সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

একা এবং একা (পর্ব- দুই) : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
২২ জুন ২০২০ ২১:২৬

আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:০৭

 

তিনজনেই চমকে মারুফের দিকে তাকাল। মারুফ শান্ত স্বরে বলল

- এই তোমরা এখানে কি কর?

তিনজনের একজন লাফিয়ে উঠে দাড়াল । তার হাতে একটা পিস্তল। সে আতঙ্কিত গলায় চেচিয়ে উঠল

- এই তুই কে?

এবার অন্য দুজনও লাফিয়ে উঠল, একজনের হাতে ছুরি। পিস্তলটা যে ধরেছে সে অস্ত্রটা ধরেছে হরাইজন্টালি, আনুভূমিক ভাবে;  তার মানে সে প্রফেশনাল। কিন্তু ছুরি ধরেছে যে সে বাওয়া তার ধরাটা ভার্টিকালি, লম্বা লম্বি; সে মনে হয় এখনও এত প্রফেশনাল হয়ে উঠে নি। পকেটের জিনিষটা বের করার সময় এখনো হয় নি ভাবে মারুফ। তা ছাড়া এরা নেশাগ্রস্থ, একই সঙ্গে কিছুটা আতঙ্কিত বা হতভম্ব। মনে হয় সুবিধা করতে পারবে না, তারপরও ঝুকি নেয়া যাবে না।

- ওস্তাদ ফালায়া দেই কি কন?

- এই তুই কোন শালা? তৃতীয় লোকটার হাতেও একটা ছুরি দেখা যাচ্ছে।

 

‘আমি তোদের বাপ’। আস্তে করে বলে মারুফ। মারুফ আড় চোখে উপরের ফ্যানটার দিকে তাকায়। বেঞ্চে পা দিয়ে লাফিয়ে ধরলে কি ফ্যানটা তার ওজন নিতে পারবে? না পারলে সমস্যা। তারপরও ঝুকিটা নিতে হবে। ছুরি হাতে লোকটা ঝাপ দিল মারুফের দিকে।  মারুফও ঝুকিটা নিল। ওরা অবাক হয়ে দেখল , লোকটা বেঞ্চে এক পা দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে উপরের দিকে দু হাতে ফ্যানটা ধরে আচমকা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে তার দু’পা ঝড়ের মত নেমে আসে দুজনের উপর। পিস্তলটা ছিটকে অন্ধকারে কোথায় পড়ল ঠিক বোঝা গেল না। তবে ছুরি হাতের লোকটা ‘বাপরে’ বলে বসে পড়ল। ততক্ষনে ফ্যান ছেড়ে নেমে এসেছে মারুফ মাটিতে। তৃতীয় লোকটা ঝাপ দিল এবার মারুফের উপর। খুব শিগ্রী নাকে হাত দিয়ে ‘মাগো’ বলে বসে গেল। তার আঙুলের ফাক দিয়ে রক্ত দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভব নাকের ব্রিজটা ভেঙে গেছে!

 

শিগ্রী মারুফ টের পেল তিনজনই পালিয়েছে। ক্লাশরুম শূণ্য। মোম দুটোর একটা নিভে গেছে। একটা তখনও টিম টিম করে জ্বলছে। ওরা একটা ব্যাগ ফেলে গেছে। আর পিস্তলটাও পাওয়া গেছে। জিনিষ দুটো নিয়ে সাবধানে বের হয়ে এল মারুফ। ব্যাগে কি আছে? নিশ্চয়ই হেরোইন বা বাবা। মানে ইয়াবা। তবে বের হওয়ার আগে বেঞ্চগুলো সরিয়ে আগেরমত করে দিল। এখন দেখে কেউ বুঝবে না যে একটু আগেও এখানে দক্ষ-যজ্ঞ ঘটে গেছে।

 

নিজের ঘরে এসে চমকাল মারুফ । ব্যাগ ভর্তি টাকা । ভোর রাত পর্যন্ত গুনলো । এক লাখ পঞ্চান্ন হাজার টাকা। ১০০, ৫০০ আর এক হাজার টাকার নোট। ৫০০ টাকার নোটই বেশী।    

 

ব্যাগটা চকির নিচে ঢুকিয়ে মারুফ ভাবতে বসল। কাজটা কি ঠিক হল? প্রথম দিনেই এত কান্ড করা? পরিশ্রম হয়েছে মন্দ নয়। চট করে চোখের পাতা ভারি হয়ে এল মারুফের। মারুফের একটা গুণ হচ্ছে যেকোন টেনশন সে নিতে পারে। খুব শিগ্রী তার হালকা নাক ডাকার শব্দ শুরু হল।

 

পরদিন স্কুল খোলা। ঘুম থেকে উঠে দেখে নাস্তা নিয়ে মবিন হাজির। পরোটা ডিম ভাজি ।

- স্যার বাকিতে আনছি টেকা দিয়া দিয়েন।

- আচ্ছা। অন্য স্যাররা কি এসেছেন?

- জি সবাই আসছেন। আপনেরে ডাকে কাকায়।

- হেড স্যার তোমার কাকা হয়?

- ছোডো কালে ডাকতাম। মাঝে মাঝে আইয়া পড়ে।

 

হেড স্যারের রুমে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে । মারুফ ঢুকতেই সবাই চুপ করে গেল। হেড স্যার ছাড়াও দুজন মহিলা আর দুজন পুরুষ বসে আছেন। মবিনের তথ্য ঠিক হলে এরাই এই স্কুলের সবেধন নীলমণি চারজন টিচার।

- পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি মারুফ রহমান, আমাদের নতুন ড্রিল টিচার।

- আরে রাাখেন ড্রিল টিচার। তিন মাস বেতন দিতে পারেন না আমাদের। আবার নতুন ড্রিল টিচার আনেন কোন আক্কেলে? উনি জানে স্কুলের অবস্থা!

- মজিদ সাহেব। উনি নতুন মানুষ । উনার সামনে এভাবে কথা না বললে হয় না? আমি বলেছিতো এ মাসেই একটা ব্যবস্থা হবে। আমার ভাইঝি মালয়েশিয়া থেকে...

- রাখেন আপনার ভাইঝির গপ্পো , এই গপ্পো অনেক শুনছি।

এই সময় মবিন ট্রে ভতি করে সিঙ্গারা মিষ্টি আর চা নিয়ে ঢুকে। সবাই বেশ হকচকিয়ে যায়। এইরকম আপ্যায়ন সম্ভবত এই স্কুলে অনেকদিন হয় না। মারুফ কেশে গলা পরিস্কার করে।

- নিন সবাই মিলে চা খাই। স্যার প্লিজ নিন।

- চা সিঙ্গারা খেতে খেতে সবাই একটু সহজ হল। চেচামেচি করছিলেন যিনি তিনি এক ফাকে স্যরি বলে ফেললেন। মনিকা ম্যাডাম জানালেন তিনি বিজ্ঞান পড়ান। আর আরেকটু বয়স্ক মহিলা যিনি, তিনি বাঙলা পড়ান। মজিদ স্যার অংক। রফিক স্যার ইংলিশ। আসলে ঘুরে ফিরে সবাইকেই সব ক্লাশই নিতে হয়। তবে সমস্যা একটাই টিচারদের বেতন নাই। 

 

তবে খুব শিগ্রী হঠাৎ করে সবাই বেতন পেয়ে গেলেন। দু মাসের বেতন এক সঙ্গে। মবিন পেল তার তিন মাসের বেতন এক সঙ্গে। সবাই জানল, মানবেন্দ্র স্যারের ভাইঝি মালয়েশিয়া থেকে যে টাকা পাঠানোর কথা হয়েছিল সেটা অবশেষে এসে পৌছেছে । বেশ মোটা অংকের টাকা।

 

শুধু একদিন হেড স্যার মারুফকে একা পেয়ে বললেন ‘ এত টাকা কোথায় পেলে তুমি?’ মারুফ হেসে উঠল।

- এই টাকা তোমাকে শোধ করতে হবে না?

- না স্যার

- মানে?

- মানে স্যার বাংলা একটা প্রবাদ আছে না চোরের উপর বাটপারি?

- হ্যাঁ আছে তো কিন্তু ... এর সাথে এর সম্পর্ক কি?

- স্যার বাদ দেন , ধরে নেন এই স্কুলে এসে আমি একটা আলাদিনের চেরাগ পেয়েছি। তবে স্যার স্কুলটা আমি মেরামত করতে চাই। আপনি অনুমতি দেন।

- অনুমতি কি দিব। এই স্কুল আজ থেকে তোমার। হেড স্যার পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছেন। কেন যেন তার আজ সরযুবালাকে মনে পড়ছে। এই স্কুলটা নিয়ে সরযুর অনেক স্বপ্ন ছিল। নিজের নামে স্কুল দেওয়ায় তার ঘোরতর আপত্তি ছিল কিন্তু মানবেন্দ্র দাস মানেন নি।

 

খুব শিগ্রী স্কুলে উন্নয়নের কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রথমেই একটা নতুন ঝকঝকে সাইনবোর্ড লাগল। যে ক্লাশগুলোর সমস্যা ছিল সেগুলো ঠিক করা হল। রং করা হল পুরো স্কুল। সবচে বড় কথা স্কুলে কোনে গেট ছিল না, একটা সুন্দর গেট বসানো হল। একদিন মবিন একটা প্রস্তাব নিয়ে এল।

- স্যার একটা কথা বলতাম

- বলে ফেল। মারুফ বলে

- স্যার গেটের কাছে ঐ যে ভাঙা ছোট ঘরটা আছে ঐটা ঠিক কইরা একটা রেস্টুরেন্ট দেই। ঐখানে সিঙ্গারা সামুচা পাওয়া যাইব । পোলাপান কিইনা খাইব, ইস্কুলের ইনকাম হইব।

- কিন্ত ঐ রেস্টুরেন্টের দায়িত্ব নিবে কে?

- স্যার আমার এক চাচা আছে, শাহজাহান চাচা। হেই সব করব।

- বেশ, দেখি হেড স্যারকে বলে। 

 

খুব শিগ্রী সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের গেটের কাছে একটা ছোট খাট রেস্টুরেন্টও হয়ে গেল । এখানে সকালে পাওয়া যায় সিঙ্গারা সামুচা। বিকালে গরম গরম পুড়ি। আর মাঝখানের সময়টায় চাইলে ভাতও খাওয়া যায়। দেখা গেল মবিনের চাচাা শাহজাহান লোকটা খুবই কাজের, এবং প্রফেশনাল। প্রথম দিন সবাই মোটামোটি ফ্রি খেল। দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হল কেনাকাটা। দেখা গেল এখন আর বাইরে থেকে চা সিঙ্গারা কিনতে হয় না। সব কিছু স্কুলেই পাওয়া যাচ্ছে। স্যাররাতো খানই, মাঝে মাঝে স্যাররা যাওয়ার সময় এটা সেটা কিনেও নিয়ে যান।

তবে আরেকটা সুবিধা হয়েছে। এই স্কুলের কোনো দারোয়ান ছিল না। এবার শাহজাহান সে দায়িত্বও পালন করে। যেহেতু গেটের কাছেই এই ছোট্ট রেস্টুরেন্ট , সে কড়া নজর রাখে কে এল কে গেল।

 

পুরো স্কুলে যেন সুবাতাস বইছিল। সবাই কম বেশী খুশী। নতুন করে যেন স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে একদিন ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল। মারুফ অপেক্ষা করছিল এইরকম একটা ঘটনার। এক সকালে নবী নগরের মেয়র দুজন লোক নিয়ে এসে হাজির হলেন। সরাসরি ঢুকে গেলেন হেড স্যারের রুমে।

চা সিঙ্গারা খেতে খেতে মেয়র সাহেব তার চাপ-দাড়ীতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন

- স্যার স্কুলের চেহারাতো বদলায়া ফেলাইছেন

- হ্যাঁ তা একটু বলতে পারেন রেনোভেশন...

- বেয়াদবি নিয়েন না এত টেকা কই পাইলেন?

মিথ্যা কথাটা বলতে মানবেন্দ্র দাসের সবসময় একটু অস্বস্থি লাগে। তবুও বললেন। মারুফ এটাই বলতে বলেছে

- আমার এক ভাইঝি থাকে মালয়েশিয়ায়, সে কিছু সাহায্য করেছে।

- ভাল ভাল

- স্কুলে নাকি নতুন স্যার নিছেন একজন? ডাকেন না একটু আলাপ পরিচয় করি। শহরে নতুন লোক আসলে জানার দায়িত্বও একটা আছে মেয়র হিসেবে কি বলেন... হে হে

- হ্যাঁ ড্রিল স্যার, মারুফুর রহমান। ঠিক তখনই মারুফ ঢুকল।

- মারুফ বস , উনি এখানকার মেয়র ইদ্রিস আলী

- মারুফ সাহেব কেমন আছেন বাাড়ী কই?

- বাড়ী কই বলছি। তার আগে সিগারেটটা ফেলুন। এটা ধূমপান মুক্ত এলাকা, বাইরে সাইনবোর্ডে কিন্তু লেখা আছে। আপনি মেয়র আপনার জানা উচিৎ। মেয়র ইদ্রিসের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। শান্ত ভাবে সিগারেটটা সামনের চায়ের কাপে নিভিয়ে ফেললেন।

- আমার বাড়ী রাজশাহী। এখানে ড্রিল টিচার হিসেবে জয়েন করেছি।

- ও । মেয়র সাহেব মনে হচ্ছে কথা খুঁজে পাচ্ছেন না।   তারপর হঠাৎ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন

‘আপনি মাস্টার হিসাবে জয়েন করলেন। আমিতো স্কুল কমিটির একজন মেম্বার। আমি জানলাম না, ঘটনা কি মানবেন্দ্র বাবু?’

- দেখুন শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে মেম্বারদের মতামত জরুরী না। তা ছাড়া নতুন কমিটি হয়েছে অনেক আগেই আপনি... এই কমিটি এমপি সাহেব করে দিয়ে গেছেন...

- আরে রাখেন এমপি সাহেব ... উনি এলাকায় থাকে? গত পাঁচ বছরেও কেউ তাকে চোখে দেখছে? কাজ যা করারতো আমিই করি...।  লোকটা বিশ্রি ভাবে চেচিয়ে কথাগুলো বলতে লাগলো। তাকে হাত তুলে থামাল মারুফ।

- আস্তে... আমার একটা জিনিষ জানার আছে , গত বছর সরকার থেকে একটা অনুদান এসেছে এই স্কুলের নামে। সেটা এখানো স্কুল পায়নি কেন? জানতে পারি মেয়র সাহেব?

- কিসের অনুদান? ফালতু কথা

- ফালতু কথা না। আপনি ভাল করেই জানেন। টাকার পরিমান আর স্মারক নম্বরটা বলব?

- এসব আপনি জানার কে?

- আমি জানার কেউ না, কিন্তু হেড স্যারের বয়স হয়েছে সব দায়িত্ব তার পক্ষে পালন করা সম্ভব না। কিছু কিছু দায়িত্ব উনি আমাকে দিয়েছেন।

হঠাৎ উঠে দাড়াল মেয়র। ‘এই বিষয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলব না’

- আমার সাথেই কথা বলতে হবে। আমি কাল আপনার অফিসে যাব। কাগজ পত্র রেডি রাখবেন।

মেয়র তার সাথের লোক দুজনকে নিয়ে ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলেন।

 

(চলবে)


একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top