সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

একা এবং একা (পর্ব আট) : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২০ ২১:৫৭

আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৭

 

(আহসান হাবীব মূলত একজন প্রফেশনাল কার্টুনিস্ট। তিনি পেশাগত কারণে সাধারনত কমিকস, গ্রাফিক নভেল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। তিনি যখন লিখেন তখন তার মাথায় থাকে কমিকস বা গ্রাফিক নভেলের কনটেন্ট। তার গল্পের পিছনে থাকে স্টোরি বোর্ডের মত ছবির চিত্রকল্প। এই কারণেই তার লেখায় একটা সিনেমাটিক ড্রামা থাকে প্রায়শই। তিনি মনে করেন যেকোনো গ্যাজেটেই/ফরম্যাটেই হোক, স্ক্রিনে যে গল্প পাঠক পড়ছে, সেখানে তার সাব-কনসান্স মাইন্ড ছবি খুঁজে। আর তাই ‘প্রভাত-ফেরী’র পাঠকদের জন্য তার এই ধারাবাহিক ইন্ডি নভেল ‘একা এবং একা ’ )

(পর্ব আট)

 

- স্যার জরিনা আপুতো নাই

- মানে? মবিনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় মারুফ।

- মানে স্যার উনারে দেখতেছি না। সকালেও ছিলেন উনি, নাস্তা খাইছেন। দুপুরেও ভাত খাইছেন। বিকালের কিছু আগ থাইকা আর দেখতাছি না।

- কি বলছ? ওর সঙ্গে কোনো কথাও ঠিক মত হয়নি কোত্থেকে এখানে এল, কারা তাকে আনল, কোথায় ছিল

- সেই সব স্যার আমি জানি। বেশ সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে মবিন।

- কি ভাবে জান?

- স্যার যেদিন আপনি প্রথম স্কুলে জয়েন করলেন ঐ দিন থাইকাই আমি আপনেরে নজরে রাখছি। মবিন হাসে।

- কেন? মারুফ স্যার অবাক হন!

মবিন হাসে। ‘ক্যান স্যার কইতে পারুম না। যেদিন রাইতের বেলা ক্লাশ রুমে আপনে তিনটারে পিডায়া সাইজ করলেন সবই দেখছি আমি বাইরে থাইকা, আমিও কিন্তু স্কুল কম্পাউন্ডে ছিলাম।‘

ভ্রু কুঁচকে তাকায় মারুফ; এই ছেলেটাকে ক্রমে ক্রমেই রহস্যময় লাগছে কেন?

- স্যার এতে একটা লাভ হইছে  

- কি লাভ?

- স্যার অনেক কিছু জানছি, আবার শিখছিও। আপনেরে কেন্দ্র কইরা অনেক ঘটনা ঘটছে, আপনি নিজেও জানেন না। তবে স্যার একটা আকাম হইছে...!

- কি?

- জরিনা আপু যাওয়ার সময় আমার পিস্তলটা নিয়া গেছে।

- তাই নাকি? সেই পিস্তলটা? কোল্ট থার্টি টু?

- জি স্যার, আমার সন্দেহ হয় আজ কালের মধ্যে খারাপ কিছু একটা ঘটব।

 

কথা হচ্ছিল শহরের এক প্রান্তে একটা ছোট্ট একতলা টিনশেড বাড়ীতে, এটাই আপাতত মবিনের আস্তানা। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ মবিন যে ভিতরে ভিতরে কেউকেটা হয়ে উঠছে তাতে তার এই ভাড়া বাসা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কে বলবে কিছুদিন আগেও সে একটা স্কুলে পিয়ন ছিল। তবে অবশ্যই বেশ স্মার্ট পিয়ন।

 

ঐ দিন নৌকার ঘটনার পর তারা চারজন এই বাড়ীতে এসে উঠে, প্রথম দুদিন টানা ঘুমায় সবাই। বিশেষ করে জরিনা মেয়েটা। কে জানে কত রাত ঘুমায়নি সে।

 

কুদ্দুস আর রফিক স্যার লোকাল ট্রেনের একটা থার্ড ক্লাশ কম্পার্টমেন্টে বসে আছে। ট্রেনটা ঢিলে তালে চলছে। এই লাইনে ট্রেনের এই অবস্থাই। লোকাল ট্রেনগুলো কোনরকমে চলাচল করে। ট্রেন প্রায় পুরাটাই খালি, শেষের দিকে অবশ্য অনেকগুলো মালের বগি লাগানো। মাল পৌছানোই বোধহয় এদের প্রধান কাজ; মাঝে মধ্যে যাত্রীদের জন্য কিছু কম্পার্টমেন্ট থাকে। 

- কুদ্দুস আমারে কই নিচ্ছ? প্রশ্নটা রফিক স্যার ঝিমাতে ঝিমাতে করেন। কুদ্দুসের ধারনা ছিল রফিক স্যার ঝামেলা করবে, যেতে চাইবে না। কিন্তু তিনি বেশ আনন্দের সঙ্গে রাজী হয়েছেন যেতে।

- স্যার বেড়াইতে যাই আপনের ভাল লাগবে, সুন্দর জায়গা!

- কিন্তু আমারতো একটা ক্লাশ নিতে হবে। কমন মিসটেক ইন ইংলিশ

- স্যার ঐখানে নিবেন। সমস্যা নাই

- ঐখানে ভাল স্কুল আছে?

- আছে স্যার

- অবশ্য সব স্কুলই ভাল, স্কুল খারাপ ভাল হয় মাস্টরের কারণে, কি ঠিক বলছি না?

- জি স্যার। একদম ঠিক কথা।

- আচ্ছা ওল্ড টেনের সব ছাত্র-ছাত্রীদের থাকতে বলবা। এটা ওদের পরীক্ষায় কাজে লাগবে।

- জি স্যার বলব। কুদ্দুস ভাবছিল এখন যেকোন একটা স্টেশনে নামিয়ে দিলেই হবে স্যারকে।

 

অনেকটা দূর আসা হয়েছে; পথ চিনে রফিক স্যার আর  শহরে ফিরতে পারবে না। রসুলপুর স্টেশন নামে একটা ভাঙাচোরা স্টেশনে ট্রেনটা থামল, স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘাস গজিয়ে গেছে, এখানে  ট্রেন থামার কথা না; কিন্তু থামলো। এখানেই নেমে পড়লে কেমন হয়। চট করে কুদ্দুস উঠে দাড়ায়!

- স্যার নামেন

- আসছি?

- জি স্যার।

 

পুরোনো ভাঙা একটা স্টেশন, এখানে ট্রেন থামার কোন কারণ নেই। আজ থামলো কেন কে জানে। স্টেশনের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এটা একটা বাতিল স্টেশন। 

তারা স্টেশনে নেমে একটা বেঞ্চে বসল।

- স্যার আপনি বসেন আমি চা-বিস্কুট আনি আপনার জন্য

- আচ্ছা আন। একটা সিগারেটও এনো।

- স্যার এই টাকাটা রাখেন। একটা একশ টাকার নোট এগিয়ে দেয় কুদ্দুস।

- টাকা কেন?

- স্যার রাখেন, যদি হঠাৎ কিছু কিনতে ইচ্ছে করে। আমি চা নিয়ে আসি। কুদ্দুসের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। কাজটা কি ঠিক করল সে? কিন্তু উপায় কি? মজিদ স্যারের নির্দেশ। সে হন হন করে স্টেশন থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে ছুটলো। সাধারনত স্টেশনের আশে পাশেই বাস স্ট্যান্ড থাকে। বাস ধরে ফিরতে হবে, রফিক স্যার কিছু বুঝে উঠার আগেই।

 

মবিনের কথাই ঠিক হল। দুদিন পর এই ছোট্ট মফস্বল শহরটায় একই দিনে দুটো খুন হল। নদীর পারের দোতলা বাড়ীতে ঢাকা থেকে স্পিড বোটে আসা  সেই ওস্তাদকে স্পিড বোটের ভিতরই কেউ গুলি করে মারল, তার নিজস্ব সিক্যুরিটি কোনো কাজে লাগলো না। আর দ্বিতীয়জন মেয়র আলহাজ্ব মোরতাজুল ইসলাম। তাকে তার অফিসের ভিতর কেউ ঠান্ডা মাথায় কুপিয়ে হত্যা করেছে। 

 

খবর শহরে রটতে খুব বেশী দেরী হল না, সবাই জেনে গেল। মেয়র সাহেবকে কেউ কুপিয়ে হত্যা করেছে। সন্ধ্যার পর পর তার অফিসের ভিতরেই কে বা কারা এই কাজ করেছে। তবে নদীর পারের স্পিডবোটের ভিতর ওস্তাদের মৃত্যু, রহস্যময় কারণে ধামা চাপা দেয়া হল। দাঙ্গা পুলিশের একটা ব্যাটালিয়ন নামল শহরে সঙ্গে সঙ্গে। পুরো শহরে থমথমে ভাব। কেউ কার্ফু দেয়নি, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে কার্ফু চলছে শহরে...। রাস্তা ঘাট সব ফাকা!

 

কুদ্দুস হন হন করে হাঁটছিল। খবরটা সেও পেয়েছে। স্কুল থেকে বেরুতে বেরুতে দেরী হয়ে গেছে। মজিদ স্যারের  বাসায় কিছু খাতাপত্র পৌছে দিয়ে নিজের মেসে ফিরতে দেরী হয়ে গেল। দু একটা টং এর দোকান অবশ্য এখনো  খোলা। সেখানে জোর আলোচনা চলছে মৃত মেয়রকে নিয়ে। কালভার্টটার কাছে এসে থমকে দাড়াল কুদ্দুস। রফিক স্যার বসে আছে! হাতে ওটা কি? অসম্ভব! রফিক স্যারকে গত পরশুর আগের দিন কুদ্দুস নিজে ফেলে এসেছে রসুলপুর স্টেশনে, ঐ স্টেশনে ট্রেন থামে না। তারপরও কি কারণে ঐদিন থেমেছিল কে জানে। রাত বলে কেউ টের পায় নি। ওখান থেকে মাথা নষ্ট রফিক স্যারের ফিরে আসার কথা না। স্টেশনের আধা মাইলের ভিতর কোন বাসস্ট্যান্ড নেই। কুদ্দুসকে ফিরতেই বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

কুদ্দুস পিছিয়ে গিয়ে রাস্তা পার হল। আবার তাকাল কালভার্টটার দিকে কই কেউতো নেই। নিশ্চয়ই ভুল দেখেছে সে। হয়ত রফিক স্যারের মত কেউ বসে ছিল। এখন নেই।

 

মনিকা ধরমর করে উঠে বসল। মরার মত ঘুমাচ্ছিল সে। উঠে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে পাশে বসে আছে ছোট বোন শর্মি।

- শর্মি আমি কোথায়?

- বাসায়। আপু গরম খবর আছে!

- কি?

- মেয়র মোরতাজুলকে মেরে ফেলেছে?

- সত্যি? কে মেরেছে?

- তা জানি না।  

- শর্মি আমি বাসায় আসলাম কিভাবে তোর মনে আছে? ফিক করে হেসে ফেলল শর্মি।  

- হাসলি কেন?

- একজনের কোলে চড়ে এসেছিস, তোদের সেই প্রবলেমেটিক মারুফ স্যার। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল তখন, কোন রিক্সা না পেয়ে বেচারা ভদ্রলোক নাকি এতটা রাস্তা তোকে কোলে করে নিয়ে এনেছে, কি যে হাস্যকর লাগছিল... একবারে হিন্দি সিনেমা...হাম তোম দিলকে চাঁদ টাইপ, হি হি হি...।  

- যাহ ফাজিল কোথাকার!

- তবে আমার কি মনে হয় জানিস আপু?

- কি?

- রিক্সা ঠিকই ছিল রাস্তায় ... ইচ্ছে করেই উনি... হি হি হি  

- কি সব বলিস! কেউ দেখেছে?

- কে দেখবে?  বললাম না খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।  

- বাসায় বসেছিল স্যার?

- না চা খেয়ে যেতে বলেছিলাম। বসে নি। বলল তুই অজ্ঞান হয়ে গেছিস মুখে পানির ঝাপটা দিতে। ঐদিন বাসায় বাবা মা কেউই ছিল না তখন। 

- কিছু বলেও যায় নি উনি?  

- না। আপু তোর সত্যি কিচ্ছু মনে নেই?

- বলছিতো মনে নেই এর মধ্যে আবার সত্যি মিথ্যার কি আছে? মেজাজ খারাপ হয়ে যায় মনিকার। ‘যাতো আমার জন্য কড়া করে এক কাপ চা নিয়ে জলদি।’ শর্মি চা আনতে ছুটলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আপুর সাথে মারুফ স্যারের প্রেম-ট্রেম কিছু একটা হয়ে গেছে। চা নিয়ে ফিরে দেখে আপু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফোপানোর মত শব্দ করছে!

- কি হল কাঁদছিস কেন আপু?

- কই কাঁদলাম, চা দে। নিজেকে সামলে নিয়ে মনিকা চায়ের কাপ হাতে নেয়। ‘আচ্ছা মেয়রকে মেরে ফেলল কে? কয়টার সময় ঘটেছে এটা জানিস কিছু?’ শর্মি উত্তর না দিয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগলো, নিশ্চয়ই মারুফ স্যারকে নিয়ে নতুন কোন বিটলে চিন্তা তার মাথায় এসেছে। তার এই বোন যথেষ্ট ফাজিল টাইপ চিন্তা ভাবনা করে! 

 

পরদিন স্কুলে টিচারস রুমে বিরাট হই চই করে মেয়রের হত্যাকান্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবাই একমত এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে মারুফ আর মবিন মিলে।

- কারণ দেখেন মারুফ স্যারের চাকরী নেই তারপর এই শহরে ঘুর ঘুর করছে কেন? হোয়াই?

- ঠিক বলেছেন। আমি ওদের দুজনকে এক সাথে দেখেছি।  

- পুলিশ কিছু করছে না কেন?

- ধরবে ধরবে পুলিশ পারে না এমন কাজ নেই। ঢাকা থেকে স্পেশাল পুলিশ এসেছেরে ভাই। দুজন ডিটেকটিভ এসেছে বলে শুনেছি। এবার নবী নগরের খবর আছে।  

- উনাকে কখন মেরেছে? মনিকা তাকাল সবার দিকে

- ঠিক আটটা বিশে তার লাশ পাওয়া যায়। তখনও নাকি পালস ছিল। হাসপাতালে নিতে নিতেই... ঠুস! এই মৃত্যু কিছুটা হলেও সবাইকে বেশ উৎফুল্ল করেছে বলে মনে হচ্ছে, মনিকার তাই মনে হল। সে নিজেও কি স্বস্থিবোধ করছে না? কিন্তু মারুফ স্যারের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিছু কথা তাকে না বললেই নয়...।

 

স্যারদের  এই আড্ডায় অবশ্য মজিদ স্যারকে দেখা গেল না। মনিকা সময়ের হিসাব মিলানোর চেষ্টা করে । সে মেয়র অফিস থেকে বের হয়েছে সাতটার দিকে, তার মানে তার পরের ঘটনা, তার বেরুনোর পর পর কেউ ঢুকেছে। তার কি মজিদ স্যারের সঙ্গে দেখা করা উচিৎ? মেয়রের সঙ্গে তাদের স্কুল নিয়ে এতসব গোপন মিটিং ফাঁস হলে কি হবে কে জানে। মনিকা এখন বেশ বুঝতে পারছে। তাকে প্রতিটা মিটিংয়ে সাথে রাখা হয়েছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে। তার অবশ্য তখন কিছু করার ছিল না। মেয়রের কাছে তার হাতপা বাধা ছিল, বাবার লোনের কারণে। কিন্তু এখন? এখন কি হবে! স্কুলের ঘন্টা বেজে উঠল। সবাই ছুটলো যার যার ক্লাশে। মনিকা বসে রইল , তার ক্লাশ দ্বিতীয় পিরিয়ডে। এক কাপ চা খেতে পারলে হয় কিন্তু আজ কি চা পাওয়া যাবে। সবই কেমন গোলমেলে ঠেকছে আজ। গতকালের কথা মনে পড়ছে ... একটু অস্বস্তি বোধ করছে বটে। লোকটা কি সত্যিই কোন রিক্সা না পেয়ে তাকে এতটা রাস্তা...

 

সেদিন স্কুলে ঠিকমত ক্লাশ হয় নি। শহরে এখনও থমথমে ভাব। যেখানে সেখানে পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। সন্দেহজনক মনে হলেই লোকজনকে থামাচ্ছে। যেমন কুদ্দুসকে দু’বার থামানো হল। প্রথমবার তেমন কিছু জিজ্ঞেস করে নি। দ্বিতীয়বার জানতে চাইল কোথায় কাজ করে, এত রাতে কেন ফিরছে!

- স্কুলের অনেক কাজ ছিল শেষ করতে করতে...

- স্কুল ছুটি হয় কয়টায়? পুলিশ কনস্টেবল জানতে চায়     

- ৫ টায়। কিন্তু আমাদের থাকতে হয় ৭টা ৮টা পর্যন্ত।  

- আজকে ১০ টায় কেন?

- স্যার একটু বাজার সওদা করলাম

- বাসায় আর কে আছে?

- স্যার আমি একা মেসে থাকি

- মেস মেম্বার কয়জন?  

- দুইজন তবে এখন আমি একা আছি। আমার রুম মেট বাড়ি গেছে

- কবে গেছে?

- সপ্তাহ খানেক হইল।

- আচ্ছা যাও

কুদ্দুসের মেস যে গলিতে সেটা অন্ধকার হয়ে আছে। এই সময়টায় এখানে প্রায়ই লোডশেডিং থাকে। যথারীতি আজও। কোন মতে হাতরে হাতরে বাসার সামনে এসে দাড়ায়। সিড়িতে বসে আছে কে যেন? তাহলে কি রুমমেট মফিজ চলে এসেছে, চাবি কুদ্দুসের কাছে বলে বসে আছে বাইরে!

- মফিজ ভাই আসছেন?

মফিজ কোন উত্তর দিল না। কুদ্দুস আরেকটু কাছে গেল। তখনই তার বুকটা ধ্বক করে উঠল। মফিজ ভাই না। বসে আছে রফিক স্যার, হাতে একটা ছোট্ট চায়নিজ কুড়াল, হাতলটা বাকা। 

- কুদ্দুস আমি রফিক স্যার। ঢোক গিলে কুদ্দুস।

- তুমি যে ১০০ টাকা দিসিলা ঐটা দিয়া এইটা কিনসি, অনেক ধার। ৯০ টাকা নিসে। ৫ টাকার চা খাইছি আর এই যে ৫ টাকা ফেরৎ নাও ধর...

- স্যা- স্যার... কুদ্দুসের গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না।  

- কি হইল নাও। টাকা পয়সা খুব খারাপ জিনিষ, হিসাব পত্র পরিস্কার থাকা দরকার। এক কাজ কর তুমি এখন আমাকে মজিদ স্যারের বাসায় একটু নিয়া চল। ... ও তোমারে বলি নাই, সন্ধ্যার দিকে মেয়ররে মারছি এই কুড়াল দিয়া; দুই কোপেই শেষ, ঠিক করছি নবী নগরে খারাপ মানুষ রাখব না... একটা লিস্ট করছি। লিস্টটা শুনবা?

- জি স্যা-স্যার... কুদ্দুসের জীবটা কেমন এলামেলো হয়ে যাচ্ছে। গলিতে লাইট এসেছে। সেই আলোয় সে স্পষ্ট দেখল রফিক স্যারের হাতে ধরা ছোট্ট কুড়ালটার ধারালো ফলায় লাল রক্ত জমাট বেধে কালচে হয়ে আছে। রফিক স্যার উঠে দাড়ালেন।

-           কদ্দুস মিয়া চল, মজিদ স্যারের বাসায় নিয়া চল। I have much work this evening ... বুঝলা কুদ্দুস এই বাক্যটা কিন্তু  ভুল, কমন মিসটেক ইন ইংলিশ। আসলে বলতে হবে I am very busy this evening  ... আবার এইটাও তুমি বলতে পার I have a lot of work to do this evening ...

 

কুদ্দুস এলামেলো পায়ে হাঁটছে। একটু পর পর তার গলা শুকিয়ে আসছে, পানি খেতে পারলে ভাল হত। ঘাড়ের কাছটায় শির শির করছে , রফিক স্যার যদি এখন পেছন থেকে চায়নিজ কুড়াল দিয়ে হঠাৎ কোপ দিয়ে বসে! স্যারকে রসুলপুর স্টেশনে ১০০ টাকা দিয়ে আসাটা বিরাট মিসটেক হইছে, কমন মিসটেক ইন ইংলিশ না...  বাংলা! কুদ্দুস ঢোক গিলে। হঠাৎ সে টের পেল, সে আসলে মজিদ স্যারের বাসার দিকে যাচ্ছে না। যাচ্ছে লোকাল থানার রাস্তায়!   

- কুদ্দুস এটা কোথায় আনলা? কুদ্দুস উত্তর না দিয়ে হঠাৎ চেচিয়ে উঠল ‘ খুনি খুনি... মেয়র স্যারের খুনি, জলদি আটকান উনারে... !! ’

হতভম্ব দুজন কনস্টেবল ছুটে এসে ঘিরে ধরে রফিক স্যারকে! রফিক স্যার বির বির করেন ‘ কুদ্দুস মিয়া কাজটা ঠিক করল না... মিসটেক করলা একটা, অনেক বড় মিসটেক!! ’

 

(চলবে)


একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top