বলেন, ‘গত ২৮ জানুয়ারি থেকে আমাদের কারখানায় সার উৎপাদন শুরু হয়েছে। ৯০ শতাংশ লোডে সার উৎপাদন হচ্ছে দুই হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। এভাবে উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারলে দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে।’

কোন কারখানায় কত উৎপাদন, কত খরচ

গত ১৫ জানুয়ারি গ্যাসের অভাবে যমুনা সার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। গ্যাস কবে পাওয়া যাবে, তা-ও বলতে পারেননি কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে জামালপুর জেলার তারাকান্দির যমুনা ফার্টিলাইজার কম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা প্রতিদিন এক হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। বন্ধ হওয়ার আগে প্রতিদিন ৮৫ শতাংশ লোডে আমাদের উৎপাদন ছিল এক হাজার ৪২৫ মেট্রিক টন। এতে উৎপাদন খরচ প্রতি টন ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। এর চেয়ে বেশি গ্যাস আমরা পাইনি। আমরা যদি আরো গ্যাস পাই, তাহলে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০০ টন উৎপাদন করা সম্ভব। এতে প্রতি টন সারের খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি চলে আসবে।’

এ ব্যাপারে তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় নরসিংদী ঘোড়াশাল সার কারখানাটি চালু করা হয়েছে। তাই সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে জামালপুরে যমুনা সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।’

গ্যাসসংকটের কারণে চিটাগাং সার কারখানায় উৎপাদন গত ১৯ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে যায়। তবে গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ায় আবার চালু হচ্ছে। এই কারখানার ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মেট্রিক টন ইউরিয়ার উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি টন প্রায় ১৭-১৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি ১৭-১৯ টাকার মধ্যে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস না থাকার কারণে কমে গেছে উৎপাদন। অন্যদিকে সারের উৎপাদনও প্রতি কেজি ৩০ টাকার ওপরে উঠে গেছে। তবে এই কারখানার কর্মকর্তারা বলছেন, যদি পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে প্রতি কেজি সারের উৎপাদন খরচ ২০ টাকার নিচে চলে আসবে।

চিটাগাং সার কারখানার হিসাব ও অর্থ বিভাগের উপপ্রধান মো. মোবারক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের উৎপাদন যখন বেশি হবে, তখন খরচও কমবে।’ তিনি বলেন, ‘বিসিআইসির যত কারখানা রয়েছে, এর মধ্যে এই কারখানায় সবচেয়ে কম উৎপাদন খরচ। পর্যাপ্ত গ্যাস থাকার ভিত্তিতে আমরা যদি বছরে তিন লাখ টন উৎপাদন করতে পারি, তাহলে প্রতি টন সার উৎপাদন ২০ হাজার টাকার নিচে চলে আসবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে মাত্র ৪০ হাজার ৭২০ টন উৎপাদন হয়েছে।’


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top