সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বধির নিরবধি (পর্ব ছয়) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
৬ অক্টোবর ২০২০ ২০:৫৮

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২১:২৭

 

(দেশসেরা দুই ফান ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’ ও ‘রস+আলো’তে লেখার সুবাদে আসিফ মেহ্‌দী রম্যলেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আগেই। ‘বেতাল রম্য’ নামের প্রথম বইয়েই তিনি লাভ করেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। তারপর একে একে প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি বইয়ে ব্যঙ্গ আর হাসির সঙ্গে গভীর জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি শুধু পাঠকপ্রিয়তাই লাভ করেননি, তাঁর বইগুলো উঠে এসেছে বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়। সেগুলোর মধ্যে 'বধির নিরবধি', ‘মায়া’, ‘অপ্সরা’, ‘তরু-নৃ’ অন্যতম। এছাড়া এনটিভিতে প্রচারিত তাঁর লেখা নাটক ‘অ্যানালগ ভালোবাসা’-র বিষয়বস্তুর জীবনঘনিষ্ঠতা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছে। ‘ন্যানো কাব্য’ নামে একটি বিশেষ কাব্যধারার প্রবর্তক আসিফ মেহ্‌দী কবিতা প্রেমীদের কাছে ন্যানো কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ।)

 

পর্ব ছয়

সন্ধ্যা হয়েছে বেশ আগে। বৃষ্টি থেমে গেছে মধ্যবিকেলে কিন্তু আবহাওয়াতে ঠাণ্ডা মিষ্টি আমেজ এখনো বর্তমান। ‘দাদা চাপ’-এর স্টলে বেশ চাপ। সারাদিনের কাজের চাপের পর একটু চাপমুক্ত হতে অনেকে চাপ-এর দোকানে হাজির। মানুষ এখানে কিছুটা রিলাক্স হতে এলেও আসলে এসব খাবার রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে। চাপ-এর সঙ্গে গরম লুচির ব্যবস্থাও আছে। রুহানের পিছু নিয়ে রনি দাদা চাপ-এর ভেতরের একটি বেঞ্চিতে বসল। চাচার হঠাৎ তলব কেন, ঠিক বুঝতে পারছে না।

রুহান বলল, ‘কী খাবি?’

‘আসলে ক্ষুধা নাই, চাচু। তুমি ডাকলে বলে চলে এলাম। কোনো বড় সমস্যা না তো?’

‘আমার জন্য সমস্যাটা বেশ বড়ই বলতে পারিস। বুঝতেই পারছিস, তা নাহলে বাসায় না বসে বাইরে তোকে নিয়ে বসার দরকার ছিল না।’

দাদা চাপ-এর স্টলটি শ্রবাণী ভিলার কাছে। এখান থেকে হেঁটে যেতে বড়জোর পনেরো মিনিট লাগে। কিন্তু যে ব্যাপারটিতে রনির সহযোগিতা চায় রুহান, সেটি বাসায় আলোচনা করা সম্ভব না। তাই এখানে আসা।

ওয়েটারকে ডেকে রুহান বলল, ‘দুইটা চাপ আর কিছু লুচি নিয়ে আসো।’ ওয়েটারের ওয়েট করার সময় নাই। কথা শেষ হওয়ার আগেই বাকিটুকু বুঝে ফেলল মনে হয়। উল্টো ঘুরে ছুটল।

রনি বলল, ‘এখন বলো, চাচু।’

‘আমি আসলে খুব বিপর্যস্ত। ফ্যামিলিক্যাল ইস্যু। কিছুটা তুই জানিসও। সেই লাফাঙ্গাটা এখনো আসা-যাওয়া করে। এতসব পাবলিকলি আর নাইবা বলি। তুই বলেছিলি তোর পরিচিত এক বড়ভাই আছেন। তিনি নাকি সব সমস্যার সমাধান দিতে পারেন...’

‘ও, হ্যাঁ! ইনোভেটর ভাই। সব সমস্যার সমাধান তুমি তার কাছে পাবে।’

‘সব?’

‘হ্যাঁ, সব।’

‘আই মিন, পারিবারিক সমস্যারও সমাধান সম্ভব?’

‘শুনেছি, পারিবারিক সমস্যার সমাধান নাকি আরও ভালো দিতে পারেন তিনি। যদিও নিজে এখনো পরিবার গঠন করেননি!’

‘আহ্, এখন নিজেকে কিছুটা টেনশনমুক্ত লাগছে বুঝলি।’

‘কোনো চিন্তা কোরো না তো, চাচা। চাচা-ভাস্তে থাকলে সমস্যা নিয়ে ভাবার কোনো কারণই দেখি না। দরকার হলে কাস্তে হাতে সমস্যার মূলোৎপাটন করব।’

‘ধন্যবাদ, রনি। আমি কালকে অফিস শেষে একটু তার কাছে যেতে চাই। তোর সঙ্গে যেতে পারলে ভালো হতো।’

‘শিওর, চাচু।’

রুহান যেন বুকে সাহস পাচ্ছে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এরমধ্যে খাবারও চলে এসেছে। স্বাস্থ্যকর খাবার এখানে কিছুই নেই কিন্তু এসব খাবারই কেন যেন সুস্বাদু। রুহান মনেমনে ভাবে, অস্বাস্থ্যকর খাবার যেমন পেটের ক্ষুধাকে ফুঁসলে দেয়, তেমনি অসুস্থ সম্পর্ক যৌনক্ষুধাকে উসকে দেয়। এসব ভেবে তার মুখের হাসি আবার ম্লান হয়ে গেল।

 

বন্ধুমনা সংঘের সবাই যে যার বাসায় চলে গেছেন। সব গুছিয়ে ইনা নিজের রুমে এসে বিশ্রাম করছে। সারাদিন বেশ ধকল গেছে। শখের বশে সে রান্না করে সত্য কিন্তু নিয়মিত রান্নাবান্না করা তার পছন্দ না। তাই বাসায় এমন কোনো প্রোগ্রাম থাকলেই কেবল মা-কে সাহায্য করে। ইনার কাছে রান্নার কাজটা বেশ ঝক্কির লাগে। এক রোস্ট রান্নাতেই কতগুলো স্টেজ! কাঁচা মাংস প্রসেসিং থেকে শুরু করে রোস্ট রান্না হওয়া পর্যন্ত অনেক ধাপ-মাংস টুকরাকরণ, পরিষ্কারকরণ, কম জ্বালে ভাজিকরণ; তারপর ভাজা মাংস ঘি, বেরেস্তা, লবণ, আদা বাটা, ধনিয়া গুঁড়া, পোস্তদানা বাটা, জাফরান, রসুন বাটা, দারুচিনি বাটা, টকদই, গোলমরিচ গুঁড়া, জয়ত্রী গুঁড়া, এলাচ বাটা ইত্যাদি দিয়ে কষাইকরণ; সবশেষে কম জ্বালে রান্নাকরণ। এতকিছুর পরও এই ধাপগুলো ধকল মনে হতো না, যদি মানসিক চিন্তাটা না থাকত। সকালে দাদাজান এমন এক কাজ ধরিয়ে দিয়েছেন, যেটা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত ইনা কীভাবে ঘুমাবে, তা-ই ভেবে পাচ্ছে না।

ইনা তার রুমের বাতায়ন-আসনে বসে রাস্তায় চলাচলকারী মানুষজন দেখছে আর ভাবছে কীভাবে কাজটা করা যায়। এক্ষেত্রে শোভনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে ইনার মনে হয় না; বরং এ ঘটনা শুনলে তা থেকে সে তার নতুন গল্প-উপন্যাস বা নাটকের প্লট তৈরি করবে। রনি ভাইকে দিয়ে আপাতত কোনো কাজ হবে না। ইদানিং তাকে চিরবিষণ্ন এক ব্যক্তি বলেই মনে হয়। স্যাডিস্ট ব্যক্তির দুঃখ দূর না হওয়া পর্যন্ত তাকে দিয়ে যে কাজই করানো হোক, তা সফলতার মুখ দেখে না। আর একজন আছে-ছানোয়ার। ছেলেটা একটু বেশিই পড়াশোনা করে। পরিপূর্ণ আঁতেল বলতে যা বোঝায়। নিজের নামের বানান লেখে ‘স’ এর বদলে ‘ছ’ দিয়ে-ছানোয়ার। ইনা একবার একটি সহজ কাজ দিয়েই বুঝেছিল, এই আঁতেলকে দিয়ে পড়া ছাড়া জগতের অন্য কিছু সম্ভব না। ইনা সিদ্ধান্ত নিল, কাজটি সে একাই করবে। এটা সত্য, এর ফলে কিছুটা রিস্ক তাকে নিতে হবে কিন্তু দাদাজানের কাহিনি ও কাজের ধরন তার মধ্যে যে প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা তৈরি করেছে, সেই তুলনায় রিস্ক নগণ্য বলা চলে।

 

রুহান বাসায় ফিরলেই তার তিন বছরের মেয়ে স্নেহা দৌড়ে চলে আসে বাবার কোলে ওঠার জন্য। স্নেহা বেশ মজার মজার কাণ্ড ঘটায়। গত মাসের একদিনের ঘটনা। টেলিভিশনে কার্টুন ছবি দেখছিল সে। কার্টুনে হঠাৎ এক ডাইনোসরকে নিজের দিকে তেড়ে আসতে দেখল। দৌড়ে আসা ডাইনোসরটিকে মারার জন্য স্নেহা তার আদরের খেলনাগুলো ছুড়ে মারল টিভির পর্দায়। ফলাফল হিসেবে বারোটা বাজল টেলিভিশন ডিসপ্লের! সেই ডিসপ্লে সারতে সাড়ে তেরো হাজার টাকা খরচ হলো রুহানের। গেল সপ্তাহেও স্নেহা মজার ঘটনা ঘটিয়েছে রুহানের বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে। সেখানে জ্যান্ত বিড়াল নিয়ে সে এমনভাবে খেলা শুরু করল যেন বিড়ালটি খেলনা! এমনকি ওই বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কচিকণ্ঠে আঙ্কেল-আন্টিকে বলল, ‘বিড়ালের ব্যাটারিটা খুলে রেখো’!

আজকেও মজার কাণ্ড ঘটিয়েছে স্নেহা। রুহান যখন ঘরে ঢুকল, সেটি বলার জন্যই স্নেহার পেছন পেছন ছুটে এল প্রীতি। কিন্তু রুহানের মন ভালো নেই। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তার মধ্যে। প্রীতি বলল, ‘শুনছ, তোমার মেয়ে আজ যা বলেছে, হাসতে হাসতে আমি শেষ!’ বলেই প্রীতি খানিক হেসে নিল। কিন্তু ইদানিং সহজে হাসি আসে না রুহানের মুখে। জ্বরাক্রান্ত শরীরে যেমন অস্বস্তি ভর করে, কোনো কিছু ভালো লাগে না, আরামদায়ক লাগে না; তেমনি রুহানের মনও যেন জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েছে, ভালো কোনো কিছুও তার মনকে সহজে প্রফুল্ল করতে পারে না।

‘মেয়ে কী করেছে?’ মনমরা সুরে এটুকু বলল রুহান। প্রাণখুলে কথা বলতেও তার কষ্ট হচ্ছে। বুকে যেন জমাট বেঁধে আছে কষ্ট। রুহানের মনমরা ভাবকে পাত্তা না দিয়ে প্রীতি হাসিমুখে বলল, ‘তোমার মেয়ে আমাকে বলল, সে নাকি বড় হলে আমার বোন হয়ে যাবে!’ এটুকু বলেই আবার শব্দ করে হাসা শুরু করল প্রীতি। মেয়েকে বিরসমুখেই কোলে তুলে নিল রুহান।

  

রনি ইতিমধ্যে ইনো ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছে। তিনি কালকে অফিস টাইমের পর রুহানকে দেখা করতে বলেছেন। আবার খানিক আগেই রনিকে তার অফিসের বস ফোন করে জানিয়েছেন যে কাল সন্ধ্যায় একটি জরুরি মিটিংয়ে বসতে হবে। তার মানে, কাল চাচার সঙ্গে রনির যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চাচাকে মোবাইলে কল দিয়ে হঠাৎ মিটিং পড়ে যাওয়ার বিষয়টি রনি জানাল। ইনো ভাইয়ের সঙ্গে তার যে কথা হয়েছে, তা সংক্ষেপে বলল। ভাইয়ের বাসার ঠিকানাটিও জানিয়ে দিল। এক বাড়িতে থাকলেও যেকোনো প্রয়োজনে মোবাইলেই যোগাযোগ হয় চাচা-ভাতিজার। শ্রাবণী ভিলার তিনতলায় অন্যরা কেউ যায় না। সিঁড়িতে দৃশ্যমান কোনো বাধা না থাকলেও প্রীতির ব্যবহারের কারণে একধরনের মানসিক বাধা সবার মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে! 

রনি রুমে শুয়ে ইনো ভাইয়ের কথাগুলোর সঙ্গে নিজের জীবনের ঘটনাগুলো মেলানোর চেষ্টা করছে। এভাবে কখনো জীবন নিয়ে ভাবা হয়নি। চলার পথে মানুষ ও পরিস্থিতি চিনে এগোনো আসলেই খুব প্রয়োজন। গভীরভাবে ভাবার কারণে জীবনের অনেক দুর্বোধ্য বিষয়ও রনির কাছে খোলাসা হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছে-সব মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষী না, সব পরিস্থিতি সফলতা বয়ে আনে না। জীবনে চলার পথে নানা সময়ে কাছে টেনে নেওয়া ভুল মানুষের মুখ, আপন করে নেওয়া ভুল পরিস্থিতির অবয়ব আজ তার চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ভুল মানুষের মুখের জায়গায় নূপুরের মুখও দেখতে পাচ্ছে রনি। তবু ভালোবাসাকে পবিত্র ভাবে সে। নূপুর তাকে ছেড়ে চলে যাবে-এটি বিশ্বাস করে না রনি। তাই ইনো ভাইয়ের বাতলে দেওয়া ভালোবাসার পরীক্ষা নেওয়ার কৌশলগুলো তার ভালো লাগেনি। পবিত্র ভালোবাসার শুদ্ধতা এমন কৌশলে পরীক্ষা করাকে হঠকারিতা মনে হচ্ছে।

 

রাত এগারোটার দিকে শ্রাবণী ভিলাতে আবিষ্কৃত হয় এক দুঃসহ কষ্টদায়ক ঘটনা। শওকত সাহেবকে টয়লেটে পাওয়া যায় অচেতন অবস্থায়। মূলত, সুহান রাতে বাবার ঘরে গিয়ে তাকে না পেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। দশ-পনেরো মিনিটেও বাবার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে টয়লেটের সামনে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করেন। জোরে ডাকাডাকিতে বাসার সবাই সেখানে জড়ো হয়ে যায়। তারপরও সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে দেখা যায়, শওকত সাহেব অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। বাবাকে এ অবস্থায় দেখে ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন সুহান। তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। অ্যাম্বুলেন্স এলে শওকত সাহেবকে নেওয়া হয় ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে। সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান যে হার্ট অ্যাটাকের কারণে তিনি কোমাতে চলে গেছেন। তাকে দ্রুত নেওয়া হয় আইসিইউতে। শ্রাবণী ভিলার বাসিন্দাদের জন্য শুরু হয় সুদীর্ঘ একটি রাত।

 

আসিফ মেহ্‌দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

বধির নিরবধি (পর্ব এক)
বধির নিরবধি (পর্ব দুই)
বধির নিরবধি (পর্ব তিন)
বধির নিরবধি (পর্ব চার)
বধির নিরবধি (পর্ব পাঁচ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top