সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:২৩

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০০:১১

ছবিঃ অমর মিত্র

 

রেবা জিজ্ঞেস করল, কতদিন গেল?

গন্ধবতী অস্ফুটস্বরে বলে, অঘ্রান মাস যাচ্ছে, আর তিনটি মাস, ছয় পক্ষবাদে চৈতি পূর্ণিমা, ঘোর বসন্ত ছিল, পাতা ঝরছিল বিরামহীন, কাপাসের তুলো উড়ছিল, ভ্রমর ঘুরছিল, আমের মঞ্জরীর কী সুগন্ধ, মা তোর মনে নেই, সেদিন ছিল মদনোৎসব।

রেবা ত্রস্ত হাত তোলে, থাক সুগন্ধা থাম, আশ্বিন মাসে আমের মঞ্জরী কোথায়, ওই সময়ে মদনোৎসবই বা কোথায়?

কথাটা শুনতে পায় না বোধহয় গন্ধবতী, ফিসফিস করে বলে, কামদেবের মন্দিরে গেলাম, পুজো দেব, সবাই গেছে সেদিন ওখানে, রানী এসেছিলেন, এসেছিলেন উজ্জয়িনীর কতো সব সুন্দরী, কন্দর্পের মতো তাদের প্রেমিক, ভালবাসার জন, আবীর নিয়ে ফুল নিয়ে ও ওর পিছনে ছুটছে, ফুল ছুঁড়ছে, আবীর ছুঁড়ছে, অশোক ফুলে বাগান মন্দির চত্বর রঙিন।

রেবা বিড়বিড় করছে, সে ছিল আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী, আকাশ তারায় তারায় ভরা, সমস্ত  রাত আমি বসেছিলাম আঙিনায়, হিম পড়তে শুরু করেছে তখন, দিনখানি মনের ভিতরে আঁকা হয়ে আছে।

গন্ধবতী এবারও যেন শুনতে পায় না। সে বিভোর হয়ে আছে চৈত্রপূর্ণিমার দিনটিতে। কামদেবের মন্দিরে, মদনোৎসবে সেই তার প্রথম যাওয়া। মা পাঠিয়েছিল। সঙ্গে পার্বতী বুড়ি। বুড়ি খুব কুটনি। ফিরল আঁচলভরে অশোক,বকুল নিয়ে। সখা, ধ্রুবপুত্র ছিল ঘরবন্দী হয়ে। কামদেব, কন্দর্পের রূপখানি তার চোখের সামনে ভাসছে তখন। চোখের সামনে ভাসছিল আবীর, কুমকুম, অশোক ফুলে রঞ্জিত, কাম জর্জরিত প্রেমিক-প্রেমিকাদের মুখ। পুরুষ সকলই কামদেব। সব প্রেমিকই সেদিন কামদেব। কী সুন্দর তিনি। সুচারু নাসিকা, ঊরু, কটি, জঙ্ঘা সুবৃত্ত। কুসুমরঙের বস্ত্রটি তাঁর কটিদেশ আবৃত করেছিল। বিস্তৃত বক্ষদেশ। তাঁকে দেখে ধ্রুবপুত্রের মুখখানি মনে পড়েছিল তার। শিহরিত হয়েছিল একা একা। কী সুন্দর তাঁর রূপ। চক্ষুদ্বয়, মুখ, ওষ্ঠাধর, পদতল, নখ সবই আরক্তবর্ণ। তিনি বকুল ফুলের স্তূপে বসেছিলেন মকর বাহন নিয়ে। মন্দিরে, বিগ্রহের চতুর্দিকে নব মুকুলের গন্ধ, হাতে কুসুমধনু, কুসুমশর—পুষ্পবাণ নিক্ষেপ করলেই প্রেমিক প্রেমিকারা উদ্বেল হয়ে উঠবে প্রেমে। ঘৃত প্রদীপের উত্তাপ নিয়ে ফিরে এসেছিল গন্ধবতী।

মা রেবা বলল, পাঁচটি বৎসর যেন কতকাল। কতকাল গেল!

দীর্ঘশ্বাস কানে আসতেই গন্ধবতী লজ্জায় অধোবদন হয়। দু’চোখে আলো ফুরিয়ে যায়। মা একটি তিথির সঙ্গে আর একটি তিথি মিশিয়ে দিচ্ছে। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী তিথির কথা বলছে মা। সেদিন এক যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। সেই যাত্রা শেষ হয়নি।  প্রত্যাবর্তন করেনি এ বাড়ির মানুষটি। পিতার মুখখানি তার চোখের উপর থেকে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সেই মুখ গিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ধ্রুবপুত্রের মুখখানি। গন্ধবতীর মনে পড়ে পিতা কার্তিককুমারের ধূসর হয়ে আসা মুখখানি। ডাক শোনে যেন গন্ধবতী। কে ডেকেছিল সুগন্ধ সুগন্ধা বলে? কবে, কোন দিনে, কোন কালে, কোন তারার আলোর ভিতরে? মাথার উপরে জেগে উঠেছে তখন আকাশগঙ্গা, তার ভিতর শ্রবণা নক্ষত্রটি। অভিজিৎ, স্বাতী নক্ষত্রটি জ্বলজ্বল করছিল আকাশগঙ্গার ওপারে। ছিল ধ্রুবতারা, সপ্তঋষি, আর শতভিষা। মানুষটি আঙিনায় দাঁড়িয়ে ওই সব নক্ষত্রদের প্রণাম করছিল। মনে পড়ে সব। বিকেলে হরিদ্রাবর্ণের পাগড়িটি কতবার যে বেঁধেছিল, কতবার খুলেছিল সেই কার্তিককুমার। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ডাকল, সুগন্ধা মা, মা সুগন্ধা আমার...। সবই মনে আছে তার, শুধু মুখখানি কেন যে আবছা হয়ে আসে। বাবা তার যুদ্ধে গিয়েছিল। হুন দমনে।

রেবার সম্বিত ফেরে এতক্ষণে। সে এমন হতভাগিনী যে মেয়ের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে নিজের দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে দিচ্ছে। তার যৌবন আর কতদিন। সুবৃষ্টির অভাবে মাটি যেমন পাথর হয়ে যায়,তার তো তেমনই হয়ে যাওয়ার কথা। সেই মানুষ কি ফিরবে? না ফিরলেও তার জন্য তো বসে আছে সে। ফিরবে জেনেই তো বসে আছে।

রেবা ডাকল মেয়েকে, কী বলছিলি, তুই চৈতি পূর্ণিমা, মদনোৎসব?

গন্ধবতীর আয়ত চক্ষুদুটির প্রান্তে জেগেছে শ্যামরেখা। মায়ের দিকে ফিরেছে সে। মা দেখল মেয়ের রূপ যেন তপস্বিনীর। মেয়ে ঘুমোয় না রাতে। মালা গাঁথে না, কবরী বাঁধে না। এই হেমন্তের কুন্দফুল তার কত প্রিয়ই না ছিল। কুন্দফুলে নিজেকে সাজাতো সে। সব ছেড়েছে এখন।

গন্ধবতী ডাকে, এবার যেন শীত আগেই নামল মা।

রেবা চুপচাপ। সে বুঝল, মেয়ে মদনোৎসবের কথা বলতে চাইছে না আর। বলছে শীতের কথা। কোথায় শীত? অন্যান্যবার অঘ্রানে শীতের দংশন আরো বেশি থাকে। এবার তো ঠান্ডাই হচ্ছে না প্রকৃতি। শিশিরপতন শুরু হয়েছে অনাবৃষ্টির পর। এই শিশিরে শীত নামে না। মেয়ে কেমন হয়ে বসে আছে। জবুথুবু, যেন কোনো বিগত যৌবনা, জরা যাকে দখল করে ফেলছে একটু একটু করে। বিড়বিড় করছে গন্ধবতী, কতগুলি পূর্ণিমা গেল তারপর, বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে সামনে অঘ্রানের পূর্ণিমা, এক বছরের পরেও সাতটি পৌর্নমাসি তিথি গেছে, আর একটি আসছে মা, সেই রাতে দক্ষিণ আকাশে অগস্তা নক্ষত্র ছিল, সে ওই নক্ষত্রকে লক্ষ্য করে দক্ষিণ-পূর্বে হেঁটে গেল, উজ্জয়িনীর গা ঘেষে চলে গেল যেন।

রেবা আনমনা হয়ে বলে, অগস্ত্য নক্ষত্রের উদয় হলে ধীরে ধীরে মেঘের  সঞ্চার হয় আকাশে, আকাশের দেবতা প্রসন্ন হন, জল না্মে, অথচ ওই এক বছর আরো সাতটি পূর্ণিমায় কতগুলি পক্ষ গেল, তেমন বর্ষা হলো কই, তোর ঠাকুর্দা জমিতে গো-ধুম বীজ ফেলেছে, অঙ্কুর ওঠেনি, যা-ও উঠেছিল, মরে যাচ্ছে, মাটি পাথর, সত্যিই কি সেই বছর, এই বছর অগস্ত্য ঋষির উদয় হয়েছিল?

হ্যাঁ মা, আমাকে তো ধ্রুবপুত্র সখাই চিনিয়েছিল আকাশ, তারপর থেকে কোনো তারা চিনতে ভুল হয় না, আমি অরুন্ধতীকে চিনি, দেখতে পাই আকাশে, ঋষি বশিষ্ঠের পাশে থাকেন, সপ্তঋষিরা সেই সময় ছিলেন উত্তর আকাশে, পরের চৈতি পূর্ণিমাতেও তাই ছিলেন।

মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে আছে। অরুন্ধতীকেও চিনিয়েছিল সেই হৃদয়হীন। অরুন্ধতীকে চেনালে তো গন্ধবতীকে ত্যাগ করে যাওয়ার কথা ছিল না তার। মুখ নামায় রেবা। মেয়ে একথা বলছে কেন, তা ভাবতে চেষ্টা করে। মনে পড়ে রেবার, বিবাহের পর এই আঙিনায় দাঁড়িয়ে সে অরুন্ধতীকে চিনেছিল। কার্তিককুমার তাকে দেখিয়েছিল। অতি  ক্ষুদ্র নক্ষত্রটিকে কার্তিকুমার তার জন্য চিনে রেখেছিল যেন। আকাশের অত সব উজ্জ্বল প্রভাময়, প্রভাময়ী তারাদের না চিনিয়ে চেনাল অরুন্ধতীকে। চেনাতে হয় সহধর্মিনীকে, তাই চিনিয়েছিল। আর কার্তিককুমার তো সৈনিক। তাকে অরুন্ধতীকে চিনেই রাজার বাহিনীতে স্থান নিতে হয়েছিল। প্রতিটি সন্ধ্যায় সে তাকে ডাকত, রেবা, দেখতে পাচ্ছ অরুন্ধতী দেবীকে?

রেবা ফিসফিস করে, তোকে কি ধ্রুবপুত্রই চিনিয়েছিল, সে ই?

হ্যাঁ মা।

গন্ধবতী মাথা নিচু করে বসে আছে। তার দুচোখ আর্দ্র হয়ে উঠছে। সে তো জানে বিবাহের এটি একটি অংশ। বিবাহের কুশন্ডিকা কালে নববধূকে দেখানো হয় অরুন্ধতীকে। মা নিশ্চয়ই দেখেছিল তা। তারপর এই গৃহে পা দিয়ে সন্ধ্যায় বাবা তাকে...। গন্ধবতী ফিসফিস করে। মা তুমি বাবার কথা বলো, কীভাবে বাবা গেলেন যুদ্ধে।

রেবা বলল, আশ্চর্য। সেদিন ছিল যাত্রার অমৃতযোগ, সন্ধ্যায় শতভিষা নক্ষত্র ওঠার পর তিনি যাত্রা শুরু করলেন, ভুলিসনি তো সুগন্ধা, যাবেন উত্তর-পুবে উজ্জয়িনীতে, সেখান থেকে পরদিন সকালে সেনাবাহিনী দশপুরার দিকে যাবে, তিনি নদীর কুল ধরে উত্তরে গেলেন, তারপর পুবে হাঁটলেন। পরদিন অবন্তীর সেনাবাহিনী তো এই পথেই পশ্চিমে গেল, আমি সমস্ত রাত আঙিনায় বসে

কৃষ্ণা সপ্তমীর সন্ধ্যা তো আঁধারময়ী  ছিল।

ছিল, মাসটি ছিল আশ্বিন, ধারাবর্ষণের পর আকাশ পরিষ্কার, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে  কত তারা জ্বলে উঠল উপরে, শ্রবণা, অভিজিৎ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, হংসমণ্ডল, ধ্রুব, শতভিষা, তিনি তারার আলোয় পথ দেখেছিলেন, তিনি বীর, অন্ধকারে, তাঁর কী ভয়?

মা সেই মানুষটি তো আর এল না?

চমকে ওঠে রেবা, কে, কে এল না? আচার্য বৃষভানুর শিষ্য, দশার্ণ দেশের সেই তাম্রধ্বজ, কার্তিক পূর্ণিমার আগে এসেছিল।

আসেনি, গণনায় কিছু পায়নি।

ঠাকুর্দার সঙ্গে এসেছিল, ঠাকুর্দা তো আর গেলেন না?

জানি না। চুপচাপ হয়ে গেল রেবা। সে তো গোপন ভয়ে দিনপাত করছে। কী পায় গণনায় সেই তাম্রধ্বজ! তাম্রধ্বজ আসেনি; যদি না আসে তো বেশ হয়। যেদিন প্রথম এসেছিল। সেদিন উৎসাহিত হয়েছিল রেবা। পরে ভেবেছে গণনা না করলেই হয়। যদি খারাপ খবর আনে তাম্রধ্বজ? হুন যুদ্ধে নিরুদ্দিষ্ট মানুষটিকে নিয়ে যে আশায় বুক বেঁধে আছে সে, সেই আশা যদি ভেঙে যায়?

ঠাকুর্দাকে আমি বলব?

না। রেবা অস্ফুট উত্তর দেয়, গণনা করে তো আগে ফেরান যাবে না তাকে, তার বিভ্রম কাটলে সে ফিরবে, ধ্রুবপুত্র ফিরবেই।

বাবা?

রেবা মাথা নিচু করে থাকে। মেয়ের তো বোঝা উচিত। মেয়েরও কি ভয় করছে না? জন্মপত্র, যুদ্ধযাত্রার দিনক্ষণ তাম্রধ্বজ নিয়ে যাওয়ার পর থেকে সে শান্তিতে নেই। শ্বশুর মশায় দীপাবলী যাওয়ার পর এক সন্ধ্যায় উদ্ধবনারায়ণের কথা বলেছেন তাকে। তারপর থেকে ভয় আরো বেড়েছে। ভয় তো বাড়বেই। সেও তো দুঃস্বপ্ন দেখেছে ক’দিন। ঘুম ঘোরে ডাকও যে শুনেছে কার্তিককুমারের। কী রূপবান স্বামী তার! কী তার দেহখানি। যুদ্ধযাত্রার আগে তাকে তো সে নিজ হাতে সাজিয়েছিল। স্বামী যুদ্ধে গেল বলে সে গলার স্বর্ণহারটি খুলে রেখেছিল। যাওয়ার আগে যে হরিদ্রাবর্ণের শাড়িটি এনেছিল কার্তিককুমার তার জন্য, সেটি পরবে পরবে করেও পরেনি। তুলে রেখেছিল তোরঙ্গে। ভেবেছিল দীপাবলীর আগেই হয়ত ফিরে আসবে সেনাবাহিনী, চার পক্ষে তো ফিরবেই সেনাদল। তখন যুদ্ধে জয়ী স্বামীর কপালে বিজয় তিলক এঁকে...। কত সাধ ছিল। সেনাবাহিনী ফিরেছিল অবশ্য মাঘী পূর্ণিমার আগে। অনেকদিন লেগেছিল যুদ্ধজয়ে। হুনজাতি দুর্ধর্ষ। যোদ্ধার জাত তারা। লুণ্ঠনকারী। সৌরাষ্ট্রের উত্তর সীমা থেকে সেই হুনজাতিকে তাড়া করতে করতে অবন্তীর সেনাবাহিনী নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। নিশ্চিহ্নও হয়েছে তারা। শোনা যায় আরো উত্তর পশ্চিমে সিন্ধুনদের তীরে তারা বসত করেছে। অবন্তীর সেনাবাহিনী বড় কাজ করেছিল ওই যুদ্ধে। লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল কৃষক, প্রজাদের। সবই হলো, কিন্তু কার্তিককুমার বিজয়ী সেনাদলের সঙ্গে ফিরল না। রেবার তো সব মনে পড়ে। কিছুই ভোলেনি সে। সেই কৃষ্ণা সপ্তমীর সকাল থেকে বহুদিন পড়ে থাকা, অব্যবহৃত তলোয়ার পরিষ্কার করেছিল মানুষটা। মাথার শিরস্ত্রাণ ঝকঝকে করে তুলেছিল তেঁতুল ঘষে। নরসুন্দর ডেকে ক্ষৌরকর্ম করিয়েছিল। যুদ্ধে যাওয়ার উত্তেজনায় মানুষটা ফুটছিল যেন সারাদিন। ঝকঝকে তলোয়ার নিয়ে ছুটে গেল কুটিরের পিছনে ঝোপঝাড়ের দিকে। সাঁই সাঁই করে তলোয়ার ঘোরাতে লাগল। তোর মনে পড়ে না সুগন্ধা?

অস্পষ্ট মনে পড়ে গন্ধবতীর। মালা গেঁথেছিল মা কুরন্টক ফুলে। চন্দন ঘষেছিল। মালা চন্দনে সাজিয়েছিল মা তার স্বামীকে। যাত্রাকালে পূর্ণকুম্ভ, ঘৃতের প্রদীপ সব দেখেছিল বাবা। শঙ্খধ্বনি করে মা দশদিকে জানিয়ে দিয়ছিল যুদ্ধে যাচ্ছে তার স্বামী কার্তিককুমার। বাবা চলে যাওয়ার পর মা যোগিনী হলো। চুল বাঁধে না, গায়ে অলঙ্কার রাখে না, রঙিন বস্ত্র পরে না। গন্ধবতী নিজের দিকে তাকায়। তাকিয়ে শিহরিত হয়। মা যা করেছে বাবা যুদ্ধে গেলে, সেও তো সেই পথে যাচ্ছে। তার গায়ে কি রং আছে? কোথায় রং, কোথায় অলঙ্কার, কোথায় তার কবরী? মা বেঁধে দিতে চাইলেও তো সে নিষেধ করে। দাঁতে অধরোষ্ট দংশন করে গন্ধবতী। কার জন্য বসে আছে সে? সখা, ধ্রুবপুত্র? সে তো উজ্জয়িনীর সেরা গণিকা দেবদত্তার, প্রেমিক, তার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিরুদ্দেশে গেছে। সখার জন্য সে সমস্ত কিছু ত্যাগ করে বসে আছে, সখা কি মনের ভিতরে এক বিন্দুও মেঘ রেখেছে তার জন্য?

গন্ধবতী বিড়বিড় করে, সে আর বোধহয় ফিরবে না মা। 

রেবা মুখ তোলে, ধ্রুবপুত্রের কথা বলছিস?

হ্যাঁ মা।

রেবা নিশ্চুপ। মেয়ে তার কাছ থেকে আশ্বাস নিতে চায়। কী আশ্বাস সে দেবে মেয়েকে? মেয়ে বুক বাঁধুক। অপেক্ষা করুক। বিরহে, প্রত্যাখানের বেদনায় পুড়ুক। কতটুকুই বা তার বিরহ? সে কি তার মাকে দেখছে না? যুদ্ধে নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। কত পূর্ণিমা তিথি গেল, কত কৃষ্ণা সপ্তমী পার হয়ে গেল, পথ তো শূন্য। শূন্য হয়ে যাচ্ছে সে নিজেও। রেবা বলল, ভালবাসিস, অপেক্ষায় থাক, কিন্তু কতকালই বা থাকবি অপেক্ষায়?

গন্ধবতী বলল, তাম্রধ্বজ না হোক, ওই পশ্চিমে কোন এক যোগিনী এসেছেন, পাহাড়ের কোলে থাকেন, তাঁর কাছে গিয়ে জানা যেতে পারে কী তার ভবিষ্যৎ?

না, তোর ভয় করে না?

গন্ধবতী বলে, কত ভয় নিয়ে বাঁচব মা, কত কষ্ট নিয়ে?

সে তো গণিকার প্রেমে পড়েছিল, তোর ঘেন্না হয় না?

কিসের ঘেন্না? অবাক হয় গন্ধবতী।

রেবার মনে হচ্ছিল মেয়েকে আঘাত করে। বিবাহের বয়স হয়ে এল। পার হয়ে যাবে এরপর। মেয়ে কার জন্য যোগিনী হয়েছে? সে কে? না, অকৃতজ্ঞ হৃদয়হীন এক পুরুষ যে এক গণিকার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে গিয়েছিল। তার জন্য কিনা তার মেয়ে বিরহে দিনপাত করছে। বৃদ্ধ শ্বশুর মশায় উদ্ধবনারায়ণের কথা বলেছেন। উদ্ধবনারায়ণ ওই কথা বলে ভয় দেখাতে চাইছে তা স্পষ্ট। উদ্ধব বিবাহ করতে চায় গন্ধবতীকে। রেবা উঠে দাঁড়ায়, ঘেন্না হয় না কেন তা দেখে আমি অবাক হই সুগন্ধা, সে তো তোকে ভালবাসে না, তুই তার জন্য নিদ্রা ছেড়েছিস, জানিস সে নাকি হুনরাজ্যে চলে গেছে সিন্ধুতীরে?

কে বলেছে? আর্তনাদ করে ওঠে গন্ধবতী।

সংবাদ এসেছে, তোর ঠাকুর্দা জানে।

না, এ হতে পারে না।

হতে পারে তোর সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে সে, তোর দিকে ফিরেও তাকায়নি, উজ্জয়িনী গিয়ে সে কিনা...। রেবার গলা জড়িয়ে যায় উত্তজনায়, প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, বেশ হয়েছে, আমি চাই না সে এখানে ফিরুক।

তোমার আজ কী হয়েছে মা?

কিছুই হয়নি, যা সত্যি তাই বলছি।

সত্যি নয় মা।

হাসল রেবা, খোলা চুলে ঝুঁটি বাঁধল মাথায়, বলল, তুই চোখ বুঁজে আছিস, এতে তো আকাশের সব তারা নিভে যাবে না, সূর্যও অকালে অস্ত যাবে না, শোন সুগন্ধা ওর আশা ত্যাগ কর, আমাদের তো বাঁচতে হবে, ওই উন্মাদের জন্য বসে থেকে কোনো লাভ নেই,  নগরে প্রবেশ করলেই ও বন্দি হবে, ও নাকি  হুন আশ্রয়ে আছে।

সব মিথ্যা।

রাজার কথা সত্যি।

রাজা বলেননি, রাজা ওকে চেনেন না।

চেনেন, রাজার কি নিজে চিনতে হয়, রাজার লোক চিনলেই রাজার চেনা হয়, উদ্ধবনারায়ণ রাজার লোক, সে যখন বলছে তা সত্যি হবেই, আর রাজগণিকা যখন...। থেমে যায় রেবা।

মিথ্যা বলছে উদ্ধবনারায়ণ।

সে রাজকর্মচারী, তার কথা মিথ্যে হতে পারে না, রাজা শুনেছেন সব কথা নিশ্চয়, রাজা তাঁর কর্মচারীর কথা যা শোনেন তা বিশ্বাস করেন, শোন সুগন্ধা, তুইও তো সেই ধ্রুবপুত্রের কাছে প্রতারিত, তার কথা আর উচ্চারণ করিসনে।

গন্ধবতী থরথর করে কাঁপছে। মা যে এই কথা বলবে তা কখনো ভাবেইনি সে। মা বরং তাকে বুক বাঁধতে বলেছে। গন্ধবতীর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। উদ্গত কান্না থামাতে সে দু’হাতে মুখ ঢাকে। রেবা বলল, কেঁদে কী হবে, মরীচিকার জন্য বসে থেকে লাভ কী, রাজার কর্মচারী বলেছে তোকে বিবাহ করবে....

না। আঘাত পাওয়া নাগিনীর মতো ফণা তুলে দাঁড়ায় গন্ধবতী। মাথা ঝাঁকাতে থাকে, বিড়বিড় করে সে অসৎ।

সৎটি কে? সেই ধ্রুবপুত্র! উদ্ধবনারায়ণ যখন প্রস্তাব দিয়েছে আমরা সে প্রস্তাব ফেরাব কী করে?

সে প্রস্তাব দেয় কী করে, আমি আর একজনের জন্য বসে আছি।

থাক! থামা তোর কথা, আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে সুগন্ধা।

গন্ধবতী আর দাঁড়ায় না। পিছিয়ে যেতে থাকে। তার ভয় করছে। মায়ের এই অদ্ভুত আচরণের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। দুই হাতে মুখমণ্ডল ঢেকে সে উঠোন ছেড়ে পথের দিকে হাঁটল। যাচ্ছে গম্ভীরার পথে। রেবা তার পিছনে হাঁটছে। গন্ধবতীকে অনুসরণ করে টলতে টলতে হাঁটছে সে। তার যে কী হলো! কিছুই হয়নি।  এই সত্য এখন মেনে নিতে হবে। হবেই। এরপর যদি মেয়ের যৌবন নষ্ট হয়ে যায় ওই উদ্ধবনারায়ণ কি ফিরে তাকাবে? কী সুন্দর তার মেয়ে! উদ্ধবনারায়ণকে বিয়ে করে মেয়ে প্রতারণার জবাব দিক। উজ্জয়িনীর সেরা সুন্দরীতে মজেছিল ধ্রুবপুত্র। তার জন্য কেন বসে থাকবে গন্ধবতী? উদ্ধবনারায়ণ ক’দিন আগেও নাকি তার শ্বশুর মশায়কে ধরেছিল। সেই মুক্তার হার নিয়ে তার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছিল তা শিবনাথ বলেছে পুত্রবধূকে। রেবা অবাক হয়ে দেখে গন্ধবতীকে। এই যৌবনে কে না মুগ্ধ হবে? শুধু ধ্রুবপুত্রই কি না--! গণিকা দেবদত্তা কত সুন্দরী? এই নবীন যৌবনের চেয়েও? রেবা দেখছিল হেমন্তের ধূসরিত পথের ধূলিতে গন্ধবতীর পদচিহ্ন আঁকা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি চরণচিহ্ন যেন ফুলের মতো। নির্দয়া ধরণীতে স্থলপদ্মের রেখা দেখতে পাচ্ছে রেবা। নুপুরের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে রেবা। উন্মাদ সে। উন্মাদ না হলে এভাবে কষ্ট দেয় গন্ধবতীকে।

রেবা ডাকল, সুগন্ধা, দাঁড়া, আমার কথা শোন।

ভয় নেই মা, আমি মরব না, নিরুদ্দেশে যাব না, আমি বসেই থাকব তার জন্য, আমি বসেই থাকব মা, তুমি যাও, আমি গম্ভীরার ধারে যাচ্ছি, আমার জন্য তুমি ভেব না; তোমার কোনো কথাই যে সত্যি নয়, তা তো তুমিও জান।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top